কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ শেষ পর্ব

0
1402

#কৃষ্ণপক্ষের_চাঁদ
#শেষাংশ(অপেক্ষার শেষ প্রহর)
#JannatTaslima (writer)

.
.
.
আমি ‘আধারিকা রহমান’। আমার বয়স পয়ত্রিশ।আমার এই পয়ত্রিশ বৎসর বয়সে,আমার নামের সাথে চারটি এম যুক্ত হয়েছে।আমার আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত আমার নাম ছিলো ‘মিস আধারিকা রহমান ‘।আঠারোর কোটা পেরুতে না পেরুতেই একপ্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই আমার নামটা হয়ে যায় ‘মিসেস আধারিকা রহমান’।হঠাৎ করে বদলে যায় আমার স্থায়ী ঠিকানা। আমি সৈকত রহমানের মেয়ে থেকে হয়ে উঠি তাসফীন মাহমুদ চন্দ্রের স্ত্রী ‘মিসেস আধারিকা রহমান ‘।এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে না সব মেয়ের ক্ষেত্রেই হয়।আমার বয়স যখন চব্বিশ বা পঁচিশের কাছাকাছি, তখন সিজিপিএ 4.00পয়েন্ট বা ফাস্ট ক্লাস পেয়ে আমি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করি।দুর্ভাগ্য জনিত কারণে, এর কিছুদিন পূর্বেই আমার পিতৃতুল্য শশুর অসুস্থ হয়ে যান।তার সাথে সবসময় থাকার জন্য একজন লোক অনিবার্য হয়ে পরে।তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই, আমার পড়ালেখার আমি এখানেই ইতি টানবো।কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত আমার স্বামীসহ কোনো প্রিয়জনের,এমনকি আমার অসুস্থ শশুরের নিকটও তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো শিখা। নিজের সাথে ঘটা একটি দুর্ঘটনার কারণে,আমার উদ্দেশ্যের সাথে আরো একটি শব্দ যুক্ত হয়।আমি বাংলাদেশের আইন জানতে চেয়েছিলাম, শিখতে চেয়েছিলাম। তাই আইন নিয়ে স্নাতক পড়ার মনস্থির করি।কেননা, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হলো পাঠ্যপুস্তক ভিত্তিক। আমরা শুধু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য পড়ালেখা করি।তাই যেগুলো আমাদের পরীক্ষায় আসবে বা আসতে পারে, সেগুলোই আমরা পড়ি।এর বাইরে কিছু জানা আমাদের কাছে অতিরিক্ত সময় ব্যায় বলে মনে হয়। সেজন্যই আমি আইন নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম।এবং আমি পেরেও ছিলাম।সবার জোরাজোরিতে আমি আবার সিদ্ধান্ত বদলাই।কিন্তু বিভ্রান্তিতে পরে যাই, এরপর আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী হবে!যেহেতু আমার জীবনের নির্ধারিত কোনো লক্ষ্য ছিলো না,কোন পেশায় যাবো।যদিও আমার পড়াশোনা যে এতটুকু পৌছাবে তাও অনিশ্চিত ছিলো।প্রতিবারের মতো এবারও আমার আঁধারে চাঁদ হয়ে আসেন আমার ‘কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ’ আমার স্বামী চন্দ্র। তিনি আমার হাতে ধরিয়ে দেন বিজিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক একটি বই।পেয়ে যাই আমার নতুন লক্ষ্য।খুবই সহজভাবেই যেন ৭০% মার্ক পেয়ে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতিও বেশ ভালো ছিলো, কিন্তু পরীক্ষার আগের রাতে আরেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত এম আমার নামের আগে যুক্ত হয়ে যায়।আমি জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি।সেদিন আমি এতো খুশি হয়েছিলাম,যে আনন্দে আমার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে আধঘন্টা কেঁদে ছিলাম।পরমুহূর্তে যখন পরীক্ষার কথা স্বরণ হলো,আমি বেশ দোটানায় পড়ে যাই।এখন আমার কী করা উচিত?
পরীক্ষা দিবো কী না?ঠিক তখনও আমার স্বামী আমায় পরীক্ষার হলে নিয়ে যান।লিখিত পরীক্ষার ফলাফলও বেশ ভালো আসে।কিন্তু আমি মৌখিক পরীক্ষা না দেওয়ার মতো একটা সিদ্ধান্ত নিলেও।চন্দ্রের জন্য সেটা হয়ে উঠে নি।প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বিজিএস(বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস)এর মতো একটা পাবলিক পরীক্ষায়, মৌখিক পরীক্ষা দেওয়া আমার জন্য চ্যালেন্জিং হয়ে ওঠে। তবুও চন্দ্রের সহোযোগিতা আর আমার অক্লান্ত পরিশ্রম আমায় সফল করে।আমি একই বছর ‘মাদার’ও ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ এদুটি এম আমার নামের আগে যুক্ত করি।কেউ একদিন বলে ছিলো আমি নিজের ভালো মন্দ বিচার করতে জানি না।নির্বোধের মতো বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছি অথচ আজ আমি একজন বিচারক।যে শুধু নিজের ভালো মন্দ না, অপরাধীর ভালো মন্দও বিচার করি।একদিন যার জন্য বাড়ি ছেড়ে ছিলাম,ধর্ষিতা,কলঙ্কিনী, চরিত্র হীনা উপাধি পেয়েছিলাম।যার বিচার আমি কোথাও পায়নি।সময় যে তার বিচার আমার আদালতে করবে,আমার কলম দিয়ে তার ফাঁসির আদেশ লিখবে তা জানা ছিলো না।কেউ একদিন বলেছিলো,পাপ বাপকেও ছাড়ে না।আমি পাপ করেছি,আমি জীবনে যত সফলই হই না কেনো মা হতে পারবো না।অথচ আমি আজ আমার পাপের শাস্তি পেয়েছি, মা হয়েছি আমি।দুই মেয়ের মা।এর থেকে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে?এই মেয়েরাতো এক কদম ফেলতে দশটা ভুল করবে।যাক সেসব কথা।আমি আমার বক্তব্য আর দীর্ঘ করতে চাই না।আজ আপনারা যারা নবীন শুধু তাদের উদ্দেশ্যে, একটা কথা বলেই সমাপ্তি ঠানছি,অতীত মৃত লাশের মতো।একে যত আকড়ে ধরে রাখবে কষ্ট পাবে।তারমানে এই নয়,অতীত ভুলে যাবে।অতীত ভুলে যাওয়া বা আকড়ে ধরে রাখার জন্য নয়।শিক্ষা গ্রহণের জন্য।জীবন কোনো নাটক সিনেমা না যে সবকিছু সুন্দর হবে।বাস্তবতা অনেক কঠিন প্রিয়।আপনার সাথে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে।তাই বলে আপনার জীবন ওখানেই থেমে থাকবে না,এগিয়ে যাবে আর আপনাকেও তার সাথে এগিয়ে যেতে হবে।

বলেই মুচকি হেসে মঞ্চ থেকে নেমে এলাম।চারিদিক করতালির ধ্বনিতে মুখরিত হতে থাকলো।তিনটি উৎসুক মুখ হাঁসি ঝুলিয়ে গর্বের সহিত হাত তালি দিচ্ছে। সে আর কেউ না,আমার চুল পেকে যাওয়া কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ,আর দশ বছর ও আট বছর বয়সী দুই কন্যা আলো ও আশা।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

আমাদের ভার্সিটির নবীন বরণ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলাম আমি।যদিও এখানে শিক্ষকতা করার প্রস্তাব আমায় দেয়া হয়েছিল।আমি সেটা বিনা বাক্যে নাকোচ করে দিয়েছি।কারণ আমি অবসরে হলেও কিছুটা সময় আমার মেয়েদের দিতে চাই।আমি চাই আমার মেয়েরা আমায় দেখে বড় হোক, কাজের বুয়াকে দেখে নয়।আজ আমার সব আছে।নিজের একটা বাড়িও আছে।আলোর জন্মের দুই বছর পর আশার জন্ম হয়।বাবাতো এদের দুজনকে পেয়েই প্রায় সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।আমার এটা ভাবতেই ভালো লাগে, আমি তাকে বেশি কিছু না দিতে পারলেও,শেষ কালে এ দুইটা আনন্দ উপহার দিতে পেরেছিলাম।নবজন্মা আশা যখন তিন দিনের নবজাতক ছিলো, তখনই আমরা এই নতুন ছোট্ট বাড়িতে উঠি।তার দুই বছর পরই বাবা ইহলোক ত্যাগ করেন।সানজুর সাথে এখন কথা শুধু ফোনেই হয়।ওদের অনেক বার দেশে আসার কথা থাকলেও,নানাবিধ কারণে আসা হয়ে উঠে নি।এখনতো আবার ওর কাঁধে সংসারের গুরুদ্বায়িত্ব।আমাদের দুই বান্ধবীর কাছে দুজনের বিয়েটা আপেক্ষিক-ই রয়ে গেলো।মৃত্যুর আগে ওর সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে কী না জানা নেই।চাঁদনিও আমার আরেক বাবা মার ঘরে ভালোই আছে।আর আমরা তিন ভাইবোন এখন শুধু রহমান বাড়ির নয় পুরো গ্রামের গর্ব।আদনান ডাক্তার আর আরিয়ানতো শুরু থেকেই দুলাভাই ভক্ত।তার পেশাকেই নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে।আলো-আশা জন্মের আগে চন্দ্র আমায় আমাদের বাড়ি যেতে না দিলেও,ওদের জন্মের পর ঠিকই নিজে নিয়ে গিয়ে ছিলেন।আমার মেয়েদেরকে আমার মা থেকেও বেশি আদর করে বড় চাচা আর বড় চাচী।কেন করবে না,তাদের নিজের নাতি নাতনীকে তো ওরা কাছেও ডেকে আনতে পারে না।ছোটো চাচা-চাচী যে ওদের অনাদর করেন, সেটা বলা অন্যায়।”মানুষ অভ্যাসের দাশ”আলম ভাইও তার চিরাচরিত অভ্যাস ছাড়তে পারেন নি।প্রতিবার চালাকির সাথে বেঁচে গেলেও এবার বাঁচেন নি।একটা মেয়েকে জোর করে ধর্ষণ করতে না পেরে,রাগের বশে খুন করে ফেলেছিলেন।তার পরের ঘটনাটা আরেক বার না হয় না-ই বলি।
নিজের জীবন দর্শনের লম্বা পথ পারি দিয়ে আমাদের সেই স্বপ্নের বাড়িতে পৌছালাম।
|
|
|
চন্দ্র চায়ের পেয়ালা নিয়ে সামনে ছুটছেন,পেছনে ছুটছে আমার দুই মেয়ে।আলো আমার মতো শান্তশিষ্ট হলেও,আশা অনেক চঞ্চল।খপ করে বাবাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।আর আলো এসে গম্ভীর মুখে চন্দ্রের হাতের পেয়ালাটা নিয়ে, আরেকটা পেয়ালা ধরিয়ে দিলো।ওনি পানসুটে মুখে পেয়ালাটা হাতে নিয়ে আমার দিকে আসতে শুরু করলেন।আমি বুকে হাত গুজে বাড়ির লোনে দাড়িয়ে, এই বাপ মেয়েদের নিয়মিত দৌড় প্রতিযোগিতা দেখে মিটি মিটি হাঁসছি,

–তোমার এই কম চিনির চায়ের জন্য আমার জীবনটাই পানসে হয়ে গেলে।

চন্দ্রের মুখমন্ডলের এমন বেহাল অবস্থা দেখে আমার দমফাটা হাঁসি পাচ্ছে,
–আমি কী বলেছিলাম, আপনাকে বেশি খেয়ে ভুরি বানান সাথে ডায়াবেটিসও বাঁধান।

ওনি অসহায় মুখ করে তাকালেন।আমি চোখ রাঙাতেই নাকমুখ কুচকে চা টা ঢকঢক করে গিলতে থাকলেন।

এক বছর হলো চন্দ্রের ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। গত একমাস আগে একবার হার্ট অ্যাটাকও করেছেন।ডাক্তার ওনার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে বলেছেন।আমার ওনাকে নিয়ে অনেক ভয় হয়।আমি চাই না এই মানুষটা হারিয়ে যাক।আমি চাই এই মানুষটা সব সময় আমার আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ হয়ে থাকুক।

———সমাপ্ত——————

***

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here