বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ১

0
1911

রাতে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়েছিলাম। সকাল বেলা আবারও ঝগড়া হয়, একপর্যায়ে সে আমাকে একটা থাপ্পড় মেরে বসে। আমি চুপচাপ অফিসে চলে যাই৷ চার বছরের সংসার জীবনে এরকম কষ্ট আমার কখনো হয়নি। মা-বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছি, স্বামী হিসেবে তিনি যথেষ্ট ভালো ছিলেন।

অফিসে এসে আমি কোনভাবেই কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। তাজুলের মুখে রাতে অমন বিশ্রী কথাবার্তা শুনে আমি বাকরূদ্ধ। তাছাড়া সে আমার গায়ে হাত তুলবে এটা তো আমার কল্পনাতেই ছিল না।

দুপুর পর্যন্ত শুধু ভাবনাতেই কেটে গেল। অফিসের ক্যান্টিনে খেয়ে নিলাম। বেশ কিছু অভিজ্ঞতা এই প্রথমবার হচ্ছে।
স্বামীর হাতে প্রথম চড় ছাওয়া।
রাগ করে খাওয়া বন্ধ করা।
সকালে উঠে রান্না না করা।
অফিসে খাবার না নিয়ে আসা।

দুপুর ২:৪০ PM
রিসিপশন ডেস্ক থেকে টেলিফোনে কল দিয়ে বললো ” আপা আপনার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছে। ”

রিসিপশনের বলা সেই ভদ্রলোক তাজুল ছাড়া আর কেউ নয়। তাজুল আমার অফিসে কোনদিন আসেনি। তার এই অফিসে আসাটাও আজ প্রথম। প্রথমবারের ঘটনা ঘটার রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। তাজুল আমার রুমের মধ্যে এলো। তাকে দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না।
ঘেমে জবজবে শরীর, চেহারার মধ্যে মারাত্মক চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ঝগড়ার কারণে অনুতপ্ত হয়ে এরকম করার কথা নয়। তারমানে অন্য কিছু ঘটনা আছে, কিন্তু সেটা কি? কি এমন হতে পারে যার কারণে এতটা চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে।

” বললাম, কি হয়েছে? এভাবে ঘামছো কেন? আর তুমি এ সময় তোমার অফিসে না গিয়ে এখানে কি করো? ”

” একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে মিতু। ”

” কি হয়েছে? ”
রাতের আর সকালের সবকিছু ভুলে আমি তাজুলের দিকে স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে রইলাম।

” আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো আমার কোনো দোষ নেই। আমি কিছু করিনি! ”

” ভালো করে বলো কি হয়েছে? তুমি কি রাতের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে এসেছ? যদি তাই হয় তাহলে এসব নিয়ে আমরা বাসায় গিয়ে কথা বলতে পারবো। ”

” না! রাতের বিষয় কিছু না। ”

” তাহলে কি হয়েছে ভালো করে বলো? ”

” আমি লাঞ্চ করতে বাসায় গেছিলাম। ”

আমাদের বাসা থেকে মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে হেঁটে হেঁটে তাজুলের অফিসে যাওয়া যায়। আমরা সেক্টরের বাইরে তবে ওর অফিস সেক্টরের মধ্যে। বাসা থেকে বের হয়ে রেললাইন পার হলেই ওর অফিস।
যখন আমি চাকরি করতাম না তখন নিজের অফিসের কাছেই বাসা নিয়েছিল তাজুল। বছর খানিক আগে আমি যখন চাকরি নিলাম তখন দেখা গেল আমার অফিস দুরে। কিন্তু সুবিধা হচ্ছে অফিসের গাড়ি আছে। তাই আমার যাতায়াতের অসুবিধা হবে না মোটেই। সুতরাং বাসা আর পরিবর্তন করা হয়নি। প্রতিদিন আমি বাসা থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে আসি কিন্তু তাজুল লাঞ্চ টাইমে বাসায় গিয়ে খায়।

বললাম ” আমি তো সকালে রান্না করিনি তাহলে বাসায় গেলে কেন জানতে পারি? ”

” তোমার মোবাইল আজকে বাসায় রেখে আসছো তাই না? ”

” হ্যাঁ। কিন্তু কি হয়েছে সেটা বলো না কেন? ”

” বারোটার দিকে আফরিন আমার কাছে কল করেছিল। ”

আমি চমকে গেলাম। আফরিন মাত্র দুদিন আগে আমাদের বাসায় এসেছিল। আফরিন আমার ছোটবোন। আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট আর ওর এখনো বিয়ে হয়নি। মাঝে মাঝেই সে চলে আসে আমাদের কাছে। কিন্তু তাই বলে সপ্তাহের মধ্যে দুবার চলে আসবে ভাবিনি। কারণ কি?

বললাম ” আফরিন কল দিয়ে কি বলেছে? ”

” আমাকে বললো যে, দুলাভাই আপা তো কল রিসিভ করে না। আমি তো আপনাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ ”

আমরা থাকি উত্তরা! আমার মা-বাবা সবাই মিলে থাকে ধানমন্ডি। যেহেতু আফরিন এভাবে হুট করে কখনো আসে না। তাই সন্দেহ হচ্ছে তাজুল হয়তো কল দিয়ে ওকে আসতে বলেছে। নিশ্চই আমার রাগের কথা বলে ওকে নিয়ে এসেছি ওকালতি করতে।

বললাম ” আফরিনকে আমাদের ঝগড়ার কথা বলতে গেলে কেন? ”

” আমি তো বলিনি কিছু। সে আমাকে হঠাৎ কল দিয়ে বললো যে সে বাসার সামনে। আমি তাকে আমার অফিসের সামনে যেতে বলি। তারপর আফরিন অফিসের সামনে গেল। আমি ওকে বাসার চাবি দিলাম। আফরিন বাসায় চলে গেল। যাবার সময় শুধু বললাম,
” তোমার আপার সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে তাই সকালে রান্না হয়নি। ”

আফরিন বললো ” ঠিক আছে দুলাভাই, আমি তাহলে বাসায় গিয়ে রান্না করে রাখবো। আপনি খেতে চলে আসবেন দুপুরে। ”

তখন আমি বললাম, ” সমস্যা নেই তুমি রান্না করে খেয়ে নিও। আমি বরং আজ হোটেলে খাবো। ”

ও বললো ” তা কি করে হয় দুলাভাই। আপনার অফিস থেকে তো কাছেই। আপনি বাসায় চলে যাবেন। ”

একটু থেমে তাজুল আবার বললো, দেড়টার দিকে আমি অফিস থেকে বের হলাম। কারণ এর আগে তিনবার কল করেছে। রেললাইন পার হয়ে আমি আফরিনের নাম্বারে কল দিলাম। আফরিন কল রিসিভ করলো না। রেললাইনের পাশের বাজার থেকে দুই কেজি দই কিনে বাসায় গেলাম। তুমি পরশু বলেছিলে দই কিনতে।

আফরিন তখন একটা মেসেজ দিয়ে বললো ” কল দিতে হবে না, আপনি চলে আসেন। ”

বাসায় গিয়ে দেখি ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। আমি আস্তে আস্তে ভিতরে প্রবেশ করি। আফরিনের নাম ধরে ডাকতে থাকি কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দিনের মধ্যেও কেন জানি ভয় করতে লাগলো। এমন তো হবার কথা নয়। তারপর আমাদের রুমের মধ্যে গিয়ে দেখি…..

তাজুল থেমে গেল, ওর চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আরও। আমি ধৈর্য ধরতে না পেরে বললাম,

” আমাদের রুমের মধ্যে কি হয়েছে? ”

” আমি বলতে পারবো না তুমি আমার সঙ্গে চলো এখনই। বাসায় গিয়ে দেখবে। ”

” ন্যাকামি করো না তো, বলো কি হয়েছে। ”

” আমাদের বিছানার উপর আফরিনের লাশ পড়ে আছে। ওর ওড়না দিয়েই ওকে ফাঁস দেওয়া হয়েছে। চোখ গুলো এখনো খোলা। ”

তাজুল কাঁপছে, আমার শরীরও তখন কাঁপা শুরু করেছে। আমি অস্পষ্ট গলায় বললাম ” আফরিন এর কি হয়েছে বললা? ”

তাজুল আমার হাতটা টেবিলের উপরে ধরেই বললো ” মিতু বিশ্বাস করো আমি কিছু জানি না। আমি শুধু ওকে চাবি দিয়ে দিছিলাম। কিন্তু আমি বাসায় যাবার আগেই কেউ হয়তো আমাদের বাসায় গিয়ে ওকে খু!ন করেছে। ”

আমার দম বন্ধ লাগছিল, তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে গেলাম। কাউকে কিছু না বলে অফিস থেকে বের হলাম। তাজুল আমার পিছনে পিছনে আসছে আর বলছে ” আমি এখনো কাউকে কিছু বলিনি। বিশ্বাস করো খুব ভয় লাগছে। আমি রুমের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে সরাসরি তোমার কাছে এসেছি। ”

একটা সিএনজি নিয়ে আমরা দুজনেই একসঙ্গে বাসায় এলাম। দারোয়ান আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললো ” ভাবি আপনাকে এমন লাগছে কেন? আর এমন সময় আপনি বাসায়। কোথাও কিছু হয়েছে নাকি? ”

ফ্ল্যাটের মধ্যে এসে আমাদের রুমের মধ্যে দেখি সত্যি সত্যি আমার বোনটা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেছে। না না কেউ একজন ওকে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে। তাজুল নিচ থেকে আসার সময় দারোয়ানকে বলেছিল বাড়িওয়ালাকে আমাদের বাসায় পাঠাতে।
একটু পরেই সদর দরজায় বাড়িওয়ালার কণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল। তাজুল তাকে বেডরুমে নিয়ে এলো। আমি তখন ফ্লোরে বসে আছি। কোনকিছু বলার মতো ভাষা আমার মুখ থেকে হারিয়ে গেছে।

বাড়িওয়ালা তখন তাজুলের কাছে কি কি হয়েছে সব শুনতে শুনতে পুলিশের কাছে কল করে। ধানমন্ডিতে মা-বাবার কাছে খবর দেওয়া হলো। আপন ছোটবোনের এমন লাশ দেখে একসময় আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমার চারিদিকে অনেক মানুষ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই তাজুল দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ওর হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো।

ওসি সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ” আপনি কি এখন ঠিক আছেন? ”

আমি কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম। ওসি সাহেব আবার বললেন ” আমরা ঘটনার প্রাথমিক কিছু কথাবার্তা শুনলাম। বাসার দারোয়ানের বর্ননা আর ফ্ল্যাটের পরিস্থিতি দেখে আপাতত আপনার স্বামীকে আমরা সন্দেহ করছি। আপনার বোনের লাশ পোস্টমর্টেম করতে পাঠানো হয়েছে।
আপনার স্বামীর সঙ্গে কখন দেখা হয়েছে আর সে আপনার কাছে কি কি বলছে সেগুলো একটু বলবেন? আর আপনার সন্দেহের তালিকায় আর কেউ আছে নাকি? থাকলে বলেন।

আমি তাজুলের দিকে তাকিয়ে আছি। অসহায় দৃষ্টিতে তাজুল আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটু একটু করে সব বললাম পুলিশের কাছে। তারপর পুলিশ তাজুলকে থানায় নিয়ে গেল। বাবা পুলিশের কাছে মামলা করে এলো৷


খালি কফির কাপটা হাতে নিয়ে সাজু ভাই বসে আছে। কফি খেতে খেতে মিতুর কাছ থেকে এতক্ষণ ধরে সবকিছু শুনছিলেন তিনি। গতকাল খুনের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে সাজু গিয়েছে থানায়। তারপর গিয়েছে তাজুলের অফিসে। সেখান থেকে মিতুর অফিসে গিয়ে তারপর এসেছে বাসায়।

সাজু ভাই বললেন ” সবকিছুই তো বললেন মিসেস মিতু। বাট চার বছরের মধ্যে প্রথম ঝগড়া কেন হয়েছে সেটা তো বললেন না। ”

মিতু বললো ” সেরকম বড় কোনো বিষয় না। ”

” আরেকটা প্রশ্ন, আপনি বলেছেন আপনি অফিস ক্যান্টন থেকে দুপুরে লাঞ্চ করেছেন। কিন্তু আমি খবর নিয়ে এলাম যে আপনি লাঞ্চের সময় অফিস থেকে বের হয়েছিলেন। এবং প্রায় দেড় ঘন্টা পরে অফিসে প্রবেশ করেছেন। ”

মিতু চুপ করে রইল। সাজু বললো ” কোথায় ছিলেন সত্যিটা ভালো করে ভাবুন, আমি বরং ততক্ষণে রান্না ঘরে গিয়ে ঘুরে আসি। আপনার বোন গতকাল কি কি রান্না করেছে সেটা তো দেখা দরকার তাই না? রান্না করতে পেরেছে নাকি তার আগেই খু!ন হয়েছে সেটা বরং দেখে আসি। ”

মিতু খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সাজু তার সেই চিরচেনা গম্ভীরতার মধ্যে ঠোঁটের আগায় হাসি দিয়ে
রান্না ঘরে গেল। পুলিশ গতকালই সবকিছু দেখে গেছে একবার। সাজু চারিদিকে তাকিয়ে অবশেষে ফ্রিজটা খুলে ভিতরে উঁকি দিল। অবাক হয়ে পাঁচ মিনিটের মতো তাকিয়ে থেকে আবার মিতুর কাছে এসে বললো,
” আপনার স্বামীকে না নিয়ে পুলিশ আপনাকে ধরে নিয়ে গেলেই বেশি ভালো হতো। ”

#চলবে… [ সবাই নিজের মতামত জানাবেন। ]

গল্প:- বিশ্বাস-অবিশ্বাস।
পর্ব:- ০১
লেখা:- মোঃ সাইফুল ইসলাম (সাইফ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here