#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩২
প্রেমের হাত খামচে ঝাপটে চোখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে ঐশ্বর্য। মনে হচ্ছে প্রেমের হাতটা ছিঁড়ে ফেলার ধান্দা করছে মেয়েটা। প্রেম নিজেও চমকে গেছিল ঐশ্বর্যের এমন ব্যবহারে। অতঃপর বুঝল মেয়েটা একেবারেই ঢেঁড়স। মানে রান্নাবান্না নিয়ে কোনোরূপ ধারণা তো দূর চুলো থেকে ফট করে আগুন বের হয় সেটাও সে জানে না। উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রেম বলল,
“চুলো থেকে আগুন বের হবে না তো কি পানি বের হবে?”
ঐশ্বর্যের হুঁশশ এলো। আসলেই তো! পানি দিয়ে তো আর রান্না করা যায় না। এতোটুকু অন্তত ঐশ্বর্যের জানা আছে। তারপর তার মনে হলো সে প্রেমের হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার ওপর সে ভয়ানক রেগে আছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে ছিটকে অন্যপাশে দাঁড়ালো সে। সাহস জুগিয়ে বলল,
“উঁহুম! হঠাৎ করে আগুন দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। স্বাভাবিক ব্যাপার।”
“কাল রাতে তো খুব আগুনের কাছে গিয়ে বসে ছিলে চেয়ার নিয়ে গার্ডেনে। মনে হচ্ছিল যেন চেয়ার নিয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আজকে আগুন দেখে ভয় লাগছে?”
“উঁহু, হুট করে এমনভাবে শব্দ করে আগুন বেরিয়েছে। যে কারোর ভয় লাগবে। সবসময় বেশি না বুঝলে হয় না তাই না আপনার? দেখি দূরে সরুন। আমার হেল্প করতে হবেনা আপনার। আমি একা করতে নিতে পারব।”
“আর ইউ সিউর?”
ঐশ্বর্যের দিকে খানিকটা ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল প্রেম। ঐশ্বর্য চুলোর দিকে খানিকটা তাকিয়ে বলল,
“ইয়াহ, আই এম সিউর।”
প্রেম আর কোনো কথা বাড়ালো না। কিছু দূরে গিয়ে কিচের কেবিনেটের সাথে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঐশ্বর্যের কর্মকান্ড দেখতে লাগল। ঐশ্বর্য হালকা করে আগুনের দিকে এগিয়ে গেল। এবার আর তেমন ভয় লাগছে না। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আশেপাশে কিছু একটা খুঁজতে থাকলো। হঠাৎ করে চোখ থামলো বাসনের মিটসেফে। সেখানে গিয়ে বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করেও বুঝতে পারল না কিসে রান্না করবে সে। অবশেষে একটা কাঁচের বড় বাটি বেশ কনফিউজড হয়েই হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল চুলোর দিকে। প্রেম বড় বড় করে চেয়ে রইল সেদিকে। ঐশ্বর্য কাঁচের বাটিটাই চুলোতে বসাতে গেল। প্রেম ধড়ফড় করে এগিয়ে বাটিটা ঐশ্বর্যের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“ওহ মাই গুডনেস! কাঁচের বাটিতে কেউ রান্না করে? চুলোয় বসানোর সাথে সাথে বাটি ফেটে ভেঙে যাবে।”
ঐশ্বর্য ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তবে প্রেমকে বুঝতে দেওয়া যাবে না সে একেবারেই অকর্মন্ন। হালকা কেশে কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বলল,
“জানি জানি। আমি এটা জানি। আমি তো জাস্ট আপনাকে চেক করছিলাম। যে আপনি এসব জানেন কিনা!”
প্রেম এবার পুরো হতভম্ব! মেয়েটা ভাঙবে তবুও মচকাবে না। কাঁচের বাটি নির্ধারিত জায়গায় রেখে একটা কড়াই এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটাতে রান্না করে।”
ঐশ্বর্য কিছু না বলে সেটা ছোঁ মেরে নিয়ে চুলোয় বসালো। তারপর ঝাল লবণ দিয়ে মাখানো মাছের বাটি হাতে নিল। একবার কড়াই একবার মাছের দিকে তাকিয়ে মাছের এক অংশ হাতে নিয়ে সেটা কড়াইয়ে ছাড়তে যেতেই প্রেম তার হাত খপ করে ধরে ফেলল।
“মিস. ঢেঁড়স, আপনি যে রান্নার ব্যাপারে কতটুকু জানেন সেটা বুঝতেই পারছি। কড়াইয়ে আগে তেল দিতে হয়। তারপর সেটা গরম হলে মাছ দিয়ে ভাজতে হয়।”
ঐশ্বর্য মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। ফোঁস করে বলে উঠল,
“জানি আমি। আপনি আমাকে মিস. ঢেঁড়স বললেন কেন?”
“মিসেস. ঢেঁড়স বললে মি. ঢেঁড়স আমি হয়ে যাব। অ্যান্ড আমি ঢেঁড়স নই। একটুআধটু হলেও রান্নাবান্না জানি। বিদেশে থেকেছি। তাই রান্না টুকিটাকি শিখতে হয়েছে। আর আপনি কতটা জানেন সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
মুখ টিপে হেঁসে জবাব দিল প্রেম। ঐশ্বর্য আর কিছু বলল না। অপমানে মুখশ্রী লাল বর্ণ ধারণ করল। প্রেম তেল কড়াইয়ে দিল। তারপর বলল,
“এখন মাছগুলো কড়াইয়ে দিতে পারো।”
ঐশ্বর্য জবাব না দিয়ে মুখ ফুলিয়ে মাছের একটা অংশ তুলে তেলে ছেড়ে দিতেই তেল ছিটকে পড়তে লাগল। যেটা সাধারণত হয়ে থাকে। ঐশ্বর্যের প্রাণ ভয়ে শুঁকিয়ে এলো। লাফিয়ে গিয়ে মাথা লাগিয়ে দিল প্রেমের বুকে। একহাত দিয়ে প্রেমের গেঞ্জি খামচে দিয়ে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
“এটা কি হচ্ছে!”
“কিছু ভাজতে গেলে এমন হয়ে থাকে। কোনোদিন তো রান্না ঘরের ছায়া পর্যন্ত দেখোনি। কিভাবে জানবে এসব!”
ঐশ্বর্য এবার একচোখ খুলে তেলে দেওয়া মাছের দিকে তাকালো। বিষয়টা তো বড়ই ঝামেলার। তখনি কেউ চিৎকার দিয়ে উঠতেই ঐশ্বর্য আর প্রেম দুজন দুইদিকে ছিটকে গিয়ে দাঁড়াল।
“হায় হায়! বিশ্বাস করো আমি কিছু দেখি নাই। রান্নাঘরে রান্নার বদলে এগুলা চলতেছে জানলে আসতাম না। আমি আর আসব না।”
এই বলে রান্নাঘরের দরজা থেকে দৌড় দিল মিতালি। ঐশ্বর্য আর প্রেম দুজন দুজনের দিকে তাকালো। ঐশ্বর্যের চোখ গেল প্রেমের সাদা গেঞ্জির দিকে। যেটা সে নিজের ঝাল লবণ দিয়ে মাখানো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। বর্তমানে তার গেঞ্জি হলুদ হলুদ বর্ণে পরিণত হয়েছে। ঐশ্বর্যের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তবে কিছু বলল না। প্রেম সেখান থেকে বেরিয়ে গেল তৎক্ষনাৎ।
রাত হয়েছে। অর্ধ থালার মতো চাঁদ আকাশে জ্বলজ্বল করছে। মিটমিট করছে অসংখ্য তারা। জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে শীতল হাওয়া। হাওয়ায় উড়ছে পর্দা। ঠান্ডায় এসি অফ করা। এসির ঠান্ডা ঐশ্বর্য সহ্যও করতে পারে না। সবেমাত্র খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো প্রেম। ঘুম পেয়েছে বেশ। বিছানায় শুয়ে বেশ ভালোমতো ঘুম দেওয়ার পরিকল্পনা তার। হাই তুলে বেডের দিয়ে এগিয়ে যেতেই চক্ষু চড়কগাছ তার। জোর গলায় বলে ওঠে,
“এই মেয়ে কি করছো এটা?”
ঐশ্বর্য দড়ি দিয়ে পর্দা বাঁধছিল। প্রেমের কন্ঠ শুনে পিছু ফিরে তাকালো। সমস্যা হচ্ছে পর্দাটা ঐশ্বর্য বেডের একদম মাঝ বরাবর পর্দা টানিয়ে দিচ্ছে। ঐশ্বর্য অকপটে উত্তর দেয়,
“দেখছেন না? পর্দা দিয়ে দিচ্ছি বেডের মাঝখানে?”
“দেখছি। বাট বেডের মাঝে কে পর্দা দেয়?”
“আসলে কি বলুন তো আমার কোনো ইচ্ছেই নেই যেই লোক আমার সাথে বাধ্য হয়ে একই ছাঁদের নিচে আছে সেই লোকের সাথে এভাবে ঘুমাতে তাই এই কাজ। আমাদের মাঝে পর্দা থাকবে।”
প্রেম এবার হতাশ চোখে তাকায়। মেয়েটার রাগ এখনো কমেনি। বিন্দুমাত্র কমেনি। এভাবে আর রেগে থাকবে কতক্ষণ! প্রেম এগিয়ে বেডের কাছে এলো। ঐশ্বর্য বেডের ওপর দাঁড়িয়ে চাদর টানিয়ে দিচ্ছে। প্রেম গাম্ভীর্যের সাথে বলল,
“ওখান থেকে নামো।”
“চাদর লাগিয়ে দেই আগে তারপর।”
“আমি বলছি নামো।”
ঐশ্বর্য শুনে শোনে না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে। বিরক্ত হয়ে ঐশ্বর্য এক হাত ধরে নেয় প্রেম। হাত টেনে বলে,
“কত সুন্দর প্রথমদিন বুকে চোরের মতো ঘুমিয়েছিলে তখন তো চাদর টানিয়ে ঘুমোনোর কথা মনে পড়েনি!”
“তখন তো জানতাম না আপনার এইসব কথা। জানলে আপনার ছায়াও মারতাম না। হাতটা ছাড়ুন।”
প্রেম হাতটা ছাড়ে না। দুজনের এমতাবস্থায় হঠাৎ করে নিজেকে সামলাতে না পেরে চাদর নিয়েই বেডে পড়ে যায় ঐশ্বর্য। প্রেমও তা সামলাতে পারে না। সেও ধপ করে আধশোয়া হয়ে পড়ে এমন কর্মকান্ডে। দুজনেই হতভম্ব! চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে। প্রেমের মুখের ওপর পর্দা পড়ে আছে। ঐশ্বর্য পর্দার ওইপারে তাকিয়ে দেখছে পর্দায় আবৃত প্রেমের আবছা মুখ। ঐশ্বর্য নিজেকে সামলে ওঠার চেষ্টা করল। সাথে সাথে প্রেম চেপে ধরল তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। ঐশ্বর্য ঢক গিলল। চিকন সুরে বলল,
“আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাব।”
“তো ঘুমাও।”
“ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়তে হবে। আর আপনি আমাকে ধরে রেখেছেন।”
প্রেম নির্বিকার কন্ঠে বলল,
“প্রথমদিন তুমি আমাকে ধরে ঘুমিয়েছিলে। আর আজ আমি তোমায় ধরে ঘুমাব। ইটস রিভেঞ্জ সুইট গার্ল!”
ঐশ্বর্য তিক্ত মেজাজ নিয়ে বলল,
“আপনি না ছাড়লে আর পর্দা না লাগাতে দিলে গতকালকের মতো আমি আবারও বাহিরে গিয়ে রাত কাটাবো। বলে রাখলাম।”
প্রেম একগাল হেঁসে বলে,
“তোমাকে না ছাড়লে তুমি যাবে কিভাবে? আর তুমি ভুলে যাচ্ছো তুমি পর্দা টানিয়ে রাখার কথা বলোনি। একটু আগে তুমি বলেছিলে আমাদের মাঝে পর্দা থাকবে। টানিয়ে রাখবে নাকি ঝুলিয়ে রাখবে এ কথা একদম বলো নি। লুক! আমাদের মাঝখানেই পর্দা আছে। সো গুড নাইট।”
“দেখুন আপনি… আপনি কিন্তু…!”
কোনো শব্দ আর মুখে আসেনা ঐশ্বর্যের। প্রেম চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ঐশ্বর্য বেশ কিছুক্ষণ ছটফট করে। এই মূহুর্তে ইচ্ছে করছে সামনে থাকা শক্তিশালী পুরুষটিকে নিজের আসল রুপে এসে বড় নখ দিয়ে একেবারে চেহারা পরিবর্তন করে দিতে। কিন্তু বড়ই আফসোস। এটা অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব!
বেশ ক্লান্ত হয় ঐশ্বর্য। চোখ লেগে আসে তার। পর্দার এপাশ দিয়ে ঘুম ঘুম বেশে তার মাথা ঢুলে পড়ে প্রেমের বুকে। চোখ লেগে আসে তার। প্রেমের বুকে ঢলে পড়ে ঐশ্বর্য। তাদের দূরত্ব সামান্য একটা পাতলা চাদরের। তবুও যেন এই পাতলা আবরণ তাদের আলাদা করতে অসফল!
চলবে….
#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৩
পরেরদিন সকালের ব্রেকফাস্ট বানানোর তোড়জোড় চলছে। সকালে খুব হেলদি খাবার না বানানো হলেও স্যান্ডউইচ, ডিম, ফ্রুট স্যালাদ আর জুস হয়েই থাকে। কিন্তু সমস্যা সেখানে না। ঐশ্বর্য রান্নাঘরের চুলার সামনে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে। এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে মিতালি নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। তার এমন উদ্ভট দৃষ্টি দেখে ঐশ্বর্য আমতা আমতা করে বলল,
“কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে দেখতে কি ভূতের মতো লাগছে?”
“আসলে না বউমণি, ম্যাডাম অমলেটের কথা বলেছিল সেই জিনিসটা আপনি নিজের দায়িত্বে নিলেন। কিন্তু ম্যাডাম চলে যাবার পর থেকে আপনি ১০ মিনিট ধরে চুলার সামনে দাঁড়িয়েই আছেন। কিন্তু একটা অমলেট ভাজতে পারলেন না। তাই দেখছিলাম। আমি ভেজে দেব কি?”
ঐশ্বর্য কিছু না ভেবেই জোর গলায় বলে উঠল,
“একদম না। আমি তো এমনিই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি যাও ওইদিকে ব্রেকফাস্ট যেসব তৈরি হয়েছে নিয়ে যাও আর টেবিলে সাজাও আমি তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছি।”
“কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করব? আপনি সত্যি রান্না পারেন তো?”
মিতালির কথাটা বলার সাথে সাথে চোখ গরম করে তাকালো ঐশ্বর্য। সঙ্গে সঙ্গে ঢক গিলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল মিতালি। হাফ ছেড়ে চুলোর দিকে তাকালো ঐশ্বর্য। সব তো মিতালিই করছিল! তবে কেন যে শুধু শুধু সে রান্নাঘরে আসতে যায়! তার ঠিক নেই। কাঁপা কাঁপা হাতে চুলো ধরিয়ে নিজেই কেঁপে উঠল ঐশ্বর্য। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে একটা কড়াই এনে বসালো। তারপর কালকের মতো তেল দিয়ে নিল।
এরপর দিশেহারা হয়ে পড়ল ঐশ্বর্য। কি করতে হবে এখন তা তো কিছুই জানে না। তবুও আন্দাজ করে একটা ডিম হাতে নিল সে। এটা এখন কি করে ভেতর থেকে অংশগুলো বের করবে সেটা নিয়ে ভাবতে থাকল সে। তখনই কারো কন্ঠস্বর পেয়ে বেশ খানিকটা চমকালো। কন্ঠস্বর পরিচিত। তবে প্রেমের নয়। অন্যকারো সেই কন্ঠ। ভ্রু কুঁচকে পিছু ফিরে তাকায় সে।
“বাড়ির বউ রান্নায় মন দিয়েছে? ইন্টারেস্টিং!”
ইফান ফ্রিজ খুলতে খুলতে উদ্ভট হেঁসে কথাগুলো বলল। ঐশ্বর্যও কঠোরতা বজায় রেখে জবাব দিল,
“বাড়ির বউ বলে কথা! আপনি যদি হতেন আপনিও নিশ্চয় একই কাজ করতেন।”
“অভিয়েসলি নট। আপনার মতো এতো পাওয়ারফুল মানুষ হলে আমি অবশ্যই একাজ করতাম না। হ্যাঁ করতাম যদি সেটা সাধারণ বিয়ে হতো। দয়ার বিয়েতে এসব করা সাজে বলে মনে করি না। তাও আবার আপনার মতো একজন যে অন্যকে দয়া করে। দয়া নেয় না।”
ঐশ্বর্যের ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে গেল। স্মরণে এলো কথাগুলো কিন্তু ভুল নয়। আসলেই সঠিক। ঐশ্বর্য সিনহা! যে নিজের মতো বেঁচেছে আর নিজের পথ নিজে ঠিক করে নিয়েছে। সেখানে প্রেমের মতো একজন পুরুষের পদার্পণ তার এই ধোঁয়াশাময় জীবনে হয়েছিল ঠিকই। তবে মানুষটা তাকে দোটানায় ফেলে দিয়ে নিজে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করছে। প্রিয় মানুষটির দয়ার চেয়ে বোধহয় বিষাক্ত কিছু আর হতে পারে না। ইফান ফ্রিজ থেকে খুঁজে খুঁজে অ্যাপেল বের করে বেসিনে ধুয়ে তাতে কামড় বসিয়ে খেতে লাগল আর ঐশ্বর্যের মুখভঙ্গি দেখতে লাগল। মেয়েটা অসম্ভব রূপবতী। আগুনের সামান্য আঁচে যেন রক্তিমা হয়ে উঠেছে সে। বেগুনির সাথে সাদা পাড়ের শাড়িটা তার মাধুকরী রূপ শিরায় শিরায় ফুটে উঠেছে। ঐশ্বর্যের মৃদু কাঁপুনি আর চেহারায় রক্তিম বর্ণের গাঢ়তম হতে দেখে বুঝতে বাকি রইল না সে ক্রুদ্ধ হয়েছে। নিজেকে ক্রমাগত সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। ইফান আর কিছু বলল না। অ্যাপেল খুঁজতে এসেছিল। সেটা নিয়েই স্থান ত্যাগ করল সে। ঐশ্বর্য একা একা দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। আনমনে বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে ঐশ্বর্য বলার চেষ্টা করল,
“বিয়েটা বিয়েই। আমি এখন না এর থেকে বের হতে পারব! আর না এই সম্পর্ক আমি ভাঙতে পারব। কারণ আমিও ভালোবেসেছিলাম। #প্রেমের_ঐশ্বর্য হতে চেয়েছিলাম। কোথাও একটা সেই মানুষটার ব্যক্তিগত হতে গিয়ে বেশ লোভী হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এই বিষাক্ত ‘দয়া’ নামক শব্দটির কি হবে? যতবার চাই ভুলে যেতে ততবারই কেন সেই কথাই স্মরণে আসে? পরিত্রাণ চাই আমার!”
বেশ কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নিজের কাজে মন দিল ঐশ্বর্য। হাতে থাকা ডিম নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফট করে ফাটাতে গেল সেটা। হঠাৎ করেই ডিমটা ফেটে একেবারে নিচে সব অংশ পড়ে যা তা অবস্থা করে ফেলল সে। চোখ কপালে তুলে কাঁদো কাঁদো হয়ে হাতে টিস্যু নিয়ে মুছতে লাগল। অতঃপর আবার চেষ্টা করল। পর পর ৩ বার পর অবশেষে কড়াইয়ে অমলেট রান্না শেষ হলো তার। চোখেমুখে ভীষণ ঘাম! যেন যুদ্ধ করেছে!
বিকেল তখন সাড়ে পাঁচটা। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে ঐশ্বর্য। গভীর ঘুমের মাঝে হঠাৎ কেঁপে উঠে পা ঝটকা মেরে সরিয়ে নিল সে। ঘুমন্ত অবস্থায় তার কপালে পড়ল দৃঢ় ভাঁজ। তার পায়ে কিছু একটা ঠেকছে। যা বড্ড সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আবারও বিষয়টা অনুভূতি করায় হুড়মুড়িয়ে সদ্য ঘুম থেকে উঠে বসল সে। চোখ থেকে এখনো অবধি ঘুম যায়। অস্পষ্ট চারিদিকে। সর্বপ্রথম চোখ রাখল পায়ের কাছে। অস্পষ্ট হলেও চিনতে খুব একটা দেরি হলো না। গায়ে সাদা শার্টে ইন করা ফর্মাল লুক দেওয়া লোকটাকে দেখে কোনোমতেই বোঝা যাবেনা লোকটা দিনকে দিন ফাজিলের গোডাউন হয়ে চলেছে। চোখ কচলাতে কচলাতে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
“কি সমস্যা আপনার? ঘুমাতে দেবেন না নাকি? লাইফটা দুর্বিষহ করে তুলছেন কেন?”
প্রেম এবার ঐশ্বর্যের পা ধরে নিজের এক হাত দিয়ে আবারও যত্ন সহকারে একই কাজ করায় লাফিয়ে ওঠে ঐশ্বর্য। পা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে চায়। তবে প্রেম ছাড়ার পাত্র নয়। ভার কন্ঠে বলে,
“তোমার কি সমস্যা? আজকে আমাদের মালদ্বীপে যাওয়ার ফ্লাইট আছে তুমি ভুলে নিশ্চয় যাওনি। ভুলে যাওয়ার কথা নয় আমি জানি। আমি বলেছিলাম তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে। বাট তোমার তো জন্মগত স্বভাব আমি যা বলব ঠিক তার বিপরীত কাজ করা।”
“আমি যাব না আপনার সাথে। শুধুমাত্র এই কথা বলার জন্য আমার ঘুম ভাঙিয়েছেন? পা ছাড়ুন নয়ত খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি।”
অকপটে বলে ঐশ্বর্য। প্রেম তবুও ছাড়েনা। প্রেম আগের মতোই বলে ওঠে,
“উঠে পড়ো আর লাগেজে যা যা লাগবে সেসব তুলে নাও। পরে তোমারই প্রবলেম হবে।”
ঐশ্বর্যের রাগ ওঠে। রাগ চোখের রঙ পাল্টাতে থাকে। নীল রঙ ধূসর বর্ণে ভরে ওঠে। সেই চোখে কোনো অনুভূতি নেই। খুব জোরে চিল্লিয়ে উঠে বলে ওঠে,
“কি ভাবেন নিজেকে আপনি? খুব দয়ালু মানুষ? যাকে ইচ্ছে দয়া করবেন? ঐশ্বর্য সিনহা কারো দয়া নিয়ে চলে না। আপনার ধারণাও নেই আমি ঠিক কি কি করতে পারি! আমাকে রাগাবেন না। এর ফল আপনি ভুগবেন। আর হ্যাঁ আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। গেলে একটা জায়গায় যাব। সেটা হচ্ছে একান্ত আমার জায়গা, আমার রাজ্য। যেখানে না থাকবেন আপনি আর না থাকবে আপনার এই সো কলড দয়া।”
নিজের পা সর্বশক্তি দিয়ে ছাড়িয়ে নিজেকে ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে ঐশ্বর্য চোখ বন্ধ করে। প্রেম হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাকে কিছু বলার সুযোগ দিল না? এমন ব্যবহার হঠাৎ কেন? কি হয়েছে আবার ঐশ্বর্যের?
বেশ কিছুক্ষণ পর আবারও যখন ঐশ্বর্যের হালকা ঘুম পেয়েছে তখনই তার পিঠে কারো ছোঁয়া লাগতেই ঘুম হারিয়ে চোখ মেলে তাকায় সে। এবার আগের চেয়ে বেশি বিরক্ত হয় সে। যখন নিজেকে শূন্যে অনুভব করে তখন চোখ বড় করে তাকাতেই যা ঘুম ছিল তাও যেন কর্পূরের মতো উড়ে যায়। তার চোখে সামনে একটু উপরে প্রেমের থুঁতনি দেখে। থুঁতনিও রয়েছে ছোট ছোট দাঁড়ি আবৃত। বেশ অদ্ভুত সুন্দর যা! তারপর তার খেয়াল হলো তাকে কোলে করে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত আনা হয়েছে। নিচে নামার জন্য ছটফটিয়ে গেল ঐশ্বর্য। প্রেমের মুখে না আছে বিরক্তি আর না আছে কোনো শব্দ! সামনে পড়ল মিতালি। প্রেম শুধু তার উদ্দেশ্যে বলল,
“মিতালি, মা হয়ত নিজের ঘরে আছে। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। ফ্লাইট আছে।”
মিতালি হা হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রেম আর কোলে থাকা ঐশ্বর্যের দিকে। হালকা কেশে জবাব দেয়,
“কিন্তু তার তো দেরি আছে।”
“আমি এখনি বের হচ্ছি।”
আর কোনো প্রকার কথা না বলে সোজা গার্ডেনে গাড়ির কাছে এসে খোলা দরজা দিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয় ঐশ্বর্যকে প্রেম। ঐশ্বর্য কিছু বলতে উদ্যত হওয়ার আগেই প্রেম এবার তাকে ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠল,
“শাট আপ! জাস্ট শাট আপ। আর যদি একটা কথাও বলেছো ঠাস করে চড় মেরে দেব। তখন তুমি চিল্লিয়ে কথা বলেছো আমি কিছু বলিনি। বাট ইটস মাই টার্ন। অ্যান্ড ইউ হ্যাভ টু শাট ইউর মাউথ!”
“আমি আপনাকে আগেও বলেছি এখনো বলছি আমি যাব না আপনার সাথে। আপনি কিসের জোরে আমার সাথে এমন করতে পারেন?”
প্রেম উত্তর না দিয়ে আগে গাড়িতে বসে। গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। ঐশ্বর্য দ্রুত গাড়ি থেকে নামতে চাইলেও তার হাত টেনে ধরে প্রেম। আর দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আর একবার যদি এমন ছটফট করেছো তবে আমি তোমায় ছেড়ে দিয়ে রোজের কাছে যাব। তাও এখনি।”
ঐশ্বর্য থমকায়। তার ছটফটানি কমে। কন্ঠের ঝাঁঝালো ভাবটা কমে। শান্ত সুরে বলে,
“রোজ কেন?”
“তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইছি তুমি তো যেতে চাইছো না। এখন রোজকে গিয়ে একই প্রস্তাব দিলে সে তখনি রাজি হবে আমার সাথে ঘুরতে দেওয়ার জন্য আমি গ্যারান্টি দিতে পারি। দেখবে?”
“না থাক!”
প্রেম হালকা হেঁসে বলে,
“দেন ইউ আর রেডি টু গো উইথ মি?”
ঐশ্বর্য জবাব দেয় না। শুধু হালকা করে মাথা নাড়ায়। প্রেম নিজের হাসি প্রসারিত করে ঐশ্বর্যের গাল টেনে দিয়ে বলে,
“মাই সুইট ওয়াইফ!”
চলবে…
[বি.দ্র. আজকের পার্ট টা হয়ত অগোছালো হয়ে গিয়েছে। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]
লেখিকার গ্রুপ : আনিশার গল্পআলয় (সাবির পাঠকমহল)?