#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___২৬
‘ বাহির থেকে আসার সময় দেখলাম একটা ছেলে একটা মেয়েকে হয়ত ছেলেটার গার্লফ্রেন্ড হবে,মেয়েটাকে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে ধরবার পর ছেলেটার মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হলো বিষয়টা খুবই তৃপ্তিদায়ক। সেই মুহুর্তে মনে পড়ে,আমার তো একটা বউ আছে। বউয়ের উপর এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হবে। তাই তোমাকে বুকে টেনে নিলাম। আর তুমি সুযোগ বুঝে আমার চুল ছিঁড়ে ফেলছো?বিন্দুমাত্র স্পর্শে এত উত্তেজিত হলে চলবে?দুপুরের গোসল টা দেওয়া কিন্তু এখনও বাকি। তবে কি শুরু করবো?’
গাঢ়,ফিচেল স্বরে উচ্চারিত অক্ষরগুলো অনায়সে শ্রেয়ার শ্রবণগ্রন্থি উত্তপ্ত করে তুলে। হৃদযন্ত্র থমকে যায় ক্ষণিকের নিমিত্তে। হাতের করপুট ঢিলে করে সরিয়ে আনে ঝটপট। মুক্ত করে দেয় তূর্যর চুলগুলো। কি ভেবেছিল,কি হলো!লজ্জায় আরক্তিম হয়ে উঠলো শুভ্র মুখ খানি। এক মুহুর্তের জন্য ভেবেছিল তূর্য ওকে আপন করে নিবে কিন্তু আশার প্রতিফলন হলো না। উল্টো একরাশ অস্বস্তি, লজ্জায় ডুবিয়ে দিল ওকে। অভ্যন্তর অস্থিরতায় ভরিয়ে দিল। দুই হাত ছড়িয়ে রাখল দু পাশে। তূর্য তখনও মুখ টা শ্রেয়ার কর্ণকুহরের অভিমুখে রেখে গরম নিঃশ্বাস বিমোচন করে চলছে। তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ছোঁয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে শ্রেয়ার কন্ঠনালি, অন্তঃস্থল। আবেশে বারংবার চক্ষু মুদে আসছে। একটা সময় আবিষ্কার করে তূর্য বাহুবন্ধনী হতে সরিয়ে দিয়েছে ওর দেহ টা। কিন্তু মন যেন লেপ্টে গিয়েছে মানুষ টার প্রশস্ত শক্তপোক্ত বুকে। এত শান্তি, সুখ শ্রেয়া কখনো পায় নি,কখনো না।
তূর্য ভ্রুঁ যুগল উঁচিয়ে চাইল চোখ বুঁজে থরথর করে কাঁপতে থাকা শ্রেয়ার পানে। বৃদ্ধাঙ্গুল কাছে নিয়ে তুড়ি মেরে ভেঙে দিল শ্রেয়ার ধ্যান, মগ্নতা, ভাবনার দেয়াল। চট করে নেত্রদ্বয় মেলে সামনে তাকায় ও। তূর্য দাঁড়িয়ে তুখোড় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে। স্থির,নিষ্পলক চক্ষু দৃষ্টি। অস্বস্তিতে বিছানা ছাড়তে নিলে শোনা গেল অতীব পরিচিত, চিরাচরিত কন্ঠস্বর,
‘ আমি কিন্তু প্রেম মিশিয়ে বুকে টানি নি,জাস্ট এক্সপেরিমেন্ট ছিল।’
শ্রেয়া বিছানা ছেড়ে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়াল। বাক্যটা ধারালো ছুরির ন্যায় গিয়ে বিঁধল ওর কোমল হৃদয়ে। মলিন, নিষ্প্রভ স্বরে জড়তা ছাড়াই প্রতি উত্তর করে,
‘ জানি স্যার। ‘
তক্ষুনি তূর্যর পাল্টা প্রশ্ন,
‘ আর কি কি জানো তুমি?’
‘ আপনি যা যা বলেছেন এসবই জানি। ‘
শ্রেয়া নিঃসংকোচ জবাব দিতেই তূর্যর ওষ্ঠ কার্ণিশে হাসির দেখা মিলে। শ্রেয়া তীররেখা নজরে দেখে তা। কেমন বাঁকা, রহস্যময় সেই হাসি। পরিস্থিতি পাল্টানোর জন্য জায়গা ত্যাগ করলে ভালো হবে ভেবে পা বাড়ায় ও বারান্দার দিকে। তবে বারান্দায় আর যাওয়া হয় না। ঝড়ের বেগে এসে তূর্য ওর হাত ধরে আঁটকে দিল। বাড়িয়ে দিল শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবিধি। সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে বসল খাটে বালিশে হেলান দিয়ে।
বিমূঢ়তায় বাক হারা শ্রেয়া। কি হলো অকস্মাৎ! ওকে বসালো সোফায়,নিজে বসল গিয়ে খাটে। কেন?হঠাৎ এটা করার কারণ কি?আবার চেয়ে আছে নির্নিমেষ চক্ষে। নিশ্চুপে,নিরবে থাকতে পারল না ও বেশিক্ষণ। মৃদু,রিনঝিনে কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
‘ আপনি কি কিছু বলবেন?’
তূর্যর দায়সারা জবাব,’ না। বলবে তো তুমি। ‘
‘ আমি?’— অবাক হলো শ্রেয়া। জিজ্ঞেস করলো বিস্মিত স্বরে।
বেজায় বিরক্ত তূর্য। চোয়াল শক্ত করে কয়েক পলক চেয়ে বলে ওঠে,’ তুমি সকালে বললে কিছু বলতে চাও। দুপুরে শুনবো বলেছিলাম। সো নাও স্টার্ট। সময় শুধু চার মিনিট। ‘
দোনোমোনো করছে শ্রেয়া। তূর্য কথাটা মনে করিয়ে দিতেই ওর বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। সকালে বর্ণগুলো সাজিয়ে সজ্জিত করে রেখেছিল তূর্য কে বলার জন্য। কিন্তু তার করা কিয়ৎক্ষণ পূর্বের কার্যকলাপ সেই শব্দাংশ, অক্ষর অবিন্যস্ত করে দেয়। অন্তঃকরণে সৃষ্ট করে তোলপাড়। কিন্তু কথাগুলো বলা যে অত্যধিক জরুরী। অপর মানুষ টা যা-ই ভাবুক,সাজায় না কেন নিজের দিক হতে একবার হলেও সাফাই গাওয়া উচিত। কারণ একপক্ষের চিন্তা ভাবনা মানুষের ধারণা আরো শক্তিশালী করে তুলে, কিন্তু দুই পক্ষের কথা,ভাবনা বিবেচনা করলে ধারণায় যত ভুল থাকে তা বিলীন হয়ে যায়। তাই অপর মানুষ টা ভুল বুঝুক কিংবা সঠিক তবুও নিজের তরফ হতে একটা বার মনের জমায়িত কথাগুলো ব্যক্ত করা প্রয়োজনীয়।
শ্রেয়া উসখুস করে নিজেকে সামলাতে নিমগ্ন হলো। তন্মধ্যে কাটিয়ে দিল দু,দু’টো মিনিট। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ রেখে কন্ঠে দৃঢ়তা টানলো,
‘ স্যার আপনি আমার ব্যাপারে সবটাই জানেন। অতীত,বর্তমান সব। তবুও আমি একবার আমার মুখে আমার অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে চাই। অতীত টা ভালো ছিল না। আমরা যেই ভাড়াটে বাসাটায় থাকতাম সেটা ছিল প্রায় বস্তির কাছাকাছি। আব্বুর অসুস্থতার পর পরই আর্থিক সমস্যাজনিত কারণে আম্মু এরকম একটা বাসায় উঠে। নানুর বাড়ি,খালার বাড়িতে সবার সাথে যোগাযোগ করে আম্মু কিন্তু কেউ আমাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে নি। কখনও কোনো আত্মীয়দের মুখ আমি দেখি নি। জন্মের পর যখন বুঝ হলো তখন থেকেই জানি আপন বলতে আম্মু আর আব্বু। কিন্তু আব্বু ছিল পাগল। বাহিরে খেলতে গেলে কেউ আমার সাথে খেলত না। বস্তির ছেলেমেয়ে পর্যন্ত আমাকে ব্যঙ্গ করে বলত আমি নাকি নোংরা কারণ আমার বাবা পাগল। ওদের মা-বাবারা আমার সামনে,আম্মুর সামনে বলত পাগলের মেয়ের সাথে মিশবি না। পরে কিছু হলে ওর পাগল বাপ এসে আমাদের মার*ব। একা একা সময় কাটাতাম। আম্মু কে দেখতাম লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। কখনও কখনও আম্মুর সেই কান্না চিৎকারে পরিণত হতো।
বাসা টা ভালো না হলেও ভাড়া ছিল অনেক। আম্মু মানুষের বাসায় কাজ করে সেই ভাড়া মিটাত। আব্বুকে একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে পারত না টাকার অভাবে। জীবনের জটিল পরিস্থিতি আমাকে সাত বছর বয়সে কেমন বড় করে দিল। ওই বয়সেই আমি কত সুন্দর ও নিখুঁতভাবে অনুভব করতে পারতাম আম্মুর কষ্ট, আব্বুর বেদনা। মাথায় হাত চেপে কত চিৎকার চেঁচামেচি করত আব্বু। বন্ধ রুম থেকে বাহিরে আসার জন্য ছটফট করত। এমনও দিন গিয়েছে আম্মু খাবার দিতে গেলে তার গলা চেপে ধরে মে*রে ফেলার চেষ্টা করে আব্বু। অথচ আম্মু আমাকে রূপকথার গল্পের মতোন তাদের প্রেমকাহিনী শুনাতো। বলত,জানিস শ্রেয়সী তোর আব্বুর মতো পুরুষ আমি দু’টো দেখি নি। এত ভালোবেসেছে লোকটা,সেই ভালোবাসার টানে না এসে পারলাম না। আমি তখন মন খারাপ করে বলতাম আম্মু আব্বু তো ভালো না,তোমাকে মা’রতে চায়। আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে পাগল তো তাই সঠিক, ভালো মন্দ বুঝে না মা। চিকিৎসার জন্য অনেকের কাছেই সাহায্য চায় আম্মু। কেউ করে নি। কারণ সবাই জানে বড় ধরনের টাকার পরিমাণ শোধ করা আম্মুর পক্ষে সম্ভব না। ‘
শ্রেয়ার কন্ঠনালি ভিজে গেছে। অশ্রুসিক্ত আখিঁদ্বয়। থেমে না থেকে কান্নায় দলা পাকানো কন্ঠে বলতে থাকলো,
‘ যেদিন আব্বু আম্মুকে খু*ন করে তার নিথর,রক্তাক্ত দেহটা ফেলে রাখে সেটা শুধু আমি দেখি। চোখ গুলো মেলে স্পষ্ট তাকিয়ে ছিল আম্মু কিন্তু দেহে প্রাণ ছিল না। আর আব্বু আম্মুর লা*শের সামনে বসে ভয়ংকরভাবে হাসছিল। খু*ন করে যেন খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। আব্বু কে যেই রুমে বন্দী করে রাখা হতো সেই রুমের দরজা খোলা দেখতে পাই। আমাকে দেখে হাতের বটি টা নিয়ে ওঠে আসে আব্বু। এগিয়ে আসতে আসতে প্রলাপ করে,” আয় আয় তোকেও খু*ন করি। ” বিশ্বাস করেন স্যার ওই মুহুর্তে আমি ভয়ে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ি ছেড়ে শুধু দৌড়ে যেখানে দু চোখ যায় ছুটে চলেছি। মাথায় শুধু ঘুরছিল হাতের নাগালে পেলে আব্বু আমাকে ওই বটি দিয়ে কে*টে ফেলবে। সেই যে বেরিয়ে আসি তারপর ঠাঁই হয় আপনাদের এতিম খানায়। সেখান থেকেই মাদারের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আব্বু আত্ম*হত্যা করেছেন।
জন্মের পর থেকে নিজের বাপ কে পা’গল,আর্থিক জটিলতা,বা’বার হাতে মা’য়ের মৃ*ত্যু,একা একটা জীবন সব মিলিয়ে নিজেকে নিজের কাছে ত্যক্ত লাগছিল। মন চাইত,এই পৃথিবীর মোহ মায়া ছেড়ে আমিও চলে যাই। সুখ,শান্তি, ভালোবাসার,আমার নিঃস্ব জীবনে সঙ্গী সবগুলো খুবই প্রয়োজন ছিল। আপনার দাদি বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর পর আমার মাথায় এসেছিল বিয়ের পর তো আমি এগুলো পাবো। আর কোনো ভয় আমার পিছু নিতে পারবে না। আমাকে আগলে রাখার জন্য কেউ একজন থাকবে। কিন্তু এ বাড়িতে পা রাখার পর যখন ফুলশয্যার মুহুর্তটা এলো,তখুনি আমার সকল চাওয়া নিঃশেষ হয়ে গেল। জীবনে আবারও হেরে গেলাম আমি। পরের সকাল টা আরো তিক্ত হয়। আমার অতীত এসে আমার গলা চেপে ধরে। আব্বু যেন কানের কাছে এসে বার বার বলছিল সেই বাক্যটা, আম্মুকে খু*ন করার পর বটি দেখিয়ে যেটা বলেছিল। আমার মনে হয়েছে আমি ম*রে যাবো,এবার আর বাঁচব না৷ এখান থেকেও পালাতে হবে আমার,যেভাবেই হোক। নয়ত আপনিও আমাকে মে’রে ফেলবেন। সত্যি বলছি স্যার,আমি অর্থের লোভে এ বাড়ির বউ হয়ে আসি নি। শুধু একটা লোভেই এসেছিলাম, ভালোবাসার লোভে। এটা কি খারাপ স্যার?এটা চাওয়া ভুল?মানুষ কেবল নিজেরা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লে অন্যের কষ্ট বুঝতে পারে। এছাড়া সহমর্মিতা দেখায়,স্বান্তনার হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমি তো এগুলোও পাই নি। হয়ত এতিম বলে,পাগলের মেয়ে বলে!আমিই খারাপ। ভয়ের তাড়নায় আপনার হাত ছেড়ে দিলাম। আমার উচিত ছিল স্ত্রী হয়ে আপনার পাশে থাকা। অতীতের ভয় আমার মধ্যে এমনভাবে বাসা বেঁধেছিল তা সব শেষ করে দিয়েছে, যার ফল এখনও পাচ্ছি। এ কারণেই আজ আপনি আমাকে দূরে ঠেলে রেখেছেন। আমি কি করবো স্যার?আমার কষ্ট কেন কমে না?আমার নিঃশ্বাস কেন বন্ধ হয় না? হলে তো সবকিছুর সমাপ্তি ঘটে যেত। বুঝ মনে কখনও কোনো পা’প করি নি,কেবল আপনাকে ছেড়ে যাওয়া ছাড়া। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার,আপনি ক্ষমা করে দিলে মুক্তি পাবো। দয়া করে,,
কাজলমাখা আঁখিদ্বয় ভেদ করে টপাটপ অশ্রু শাড়ির কোল ভিজিয়ে দিচ্ছে। থেমে থেমে যাচ্ছে ক্রন্দনরত কন্ঠস্বর। বিবর্ণ আঁধারে ছেয়ে গেছে শ্রেয়ার মুখশ্রী। সেকি বিধস্ত ভাব চেহারায়! কন্ঠনালি গলিয়ে বারংবার কান্নার আওয়াজ প্রবেশ করছে তূর্যর শ্রবণ নালিতে। তবুও গম্ভীর কন্ঠের প্রশ্ন,
‘ পালালে কেমন করে?’
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর একটা অনুরোধ করবো– সবাই দোয়া করবেন আমার জন্য।)