এক_ফাগুনের_গল্প
পর্বঃ-০৩
– সত্যি সত্যি যদি আমাকে এতটা ভালবাসে তাহলে আমার সামনে আসতে বলবেন প্লিজ? আমি অনেক দিন ধরে ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করে আছি। মনের মধ্যে আস্তে আস্তে করে তীব্র ভালবাসা জমা করে আজ সেটা বিশাল পাহাড় হয়ে গেছে। হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই কিন্তু আমি ওকে চাই।
– বান্ধবী বললো, অর্পিতা আপনাকে সামনে দাঁড়িয়ে কথার মতো সাহস পাচ্ছে না। গতকাল আপনি নাকি ওকে জড়িয়ে ধরেছেন, বাসায় ফিরে ও শুধু নিজে নিজেকে জড়িয়ে ধরে কত কান্না সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। তবে আবারও অর্পিতার জন্য ক্ষমা চাই আপনার কাছে, আপনি ওকে মাফ করবেন প্লিজ।
– আমি ওর সাথে দেখা করবো।
– দেখা তো হয়েছে দুইবার।
– সেটা দুরত্ব বজায় রেখে, আমি আমার ভালবাসার মানুষ হিসেবে তাকে দেখতে চাই। কথা দিচ্ছি সে যদ সামনে দাঁড়িয়ে চলে যেতে বলে আমি চলে যাবো। আর কোনদিন বিরক্ত করতে আসবো না, কষ্ট দিয়ে যার জীবন তৈরি তার আবার কষ্ট কিসের?
– আমি বাসায় গিয়ে দেখি অর্পিতা কি বলে?
– আমি কি এখানে অপেক্ষা করবো?
– না না, আপনি বাসায় চলে যান আমি বাসায় গিয়ে ওকে বুঝিয়ে তারপর আপনাকে জানাবো।
– কিন্তু….!
– এছাড়া কিছু করার নেই, তাছাড়া বাসায় যেতে হবে তাড়াতাড়ি আমাকে। কারণ অর্পিতা বাসায় একা তাই ওর সাথে থাকা জরুরি।
– ঠিক আছে চলে যান আপনি, তবে আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকব।
– আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু ও যদি দেখা করতে না চায় তবে কিছু মনে করবেন না।
– আমার সর্বশেষ একটা প্রশ্ন ছিল।
– কি প্রশ্ন?
– গতকাল বইমেলায় অর্পিতার পুরনো সিম দিয়ে কি আপনি কল দিয়েছেন? আর আমি দীর্ঘদিন যার সাথে সানজিদা ভেবে কথা বলেছি সেই যদি অর্পিতা হয় তাহলে এই দুদিন কণ্ঠ অপরিচিত ছিল কেন?
– উত্তর ০১ঃ- গতকাল অর্পিতা পুরনো সিম আমার কাছে রেখে গেছিল, সে আমাকে বলেছে যে আমি যদি ফোন করি তাহলে আপনি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করবেন যে ও অর্পিতা নয়।
– আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর?
– মোবাইলে ভয়েস পরিবর্তন করে অর্পিতা দুদিন ধরে আপনার সাথে কথা বলেছে তাই আপনি ওর কণ্ঠ চিনতে পারেননি।
– ওহহ আচ্ছা ঠিক আছে মেলা মেলা ধন্যবাদ।
– ভালো থাকবেন ভাইয়া।
– আপনিও।
★★
অর্পিতার বান্ধবী চলে গেল, আমি অর্পিতার দেয়া উপহার নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। তারপর আস্তে আস্তে অর্পিতার সাথে যেমন করে এসেছি তেমন করে রাস্তার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে মনে হয়, শিরশির করে বাতাস এসে গায়ে লেগে যাচ্ছে। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখতে গিয়ে দেখি অর্পিতার নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে।
” কোই তুমি? বাসায় যাচ্ছ তো? প্লিজ কষ্ট নিও না, বাসায় যাও। পিছনে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াও। চলন্ত ইজিবাইকে করে জোরাগেট চলে যাবে, মাত্র দশ টাকা নিবে। সাবধানে যেও, বাসায় পৌঁছে একটা কল দিও নাহলে চিন্তায় থাকবো৷”
আমি মেসেজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, কথায় বলে অভাগা যেদিকে তাকায় সাগর শুকিয়ে যায়। আমি এখানে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু ইজিবাইক পাচ্ছি না।
– হঠাৎ করে পিছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, আরে সজীব না? হ্যাঁ হ্যাঁ সজীবই তো। আরে কেমন আছো বাবা তুমি?
– তাকিয়ে দেখি মানুষটা পরিচিত, মুহুর্তেই মনে পরলো ইনি মুজাফফর আহমদ। ৩/৪ বছর আগে আমরা একসাথে চট্টগ্রামে প্রতিবেশী ছিলাম। তিনি কোকোলা ফুডস প্রডাক্টের মার্কেটিং ম্যানেজার ছিলেন। সেখানে ৫ বছর আমাদের পাশের বাসায় ভাড়া ছিলেন তারা, তারপর বদলি হয়ে গেল।
– চিনতে পারছো আমাকে?
– জ্বি আঙ্কেল, আপনি মুজাফফর আহমদ।
– বাহহ, তোমাকে খুলনা শহরে দেখতে পাবো সেটা তো কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি নাই। তোমার মা-বাবা সবাই কেমন আছে? আর তুমি খুলনা শহরে কবে আসলে? কি মনে করে?
– মা-বাবা সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আর আমি গতকাল এসেছি একটা বন্ধুর বাসায়।
– বেশ তো, এখন আমার সাথে আমার বাসায় যাবে, তোমার আন্টি তোমাকে দেখলে অনেক খুশি হবে। আর আমার সন্তানেরা তো আরো বেশি খুশি হয়ে যাবে আমি নিশ্চিত। পাঁচ বছর তোমরা আমাদের প্রতিবেশী ছিলে, এখনো মাঝে তোমাদের কথা নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু কেন যেন কল দিয়ে কথা বলে যোগাযোগ করতে চাই চাই বলেও হয়ে ওঠে না।
– আজকে তো রাত হয়ে গেছে, কালকে যাই?
– আরে কালকে কেন? তোমার বন্ধুর বাসা কোথায়?
– জোরাগেট।
– তাকে কল দিয়ে আমার কথা বলে দাও, তাকে বলো যে আজকে রাতে তুমি আমার বাসায় থাকবে।
আর আমার বাসা বেশি দুরে নয়, রেললাইন পার হয়ে বামহাতে বাসা।
– থাকা যাবে না আঙ্কেল, থাকতে হলে আরেকদিন আসতে হবে তবে আমি বাসায় গিয়ে আন্টির সাথে দেখা করে আসতে পারি।
– ঠিক আছে আগে চলো তো, তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া যাক কি করবে?
– ঠিক আছে চলুন।
পিছনে যে সিটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট দেখেছি ঠিক তার অপজিটে একটা গলি। সেই গলির একটু সামনে গিয়ে একটা রেললাইন সেটা পার হয়ে সামনে গিয়ে একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। তিনতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় চলে গেলাম আমরা, দরজা খুলে আন্টি আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল।
হাতের ব্যাগ রেখে সামনে বসে পরলাম, অনেকদিন পরে দেখা তাই আন্টি কেমন সদ্যব্যস্ত হয়ে গেছে। ড্রইংরুমে টিভি চলছে, টিভিতে একটা হিন্দি সিনেমা চলছে। আঙ্কেলের ছেলে সাজিদ এসে আমার পাশে বসে কিছুক্ষণ কথা বললো। সাজিদ যখন আমাদের কাছে ছিল তখন সে ক্লাস সিক্সে পড়তো। এখন সে ক্লাস টেনে পড়ে।
অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে, মোবাইলে অর্পিতা কল দিয়েছে আমি সাজিদকে বলে দরজা খুলে বেরিয়ে ছাদে গেলাম। আঙ্কেল তখন মনে হয় ভিতরের ঘরে কিংবা রান্না ঘরে ছিলো।
– ছাঁদে এসে কল দিলাম, হ্যালো।
– কোই তুমি?
– বাসায়।
– কল দিলে না যে? রেগে আছো?
– আমি রকির বাসায় নয়, তুমি যেখানে রেখে গেছ তার পাশেই একটা পরিচিত লোকের বাসায়।
– মানে কি? এই খালিশপুরে তোমার পরিচিত মানুষ আছে জানতাম না তো। কে সে?
– বছর চারেক আগে আমরা একসাথে চট্টগ্রামে প্রতিবেশী ছিলাম। তারপর তারা চলে এসেছেন আর সেই থেকে পরিচয়।
– ওহহ আচ্ছা, মিরাকল জাতীয় ঘটনা।
– হ্যাঁ ঠিক তোমার মতো, যেটা কখনো কল্পনা করতে পারি নাই সেটাই হয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে চারিদিকে শুধু হতাশা আর হাহাকার।
– আমি যে অপরাধী সেটা বারবার মনে করিয়ে দিয়ে আনন্দ পেতে চাও? যদি তাই পাও তবে নিষেধ করব না আমি।
– কষ্টে মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, কিছু মনে করো না।
– আচ্ছা, চট্টগ্রামে কবে যাবে?
– তোমার সাথে দেখা করে তারপর যাবো।
– শর্ত কি ছিল?
– কোনটা?
– বলেছিলাম সানজিদার আসল পরিচয় পেয়ে তুমি চট্টগ্রামে চলে যাবে, আর আমাদের দেখা হবে না।
– হুম মনে আছে।
– তাহলে?
– জানিনা আমি, শুধু জানি তোমাকে দেখতে চাই।
– তোমার সামনে গেলে আমার খুব খারাপ লাগে, নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হয়। যে সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ নেই সেটা নিয়ে সামনে গিয়ে মায় নামক বস্তু টা আর কত তীব্র করবো?
– আমি তো কিছু জানতাম না, আমি একটা অদৃশ্য মানুষকে ভালবেসেছি কিন্তু তুমি তো সবকিছু জানো। আমি মুসলিম তুমি হিন্দু সেটা তো তুমি জানো তবুও কেন এতদূর সম্পর্ক টানলে তাহলে?
– আমি তো বলেছি আমার ভুল হয়েছে, তার জন্য আমি মাফ চাই। তুমি মাফ করো বা না করো তবুও আমিও কিন্তু তোমার মতো কষ্ট পাবো। কারণ আমি তোমাকে ভুলতে পারবো না, তোমাকে হারানোর বেদনা আমাকে সারাজীবন পোড়াবে।
– তাহলে চলো এক হয়ে যাই?
– সেটা সম্ভব না সজীব।
– কেন?
– আমি আমার মা-বাবাকে কষ্ট দিতে পারবো না, আর তাছাড়া তোমার কাছে তোমার ধর্ম যেমন প্রিয় আমার কাছে আমার ধর্ম ঠিক ততটাই প্রিয়। তাই এগুলো বিসর্জন দিয়ে সুখী হতে চাই না, তাছাড়া ধর্ম আর মা-বাবার সঙ্গে বেঈমানী করে তাদের অভিশাপ নিয়ে বাঁচা অসম্ভব।
– আমার আর কিছু বলার নেই।
– রেগে যাচ্ছ?
– কার সাথে? রাগ করে কি লাভ বলো?
– ঠিক আছে রাখলাম তাহলে? ভালো থেকো।
– চেষ্টা করবো।
কল কেটে দিয়ে বাসার মধ্যে এসে বসে আছি, মনে হয় সবকিছু কেমন বিষন্ন ভগ্নহৃদয়। আমার সামনে চলন্ত টেলিভিশন, আপাতত সেদিকে তাকিয়ে দেখি কিছু বোঝা যায় নাকি?
আঙ্কেল চা নিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন, আমি তার সামনেই চা তুলে নিলাম। হঠাৎ করে দরজা খুলে একটা মেয়ে প্রবেশ করলো, আমি চা হাতে তার দিকে তাকিয়ে আছি।
– আঙ্কেল বললো, বৃষ্টি আয় মা আয়, দেখ কে তো চিনতে পারিস কিনা। চিনতে পারছো না? চট্টগ্রামে সজীবের কথা মনে নেই তোর?
– হ্যাঁ মনে আছে বাবা, আমি ভাবছি তিনি এখানে আসলো কীভাবে?
– সজীব এর বন্ধুর বাসা হচ্ছে জোরাগেট, সেখানে বেড়াতে এসেছে। আমি রাস্তায় পেয়ে ক্ষপ করে হাত ধরে নিয়ে এসেছি, হাহাহা হাহাহা।
– কেমন আছেন সজীব ভাই?
– হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুমি কেমন আছো?
– জ্বি ভালো তা বন্ধুর কাছে এসেছেন নাকি বান্ধবীর কাছে এসেছেন?
– মানে?
– কিছু না, চা খান নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
আঙ্কেল বললো, আমি একটু ভিতর থেকে আসি ঠিক আছে? তুমি বসো বাবা।
আমি চা হাতে বসে আছি, মেয়েটা ভিতরের দিকে যাচ্ছিল তখন বললাম। ” তোমার সম্পুর্ণ নামটা কি ছিল বলো তো? ভুলে গেছি! ”
– অামার নাম নাজমা আক্তার বৃষ্টি, আর আপনি যখন ছাঁদে বসে মোবাইলে কথা বলছিলেন তখন আমি ছাদেই ছিলাম। সেজন্য জিজ্ঞেস করেছি যে বন্ধুর কাছে নাকি বান্ধবীর কাছে?
চলবে….
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)