এক_ফাগুনের_গল্প
পর্বঃ– ২১
আমি মোহনার সামনে বসলাম, মোহনা খাটের ওপর বসে আছে আর আমি তার সম্মুখে নিচে বসে হাত দিয়ে আমার দিকে তাক করিয়ে দিয়ে খানিকটা তাকিয়ে রইলাম। চোখের পানি টলমল করছে আর কিছু বেয়ে বেরিয়ে এসেছে, কপোল ভিজে যবুথবু।
– বললাম, কখন এসেছো?
– আড়াইটার দিকে বাসায় পৌঁছেছি।
– কিছু খেয়েছ?
– হুম।
– বাসা চিনলে কীভাবে? অসুবিধা হয়নি?
– না, আমি বাসে করে জিইসি মোড় এসেছি আঙ্কেল আমাকে জিইসি মোড় গিয়ে নিয়ে এসেছেন।
– কিন্তু বাবার সাথে তোমার যোগাযোগ হলো কেমন করে সেটা না জানা আমি। আর কেনই বা তুমি হঠাৎ করে চট্টগ্রামে এসেছো সেটা জানতে চাওয়া আমার কৌতূহলি মন।
– তুমি আগে অফিসের পোশাক পাল্টে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো তারপর না-হয় বলি?
– সমস্যা নেই বলো তুমি, স্যার জানে?
– হ্যাঁ এতক্ষণে হয়তো জেনে গেছে।
– কান্না করো কেন? আর চোখ মুখ কেমন যেন ভয়ে বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে, কারণ কি?
– সত্যি বলবো?
– অবশ্যই সত্যি বলবে।
– আমি তাদের সবাই কে ছেড়ে শুধু তোমার জন্য চলে এসেছি, জানিনা তুমি আমাকে কতটা আপন করে নেবে? কিন্তু বিশ্বাস করো এ ছাড়া যে আমার মাথায় আর কিছু আসে নাই। এখন তুমি যদি আমার ভালবাসা গ্রহণ করে আমাকে নিজের কাছে রাখতে না চাও তাহলে আমি কি করবো? সেই ভয়ে আছি, তাছাড়া যদি বকাবকি করো?
– আচ্ছা আমি কি তোমাকে গালি দিয়েছি?
– না।
– তাহলে চোখ মুছে তারপর বসো।
– আমাকে ফিরিয়ে দেবে না তো?
– আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আগে দেখি পরিস্থিতি কেমন হয়? তারপর ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কি করবো?
– মোহনা এবার খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল, আর আমার বুকের উপর ঝাপিয়ে পরে কান্নার আওয়াজ বাড়িয়ে দিল। তারপর বললো, তোমার দুটি পায়ে পরি আমাকে তাড়িয়ে দিও না সজীব। বিশ্বাস করো আমি মরে যাবো, তোমার এই বুকটা ছাড়া আমি আর কিছু চাই না।
মোহনা এমন ভাবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে আর কান্নার আওয়াজ এতটা মায়াবী লাগছিল যা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সত্যি ভালবাসা এমন হয় নাকি? সত্যি ভালবাসা কি মানুষকে অন্ধ করে ফেলে? সত্যিকারের ভালবাসা কি তার ভালবাসার মানুষের জন্য পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ মনে করে?
তাহলে অর্পিতা তো আমাকে ভালবেসেছে, কিন্তু সে কেন এমন করলো না? সে কি আমাকে মোহনার মতো করে ভালবাসতে পারে নাই? তার ভালবাসার মধ্যে কি এতটা অপূর্ণতা লুকিয়ে আছে?
– বললাম, আমার জীবনটা অনেক রহস্যময় তাই সেই জীবনের সঙ্গে মিলে তোমার জীবন কেন শুধু শুধু তুচ্ছ করতে চাও?
– ভালবাসা থাকলে সবকিছু জয় করা সম্ভব, তোমার ভরসায় আমি সবকিছু করতে পারি।
– তোমাকে বিয়ে করলে আমার চাকরি চলে যাবে এটা পুরোপুরি নিশ্চিত, তারপর আরেকটা নতুন জব যোগাড় করতে কষ্ট হবে। চাকরি চলে গেলে আমার সৎমায়ের এই সুন্দর ব্যবহার পরিবর্তন হয়ে যাবে।
– কেন? আমার কাছে তো অনেক ভালো মনে হয়েছে তোমার মা-কে। আর বাবার অফিস ছাড়া অসংখ্য কোম্পানি আছে, তোমার মতো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক চাকরির জন্য বেশিদিন আর ঘুরতে হবে না। দরকার হলে তুমি আমি দুজনেই ইনকাম করবো তবু এসব বাহানা দিকে আমাকে ছেড়ে দিও না। তুমি যে সকল অজুহাত দিবে সেগুলো জগতের প্রতিটি মানুষ এর জীবনে ঘটে থাকে। হয়তো কারো জীবনে কম আবার কারো জীবনে অনেক বেশি।
– তুমিও ইনকাম করবে?
– হ্যাঁ করবো, কেন পারবো না আমি?
– অবশ্যই পারবে, বোরকা পরে এক ব্যাগ চকলেট নিয়ে রাস্তায় নেমে যাবে তারপর বাসের মধ্যে বিক্রি করতে থাকবে।
– ওই শয়তান…! একদিন বিক্রি করেছি বলে তুমি সে কথা বারবার বলছো কিন্তু।
– ফাজলামো করলাম।
– কখন বিয়ে করবে?
– আগে বলো বাবার সাথে কীভাবে কথা হলো?
– তোমার মোবাইল কোথায় ছিল আজকে?
– আর বলো না, সকাল বেলা অফিসে যাবার সময় মোবাইল নিতে মনে ছিল না। তুমি গতকাল রাতে মোবাইল বন্ধ করার পরে অনেকবার চেষ্টা করেছি কিন্তু বারবার বন্ধ পেলাম। সকাল বেলা অনেকবার চেষ্টা করছি কিন্তু তবুও সেই একই সমস্যা। তারপর নাস্তা করে ভুলে মোবাইল ফেলে চলে গেছি আমি।
– গতকাল রাতে তোমার সাথে রাগ করে মোবাইল কল কেটে দিয়ে আমি বাবার সামনে গিয়ে সবকিছু জিজ্ঞেস করেছি। বাবা কেনই বা তোমাকে চট্টগ্রামে বদলি করেছে আর কেন শিমু মেয়েটি কে তোমার পিছনে লাগিয়েছে? খুব উত্তেজিত আর চিৎকার চেচামেচি করে বাবার কাছে বারবার কারণ জিজ্ঞেস করেছি। তখন বাবা হঠাৎ করে আমাকে চড় মেরে বসে, আর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে।
– তারপর?
– সকাল বেলা মা-বাবা ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমি তাদের দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিলাম। নিজের সাথে যা যা আনার ইচ্ছে ছিল সবকিছু রাতেই গুছিয়ে রেখেছি। সকাল বেলা খুব ভোরে সব নিয়ে বেরিয়ে পরলাম, বৃদ্ধ দারোয়ান কিছুই বুঝতে পারে নাই। গুলিস্তান থেকে আমি সরাসরি আসলাম নারায়ণগঞ্জ চিটাগং রোড, তারপর সেখান থেকে টিকিট কেটে রওনা দিলাম।
– বাহহ বেশ বুদ্ধি, নেক্সট…!
– কুমিল্লা এসে তারপর তোমার নাম্বারে কল দিলাম বারবার কিন্তু রিসিভ হচ্ছিল না। খুব কান্না পাচ্ছিল তখন বিশ্বাস করো, ভাবলাম তুমি যদি কল রিসিভ না করো তাহলে আমি এই শহরে কার কাছে এসে থাকবো? প্রথমে ভেবেছিলাম গতকাল রাতে রাগ করে কল কেটে দিয়ে বন্ধ করেছি তাই তুমিও হয়তো রাগ করে রিসিভ করো না।
– হাহাহা তারপর?
– একদম হাসবে না বলে দিচ্ছি, তুমি জানো তখন আমি কতটা টেনশনে ছিলাম? আরেকটু টেনশন যদি করতাম তাহলে স্ট্রোক করে ফেলতাম।
– আচ্ছা বলো।
– যখন তুমি রিসিভ করছিলে না তখন নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছিল, তখন ভাবলাম কেন রাগ করে মোবাইল বন্ধ করলাম? এরপর হঠাৎ করে আঙ্কেল রিসিভ করলেন, আমি সালাম দিয়ে তাকে বললাম যে আমি সজীব এর অফিসের বসের মেয়ে। তখন আমি জানতে পারি যে তুমি মোবাইল বাসায় রেখে অফিসে চলে গেছো। আমি আঙ্কেলকে বললাম যে আমি চট্টগ্রামে আসতেছি তিনি যেন আমাকে একটু কষ্ট করে বাসায় নিয়ে যায়। তারপর আমি বাসের মধ্যে করে জিইসি মোড় এসে নামলাম আর তোমার বাবা গিয়ে নিয়ে আসলেন।
– তাহলে এবার আমাকে মেলা মেলা ধন্যবাদ দাও।
– কেন কেন?
– আমি মোবাইল বাসায় রেখে গেছি তাই তো তুমি আসতে পারলে নাহলে তো পারতে না।
– কেন? তোমার কাছে মোবাইল থাকলে তুমি কি আমাকে নিয়ে আসতে না?
– না, ভালো করে বুঝিয়ে ঢাকা শহরে ফেরত পাঠিয়ে দিতাম।
– তারমানে আমি যে আঙ্কেলের মাধ্যমে আসলাম তাতে তুমি রাগ করেছ?
– এসেই যখন পরেছো তখন রাগ করে কি হবে?
– একটা কথা বলবো?
– বলো।
– সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এসেছি তাই আমার সেই ত্যাগের বিনিময়ে দুচোখের অশ্রু উপহার দিও না। এক বুক ভালবাসা দিতে না পারো, সমস্যা নেই তোমার নীরবতার মাঝে আমি সুখ খুঁজে নেবো।
– এমন করে কেন বলছো? আমাকে কি তোমার খুব খারাপ মানুষ মনে হয়?
– সেটা যদি মনে হতো তাহলে সব ছেড়ে তোমাকে ভালবেসে পাগল হলাম কেন?
– মায়ের কাছে গিয়ে এক কাপ কড়া করে চা নিয়ে আসো, আমি ততক্ষণে কাপড় পরিবর্তন করি।
– আচ্ছা ঠিক আছে, Love You.
– Love You too.
মোহনা রুম থেকে বেরিয়ে যাবার মিনিট খানেক পরই বিছানায় আমার মোবাইল বেজে উঠলো। তাই মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি স্যার কল দিছেন, আমি মনে হয় সামান্য ভীত দিশাহীন বোধ করলাম। কিন্তু রিসিভ করে বললামঃ-
– আসসালামু আলাইকুম স্যার।
– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, কেমন আছো সজীব?
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ স্যার আপনি কেমন আছেন?
– কীভাবে ভালো থাকবো বলো? মোহনার পাগলামি আমাকেই পাগল করে দিচ্ছে, তাই আর শান্তিতে থাকতে পারলাম না।
– সেটাই স্বাভাবিক।
– মোহনা চট্টগ্রামে গেছে তাই না?
– হ্যাঁ আমাদের বাসায় আছে।
– ওকে নিয়ে কি করা যায় বলো তো? মানসম্মান সব শেষ করে দিল।
– কিছু করার নেই স্যার, ভালবাসার উপর কেউ তো কখনো জোর করে সফল হতে পারে নাই। আমার মনে হয় আপনিও পারবেন না মোহনার মন থেকে আমাকে মুছে নিতে। তাই বাস্তবতা মেনে নিয়ে মেয়ে যা বলে তাই করুণ, কি আর করবেন?
– মানে কি সজীব?
– মানে হচ্ছে আপনি আমাদের বিয়ে মেনে নিন, আর তাছাড়া কোন উপায় নেই স্যার।
– সেটা কোনদিন সম্ভব না, এখন আমি তোমাকে যা বলি তাই করো।
– কি করতে হবে আমাকে?
– তুমি মোহনার সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাকে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করো। তুমি এমন ভাবে তার সাথে ব্যবহার করবে যাতে সে আমাদের কাছে ফিরে আসতে রাজি হয়।
– আর আপনি থাকবেন সম্পুর্ণ ফেরেশতা, তাই না?
– মানে?
– মানে হচ্ছে আমি মোহনাকে বিয়ে করবো, আপনি যদি রাজি না হন তবুও আমি ওকে বিয়ে করবো। যে মানুষ আমার জন্য এত কষ্ট করে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারবো না।
– কি বললে তুমি? আমার কথা শুনবে না?
– নাহহ, আপনার কথা যদি শুনতে হয় তাহলে তো ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে হবে। আর সেগুলো করলে তার দুচোখ ভর্তি থাকবে অজস্র পানি, কিন্তু আমি আর মোহনার চোখের পানি ঝড়াতে চাই না। তার চোখে যেন আর কোনদিন পানি না আসে সেই ব্যবস্থা করতে চাই, আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আপনার মেয়েকে ভালো রাখতে পারি।
– আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না সজীব, মুদ্রার এক পিঠ দেখেছো কিন্তু অপর পিঠ কিন্তু ভালো নাও হতে পারে সেই ধারণা আছে তোমার?
– স্যার আপনি একজন বহুরূপী মানুষ সেটা আমি অনেক আগেই বুঝতে পারছি। আপনার সম্পর্কে নতুন করে কিছু জানাতে হবে না।
– তাহলে আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর নাহলে চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরে তোমার লাশ ভাসিয়ে দিয়ে তারপর আমার মেয়ে নিয়ে আসবো।
– স্যার আপন বনে বনবিড়াল ও রাজা হয়ে যায়, এটা আমার শহর তাই এখানে আপনার দাপট কিন্তু চলবে না। আপনি ব্যবহার করবেন আপনার টাকা, প্রশাসন আর কুবুদ্ধি। কিন্তু আমি ব্যবহার করবো শুধু আপনার মেয়ের ভালবাসা আর আমার নিজের এলাকার ক্ষমতা। যদি সাহস থাকে তাহলে চলে আসেন চট্টগ্রামে, খেলা হপ্পে। আল্লাহ হাফেজ।
মোবাইল কল কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে রইলাম, তারপর আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দরজার সামনে মোহনা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ভর্তি রাগের দৃষ্টি, মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনই ওই মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত কিংবা অন্য কিছু।
– মোহনা বললো, তুমি আমার সাথে এমনটা করতে পারলে সজীব?
.
.
.
চলবে…?
.
.
.
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)এক_ফাগুনের_গল্প
পর্বঃ- ২২
– আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে বললাম, বিশ্বাস কর আমার কোন দোষ নেই আমি পরিস্থিতির স্বীকার।
– তাই বলে আমাকে চা আনতে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি ফ্রেশ না হয়ে মোবাইলে কথা বলো? ভেবেছিলাম যে তুমি আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একসাথে চা খাবো কিন্তু তুমি তো ফ্রেশ হওনাই।
– ওহহ আচ্ছা এই কথা? তুমি কি জানো আমি কার সাথে কথা বলছিলাম?
– না তো, কার সাথে কথা বলছিলে?
– তোমার বাবার সঙ্গে।
– মানে কি? বাবা কি বলে?
– তোমার বাবা বলেন যেন আমি ভালোই ভালোই তার মেয়ে তার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে দেই। নাহলে নাকি মুদ্রার ওপিঠটি খুব খারাপ হতে পারে, মানে তার চেহারার মাঝের ভালো মানুষের মুখ আর থাকবে না।
– তারপর?
– আমিও বলে দিয়েছি যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে সে যেন চট্টগ্রামে এসে নিয়ে যায়।
– মোহনা খানিকটা আমার সামনে এগিয়ে এসে বললো, পারবে তো আমাকে ধরে রাখতে?
– আমি হাত বাড়িয়ে তার গাল স্পর্শ করে বললাম, তুমি যদি আমার সাথে থাকো তাহলে পারবো। কিন্তু তুমি যদি চলে যাও তাহলে তো আমার কিছু করার থাকবে না তাই না?
– এবার মোহনা আমাকে আবারও জড়িয়ে ধরে বললো, আমি তো চলে যাবার জন্য আসিনি।
★★
খাবার টেবিলে বাবার সাথে মোহনার বিষয় সবকিছু গুছিয়ে বললাম, সব শুনে বাবা কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল। আমি মুখের ভাত চিবানো বন্ধ করে তার মুখ পানে তাকিয়ে আছি বাবার বক্তব্য শোনা জন্য।
– বাবা বললেন, তোমরা দুজন দুজনকে যদি পছন্দ করো তাহলে তো কিছু করার নেই। কিন্তু আমি বাবা হিসাবে বলছি, এটা করা মোটেই ঠিক হবে না কারণ তার স্থানে যদি আমি থাকতাম তাহলে আমিও হয়ত তার মতো কাজ করতাম। একজন বাবার কাছে তার কন্যা কতটা ভালবাসার সেটা সেই বাবা ছাড়া কেউ জানে না।
– মোহনা বললো, আঙ্কেল আমি জানি আমার বাবা আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমার নিজের ইচ্ছে বা পছন্দ তাকে মেনে নেওয়া উচিৎ। তাছাড়া আমি তো এমন কোন অযোগ্য ছেলে পছন্দ করিনি..! সজীব এর মাঝে টাকা ছাড়া একটা ভালো মানুষের সকল গুণাবলি আছে। টাকা দিয়ে কি হবে? টাকা সম্পদ এমন একটা জিনিস যেটা আজ আছে কাল নেই, সামান্য কিছু রোজগার করে নিজের পছন্দের সকল সখ পুরন করে চলার নামই প্রকৃত জীবন। যে মানুষ রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট কিংবা ফুটপাতের ফ্লাইওভার ব্রীজের নিচে ঘুমায় তার কোন টেনশন নেই। সে যখন ঘুমিয়ে পরে তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করে ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু একজন সম্পদশালী ব্যক্তি সারাদিন শেষে একরাশ টেনশন করতে করতে পরেরদিন কি কি হবে সেগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমায়।
– দেখ মা, আমি একজন বাবা হিসেবে নিজের মত প্রকাশ করলাম, আমি তোমাকে চাই যেতে বলবো না তবে আমি বলবো যে তোমরা আরো কিছুদিন সময় নিয়ে তারপর কিছু করো। তোমার বাবাকে ভালবাসা বোঝানোর চেষ্টা করো, তিনিও রক্তে-মাংসে গড়া একজন মানুষ। তার মনের মধ্যেও ভালবাসার জন্য অনুভূতি নামক বেড়াজাল আছে। সম্পদের পিছনে ছুটলেও দিনশেষে তিনি একজন বাবা, তিনি একজন স্বামী, তিনি একজন পুরুষ।
– আমি বললাম, তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছ মোহনা আর আমি স্যারকে বোঝানোর চেষ্টা করি? আপাতত আমাদের বিয়ে না করে তাকে বোঝানো উচিৎ?
– হ্যাঁ সেটাই বলতে চাই, মোহনা আমাদের কাছেই থাকবে সমস্যা নেই কিন্তু সেই ভাবে তোমাদের কিন্তু বোঝাতে হবে। তিনি যখন জানবেন যে তার জন্যই আজও তোমরা বিয়ে করো নাই তখন দেখবে মনে মনে অনেক আনন্দ পাবে। হয়তো আনন্দে চোখ দিয়ে অশ্রু বেরিয়ে আসবে, আরে এটাই প্রকৃত অর্থে ভালবাসার সুখ। সবকিছু ভালবাসা দিয়ে জয় করে তারপর সেই ভালবাসার মাঝে বসবাস করার মতো তৃপ্তি কোথাও নেই।
– মোহনা বললো, ঠিক আছে আঙ্কেল। Thank You এত সুন্দর করে আমাদের বোঝানোর জন্য।
– আমি চাই তোমরা দুজন একসাথে সুখী হও, কিন্তু সেই ভালবাসার জন্য যাতে কােন মা-বাবার হৃদয় না ভাঙ্গে সেটাও চাই।
★★
রাতে আমার রুমে মোহনার থাকার ব্যবস্থা করা হলো আর আমি ঘুমালাম আমার ছোটভাই (সৎভাই) এর রুমে। মনের মধ্যে সারারাত শুধু একটা চিন্তা ঘুরঘুর করছে, সেটা হচ্ছে আমি কীভাবে স্যারকে আমার আর মোহনার বিষয় রাজি করাবো? রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে তবুও চোখে ঘুম নেই, মোহনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। গভীর রাত, চারিদিকে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে, মোহনার মুখের পাশাপাশি অর্পিতার মুখটা ভেসে উঠছে। যেদিন সে আমার জন্য নুডলস রান্না করে রূপসা ব্রীজে নিয়ে গেছিল। সেদিন আমি যখন খাচ্ছিলাম তখন সে কত সুন্দর মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল।
হঠাৎ করে নিজেকে সংযত করলাম একবার অর্পিতা আরেকবার মোহনা এমন করে কেন ভাবছি? আমি কাকে ভালবাসি? মোহনা মুখে বলেছে যে সে কখনো অর্পিতার বিষয় মন খারাপ করবে না। কিন্তু এতকিছু করার পরও যদি সে বুঝতে পারে যে আমার মনের মধ্যে এখনো অর্পিতা বাস করে তাহলে তার মন খারাপ হবে সেটাই স্বাভাবিক। হয়তো সে তার সেই মন খারাপের অনুভূতি প্রকাশ করবে না কিন্তু তার মনের ভিতরে ডুকরে কেঁদে উঠবে।
সকাল বেলা অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না কারণ মোহনা আসার পরে অফিসে নিশ্চয়ই কিছু একটা গন্ডগোল হতে পারে। কিন্তু মোহনা ও বাবা বললেন যে সমস্যা নেই যেতে হবে আমাকে। কারণ তাদের পারিবারিক বিষয় মনে হয় অফিসে বেশি প্রভাব না ও পরতে পারে। আমি যদি না যাই তাহলে নিজেকে ছোট করা হবে তাই অফিসে আসলাম।
অফিসে এসে ঘন্টা খানিক পরে একটা অপ্রত্যাশিত সংবাদ পেলাম। আমার জুনিয়র এক লোক আমার কাছে এসে ঘটনাটা বললেন, সেই ঘটনা সাজিয়ে লিখলে এমন হয়ঃ-
” তিনদিন আগে বিজন কুমার দাস ছুটি নিয়েছে তার কারণ সে বিয়ে করবে। তার বিয়ে নাকি পারিবারিক ভাবে হবে কিন্তু এই চট্টগ্রামেই অনুষ্ঠিত হবে। বিজন এর পরিবার সেই মেয়ে পছন্দ করেছে তাই ঘরোয়া পরিবেশে মোটামুটি করে বিয়ে হবে। যেহেতু বিজনের বাসা বাগেরহাট জেলা তাই তার জন্য পছন্দকৃত মেয়ের বাসাও বাগেরহাটে। মেয়ে এখানে বেড়াতে এসেছি তাই এখানেই বিয়ে হচ্ছে হঠাৎ করে। বিয়ের পরে মেয়ে আবার চলে যাবে, কারণ সেই মেয়ের পড়াশোনা এখনো চলছে। আর ছয়মাসের মধ্যেই পড়াশোনা শেষ হবে তাই তখন একেবারে তাদের গ্রামের বাড়িতে অনুষ্ঠান করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। কিন্তু গতকাল রাতে নাকি বিজন কুমার বাইরে থেকে বাসায় ফেরার পথে নিজের বাসার গলির মোড়ে এক সিএনজির সাথে মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছে। এখন সে চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছে। ”
হঠাৎ করে মনে পরলো বিজন কুমার যেদিন ছুটির জন্য আবেদন করেছে সেদিন আমাকে তার বিয়ের এসব কথা বলেছিল। কিন্তু আমি যেতে পারবো না বলে আগেই জানিয়ে দিলাম তবে পরবর্তীতে যাবো বলে কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে হঠাৎ করে এমন এক্সিডেন্ট করেছে এটা অবশ্যই প্রত্যাশা ছিল না।
তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে পরলাম, চৌমুহনী থেকে আগ্রাবাদ গিয়ে লাকি প্লাজার পাশ থেকে রিক্সা নিয়ে মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে চলে আসলাম। বিজন কুমার কোন কেবিনে আছে সেটা আগেই জানা ছিল তাই সেই অনুযায়ী বিজনের কেবিনে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
বিজনের কেবিনে গিয়ে আমি বিজনকে দেখে যতটা আশ্চর্য হলাম তারচেয়ে বেশি আশ্চর্য হলাম অন্য কাউকে দেখে। কেবিনের মধ্যে বিজন কুমার ব্যতীত আরো পাঁচজন ব্যক্তি আছে কিন্তু সেই পাঁচজনের মধ্যে একজনের মুখ আমার পরিচিত। সে বিজনের পায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি প্রবেশ করার সাথে সাথে সেও আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল।
আমি আমার সামনে এই মুহূর্তে অর্পিতাকে দেখছি, হাতে সাখা আর মাথায় সিঁদুর দিয়ে একটা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে সে।
আমার দিকে তাকিয়ে অর্পিতা কিছু ভাবলো কিনা জানিনা, তবে আমি তার দিকে তাকিয়ে ভাবছি যে,
তার হাতে সাখা কেন?
মাথায় সিঁদুর কবে উঠলো?
আর সে এখানে কেন?
বিজনের সাথে তার সম্পর্ক কি?
চলবে…?
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)