#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৪
সবেমাত্র এয়ারপোর্টে সব চেকিং এর পর প্লেনে উঠতে দেওয়া হয়েছে। যে যার সিটে বসছে একে একে। সিট বেল্ট লাগাতে কেউ কেউ ব্যস্ত। অনেকে ফোনে কথা বলতে। কারণ আকাশে তো ফোনের নেটওয়ার্ক লাগবে না। আবার অনেকে ম্যাগাজিন খুলে খুলে দেখছে। যথারীতি প্রেম আর ঐশ্বর্যও উঠেছে। আর মিনিট বিশেক পরই ফ্লাইট। মুখ ফুলিয়ে রাখা ঐশ্বর্যের মাঝে কোনো হেলদোল নেই। একটা কথা অবধি বলেনি এখন অবধি। প্রেমের মাথা ফা*টিয়ে ফেলার ইচ্ছেটা বড্ড কষ্টে দমিয়ে ফেলেছে সে। কথায় কথায় রোজকে টেনে আনার কি কোনো দরকার আছে? ওই একটা কথাতেই তো সে হেরে যায়। ওমন একটা ডেভিলের সাথে কিনা প্রেম? মানুষ হলে না হয় তাও মানা যেতো। অবশ্য না যেতো না। কেন মানা যেতো? প্রেম মানুষটাকে ঐশ্বর্য আজীবন সিঙ্গেল রেখে দেবে। নিজেও আসবে না কাউকে তার কাছে আসতেও দেবে না। আর ডেভিল তো অনেক দূরের কথা! চেক করতে করতে মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে প্রেম টিকেটে সিট নম্বর ভালোভাবে দেখে বলল,
“এটা আমাদের সিট। কোথায় বসবে? জানালার ধারে নাকি তার অন্যপাশে?”
তার পেছন থেকে ঐশ্বর্যের কোনো উত্তর এলো না। প্রেম ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকায়। ঐশ্বর্য তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে। সে একটা বিদেশি ছেলের সাথে কথা বলছে। কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়ে যায় প্রেমের। সন্দিহার নজরে তাকায় ছেলেটার দিকে। তাদের কথপোকথন শোনা যাচ্ছে। ঐশ্বর্য বেশ বিনয়ের সাথে ইংলিশে বলছে,
“এক্সকিউজ মি! ক্যান ইউ রিপ্লেস ইউর সিট উইথ মাই সিট?”
বিদেশি ছেলেটা বসে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিল। ঐশ্বর্যের এমন মিষ্টি কন্ঠে ছেলেটি মাথা উঠিয়ে তাকালো। একটা হাসি দিয়ে বলল,
“হোয়াই নট? বাট…”
প্রেমের মেজাজ বিগড়ে গেল তৎক্ষনাৎ। হাত মুঠো করে চেহারা জড়িয়ে এলো তার। এগিয়ে যেতে নিতেই ঐশ্বর্য বলল,
“ইয়াহ। একচুয়ালি আই কান্ট শেয়ার সিটস ইউথ স্ট্রেঞ্জারস্, স্পেশালি বয়েজ। দেয়ার ইজ মাই সিট। সো প্লিজ ক্যান ইউ?”
ইশারা করে দেখিয়ে বলল ঐশ্বর্য। অন্যদিকে প্রেম রেগেমেগে আগুন! সে কিনা এখন অচেনা ছেলে? এই মূহুর্তে ঐশ্বর্য নামক এই ঘাড়ত্যাড়া মেয়েটাকে চড়িয়ে গাল লাল করে দিতে পারলে বেশ শান্তি লাগতো। কিন্তু এখন না সে কিছু করতে পারবে আর না ওর কাছে গিয়ে বসতে পারবে।
“ওহ ইয়াহ্। প্লিজ সিট হেয়ার।”
ছেলেটি উঠল। এসে ফট করে প্রেমের পাশের সিটে সুন্দর মতো বসে পড়ল। প্রেম কটমট করে তাকালো ঐশ্বর্যের দিকে। ঐশ্বর্যও ওই সিটে বসে নিজের চুল পেছনে দিয়ে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে প্রেমকে দেখেও না দেখার ভান করল। জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। প্রেমও নিরুপায় হয়ে নিজের সিটে বসে পড়ল। নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে কিছু একটা করে পিছু ফিরে ঐশ্বর্যের পানে তাকালো।
মেসেজের টোন বেজে ওঠায় জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা ঐশ্বর্য কিছুটা চকিতে তাকালো। ফোনটা আস্তে করে বের করে মেসেজটা ওপেন করল। ওপরে স্পষ্ট নামটা ভাসছে ‘মি. আনস্মাইলিং’। প্রেমের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও মেসেজের দিকে মন দিল সে। মেসেজে লিখা, ‘কাজটা ভালো করলে না। ইউ হ্যাভ টু পে ফর ইট। তোমাকে এর দাম এই ফ্লাইটেই দিতে হবে। নিজের হাজবেন্ডকেও অচেনা বানালে! একবার যদি তোমাকে হাতের কাছে পাই…!’
ঐশ্বর্য ঠিক সেভাবেই মেসেজের উত্তর দিয়ে দিল, ‘হাজবেন্ড? কিসের হাজবেন্ড? কার হাজবেন্ড? আপনিই বা কে? চিনি না আপনাকে। বাই বাই।’
প্রেমের কাছে মেসেজটা যেতেই অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্রেম। ঐশ্বর্য আর তাকালোই না তার দিকে। সে আর ওই পুরুষটাকে চেনে না। এতো দয়াবান পুরুষকে চেনার কোনো দরকার নেই।
ঘোষণা দেওয়া হলো যে যার সিটবেল্টে পড়ে নিতে। সকলে সে কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর ১০ মিনিট পড়ই ফ্লাইট। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সুন্দর রমনীর প্রবেশ ঘটেছে প্লেনে। গার্লস গ্রুপ! বেশ তাড়াহুড়ো করেই এসেছে ওরা। মুখ চোখের চেহারা দেখে বাংলাদেশি হলেও তার ড্রেসআপ দেখে মনে হচ্ছে তারা এই দেশে থাকে না। ঐশ্বর্য তাদের একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। তার মনোযোগ তখনই আবার সেসব মেয়েদের দিকে গেল যখন প্রেমের কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল। দ্রুত এবার আঁখি দুটো মনোযোগের সহিত প্রেমের দিকে রাখলো। ওদের মাঝে একটা মেয়ে প্রেমের সাথে হেঁসে বলছে,
“হ্যালো, মি. হ্যান্ডসাম! ক্যান ইউ সিট ইন দ্যা মিডিল সিট? আসলে জানালার পাশে বসতে আমার ভালো লাগে। আই লাভ ইট!”
‘মি. হ্যান্ডসাম’ শব্দটা ঐশ্বর্যের মস্তিষ্কে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল! হাত মুঠো করে সিটের হ্যান্ডেলে আঘাত করে বিরবির করে বলল,
“অচেনা কাউকে মি. হ্যান্ডসাম বলে ডাকা কি ভদ্র মেয়েদের স্বভাব নাকি আশ্চর্য! অভদ্র মেয়ে। কার পাশে বসছে জানে না!”
ঐশ্বর্য উঠে উঠে দেখার চেষ্টা করছে প্রেম কি করছে সেটা দেখতে। এয়ারহোস্টেজ এসে বেশ নরম কন্ঠে তার উদ্দেশ্যে বলে,
“প্লিজ ম্যাম, আর কিছুক্ষণ পর ফ্লাইট। নিজের আসন গ্রহণ করুন।”
ঐশ্বর্য কিছু বলে না। শুধু ধপ করে বসে পড়ে গালে হাত দিয়ে। প্রেমের সিট আর ঐশ্বর্যের সিট বেশি দূরে নয়। তার সামনের প্রেমের সিট। সিটের মাঝের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কিছুটা। ঐশ্বর্য এবার সেদিকে তাকালো। হাতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট। প্রেম পানির বোতল খুলে পানি খেল। খাওয়ার সময় হঠাৎ ওই মেয়েটির হাতে লেগেই অনেকটা পানি পড়ে গেল প্রেমের ব্লেজারে। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বলল,
“সরি সরি! আমি খেয়াল করি নি। ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ।”
প্রেম বিব্রতবোধ করলেও কিছু বলল না। চাপা সুরে বলল,
“ইটস ওকে। আই ক্যান হ্যান্ডেল!”
“ওয়েট। আমার কাছে রুমাল আছে।”
দেরি না করেই মেয়েটা রূমাল বের করল। প্রেমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“টেক ইট।”
“নো নিড। থ্যাংকস।”
মেয়েটা কোনো কথা শুনতে নারাজ। নিজেই রূমাল হাতে নিয়ে এগিয়ে প্রেমের মুখ আর ব্লেজার মুছে নিতে উদ্যত হলো। মেয়েটার এমন কাজে প্রেম বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সরে গিয়ে বলতে থাকল,
“ইটস ওকে! ইটস ওকে!”
প্রেমের ব্লেজার থেকে যত্ন সহকারে মুছে দিতে দিতে মেয়েটি মুখে দুষ্টু হাসি এনে বেশ আস্তে করে বলে,
“বাই দ্যা ওয়ে, আর ইউ সিঙ্গেল হ্যান্ডসাম?”
ঐশ্বর্যের কানে পৌঁছালো সেইসব শব্দ। রাগে কেঁপে উঠল সে। বিরবির করে বলল,
“আই উইল কি*ল দিস গার্ল! ড্যাম ইট!”
প্রেম চমকে উঠে তাকালো মেয়েটির দিকে। আর আকস্মিকতায় বলল,
“হোয়াট?”
“আই আস্কড, আর ইউ সিঙ্গেল? ইউ আর সো সুইট!”
“নো হি ইজ নট সিঙ্গেল। হি ইজ ম্যারিড!”
তাড়াহুড়ো করে সিট বেল্ট খুলে উঠে দাঁড়ালো ঐশ্বর্য। সামনে এসে দাঁড়ালো প্রেমের। রাগে তার এবার পাগল পাগল লাগছে। তখনও মেয়েটা প্রেমের ব্লেজারে হাত দিয়ে ছিল। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগে ঐশ্বর্যের। তার আসল রূপ বেরিয়ে আসতে চাইছে। বার বার চোখ বন্ধ করছ আর খুলছে। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। মেয়েটার হাত ধরে বেশ জোরে ঝটকা দিয়ে সরিয়ে বলে,
“হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মাই হাজবেন্ড!”
মেয়েটা হতভম্ব হয়। তার হাতে ঐশ্বর্যের ধারালো নখের আঁচড় লেগেছে। নিজের হাত নাড়তে নাড়তে বলে,
“সরি। আই ডোন্ট নো দ্যাট। কোনোদিক থেকেই মনে হয়নি হাজবেন্ড ওয়াইফ হবেন আপনারা। অনেকটা দূরে বসেছেন তো আপনারা। সো আই থিংক হি ইজ সিঙ্গেল!”
“ওহ। তাহলে হাজবেন্ড ওয়াইফ প্রমাণ করতে কাছাকাছি বসে থাকতে হবে? কত কাছে বসতে বলে হ্যাঁ?”
কথাটা শেষ করা মাত্র কোনোকিছু না ভেবেই প্রেমের কোলে বসে পড়ে ঐশ্বর্য। প্রেম বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ঢক গিকে ঐশ্বর্যের রাগি চাহনির দিকে তাকায়। মেয়েটা অসম্ভব রেগেছে! ঐশ্বর্য রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“এতো কাছে? নাকি আরো কাছে?”
এবার আচানক প্রেমের গালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরে ঐশ্বর্য। গভীর এক ছোঁয়া এঁকে দেয় তার গালে। প্রেম বিষম খেয়ে তাকায়। এই মেয়ে কি করছে? মাথা কি পুরোটাই গেছে? এবার প্রেমের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ক্যাবলার মতো তাকিয়ে আছেন কেন? কিস দিলে রিটার্ন দিতে হয় জানেন না? শেখাই নি কেউ?”
প্রেম দ্বিতীয় বার বিষম খায়। মেয়েটা নির্ঘাত ভুলে গেছে এটা প্লেন। তারও এবার ভীষণ ইচ্ছে করছে এই জায়গায়টা কোথায় ভুলে যেতে। ভুলে যেতে ক্ষতি কি? আচানক প্রেমও ভয়ানক কান্ড করে বসল। ঐশ্বর্যের সেই নমনীয় ওষ্ঠযুগলে ছুঁইয়ে দিল নিজের ওষ্ঠদ্বয় কোনো কিছু না ভেবেই। ঐশ্বর্য স্থির হয়ে গেল। নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারালো। মাথা থেকে পা ঠান্ডা হয়ে এলো। এখানেই থামলো না প্রেম। নিজের ঠোঁট দিয়ে ছুঁইয়ে দিল ঐশ্বর্যের দুটো গাল সাথে ঐশ্বর্যের কানের পিঠ। ঐশ্বর্য আর যেন নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না। তার কর্ণকুহরে ভেসে এলো প্রেমের শীতল কন্ঠ!
“রিটার্ন দিলাম! ডাবল নয় ট্রিপল রিটার্ন দিলাম। হানিমুনে গিয়ে ব্যাক পাব তো? নাকি এখানেই রিটার্ন করতে চাও?”
চলবে…
#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৫
ঐশ্বর্য যেন ভয়া’নক স্বপ্ন দেখছে জেগে জেগে। সে কি খেয়াল দেখছে? খেয়ালই হবে। নয়ত এতো ভয়া’বহ কান্ড কেউ করে নাকি? অসম্ভব! এতো লোকের ভীড়ের মাঝখানে কিস? অবশ্যই সম্ভব নয়। তাও প্রেমের পক্ষে নয়ই। কারণ এতোদিন ঐশ্বর্য জানতো যার কোলে এখনো অবধি সে অবস্থান করছে সে নামেই প্রেম। কাজে আস্ত নিরামিষ! কিন্তু এখনি যা হলো নিরামিষ নামক পদবী দেওয়া কি ঠিক হবে? ঐশ্বর্য বড় একটা শ্বাস নিয়ে চোখ বুঁজল। চোখ খুলে যেন সব স্বাভাবিক দেখতে পায় এই আশায়। কিছুক্ষণ পর চোখ মিটিমিটি খুলে দেখে নাহ কিছুই পাল্টায় নি। সবাই তাদের দিকে হা হয়ে চেয়ে আছে। আবার কেউ কেউ নিজেদের চোখ বন্ধ রেখেছে! এতো অস্বস্তিকর মূহুর্তে এসিতে দরদর করে ঘামছে ঐশ্বর্য। খুব কষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে সেই ভয়া’নক কান্ড করার লোকটার দিকে তাকালো সে। লোকটা এই মূহুর্তে নির্বিকার। গম্ভীর মুখে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন আদেও কিছুই ঘটেনি। রাগে লজ্জায় নিজের ওড়না খামচে ধরেছে ঐশ্বর্য। চোখজোড়া আর কিছুতেই উঠিয়ে তাকাতে পারছে না। লজ্জায় আজ কাঁদতে ইচ্ছে করছে!
এবার এয়ারহোস্টেজ এলো। হালকা কেশে উঠে নিচু সুরে বলল,
“সময় নেই ফ্লাইটের। সো আপনারা যদি কাইন্ডলি…!”
প্রেম এবার এয়ারহোস্টেজের দিকে তাকালো। মাথা দুলিয়ে বলল,
“ওহ ইয়েস! সো মাই ডিয়ার ওয়াইফ, তুমি কি আমার কোলে উঠে যেতে চাইছো? যেতে চাইলে কোনো প্রবলেম নেই। বাট ব্যাপারটা রিস্কি ইউ নো?”
ঐশ্বর্য এতক্ষণ অনুভূতিশূন্য ছিল। সবকিছু এলোমেলো লাগছিল। চোখের সামনে শুধু ঘুরছিল কিছুক্ষণ আগের ঘটা দৃশ্যটা। প্রেম আবারও বলল,
“সো, পাশের ছেলেটাকে উঠে যেতে বলি? ওখানে চুপচাপ বসে পড়ো। আই থিংক এখন আমাকে চেনো?”
ঐশ্বর্য তাড়াহুড়ো করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝটপট করে বলল,
“না না। পাশে না। আমি মাঝখানে! মাঝখানে বসব।”
ঐশ্বর্য এখনো সেই অপরিচিত মেয়েটির বিষয় নিয়ে অকপট। সে চায় না কিছুতেই প্রেমকে তার পাশে বসতে দিতে। সেই বিদেশি ছেলেটাও পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত পালালো। নিজের আগের সিটে গিয়ে বসল। ঐশ্বর্য প্রেমকে কটাক্ষ করে বলল,
“আপনি ওখানে বসুন।”
প্রেম সিট বেল্ট খুলে নিল। উঠে যাবার আগে সেই অপরিচিত হতভম্ব হয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নম্র সুরে বলল,
“ওহ ইয়েস। আপনি আমি সিঙ্গেল কিনা জানতে চেয়েছিলেন। আই এম নট সিঙ্গেল। সি ইজ মাই এ্যাংরি বার্ড। অনলি মাই ওয়াইফ।”
ঐশ্বর্যকে ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে উঠে গেল প্রেম। ঐশ্বর্য সেই জায়গায় গিয়ে বসল ধপ করে। সিট বেল্ট লাগিয়ে রাগি চাহনির সাথে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটা এতোক্ষণ ঐশ্বর্যকেই দেখছিল। তবে ঐশ্বর্য তাকানো মাত্র দৃষ্টি সরিয়ে নিজের ঐশ্বর্যের দেওয়া আঁচড় লাগা জায়গায় হাত বুলাতে থাকল। ঐশ্বর্য সেদিকে তাকালো। মনটা চাইলো আরো আঁচড়ে দিতে। দাঁতে দাঁত পিষে রাগ নিবারণ করল। তৎক্ষনাৎ প্রেমের কন্ঠে চকিতে তাকালো সে।
“আমি নাকি অচেনা পুরুষ! সো অচেনা পুরুষকে কিস করতে কি করে পারলে মিস. ইরিটেটিং?”
ঐশ্বর্য হাতটা তুলে নিজের আঙ্গুল দেখিয়ে বলে,
“শাট আপ! একটাও কথা বলবেন না। সেমলেস!”
প্রেমের হাসি পায় প্রচন্ড! আসলেই সে দিনকে দিন বড্ড নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে। তবে খারাপ লাগছে না। ভালোই লাগছে।
মালদ্বীপ! জায়গাটি মানেই সুন্দর ও মনোরম পরিবেশের একটা উল্লেখযোগ্য স্থান। এর সমুদ্র সৈকত চোখ জুড়ানো কাঁচের মতো পানি চোখ জুড়িয়ে দেয়। শ্রীলঙ্কা থেকে প্রায় বেশ কয়েকশো মাইল দূরে ছোট ছোট ১১৯২ টি দ্বীপ দিয়ে এই মালদ্বীপ। সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ জায়গায় সচরাচর দেখা যায় নতুন বিবাহিত দম্পত্তিদের। মধুচন্দ্রিমার জন্য একটা সুন্দর জায়গা। সেখানকার একটি মনোমুগ্ধকর জায়গা হচ্ছে মালে আইল্যান্ড। সচরাচর নবদম্পতিরা এখানেই আসে। জায়গাটাটি বেশ লোকারণ্য। গাছপালা, সমুদ্রসৈকত, সাদা বালি, নারিকেল গাছ, সুন্দর রিসোর্ট সব মিলিয়ে পারফেক্ট প্লেস যাকে বলে।
গাড়ি এসে থামে একটা রিসোর্টের সামনে। রিসোর্টটা হানিমুন স্পেশাল সেটা রিসোর্টের আশপাশটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নামলো ঐশ্বর্য। আশপাশটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিল। সামনেই রয়েছে বড়সড় একটা সুইমিংপুল! কাঁচের ন্যায় পানি। কৃত্রিম ঝরনা দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। ঠিক মাঝখানে সুইমিং পুলটা। পুলের আশেপাশে বসে ও শুয়ে থেকে সময় কাটানোর জায়গা রয়েছে। তার আশপাশ দিয়ে কংক্রিটের রাস্তা করা। সবুজ ঘাসগুলো যেন নিয়মিত ছাটাই করে সুন্দর রূপ দেওয়া হয়েছে। তারপর রয়েছে সুন্দর একটা রিসোর্ট। রিসোর্ট পুরো সাদা রঙের। ঝকঝক করছে সেটা। বর্তমানে সন্ধ্যা। মালদ্বীপ থেকে নেমে মালে আইল্যান্ডে আসতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে ক্লান্ত ঐশ্বর্য। চারিপাশে আলো জ্বলছে হরেক রকমের। আলোতে পরিবেশটা আরো নমনীয় হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের শীতল একটা আবহাওয়া তো রয়েছে। সমুদ্র খুব একটা দূরে নয়। কাছেই। এখান থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ কানে বাজছে ঐশ্বর্যের।
অবশেষে প্রেম লাগেজ নিয়ে ঐশ্বর্যের সাথে প্রবেশ করে রিসোর্টে। বেশ বড়সড় ভেতরটা। প্রবেশদ্বারের পর পরই ওপরে ইয়া বড় একটা ঝাড়বাতি চকমকে আলো দিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে রাজকীয় ভাবে সাজানো। কাঁচের স্বচ্ছ জিনিসপত্র দিয়ে চারিপাশটা সাজানো হয়েছে। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে যেন। রুমের চাবি দিয়ে লাগেজ সহ তাদেরকে রুম দেখিয়ে দেওয়া হলো তখনি বিনয়ের সাথে। রুমের চাবি খুলে রুমে প্রবেশ করল তারা। ভেতরের পরিবেশ বেশ রোমান্টিক। এখানে আগে থেকে স্বাগতমের জন্য তাজা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে রুম পরিপূর্ণ। টেবিলে জ্বলছে বড়সড় একটা মোমবাতি। তার আশেপাশেও মোমবাতি ছিটিয়ে রাখা। গোল শেপের সাদা রঙের বেডে সবটা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা। রুমের জিরো লাইট জ্বলছে। হালকা আলোতে মাধুকরী হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
রুমের প্রবেশ করল ঐশ্বর্য। বেশ বড়সড় একটা হাই তুলল। প্রেমও ঢুকল লাগেজ নিয়ে। রুমের ভেতরে এরেকটা ছোট রুম রয়েছে। সেখানে রয়েছে ছোট দুজনের জন্য ডাইনিং টেবিল। সেই সাথে কিছু আসবাবপত্র। প্রেম সোফায় বসে বলল,
“ফ্রেশ তুমি আগে হবে নাকি আমি আগে?”
“লেডিস্ ফার্স্ট!”
ছোট করে বলল ঐশ্বর্য। তারপর আর প্রেমের উত্তরের অপেক্ষা না করে লাগেজে হাত দিল সে। লাগেজ সুন্দরমতো খুলল। অতঃপর ভ্রু কুঁচকে লাগেজের আনাচে-কানাচে দেখে নিল। বিস্ময়ের সুরে বলে উঠল,
“আমার ড্রেস? আমার ড্রেস তো একটাও নেই। এখানে তো সব আপনার ড্রেস দেখছি। আমার ড্রেস কোথায়?”
প্রেম শুনেও না শোনার ভান করে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ নিরব থেকে উত্তর দিল,
“কিসের ড্রেস? তোমার ড্রেস আমার লাগেজে কেন থাকবে? তুমি তোমার ড্রেস প্যাক করেছিলে? রিমেম্বার? আমি প্যাক করতে বলেছিলাম তোমাকে।”
“আমি তো প্যাক করিনি।”
“তাহলে তোমার ড্রেস থাকবে কি করে?”
ঐশ্বর্যের চোখ কপালে উঠে গেল। হা-হুতাশ করে বলল,
“হোয়াট? আমি কি পড়ব? আপনিই তো জোর করে আমাকে নিয়ে এলেন। এখন? কি হবে? আপনি ঠিক করেন নি আমার সাথে।”
“অনেস্টলি! তোমার সাথে আমি এখনো অবধি কিছুই করিনি।”
ফট করে কথাটা বলে ঐশ্বর্যের দিকে তাকালো প্রেম। ঐশ্বর্যের মুখ হয়েছে দেখার মতো। বেচারি কি পড়বে সেটা নিয়ে চিন্তায় শুঁকিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। প্রেম উঠে দাঁড়ালো। গায়ের ব্লেজার খুলতে খুলতে বলল,
“বাট আই হ্যাভ অ্যা আইডিয়া!”
ঐশ্বর্য এবার সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো। কোনো তো উপায় দেবে লোকটা। কিছু করতে না পারলেও তাই যথেষ্ট। প্রেম এগিয়ে এসে লাগেজে হাত দিয়ে হাতে একটা সাদা শার্ট আর টাওয়াল বের করে বলল,
“আমার ড্রেস পড়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারো। আই ডোন্ট মাইন্ড। একটু লুজ হবে। বাট ইটস অলরাইট!”
“আর ইউ আউট ওফ ইউর মাইন্ড? আমি কেন আপনার শার্ট পড়ব?”
দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিল ঐশ্বর্য। এরপর প্রেম হাতের টাওয়াল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“দেন নেক্সট আইডিয়া হচ্ছে টাওয়াল। এটা দিয়েও কাজ চালিয়ে নিতে পারো। বাট আই থিংক এটা তুমি সামলাতে পারবে না। আর বাহিরেও যেতে পারা তো দূর আমার সামনে আসতে পারবে না!”
“চুপ করুন তো আপনি। একটা আজেবাজে আইডিয়াও আপনার মুখ থেকে আর শুনতে চাইছি না।”
প্রেম তবুও চুপ করে না। তার শার্ট আর টাওয়াল দুটোই বার বার নাড়িয়ে ঐশ্বর্যের সামনে ধরে বলতে থাকে,
“শার্ট না টাওয়াল, শার্ট না টাওয়াল, শার্ট না টাওয়াল?”
ঐশ্বর্য উপায়ন্তর না পেয়ে প্রেমের হাতের শার্ট টেনে নেয়। তারপর বলে,
“শুধু শার্ট?”
“আর কি? আমার প্যান্টও কি নিতে চাইছো? ওটা তোমার ফিটিং হবে তো?”
“তো কি শুধু শার্ট পড়ে থাকব?”
চেঁচিয়ে বলে ঐশ্বর্য। প্রেম তৎক্ষনাৎ একটা প্যান্ট বের করে দেয়। প্যান্ট বলতে টাউজার যাকে বলে। ঐশ্বর্য তা দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে যায় ওয়াশরুমে। প্রেম তাকিয়ে থাকে সেই রাগান্বিত রমনীর দিকে। মেয়েটাকে রাগিয়ে দিতে তার ভালো লাগে কেন?
মিনিট বিশেক পড়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পড়ে ঐশ্বর্য। প্রেমও বেশ ক্লান্ত। প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল বেডে আধশোয়া হয়ে। ঘুমটা ভাঙে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে। উঠে সোজা হয়ে বসে সে। ঘুমটা তবুও ছাড়েনা সহজে। তবে ওয়াশরুমের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লাস্যময়ী নারীকে দেখে ঘুমটা উড়ে যায় কর্পূরের ন্যায়। ভিজে চুল নেতিয়ে পড়েছে আশেপাশে। এলোমেলো চুল কিছু কিছু লেগে গিয়েছে গালে লেপ্টে। চোখের ঘন পাপড়িতে এখনো লেগে রয়েছে পানির ফোঁটা। গালে আর গলায় মুক্তর মতো চমকাচ্ছে পানিরকণা। পরনে সাদা শার্টে ফুটে উঠেছে তার গায়ের রঙ। আবছা আলোতে ঐশ্বর্যকে রূপবতী রাজকন্যা দেখায়। আজ আবেদনময়ী লাগছে। প্রেমের চোখে ঘোর বেঁধেছে মেয়েটিকে দেখে। নিজেকে আটকাইতে পারছে না কেন যেন। নিজের অজান্তে উঠে এগিয়ে এসেছে প্রেম। ঐশ্বর্য চমকে তাকিয়েছে তার দিকে। ঐশ্বর্যের নীল বর্ণের চোখে বিস্ময় আর প্রেমের ঘন কালো চোখে অন্যরকম দৃষ্টি! হঠাৎ ঐশ্বর্যের কোমড়ে হাত রেখে তাকে নিজের সঙ্গে চেপে ধরে প্রেম। অন্যহাত ঐশ্বর্যের বাম হাতটা নিজের সাথে আবদ্ধ করে তুলে ধরে বলে,
“তুমি শিখিয়েছিলে না কিস দিলে রিটার্ন দিতে হয়? সেটা এখন রিটার্ন নেওয়ার সময় এসে গেছে।”
ঐশ্বর্যের বাম হাতে যেন বিদ্যুত ছুঁয়েছে। তার সেই হাত কাঁপছে। হাতের সেই বিশেষ তার অজানা চিহ্ন নীল বর্ণ হয়ে জ্বলে উঠে একটু একটু করে নিশ্চিহ্ন হতে নিচ্ছে। তা কারোর খেয়ালে নেই। ওরা দুজন দুজনের মোহময় চাহনিতে মত্ত!
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]
লেখিকার গ্রুপ : আনিশার গল্পআলয় (সাবির পাঠকমহল)?