আপনিময় বিরহ পর্ব ১২

0
370

#আপনিময়_বিরহ (১২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

স্নিগ্ধ সকালের বাতাসে মন ফুরফুরে হয়ে যায় প্রিয়তার। সকালটাও যেন তাকে নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা দিচ্ছে। উল্টা পাল্টা চিন্তা করে নিজেই নিজের মাথায় গাট্টা মারে। চোখ বন্ধ করে বাতাস অনুভব করতে থাকে। কিছুক্ষণ যেতেই তনিমার ডাক। প্রিয়তা ‘আসছি’ বলেই ছাঁদ থেকে নেমে যায়৷ লিভিং রুমে আসতেই দেখে সেখানে উদয়, তনিমা, প্রিয়ম আর সিমি বসে আছে। সিমিকে দেখেই চোখ মুখ কুঁচকালো প্রিয়তা। সব সময় এই মেয়েটার কেন থাকতেই হবে! এতো সুন্দর মুডটা ঠাস করে অফ হয়ে গেলো। কেন যেনো এই সিমিকে তার সহ্যই হয় না। অকারণেই। প্রিয়তা এগিয়ে আসতেই প্রিয়ম ফোন থেকে চোখ তুলে তার দিকে তাকায়। তারপর কিছু না বলে প্রিয়তার হাত ধরে। প্রিয়তা হকচকিয়ে যায়। চমকে তাকায় প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম পাত্তা না দিয়ে বললো,

‘উদয় তুই সিমি আর তনিমাকে নিয়ে গাড়িতে যা। আমরা আসছি।’

সিমির মুখটা মলিন হয়ে গেলো। কিন্তু উদয় আর তনিমা মিষ্টি করে হাসলো। উদয় উঠতে উঠতে বললো, ‘ওকে সাবধানে আসিস। তনু আয়। সিমি আপু আসো।’

সিমি হাসার চেষ্টা করে কয়েকবার পলক ফেলে প্রিয়ম আর প্রিয়তার ধরে থাকা হাতটার দিকে তাকালো। তারপর নিঃশব্দে চলে গেলো। প্রিয়তাকে কিছু বলতে না দিয়েই প্রিয়ম তার হাত ধরে বাড়ির বাহিরে নিয়ে আসে। এতক্ষণে মুখ খোলে প্রিয়তা। বলে,

‘আজ হঠাৎ বাইকে যাবো কেন?’

‘সার্কাস দেখাতে।’

প্রিয়মের ত্যাড়া উত্তরে ভেংচি কাটে প্রিয়তা। লোকটা আগে কত ভালো ছিলো আর এখন! গম্ভীর, পেটমোটা একটা।হুহ! বিড়বিড় করে প্রিয়মের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলে। প্রিয়ম সব শুনে নিঃশব্দে হাসে। তারপর গাড়ির হর্ন দিয়ে বোঝায় যে ‘অনেক আমার গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন এখন উঠেন’। প্রিয়তা উঠে পড়ে। বাইকে উঠে বলে, ‘আমরা কই যাবো?’

‘উগান্ডায়।’

রাগে আর প্রিয়তা কিছু জিজ্ঞেস করে না। প্রিয়ম বাইক স্টার্ট দেয়। শো শো করে চলে আসে ভার্সিটিতে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘আসলেন তো সেই বাইকেই তাইলে শুধু শুধু কেন বাইক নিলেন?’

‘তোর কোনো সমস্যা?’

প্রিয়তা কিছু বলে না। একে কিছু বলে লাভ নাই। চুপচাপ নেমে নিজের ক্লাসের দিকে যেতে থাকে। হুট করেই সামনে সাদাফ এসে দাঁড়ায়। চমকে উঠে প্রিয়তা। সাদাফ হেঁসে বলে,

‘ভয় পাইছো?’

প্রিয়তা কিছু না বলে সাদাফের মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘আমার ক্লাস আছে ভাইয়া। আসছি।’

প্রিয়তা দুই পা এগোতেই সাদাফ বলে, ‘প্রিয়মের সাথে জড়াজড়ি করে আসতে তোমার সমস্যা হয় না আর আমি সামনে আসলেই তোমার যত বাহানা!’

প্রিয়তা থেমে যায়। তারপর সাদাফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি প্রিয়ম ভাইয়ের সাথে জড়াজড়ি করে আসবো না কি করবো তা একান্ত আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। আর যখন বুঝেনই আমি আপনাকে ইগনোর করি তখন আসেন কেন কথা বলতে?’

সাদাফের মুখটা মুহুর্তেই থমথমে হয়ে যায়। প্রিয়তা আর না দাঁড়িয়ে নিজের ক্লাসের দিকে চলে যায়। প্রিয়তা যেতেই হাজির হয় প্রিয়ম, রিমা, নিতু, নোমান আর সামি। প্রিয়ম শান্ত কন্ঠে বলে, ‘প্রিয়তার পেছনে পড়ে আছিস কেন?’

সাদাফ বাঁকা হেঁসে বলে, ‘তুই আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিস আর আমি তোরটা। সিম্পল!’

প্রিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকায়। সাদাফ প্রতি’শো’ধের নেশায় বুদ হয়ে আছে। তাকে যায় বলুক বুঝবে না আর। রিমা বলে, ‘সাদাফ তুই কিন্তু সত্যিটা না জেনে ওকে দোষ দিচ্ছিস!’

সাদাফ গায়ে মাখে না সে কথা। নিজের মতো চুপচাপ চলে যায়।

প্রিয়তা ক্লাসে আসতেই তনিমা চেপে ধরে। ওরা আলাদা আসলো কেন? প্রিয়ম কি ওকে প্রপোজ করছে নাকি? মানে যত প্রশ্ন আছে সব করতেছে। প্রিয়তা চোখ গরম দিয়ে বলে, ‘তুই চুপ করবি এবার!’

সাইমা এতক্ষণ চুপচাপ এদের দেখছিলো। এবার ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ব্যাপার কি তোদের?’

তনিমা বলে, ‘অনেককিছু দোস্ত।’

‘মানে?’

তনিমা কিছু বলার আগেই প্রিয়তা বলে, ‘আরে কিছু না। ওর কথায় কান দিস না।’

তনিমা গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। সাইমা সন্দেহের চোখে তাকায় প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা জোড় করে হেঁসে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে, ‘আচ্ছা তুই কি প্রিয়ম ভাইকে চিনিস?’

সাইমা বুঝে প্রিয়তা প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছে তাই সেও আর না ঘেটে বলে, ‘হ্যাঁ চিনবো না কেন! আমি তো এই কলেজেই পড়ছি। মানে আমাদের ভার্সিটিতে তো কলেজ+ভার্সিটি। তো আমি আগে থেকেই এখানে পড়ি। আমি যখন এডমিট হয় তখন প্রিয়ম ভাইয়ারা অনার্স ৩য় বর্ষ। প্রিয়ম ভাইয়ার গ্যাঙ তো ফ্যামাস। বিশেষ করে সাদাফ ভাই আর প্রিয়ম ভাইয়ের বন্ধুত্বের জন্য। আমি তো উনাদের ফ্রেন্ডশীপ দেখেই ফিদা।’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এত ভালো বন্ধুত্ব অথচ এখন উনাদের সম্পর্ক এমন কেন? প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই সাইমা বললো, ‘কিন্তু মাঝখানে সাদাফ ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড মারা যাওয়ার পর থেকে প্রিয়ম ভাই আর সাদাফ ভাইয়ের সম্পর্কও বদলে গেছে।’

কথাটা বলতে গিয়ে সাইমার গলা কেঁপে কেঁপে উঠলো। তা লক্ষ্য করে তনিমা বলে, ‘এই কথাটা বলতে তোর গলা কাঁপলো কেন?’

‘আরেহ না কিছু না।’

‘বল বল। তাড়াতাড়ি বল।’

তনিমা আর প্রিয়তার জোড়াজুড়িতে সাইমা বললো, ‘ঠিক আছে বলতেছি।’

তনিমা আর প্রিয়তা মনোযোগী দর্শকের মতো সাইমার দিকে তাকিয়ে আছে। সাইমা অন্যদিকে তাকিয়ে ধীরে বললো, ‘আমি যখন প্রথম সাদাফ ভাইকে দেখি তখনই ক্রাশ খায়ছিলাম। প্রিয়ম ভাইয়ের ওপর অনেক মেয়ে ক্রাশ খাইলেও আমার ভালো লাগলো সাদাফ ভাইকে। কিন্তু উনি একটা আপুকে অসম্ভব ভালোবাসতেন তাই কোনো মেয়েকেই পাত্তা দিতেন না। আমি ভাবতাম উনি শুধুই আমার ক্রাশ। কিন্তু কখন যে ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা হয়ে গেছে নিজেও বুঝিনি। উনাকে আপুটার সাথে দেখলেই আমার ভীষণ কষ্ট হতো কিন্তু তবুও আমি উনার কাছে নিজেকে প্রকাশ করিনি। কারণ আমি উনাদের মধ্যে ৩য় ব্যাক্তি। আমি সরে যাওয়ায় ভালো। এরপর দেড় বছর পরেই হঠাৎ শুনলাম আপুটা মারা গেছে তখন আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। সাদাফ ভাই তো পাগল হয়ে গেছিলো রীতিমতো। তখন থেকেই উনার আর প্রিয়ম ভাইয়ের মাঝে মিল নাই। কেমন শত্রু শত্রু ভাব!’

প্রিয়তা আর তনিমা দমে যায়। তনিমা নিজেও তো এই একপাক্ষিক ভালোবাসার বিরহ নিয়ে আছে। সে তো খুব ভালো ভাবেই জানে এই বিরহটা কত কষ্টের। সবাই বলে একপাক্ষিক ভালোবাসাতেই মানুষ সুখী কিন্তু এটা ভুল। হয়তো মানুষ একপাক্ষিক ভালোবাসায় হারানোর ভয় পায় না কিন্তু নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যের পাশে দেখে নিজের ভেতরের ক্ষত গভীর করে। ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার আক্ষেপে পুড়ে। সাইমা নিজেকে সামলে হেঁসে বলে,

‘শুধু যে সাদাফ ভাই একটা মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসে এমন না কিন্তু প্রিয়ম ভাইও কিন্তু একটা মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসতেন এবং সম্ভবত এখনো বাসে। পুরো ক্যাম্পাস জানে এটা।’

চমকে তাকায় প্রিয়তা আর তনিমা। তনিমা অবাক হয়ে বলে, ‘মানে?’

‘মানে আবার কি? আমি তো সেই প্রথম থেকে শুনতেছি প্রিয়ম ভাই বুকড মানে উনি নাকি কাকে ভীষণ ভালোবাসে। তবে ক্যাম্পাসের কেউ সেই মেয়েকে চিনেও না জানেও না।’

প্রিয়তা কেমন করে যেনো হাসে। সেই ২ বছর আগে তো প্রিয়তা ছিলো না প্রিয়মের লাইফে তার মানে কি প্রিয়ম অন্য কাউকে ভালোবাসে? তার এতো কেয়ার এতো রাগ শুধু এমনিতেই! রাতে ভাবা তার নতুন স্বপ্ন নতুন জীবন মুহুর্তেই নিভে যায়। তনিমা তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার দিকে।

_____________

ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনের দিকে যায় ৩ জন। প্রিয়তা আর সাইমা ক্যান্টিনের ভেতর যায়। তনিমাকে নোমান ডাকে বলে সে সেখানেই দাঁড়ায়। নোমান হাসিমুখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,

‘কি ব্যাপার? কেমন আছো?’

তনিমার যা স্বভাব তাতে সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ডাকলেন কি কেমন আছি জিজ্ঞেস করার জন্য?’

‘নাহ। তোমার সাথে কথা বলতেই আসলাম।’

‘ওহ আচ্ছা।’

‘বললে না কেমন আছো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?’

‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’

‘করেন।’

নোমান আমতা আমতা করে বলে, ‘তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?’

তনিমা ভ্রু কুঁচকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নোমানের। তারপর সরাসরি বলে, ‘কেন? না থাকলে প্রেম করবেন নাাকি আমার সাথে?’

নোমান থতমত খায়। এ মেয়ে তো ডেঞ্জারাস! কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে কোনোরকম বলে, ‘তুমি যাও তো।’

বলেই চলে যায়। তনিমা ভেংচি কেটে এগোতে নিলে কোথা থেকে উদয় এসে হাজির হয়। থতমত খায় তনিমা। মানে ভুল টাইমে এই ছেলে এখানে কেন? আজিব! তনিমা কিছু বলতে যাবে তার আগেই উদয় দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘ওর সাথে তোর কি?’

তনিমা ঢোক গিলে। উদয়কে সে ভীষণ ভয় পায়। রেগে গেলে চ’ড় থা’প্পড়ও মে’রে দিতে পারে। তাই ভয়ে ভয়ে বলে, ‘উনি ডাকছিলো তাই।’

‘কেউ ডাকলেই তোর আসা লাগবে? এক থা’প্পড়ে তোর দাঁত ফেলে দিবো।’

তনিমা মিনমিন করে বলে, ‘এক থা’প্পড়ে দাঁত পড়ে না।’

উদয় কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিনি এসে হাজির হয়। তনিমা অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে, ‘তুমি যার তার সাথে সারাদিন থাকতে পারো আর আমি কাারো সাথে ২ মিনিট কথা বললেও দোষ! বেশ। আরো বেশি করে বলবো। পারলে আটকাও। দরকার পড়লে ১০/১২ টা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরবো। তোমার কি?’

উদয় কিছু বলবে তার আগেই তনিমা গটগট করে চলে গেলো। উদয় কটমট করে তাকায় তনিমার যাওয়ার দিকে। তারপর রিনির দিকে তাকায়। রিনি ভয়ে ঢোক গিলে বলে,

‘আমার দিকে ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন? আমি কি করছি!’

‘তুই তোর বয়ফ্রেন্ডের কাছে যা বইন। আমার সামনে থেকে যা নাহলে তোর কপালে দুঃখ আছে।’

_____________

বাস থেকে নেমে চুপচাপ ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে থাকে অনিমা। নতুন শহর, নতুন জীবন নিয়ে অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছে। তার ভুল, অন্যায় সব থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছে। এড্রেস ঠিকমতো চেইক করে বান্ধবীর বাসার দিকে রওনা দেয়। বাসার সামনে এসে কলিং বেল বাজায়। দরজা খুলে দেয় তানিয়া। তানিয়া অনিমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে। অনিমা মলিন হাসে। তানিয়া বলে,

‘তোর কোনো অসুবিধা হয় নি তো?’

অনিমা মাথা নাড়ায়। তারপর ভেতরে ঢোকে। তানিয়া একা থাকে ফ্ল্যাটে। তাই দুজনের কোনো অসুবিধা নেই। তানিয়ার দেখানো রুমে লাগেজ রেখে শাওয়ার নিয়ে নেয়। শাওয়ার শেষে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নিজের অতীতের হিসাব কষে নেয়। তারপর চোখ বন্ধ করে বলে,

‘আমার জীবনে আর আপনার জায়গাটা নেই শিশির ভাই। প্রথমেই যদি আপনাকে ফিরিয়ে দিতাম তাহলে হয়তো আজ আমার এমন দিন আসতো না।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here