সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩৯+৪০

0
1616

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩৯

শ্রেয়া ধীরস্থির ভঙ্গিতে, গুটি গুটি পায়ে ছাদের দরজা অবধি এলো। গরম গরম নিঃশ্বাস ফেলছে ও। সামনে তাকিয়ে দেখে তূর্য কানে মোবাইল ধরে রেখেছে। হয়ত কথা বলছে কারো সাথে। সূর্যের প্রখর তাপে ছোট ছোট চুল থেকে ঘাম বেয়ে ঘাড়,পিঠ স্পর্শ করছে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভিজে উঠেছে পড়নের নীল টি শার্ট। এই লোকের কি কষ্ট হচ্ছে না?ঘামে হাতের লম্বা লম্বা লোমশগুলোও হতাশায়,দুঃখে লেপ্টে আছে। এইবার শ্রেয়ার ভীষণ খারাপ লাগছে। তূর্য কেমন করে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারছে না ও।

আষাঢ় মাসে কথা ছিল বৃষ্টি রিমঝিম ছন্দ তোলার। সেই ছন্দে মানবমন উতলা হতো,নৃত্য তুলে নাচত। রোমাঞ্চকর হতো পরিবেশ, প্রকৃতি, মানুষজন। অথচ হচ্ছে তার উল্টো। পা বাড়িয়ে মন্থরগতিতে সুঠাম,সৌষ্ঠব দেহের সান্নিধ্যে নিজের শীর্ণ,চিকন গা এগিয়ে আনল শ্রেয়া। তূর্য তীররেখা নজরে একবার তাকাল ওর দিকে। পুনরায় দৃষ্টি অদূর অম্বরে নিবদ্ধ করে বললো,
‘ রাখছি ভাই। বউ দাঁড়িয়ে আছে কিছু বলার জন্য। তাকে অপেক্ষা করাতে কষ্ট হয় আমার। ‘

শ্রেয়া অতিকায় অবাক হলো। চমকপ্রদ চাউনি নিক্ষেপ করলো তূর্যর দিক। তূর্য মোবাইল টা পকেটে রেখে এক হাত বাড়িয়ে শ্রেয়ার শরীর টা নিজের মধ্যে আবদ্ধ করতে গিয়েও থেমে যায়। কপালে
তুষ্ট বলিরেখার ভাঁজ ফোটে ওঠে। শ্রেয়া রিনঝিনে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,’ কি হয়েছে?’
তূর্যর নিরলস জবাব, ‘ ঘেমে আছি,এখন জড়িয়ে ধরবো না। ‘

শ্রেয়ার কন্ঠনালি ভেদ করে কোনো কথা এলো না। একটু একটু করে অতীব নিকটস্থে যায় ও তূর্যর। ছোট্ট বাচ্চাদের ন্যায় মিশে যায় বুকে। আঁকড়ে ধরে গেঞ্জি। তূর্যর ওষ্ঠদ্বয়ে নিঃশব্দ হাসি অনেকখানি জায়গা দখল করে। শ্রেয়ার ছাদের মেঝে ছুঁয়ে থাকা ওড়না টা টেনে ওর মাথার উপর দিয়ে সমস্ত চুল,মাথা ঢেকে দিল। সর্বদা ভরাট,গম্ভীর কন্ঠস্বর টা কেমন আদুরে, নরম হয়ে উঠলো। বললো,’ রোদ আমার বউকে কালো ভূত বানাতে চাইছে। ‘

‘ আর আপনি?আপনার শরীর খারাপ লাগছে না। এখানে এসে ফোনে কথা বলতে হয়?’— নির্ভয়ে প্রশ্ন করে শ্রেয়া।
প্রশ্ন করার অনুমতি টা তূর্য-ই দিয়েছে ওকে। তবুও বেশ ভয় হয় ওর। তূর্যর বদমেজাজী, রূঢ় স্বভাব সম্পর্কে ও অবগত। অবশ্য প্রথম পরিচয় টা ফুলশয্যায় হয়েছিল যদিও মানুষ টা মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত ছিল। এবং দ্বিতীয় বার সুস্থ মস্তিষ্কে এই ছাদেই দাঁড়িয়ে কি ত্যাড়া বাঁকা ব্যবহার করে ওর সঙ্গে। তখন থেকেই তূর্যর প্রতি ওর ভীতি। শ্রেয়া ভীতি কে একপাশে রেখে তূর্যর সামনে কথা বলতে গিয়ে দোনোমোনো করার আরেকটা কারণ বের করেছে, তা হলো সম্মান। ও এই মানুষ টাকে প্রচন্ড সম্মান করে। বুকে মুখ গুঁজে চক্ষুদ্বয় বুঁজে ফেলল। অচিরেই শ্রবণ হলো গলার আওয়াজ,

‘ তোমার মতো সুন্দরী বউ ফেলে প্রেমটেম আমার দ্বারা হবে না। আমি যেদিন ছোট্ট শ্রেয়সীর মাথায় জুটি দেখেছি,বড় শ্রেয়সীর কাজলমাখা আঁখি দেখেছি সেদিনই শেষ। একদম শেষ। সেটা আমার বউও জানে ভালো করে। ‘

শ্রেয়া লাল রঙের প্রলেপে ঢাকা কপোলদ্বয় লুকোতে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো। তূর্য কর্ণ পাতায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
‘ কি করছো?এটা কিন্তু ছাদ। চলো রুমে যাই। ‘
বড্ড রসাত্মক শুনালো কন্ঠ টা। কানে ঝংকার তুলে একেকটা ধ্বনি। শ্রেয়া লজ্জায় নেতিয়ে পড়ছে। তবুও অস্পষ্ট,মিহি স্বরে প্রতিবাদ করার তীব্র প্রচেষ্টা করে,
‘ আমি তো,’
‘ তুমি তো কি?চেক করতে এসেছো ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি কিনা?’
‘ চেক করতে আসবো কেন?আপনি সিগারেট খান। স্বচক্ষে দেখলাম একদিন। ‘
বুক থেকে মুখ তুলে নির্দ্বিধায় কথা খানা ব্যক্ত করে শ্রেয়া। তূর্য ওকে ছাদের রেলিংয়ের সঙ্গে ঠেসে ধরলো। দু হাত দুই পাশে রেখে আঁটকে ফেললো ওকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ কিস করার সময় নাকে সিগারেটের গন্ধ লেগেছিল?লাগলে ওয়াক,থু থু করো নি কেন?লেগেছিল?’

শ্রেয়া কিংকর্তব্য বিমূঢ়। স্থির নেত্রে তাকিয়ে রইল। ওর ললাটে জমাট হয়ে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে যাচ্ছে কানের কাছ দিয়ে। তূর্য একটু একটু করে ঘমার্ক্ত ফোঁটাতে হাত ছুঁয়ে দিল। নিশ্চল, মায়াবী নয়ন জোড়ায় কতক্ষণ চেয়ে থেকে কপালে রাখল ওষ্ঠদ্বয়। শ্রেয়ার বক্ষস্থল থরথর করে কেঁপে উঠলো। শরীরের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সেই কম্পন। ওর মনে হচ্ছে জীবন টা এখন সুখের অনুচ্ছেদ। ভালোবাসার অভাব নেই। যেদিকে দৃষ্টি মেলে রঙিন সুতোয় যেন বাঁধা পড়ে। মাস খানেক আগেই প্রাণ টা চলছিল কোনোরকম। সবকিছু সাদা মলাটে আবৃত থাকে। অতঃপর রঙিন প্রচ্ছদের শিল্পী হিসেবে আসে তূর্য নামক গম্ভীর পুরুষ। ওষ্ঠ এখনও শ্রেয়ার ললাটে ডুবে। কিয়ৎক্ষণ পর কপাল ছেড়ে নেমে আসে তিরতির করা অধর পানে। মুখোমুখি অধর জোড়া। গলা শুকিয়ে গেল শ্রেয়ার। তূর্য কি আজও পানি সাধবে?এখানে জল কোথায় পাবে?সেদিন কি তাড়াহুড়ো করেই না গ্লাসের পানি সমাপ্ত করে ও,মনে হয়েছিল কতযুগ পানি পান করা হয় নি। ভাগ্যিস তূর্য পানি দিয়েছিল নয়ত তৃষ্ণার্ত হয়ে লজ্জার ভারে সোফায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকত।

তূর্য সরে গিয়ে বললো,’ আমি সিগারেট খাই না। একবার যে ছাদে দেখে ভেবেছিলে সেটা ছিল ভুল দেখা। নিচের ফ্ল্যাটের একটা ছেলে খেয়েছিল। অর্ধ অংশ টা ফেলে চলে যেতেই তোমার আগমন। ‘

বিস্ময়াহত চক্ষে তাকায় শ্রেয়া। আনমনে,অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করে বসে,’ সত্যি? ‘
‘ বউ কি বিশ্বাস করে না?’
তূর্যর প্রশ্নে থ মে’রে যায় ও। বিশ্বাস করে ও। অনেক বেশিই করে৷
পুনশ্চঃ লহু স্বরে বলে ওঠে তূর্য,
‘ আমার জীবনের কিছু ভুল অনেকখানি সময় নষ্ট করে দিয়েছে। সুস্থ স্বাভাবিক থেকে আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। অ্যাল-কোহল, সিগারেট এসব ক্ষণিকের ডিপ্রেশন কাটিয়ে একটা মানুষকে মিছে সুখ দিতে পারবে। কিন্তু একটা সময় পাল্টা আক্র’মণ করবে এসব। তোমার কাছাকাছি আমি যে সুস্থতা অনুভব করি সেটা কাটিয়ে আমাকে পা’গল বানানোর ক্ষমতা একমাত্র তুমিই রাখো।যদি মানুষের জীবন সীমা হাজার বছর হতো,তাহলে তোমার সাথেই হাজার বছর বাঁচার আকুতি করে যেতাম শ্রেয়সী। ‘

শ্রেয়া নিশ্চুপ। অন্তর্দেশে শীতল অনুভূতি। অতিরিক্ত দুঃখে চুপ হয়ে যায় একটা মানুষ,শ্রেয়ার তা হচ্ছে না। বরঞ্চ অত্যধিক আনন্দে নির্বাক সে। তূর্য ফের বলে,
‘ ছাদে আসলে যে?’
‘ আয়ুশ ভাইয়া এসেছে। ‘
‘ হঠাৎ? ‘
‘ প্রিয়ু নাকি অনেকদিন ধরে ওনার সাথে কথা বন্ধ করে রেখেছেন তাই। ‘
তূর্য উল্টো ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
‘ বাহ!আয়ুশ তো উন্মাদ প্রেমিক হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। চলো নিচে যাই। ‘
এক প্রকার দৌড়ে কাছাকাছি আসলো শ্রেয়া। সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। তূর্য ভ্রুঁ কুঁচকালো ঈষৎ। রাশ ভারী গলায় বললো,
‘ কি হলো?’
‘ আমরা আরও পরে যাই। ‘— কম্পনরত কন্ঠে উত্তর দেয় শ্রেয়া।
তূর্য বাঁকা হাসে। বলে,’ ওদের কি প্রাইভেসির জন্য পুরো ফ্ল্যাট লাগবে?এক রুমে হয় না?আমাদের তো এক রুমেই চলে। সারাজীবন নিরব থেকে এখন আমার থেকে ধাপে এগিয়ে গেল আয়ুশ। বউটা গাধী, বোকাসোকা নাহলে আমি অনেক ধাপ পেরিয়ে যেতাম। ‘

এ যাত্রায় আর সহ্য করতে পারলো না শ্রেয়া। এত মা’রাত্মক কথা!এদিক সেদিক তাকাতেই তূর্য কব্জি চেপে ধরে বুকে মিশিয়ে বললো,’ লুকোচুরি খেলতে হলে আমার বুকেই লুকাও। ‘
.
.
প্রিয়ু ভয়ংকর রেগে আছে। রাগের কারণ আয়ুশ সত্যিই ওকে পরীক্ষা খারাপ হওয়াতে আদর দূর ফোনও দেয় নি। পরীক্ষা শেষ হয়েছে কতদিন,ঘন্টা, সেকেন্ড পেরিয়ে গেল। পাঁচটা দিন আয়ুশ ওকে যন্ত্রণায় রেখেছে। বাড়িয়েছে ছটফটানি। পরে যখন রাগ কমলে কল দেয় প্রিয়ু পাল্টা জেদ ধরে ফোন ধরে না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে আবারও চট্টগ্রাম ছুটে এসেছে। এখনও আসার পর থেকে কথা বলছে না প্রিয়ু। এমনকি দরজা লাগিয়ে রুমের ভেতর বসে আছে। আয়ুশ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মলিন কন্ঠে বললো,

‘ আমার যন্ত্রণা হচ্ছে লেট লতিফ। বেরিয়ে আসো। রেজাল্ট খারাপ হলেও বকা দেবো না। বিশ্বাস করো, খুব ভালোবাসি তোমাকে। তোমার চেহারা না দেখলে ভিতরটা ব্যথা করে,কন্ঠ না শুনলে অশান্তি লাগে। বেরিয়ে আসো প্লিজ। ‘

চট করে দরজা টা খুলে গেল। আয়ুশ মুখশ্রী দেখার পূর্বেই ওর উপর ঝাপিয়ে পড়লো কাঙ্ক্ষিত মানুষ টা। প্রিয়ুর নিকট তার নিরামিষ স্বামী এখন বদ প্রেমিক। আয়ুশ শক্ত হাতে পেঁচিয়ে নেয় ওকে নিজের সঙ্গে। গলায় ঠোঁটের তীব্র স্পর্শ মেখে বললো,
‘আমি বার বার ছুটে আসতে রাজি কিন্তু আর একদিনও কথা না বলে থাকতে পারবো না। ছোট্ট জীবন টা অভিমানে কাটিয়ে দিলে ভালোবাসবো কখন?আই লাভ ইউ প্রিয়ু। ‘

প্রিয়ু সঙ্গে সঙ্গেই এক হাত আয়ুশের হৃদয়স্থল বরাবর রাখে। ধ্বক করে ওঠে আয়ুশের ভিতরটা। শুনতে পায় প্রিয়ুর মায়ামিশ্রিত স্বর,

‘ এই স্থানের মালিক আমিই যেন চিরকাল থাকি। ‘
________________

শ্রাবণের হাওয়ায় বিষাদের গন্ধ। মধ্য রাতে ঘুম থেকে ওঠে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শ্রেয়া। দেখে তূর্য হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার তোরজোর চালাচ্ছে। শ্রেয়া কোনো কিছু না ভেবে বিছানা ছেড়ে ভয়ার্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,’ কোথায় যাচ্ছেন?’

তূর্য ওর হাত ধরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। বলে,’ যেমনই আছো,তেমনভাবেই চলো। ‘
মনটা কু ডাক ডাকছে শ্রেয়ার। গলা ধরে এলো,’ কেন?’
‘ প্রিয়ু গাড়িতে অপেক্ষা করছে। বাবার শরীর ভালো নেই। হার্ট অ্যা’টাক করেছেন। ‘

ভূ-তল কেঁপে উঠলো শ্রেয়ার। সেদিনই না ওর সন্ধি হলো বুড়ো মানুষ টার হৃদয়ের সঙ্গে? সুন্দর একটা বাবা- মেয়ের সম্পর্কও সৃষ্ট হয়েছিল। এভাবেই কি সুন্দর মুহুর্ত গুলো জলদি জলদি ফুরিয়ে যায়?

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪০

প্রকৃতি যখন দ্যুতির ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল তখনই হসপিটালের করিডোরে এসে পৌঁছায় তূর্য, শ্রেয়া,প্রিয়ু। মেহরিমা চৌধুরী থ মে’রে বসে আছেন। পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ত্রিহা। শ্রেয়া জড়তা,শঙ্কা নিয়ে ওনার কাছে এগিয়ে আসল। তূর্য গিয়েছে ডাক্তারের কাছে।
অসহায় চোখে শাশুড়ির অশ্রু বিসর্জন দেওয়া দেখছে শ্রেয়া। খারাপ লাগছে ওর। ও কেন আরেকটু হালকা করতে পারলো না নুরুল চৌধুরীর বুকে চেপে থাকা কষ্টের ভার?এই ওজন সইতে না পেরেই যেন আজ এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কখনও তিনি মুখ খুলে ছোট বাচ্চাদের মতোন আবদার করতে পারলেন না আমার ছেলেদের আগের ন্যায় ফেরত চাই। কিন্তু শ্রেয়া ঠিকই উপলব্ধি করেছে ওনার কথাগুলো কতটা আর্তনাদ মিশেছিল। ত্রিহা ওকে দেখে নিজের জায়গা ছেড়ে, ইশারা করলো বসার জন্য। মাথা নাড়িয়ে না জানালো সে। ত্রিহা শুনলো না। হাত ধরে বসিয়ে দিল। তাঁর মতে মানুষের বিপদ কালে পাশে দাঁড়ালে প্রিয় হয়ে উঠা যায়। প্রিয় না হলেও কমপক্ষে মনে কৃতজ্ঞতার একটা স্থান সৃষ্ট করা যায়। শ্রেয়া কিছু সময় পার করে মিনমিনে কন্ঠে বললো,
‘ আম্মা। কাঁদবেন না। বাবা সুস্থ হয়ে যাবেন। ‘

মেহরিমা ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলেন। চোখ মুখে বিধস্ত ভাব। কোনো কথা বলতে মন চাইছে না ওনার। তবুও কাতরস্বরে বলে উঠলেন,

‘তূর্য কে বলো তোহাশ কে কল দিতে। দরকার হলে আমি সেই বাড়ি ছেড়ে দেবো। আমার স্বামীর প্রথম ভালোবাসার চিহ্ন মুছে যাক তা আমি চাই না। যে ভালোবাসা হারায় সেই বুঝে,তার স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরে রাখতে না পারার যন্ত্রণা টা ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। আমার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে উনি ছেলের সাথে এত বছর যোগাযোগ করলেন না। আসলেই সৎ সৎ-ই হয়। যতই একদম বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলো না কেন কখনও সৎ তকমা মুছে যাবে না। আপন মা হাজার বার মা’রলেও তাতে সমাজের বা ছেলে মেয়ের কিছু আসে যায় না,সেক্ষেত্রে এটা শাসন। সৎ মা যদি একটু উচ্চ আওয়াজও করে তাহলে ধরেই নেয় মানুষ সতীনের সন্তান সহ্য করতে পারে না। সব সৎ মা আবার ভালো হয় না। কেউ কেউ হয়। আমি হয়ত সেই কেউ এর তালিকায় যুক্ত হতে পারি নি। আরিয়ানার যত কাছে যেতে চেয়েছি আমাকে সৎ শাশুড়ি ভেবে ততটাই অবহেলা, দোষ দিয়েছে। তোমার আপন শাশুড়ি হয়েও ভালো হতে পারলাম না। খারাপই চাইলাম তোমার। তার মানে আমি সত্যিই খারাপ। ভালো স্ত্রী, ভালো মা, ভালো শাশুড়ি কিছুই হতে পারি নি। এতটাই নিচু মনের হয়ে গিয়েছিলাম যে এতিম মেয়েটাকেও আঘা’ত করেছি। এটারই শাস্তি দিচ্ছেন আমাকে আল্লাহ। ‘

শ্রেয়ার বাক শক্তি হারিয়ে ফেলল খানিক সময়ের জন্য। নিস্তব্ধ,অটল চাহনি মেহরিমার দিক। একটা মানুষ কি করে পারে দোষ না করেও নিজের উপর নিয়ে নিতে সবটা?মা হয়ত এমনই হয়। কোনো নিষ্ঠুরতা,স্বার্থপরতা নেই। আছে কেবল মায়া। আচ্ছা তোহাশ কি যোজন দূরে থেকে কখনও অনুভব করেছে সে কতটা জঘ’ন্য ব্যবহার করেছিল মা’য়ের সঙ্গে? কতটা ক্ষত বিক্ষত করেছে মা- বাবার মন?আরিয়ানা কি আঁচ করতে পেরেছে নিজের ভুল নাকি সবকিছুই তার ইচ্ছেকৃত ছিল?বুক ফেটে কান্না আসার উপক্রম শ্রেয়ার। কন্ঠনালি কাঁপছে। নিজেকে সামলে ধাতস্থ হলো।

‘ আপনি কোনো দো’ষ করেন নি। বরং তোহাশ ভাইয়া নিজের কারণেই মা’য়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি ছোট নাহলে আমার মা’কে আগলে রাখতাম,তাহলে বাবা মা’রতে পারতেন না। যে বাবা মা হারায় তারাই মূল্য বুঝে। এ পৃথিবীতে বাবা মা’র মতো নিঃস্বার্থ ভাবে কেউ ভালোবাসে না। অন্য কেউ ভালোবাসলেও সেটা মানুষ ভাগ্য ভালো বলে পায়। ‘

শ্রেয়ার নরম,আফসোসের স্বর কর্ণপাত হওয়া মাত্র মেহরিমা অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হয়ে পড়লেন। কিছু বলতে পারলেন না তিনি। তূর্য ডাক্তারের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতেই ওঠে দাঁড়ালেন।

শ্রেয়ার দিকে এক নজর চেয়ে মেহরিমা চৌধুরীর দিকে তাকালো তূর্য। ক্লান্ত মেশানো গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ ভাই আসছে। গতকাল ফ্লাইটে ওঠার আগে আমাকে ফোন দিয়েছিল। পরিবার সমেতই আসছে। এখন তাকে চৌধুরী বাড়িতে কিভাবে আনবে সেটা তোমরা ভালো জানো। ‘

মেহরিমা চমকে উঠলেন। বললেন,’ হাসপাতালে আসবে?’
তূর্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,’ আমি না করেছি। বর্তমানে মিসেস আরিয়ানার চাচার বাড়িতে আছেন। আমি চাই না হাসপাতালে কোনো সিন ক্রিয়েট হোক। বাবার অবস্থা এখন কিছু টা ভালো। যা করার,বলার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। ‘
.
.
একদিন পর কিছুটা সুস্থ হয় নুরুল চৌধুরী। ওইদিকে ছেলের অবস্থা দেখে ফাতেমা চৌধুরীও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তূর্যর উপর ভরসা রেখে মেহরিমা বাড়িতে চলে গিয়েছেন। শ্রেয়া,প্রিয়ু,আয়ুশ হসপিটালেই রয়ে গেল। করিডোরে পাতানো বেঞ্চিতে বসে ঘুমে আয়ুশের কাঁধে ঢলে পড়েছে প্রিয়ু। অপরদিকে শ্রেয়া বসে বসে ভাবছে কিভাবে এত এত মনোমালিন্যের দেয়াল ভেঙে এক হবে পুরো পরিবার। একই ছাদের নিচে কত মানুষ বাস করে অথচ সবার মনের মিলন থাকে না। বিচ্ছেদ সহজ, সন্ধি কঠিন। খুবই কঠিন।

একজন নার্স এসে জানালো তূর্যকে ডাকছেন নুরুল চৌধুরী, সাথে শ্রেয়াকেও। তূর্যর পিছন পিছন শ্রেয়া কেবিনে ঢুকে পড়ে। ওদের দেখে অচিরেই রোগা চেহারাটা হাসোজ্জল হয়ে ওঠে নুরুল চৌধুরীর। দুর্বল কন্ঠে হাঁক ছাড়লেন,’ কাছে আয় তোরা। ‘

তূর্য চেয়ার টেনে বাবার কাছাকাছি বসলো। শ্রেয়া একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। নুরুল চৌধুরী আবারও মুখ খুললেন। বললেন,’ বাবার কাছে এসে বস। ‘
তূর্যর দিকে এক পলক তাকিয়ে তার পাশের টুলে বসলো শ্রেয়া। ওদের দু’জনের দিকে চেয়ে দুই অধর প্রসারিত করলেন তিনি।

‘ জিতেই গেলেন। নিজের অভিমান ভেঙে ছেলেকে ডাকলেন না,কিন্তু সেই অভিমানের ভারে দুনিয়া ছাড়তে রাজি আছেন। ‘

তাচ্ছিল্যমাখা কন্ঠে একেকটা বাক্য উচ্চারণ করলো তূর্য। শ্রেয়া আঁতকে উঠলো। একটা অসুস্থ মানুষকে এভাবে বলা ঠিক? কিন্তু নুরুল চৌধুরীর হাসি দেখে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল ও। তিনি খোশমেজাজে ওকে লক্ষ্য করে বললো,
‘ এই কথাগুলোতে কি আছে জানিস মা?কষ্ট, অভিমান, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়,ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান। তোর স্বামী আমাকে এত ভালোবাসে কিন্তু প্রকাশ করে না। ওর কি বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে লজ্জা লাগে?’

শ্রেয়া সাহসের কাজ করে বসলো। তৎক্ষনাৎ বলে ফেলল,’ হয়ত। ‘
নিমিষেই তূর্য রোষপূর্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো ওর উপর। দৃষ্টিতে দমে গেল ও। নুরুল চৌধুরী মৃদু ধ’মকে বললেন,
‘ ওকে চোখ রাঙালে কেন?আমার সহজ সরল মেয়েটাকে একদম ভয় দেখাবে না। যা সত্য তা-ই বলেছে ও। শুনলাম তোমার ভাই এসেছে? সম্পত্তির ভাগ নিতে?’

‘ না। অফিসের কাজে এসেছে। চলে যাবে আবার৷ ‘
‘ ওকে চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে এসো। সম্পত্তির ভাগ করবো। ওর বউকেও আসতে বলো। তাকে দেখাতে চাই ওর মতো এতিম আরও একটা মেয়ে আমার বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। সারাক্ষণ ভাবে কিভাবে সবার মন জয় করবে,ওর মতো ভাঙ্গার চেষ্টা করে নি।’
____________

সকাল থেকে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন চৌধুরী বাড়িতে। শ্রেয়া ও প্রিয়ু ব্যস্ত হাতে রান্নাঘর সামলাচ্ছে ত্রিহার সঙ্গে। মেহরিমা ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন নিজেকে। বসার ঘর থেকে রহিমা বড় বড় পা ফেলে রান্নাঘরের দুয়ারে উপস্থিত হলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

‘ নতুন বধূ,ত্রিহা,প্রিয়ু আইয়া পড়ছে। তূর্য বাবা লইয়া আইছে ওরা রে। জলদি আইয়ো। ‘

রান্না প্রায় শেষের দিকে। ত্রিহা আদুরে ভঙ্গিতে প্রিয়ুর উদ্দেশ্যে বললো,’ তোমরা যাও। আমি আসছি। ‘

সকাল থেকে প্রিয়ু,শ্রেয়া উভয়েই খুব উত্তেজিত তোহাশ ও আরিয়ানাকে দেখার জন্য। দু’জনেই হাত ধুয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। এসেই পা জোড়া থমকে গেল। অত্যন্ত সুন্দর গড়নের একটা মেয়ে কোলে বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে থ্রি পিস। বাচ্চা টার বয়স বড়জোর এক কি দেড় বছর হবে। মেয়েটার পাশেই একজন সুঠাম দেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে। শ্রেয়া হতবাক। কে বলবে এরা একই মায়ের পেটের না। তূর্য ও তোহাশের চেহারায় অনেকটাই মিল। ছোট ছোট পায়ে আরেকটু এগিয়ে আসে ও। ওর পিছন থেকে লাঠি ভর দিয়ে ফাতেমা চৌধুরী সামনে আসেন। তোহাশের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে সোফায় বসে পড়লেন। বলে উঠলেন,

‘ আরে মেহমানেরা দাঁড়ায় আছেন ক্যান?কত বছর পর আসলেন, বসেন বসেন। তূর্য বাবু ওদের বসতে বলবা না তুমি?’

প্রিয়ু মুখ টিপে হাসছে। তূর্য ধপ করে ফাতেমার পাশে বসে পড়লো। ফিসফিস করে বললো,
‘ ফাতু বাবু কেন ডাকো?দু’দিন পর বাবুর বাপ হবো। ‘

চারিধারে দৃষ্টি বুলাচ্ছে তোহাশ। দাদির খোঁচা মা’রা ও ঠিকি বুঝতে পেরেছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে সবার সামনে। কেউই এগিয়ে এসে কথা বলছে না। না বলাটাই স্বাভাবিক। শ্রেয়া সামনের মানুষ টার মনের হাল বুঝে নম্র কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ কেমন আছেন ভাইয়া?’
আরিয়ানা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। তোহাশ মুখে হাসি টেনে উত্তর দেয়, ‘ ভালো। তুমি তূর্যর বউ,রাইট?’
‘ হুম আমার শান্তশিষ্ট, প্যাঁচ বিহীন ভালো মনের বউ। ‘— সোফায় বসে আয়েশি ভঙ্গিতে বলে তূর্য।

#চলবে,,!
( ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here