কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ পর্ব ১৭

0
827

#কৃষ্ণপক্ষের_চাঁদ
#পর্ব :১৭(শেষাংশের প্রথম প্রহর)
#JannatTaslima(writer)




হাসপাতালের আইসিইউ রুমের দড়জা বরাবর দাঁড়িয়ে আছি।অন্দরে প্রবেশ করার সাহস পাচ্ছি না।কী থেকে কী হয়ে গেল!আজকে সকালেও তো সবকিছু নিত্যদিনের ন্যায় ঠিকঠাক ছিলো।বাবা ব্যাংকে গেলেন আর চন্দ্র অফিসে।আমার ভার্সিটি না থাকায় বাসায় ছিলাম।মাত্র দুই ঘন্টার ব্যবধানে সবকিছু উলোটপালোট হয়ে গেলো।যে মানুষটা সকালেও সুস্থ দেহের অধিকারী হাঁসি ঝুলানো মুখ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে ছিলেন।সে এখন হাসপাতালের আইসিইউর বিছানায় নিথর দেহ নিয়ে শায়িত আছেন।সাহসে কুলাচ্ছে না তার সামনে যাওয়ার।যদিও সে এখন জ্ঞানশূন্য,তবুও সংকোচ কাজ করছে।আমার আজকের অবস্থানের জন্য এই ব্যাক্তিটিরতো বহুল অবদান রয়েছে।বিনিময়ে চার বছরে আমি তাকে কী দিয়েছি?আজওতো আমার জন্য তাকে অনেক সমালোচিত হতে হয়।আমি এরকম হাজারো চিন্তার সমাগম ঘটিয়ে দড়জা অব্দিই দাঁড়িয়ে আছি।সেসময়ই চাঁদনি আটমাসের বাচ্চা রাইয়ানকে কোলে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসলো,চাঁদনির তটস্থ হাটা ওর স্বামী প্রকৌশলী শানকে পিছিয়ে দিয়েছে।বেচারা হয়তো তাল মিলাতে ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে বর্তমানে স্বাভাবিক গতিতে আসছেন।চাঁদনির অবস্থা দেখে ওযে কেঁদে কেটে বন্যা বাধায় নি,তা আর আমার অজ্ঞাত রইলো না।আমি স্বযত্নে রাইয়ানকে কোলে নিয়ে নিলাম।চাঁদনি ভাঙা গলায় বললো,
–বাবা এখন কেমন আছে ভাবী?

আমি লম্বা শ্বাস নিয়ে ভেতরটা পরিষ্কার করে নিলাম,
–আল্লাহর ইচ্ছায় এখন বিপদমুক্ত। তবে ডাক্তার বলেছেন, জ্ঞান ফিরার পর সম্পূর্ণ বোঝা যাবে।মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

উক্ত বাক্যের উল্লেখযোগ্য প্রধান দুটি শব্দেই, চাঁদনির দুটি আখিতেই ঝরনার সৃষ্টি হলো।শান তখন কাছাকাছিই ছিলেন, ওকে সামলানোর উদ্দেশ্যে হাতদ্বয় দিয়ে কাঁধে ধরতেই,চাঁদনি ওর বুকে মুখ গোজে অশ্রু ঝরাতে শুরু করলো।শান চাঁদনিকে শান্তনা দিতে দিতে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,
–বাবার কী হয়েছে আঁধার? ঠিক আছেতো সব?

শান ভাইয়ের প্রশ্নসমূহে বোধদয় হলো।দুশ্চিন্তার বশে মানসিক ভারসাম্য হারানোর কথাটা,চাঁদনিকে না বলাই উচিত ছিলো।যেখানে আমিই বাবাকে এ অবস্থায় মেনে নিতে পারছি না।ও ঔরশজাত সন্তান হয়ে এ বিষয়টা কীভাবে সইবে।নিজের করা বোকামি নিজেকেই শুধরাতে হবে,
–ধুর, চাঁদনি তুমি পুরো কথা না শুনেই ওভার রিয়েক্ট করা শুরু করে দিয়েছো।ডাক্তার বলেছে বেন স্ট্রোক করা রোগীদের মানসিক ভারসাম্য হারানোর সম্ভবনা থাকে।এরমানে এই নয় যে বাবার ক্ষেত্রে এমনটা হবে।বেন স্ট্রোক করা আজকালের যুগে স্বাভাবিক ব্যাপার।অনেকেইতো
দুই তিন বার করেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করে।এটা নিয়ে এতো ভেঙে পরার কিছু না।আর শান ভাই আপনি চাঁদনিকে ভেতরে বাবার কাছে নিয়ে যান।রাইয়ান আমার কাছে আছে, সবাই একসাথে যেতে পারবো না।আপনারা আগে গিয়ে দেখা করে আসুন।পরে আমি যাবো।

চাঁদনিকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে দুই তিন লাইন বাড়িয়ে বলা কাজে লেগেছে।এখন একটু শান্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে শান ভাই আমার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন,
–ঠিক আছে, আমি নিয়ে যাচ্ছি।তা চন্দ্র ভাইয়া কই?এখনো আসেন নি?

–এসেছেন, ঔষধ স্যালাইন এগুলোর ব্যবস্থা করতে গিয়েছেন।

–ওহ,
বলে শান ভাই চাঁদনিকে নিয়ে প্রস্থান করলেন।আমার ভিতরকার বোঝা যেন একটু হালকা হলো।হাসপাতালে বসার জন্য বিভিন্ন রঙের চেয়ারের মধ্যে,হলুদ বর্ণের একখানা চেয়ারে আসন পেতে বসতেই,আমার আর রাইয়ানের চোখাচোখি হলো।চোখ দেখে বেশ বুঝতে পারছি ছেলেটাকে ঘুম থেকে তুলে আনা হয়েছে।তাই ওর মাথাটাকে আদরের সহিত বুকে টেনে নিলাম।ভরসাযোগ্য নিদ্রাস্থল পেয়েই,ও চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়লো।মনে পরে গেলো,বছর দেড় এক আগের কথা। একদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ হলো।দড়জা খুলে বেশ অবাক হলাম,আগন্তুকরা ভেতরে প্রবেশ করতেই চন্দ্র-চাঁদনি,এমনকি বাবাও অবাক হলেন।কারণ আগন্তুকরা যে বড়ই অনাকাঙ্ক্ষিত।
ব্যারিস্টার মঈনুদ্দিন এসেছেন। তবে একা নয় সাথে তার একমাত্র ছেলে প্রকৌশলী ‘মহিউদ্দিন শানকে’ নিয়ে এসেছেন।মঈনুদ্দিন স্যারও আমায় এখানে দেখে আশ্চার্যান্বিত হয়ে ছিলেন।তার জানামতে এটা আসিফ মাহমুদ স্যার তথা বাবার বাসা।সেখানে আমার উপস্থিতির হিসাব তিনি মিলাতে পারছিলেন না।পরে প্রশ্নোত্তরের দ্বারা সূত্রানুযায়ী আমার পরিচয় বামপক্ষ=ডানপক্ষ প্রমাণিত হলো।অতঃপর তাদের পরিবারসহ আগমনের হেতুও ‘এ’ স্কয়ার +’বি’ স্কয়ার মান নির্ণয় পদ্ধতিতে জানা গেলো।তারা চাঁদের সাথে সূর্যকে বিয়ে দেওয়ার কথা বলতে এসেছেন।উদ্দীপকটা জটিল হলেও সূত্রানুযায়ী করলে সহজেই উত্তর পাওয়া যায়।যেহেতু আমাদের ঘরে বিয়ের উপযুক্ত একটা মেয়ে আছে।যার নাম চাঁদনি, মঈনুদ্দিন স্যার যার অপর একটা নাম দিয়ে ছিলেন মুন।আবার মঈনুদ্দিন স্যারের বিবাহ উপযুক্ত একটা ছেলে আছে।যার নাম শান, মঈনুদ্দিন স্যার যাকে আহ্লাদ করে মাই সান বলে ডাকেন।আমরা জানি, মুন মানে চাঁদ আর সান মানে সূর্য।সেহেতু ভার্সিটির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে শান এসেছিলেন, এবং স্যার আমি আর চাঁদনিসহ আরো দু-একজনের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।সুতরাং নির্ণেয় উত্তর :তাঁরা শানের সাথে চাঁদনির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।এটাতো খুবই সহজ সমাধান, এর জন্য লুকিয়ে উত্তরমালা দেখার প্রয়োজন নেই।ঘরে বসে এতো ভালো বিয়ের প্রস্তাব পেলে,তা ঠুকরানো আদিখ্যেতা বৈ কিছুই নয়।সকল প্রকার নিয়মানুযায়ী চাঁদ সূর্যের বিয়ের অংকের সমাধান হলো।চাঁদনিকে যেহেতু মঈনুদ্দিন স্যার আগেই পচ্ছন্দ করে রেখেছিলেন। তাই ওখানে ওর কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নি।ভাগ্য গুণে শাশুড়িও খুব ভালো পেয়েছিলো সে,শান ভাইতো আর আছেনই।তুখোড় সমালোচনার মধ্যেও আমরা এই ঠিকানাটা বদলাইনি।পৃথিবীর যেখানে যাবো আলোচনা-সমালোচনাতো থাকবেই।তাই আর পালাতে চাইনি।এখানেই রয়ে গিয়েছিলাম। একপর্যায়ে সমালোচনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও, চাঁদনির এতো ভালো জায়গায় বিয়ে, আবার সমালোচনা পুনঃআরম্ভ করে দিলো।এতোদিন এ বিষয়ে নাক না গলালেও এখন নাকসহ পুরো মস্তিষ্ক গলিয়ে দিতে পারলে ক্ষান্ত হই।কারণ, আমি চাই না,আমার জন্য চাঁদনির সুখের সংসারে আগুন লাগুক।চন্দ্র একদিন বলেছিলেন, “সত্যতো জ্বলন্ত অগ্নি শিখা লুকিয়ে রাখা যায় না”।তার কথাই ঠিক, শতো চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হলাম।একদিন চাঁদনির শাশুড়ি মঈনুদ্দিন স্যারের স্ত্রী পাশের বাসার আন্টির কল্যাণে সব জেনে গেলেন।আমিতো সিদ্ধান্তই নিয়ে নিয়েছিলাম, পায়ে পরে কান্না করে হলেও চাঁদনির সংসার বাঁচাবো।যথারীতি সন্ধ্যাবেলা মঈনুদ্দিন স্যার ও শান বাসায় আসেন,ভদ্র মহিলাতো আগেই আমাদের বাসায় ছিলেন।তাদের সিদ্ধান্ত শুনে পায়ে ধরে আকুতি করবো কী কদমবুসি করতে হলো।আমাদের সকল ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে,মঈনুদ্দিন স্যার ও তার স্ত্রী আমায় তাদের মৃত মেয়ের স্থানে বসিয়ে দিলেন।সেদিন থেকে তাঁরাও হয়ে যায় আমার আরেক মা-বাবা আর শান হয়ে যায় বড় ভাই।সেদিন হতে তাদের আব্বু-আম্মু আর শানকে ভাই বলে ডাকি।বিয়ের পর এখনো পর্যন্তো নিজের বাপের বাড়ি যাই নি।তবে গতো একবছর ধরে যেতে হচ্ছে, চাঁদনির শশুরবাড়ি আর আমার নতুন বাপের বাড়িতে।গ্রামে মা-ভাইয়েরা ভালোই আছে।আদনান এ বছর মেডিক্যালে চান্স পেয়েছে।এখন ঢাকায় থাকে।প্রথমে ওর থাকার ব্যবস্থা হোস্টেলে করলেও আব্বু-আম্মু আর শান ভাইর জোড়াজুড়িতে ওদের বাসায়ই থাকতে হলো।আরিয়ান এবার ক্লাস ট্রেনে,ও মায়ের সাথেই গ্রামে আছে।দুই তিন বছর পূর্বেই রহমান বাড়ির যৌথ পরিবার পৃথক হয়ে গেছে।দুই ছেলে প্রবাসী থাকায় অহংকারী বড় চাচীর সকল অহংকার আঁচলে বাধলেন বড় ভাবী।ছোট চাচীতো দূর্ততার সাথে এর আগেই আলাদা হয়ে গেলেন।মেজ ভাইয়া বিয়ের পর থেকেই বড় চাচীর সকল হুকুম শুধু ঝুলে রয়ে যায়,কেউ আর পালন করে না।মেজ ভাইয়ের বউ নাকি বেশ বড় ঘরের মেয়ে,তার হুকুম করার অভ্যাস আছে মানার নয়।তার উগ্র আচরণ বড় চাচীর এতোদিনের জমানো ক্ষোভ শাশুড়ির প্রতি উপচে পরে।আমার বড় চাচীওতো সয়ে যাওয়ার পাত্রী নয়।অবশেষে সবার সহ্যের উর্ধ্বে গিয়ে অবশিষ্ট পরিবারটা আরো চার টুকরো হয়ে যায়।আমার দুই ভাইয়ের বউ শশুড়-শাশুড়ি নিয়ে খেতে পারবে না।তাই আর কী করার, বাধ্য হয়ে ছোটো ভাইয়াকে দেশে আনিয়ে জরুরি ভিত্তিতে বিবাহ করানো হলো।মা ও আদনান-আরিয়ানকে নিয়ে স্বাধীনভাবে নতুন সংসার বাঁধলেন।”যেমন কর্ম তেমন ফল” বলে একটা কথা আছে না।দুই বউকে নিয়ে দুই বছর একসাথে থাকতে পারলেও,নতুন বউকে নিয়ে দুই মাস এক পরিবারের থাকতে পারেন নি বড় চাচী আর বড় চাচা।গ্রামে বৃদ্ধাশমের প্রথা তেমন প্রচলিত না থাকলেও, তাদের থাকার স্থান হয়ে ছিলো, গোয়াল ঘরের পাশে চাকরিচ্যুত মনাই কাকার ঘরে।বড় চাচীর সর্বকালের উপদেষ্টা মেজো জা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারলেও, সর্বদা অবহেলিত ছোটো জা তাদের এই অপমান মেনে নিতে পারেন নি।বড় ভাইবোন তুল্য জা-ভাসুরকে নিজের ছোট্ট সংসারে ঠাই দিয়েছিলেন আমার মা, এখনো তাঁরা সেখানেই আছেন।ছেলের বউরা তো দূরের কথা ছেলেরা পর্যন্ত তাদের মা-বাবা বেঁচে আছে বলে মনে করে না।এভাবে অতীত নিয়ে আর বেশিক্ষণ ডুবে থাকতে পারলাম না,আমার কৃষ্ণপক্ষের চাঁদকে মলিন,ক্লান্তি ভরা চেহারায় ঔষধ নিয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।

————————————————–

–এই আপেলটা কার বলতে পারেন?

–কী পাগলের মতো প্রশ্ন করছো আধারিকা?সরোতো আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

চন্দ্রের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখের সামনে একটা আপেল ধরে এরকম উদ্ভট প্রশ্ন করতেই,বিরক্ত হয়ে কথাটা বললেন চন্দ্র।আমি খুব ভালো করেই জানি চিন্তার কারণটা।সেটা হলো বাবা।আল্লাহর রহমতে তিনি সুস্থ আছেন। তবে ডাক্তারের ভাষ্যমতে মানসিক ভারসাম্য পুরোটা না হারালেও কিছুটা হারিয়েছেন।আগের থেকে কথা বলার মাত্রা বেড়ে গেছে। যে মানুষ খুবই কম কথা বলতেন,হাসতেনও কম।সে এখন সবার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলেন,যা বিরক্তির মাত্রা ছাড়ায়।তাকে এ অবস্থায় দেখে আমার খুব খারাপ লাগে। চন্দ্র-চাঁদনিও এ বিষয়টা নিয়ে ভেঙে পড়েছে।তাই আমি নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছি,
–আপনি খাবেন না চন্দ্র?

–দেখো আধারিকা,তুমি খেয়ে নাও আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।

–আপনি না খেলে আমিও খাবো না।জানেন আমার না খুব খিদে লেগেছে। সেই সকাল থেকে কিছু খাই নি।

ন্যাকা স্বরে কথাটা বললেও সত্যিই ক্ষুধা পেয়েছে প্রচুর। ওনার মন হয়তো কিছুটা গললো।নরম স্বরে জানতে চাইলেন,
–কেন তুমি কিছু খাও নি?

–আপনি না খেলে আমি খাই।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঐ আপেলটায় অল্প কামড় দিয়ে আমার দিকে আপেলটা বাড়িয়ে দিলেন।আমি আপেলটা হাত নিয়ে উঁচু করে চোখের সামনে ধরে গবেষণা শুরু করে দিলাম,
–জানেন এই আপেলটা হয়তো আমাদের দেশীয় না,বিদেশ থেকে এসেছে। এই আপেলটা যখন বাগানে ছিলো, তখন অনেকে এটার পরিচর্চা করেছে।তারপর এটা যখন বিক্রি হলো,আরো অনেক লোক এটাকে গাছ থেকে পেরেছে, প্যাকেটজাত করেছে। আবার এটা যখন গাড়ি দিয়ে বহন করে আনা হলো,তখনও নানা ধরনের লোকেরা এটাকে তোলা নামা করেছে। একসময় এটা বিমান চড়ে বাংলাদেশে এলো,সেখান থেকে আরেক জায়গায় রাখা হলো,ট্রাক করে কিন্তু বিভিন্ন জেলায়ও এগুলো পাঠানো হয়েছে। এই আপেলটা কিন্তু অন্য কোনো জেলায়ওতো যেতে পারতো,বাজারে যখন ছিলো, বাক্স বন্দী ছিলো না খোলামেলা ভাবে ফুটপাতে রাখা ছিলো।ফুটপাতে তো কত জায়গার,কত ধরণের মানুষের পদচারণা। এমনকি যে এটা বিক্রি করেছে তার অবস্থাও তো ভালো না,সে চাইলে এই আপেলটা সে নিজে খেতে পারতো। বাকিগুলো বিক্রি করতে পারতো।অথচ, দেখুন এতো জায়গা ঘুরে, এতো মানুষের হাতের নাগালে এসেও কেউ এই আপেলটা খায় নি।অনেকে হয়তো এটা দাম করেছে কিন্তু কিনে নি।আপনি কিনে আনার পরওতো,বাসায় অনেক মেহমান এসেছে কাউকে তো এই আপেলটা নাস্তা হিসেবে দেওয়া হয় নি।আমিতো নিজে এটা ধুয়ে এনেছি, আমিওতো খাই নি। কেন বলুনতো?

ওনি এতক্ষণ কপাল কুচকে আমায়ই দেখছিলেন, এখন সুযোগ পেয়ে বলে উঠলেন,
–তুমি এসব দ্বারা কী বুঝাতে চাইছো।

–আমি বুঝাতে চেয়েছি,এই আপেলটা আপনার রিজিকে লেখা ছিলো। তাই আপনি এতো মানুষের হাত লাগার পরও এই আপেলটা খেতে পেরেছেন। ঠিক তেমনি যে জিনিসগুলো আপনার তাকদীরে থাকবে,সেগুলোই আপনি অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হলেও আপনার করে পাবেন।আর যেগুলো আপনার তাকদীরে নাই,সেগুলো আপনার হাতের মুঠোয় যত্নে সংরক্ষিত থাকলেও তা আপনি পাবেন না।তাই আর ঐ ছিনতাই হয়ে যাওয়া টাকাগুলোর কথা না চিন্তা করাই ভালো। ওগুলো কখনোই আমাদের ছিলো না।তাই আমরা পাই নি।এসব চিন্তা করে কেন অযথা সময় নষ্ট করেছেন বলেনতো?

ওনি মুখ ভার রেখেই বলেন,
–চিন্তা না করতে চাইলে কী আর চিন্তা হবে টাকাগুলো বাবার সারা জীবনের সঞ্চয় ছিলো।আমাদের সবার এতো দিনের স্বপ্ন,ঢাকায় একটা নিজস্ব ফ্ল্যাট হবে।বাবার স্বপ্ন ছিলো, তার সারা জীবনের আয় দিয়ে এ শহরে আমাদের একটা নিজস্ব ঠিকানা করে দিবে।সেই স্বপ্নতো প্রায় পূরণও হয়ে গিয়েছিল, আর তখনই এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটলো।

আমি শান্তনা দিতে বললাম,
–দেখেন যা হবারতো হয়ে গেছে।বাবা সুস্থ আছেন এটাই অনেক বড় বিষয়। আমরা ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট কিনতে পারি নি বলে কী হয়েছে? দেখবেন এই শহরে আমাদের একদিন ছোট্ট একটা বাড়ি হবে।আপনি তৈরি করবেন সেই বাড়ি আপনার নিজের মনের মতো ডিজাইন করে।আমাদের স্বপ্নের থেকে ঐ বাড়িটা অনেক বেশি সুন্দর হবে।

বলে চন্দ্রের কাঁধে এক হাত রাখলাম।ওনি আমার ভরসার স্পর্শ পেয়ে আমার হাতের ওপর হাত রাখলেন। এবং চোখ দুটো বন্ধ করে আশ্বাস দিলেন,”হ্যা এমনই হবে।আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।”

———–
দুঃখের পর সুখ আছে,কথাটা মিথ্যা না।সেদিন আমাদের নিজস্ব ফ্ল্যাটে যাওয়ার কথা ছিলো। অথচ তার পরিবর্তে হাসপাতালে যেতে হয়েছিলো।কারণ বাবা তার সারা জীবনের সঞ্চয়গুলো ব্যাংক থেকে তুলে আনার সময় সব টাকা ছিনতাই হয়ে যায়।তিনি সেই আকষ্মিক আঘাত বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেন।রাস্তায়-ই ব্রেন স্ট্রোক করে বসেন।এর ফলে আমরা সবাই অনেক বড় কিছু হারালেও অনেক বড় কিছু পাই।আমার অনার্সের চূড়ান্ত ফলাফলে আমার মার্কস প্রথম স্থানে গিয়ে ঠেকে।যদিও আমার প্রথম সেমিস্টারের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই,আমার আর বন্ধুর অভাব হয়নি।সিনিয়র, জুনিয়র, ক্লাসমেট, টিচার ধীরে ধীরে পুরো প্রতিষ্ঠানে আমি হয়ে ওঠি জনপ্রিয় কিছু।মঈনুদ্দিন স্যারের সেদিনের ভাষ্যমতেই,আজ আমার বন্ধুর অভাব নেই।তবে শত্রু যে নেই তা না।আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে আমায়।শেষ পর্যন্ত কোনো ভাবে সফল না হতে পেরে, আমার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে তৈরি করা হয় তুমুল সমালোচনা।এগুলো দিয়ে কী আমায় আদৌও দমিয়ে রাখা সম্ভব ছিলো।তাঁরাতো আর জানতো না, যেগুলোকে তাঁরা আমার দুর্বলতা ভাবতো।সেই দুর্বলতাকে জয় করেইতো আমি ওই পর্যন্ত পৌঁছে ছিলাম।এদিকে চন্দ্রেরও প্রমোশন হলো।এখন বেশ মোটা অংকের টাকা প্রতিমাসে তার পকেটে আসে।এছাড়া,আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে,বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে মায়ের সাথে বড় চাচা আর বড় চাচীও বাবাকে দেখতে আসেন।তাঁরা তাদের কৃতকর্মে বেশ লজ্জিত, সানজুর বাবার কাছেও ভিডিও কলে ক্ষমা চান।আমার কাছেতো আর চাইছেনই।কিন্তু কেউ অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেই কী তাকে সহজে ক্ষমা করা যায়।মুখ দিয়ে হয়তো,”আমি ওসব কবে ভুলে গেছি” বাক্যটা উচ্চারণ করা যায়। আসলে কী সত্যিই সবকিছু ভুলে থাকা যায়। বাবার সাথের দু্র্ঘটনাটা যতোটা কষ্ট দিয়েছিলো।তার পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আরো বেশি প্রশান্তি দিয়েছিলো।না চাইতে কত কিছু পেয়ে গিয়েছিলাম।তবুও সব পূর্ণতায় একটা অপূর্ণতা থাকে। সেটা হলো সন্তান। বিয়ের চার বছরের পরও আমাদের ঘরে কোনো সন্তান নেই।চন্দ্রের এ বিষয়ে কোনো মাথা ব্যথা না তাকলেও আশে পাশের লোকজনের এ বিষয় নিয়ে অনেক মাথা ব্যথা।আমারও প্রতিটি দোয়ায় এখন এই একটাই কামনা।যদিও চার বছর পূর্বে এই কামনাটা উল্টো ছিলো।ইংরেজিতে একেই হয়তো বলা হয় ‘ডেস্টিনি’।

বি.দ্র: আমি এখানেই উপন্যাসটার ইতি ঘটাতে চাই না, আরেকটু সামনে নিতে চাই।আজকের পর্বটা বেশ অগুছালো হয়েছে, খানিকটা বিরক্তিকরও।এখন না দিতে পারলে পরবর্তীতে দিতে না পারার সম্ভাবনা বেশি তাই এভাবেই দিয়ে দিলাম।দ্বিতীয়াংশ পেতে হয়তো একটু দেরি হতে পারে। আবার তাড়াতাড়িও পেয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে।
আমার লিখনশৈলী, শব্দ চয়ন ততোটা উন্নত নয়,বানান সংক্রান্ত ভুলতো আর আছেই।তবুও যারা গল্পটা এতোদিন ধরে পড়েছেন, তাদের অনেক ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here