– আমার ছাত্রী গত মাসের টিউশনির টাকাটা দিয়ে বললো, স্যার টাকা দিয়ে কালকে ভালবাসা দিবসে আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবেন তাই না? আপু খুব সুন্দরী মনে হয়, সে কার মতো দেখতে স্যার?
– আমি বললাম, আমি যে দেখা করতে যাবো সেটা তুমি জানলে কীভাবে?
– স্যার ক্ষমা করবেন, আপনি যখন ওয়াশরুমে ছিলেন, তখন আপনার মোবাইলের মেসেঞ্জার থেকে আমি কিছু পুরাতন মেসেজ পড়েছি। সেখান থেকে বুঝতে পারলাম যে আগামীকাল ভালবাসা দিবসে আপনি তার সাথে দেখা করবেন।
– আমার ছাত্রীর নাম মারিয়া, আমি বললাম, মারিয়া তুমি কি জানো এটা অন্যায়?
– সরি স্যার, আসলে আপনি ছিলেন না তখন কিছু মেসেজ এসেছে আর আমি তো আপনার মোবাইলে প্যাটার্ন লক জানি। তাই কৌতূহল বশত অনৈতিক কাজটা হয়ে গেছে, প্লিজ মাফ করবেন।
– আচ্ছা ঠিক আছে, আর আমি তিনদিন তোমাকে পড়াতে আসবো না নিজের দায়িত্বে একটু ভালো করে পড়াশোনা করিও। ঠিক আছে?
– তিনদিন আসবেন না কেন?
– আমি যার সাথে দেখা করতে যাবো তার বাসা অনেক দুরে, যেতে আসতে দুদিন পার হয়ে যাবে।
– তার বাসা কোথায় স্যার?
– তার বাসা বাগেরহাট জেলা কিন্তু সে খুলনা শহরে থেকে পড়াশোনা করে তাই তার সাথে দেখা করতে খুলনা যেতে হবে।
– ওহহ আচ্ছা বুঝতে পেরেছি, তবে আজকেই রওনা দিবেন নাকি?
– হ্যাঁ আজকেই, রাতের গাড়িতে যাবো গত মাসের টাকা আমি তোমার কাছে রেখেছিলাম কারণ আমি আমার কাছে রাখলে খরচ হয়ে যেত। তাই তোমার বাবা পাঁচ তারিখে টাকা দেবার পরেও তোমার কাছে গচ্ছিত রেখে দিছিলাম।
– ওহ্হ আচ্ছা স্যার বুঝতে পারছি।
★★
জি.ই.সি মোড় থেকে “হানিফ এন্টারপ্রাইজ” এর টিকিট সংগ্রহ করে বাসায় যাচ্ছি, বাস ছাড়বে রাত আটটায়। আমার বাসা মুরাদপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে একটু ভিতরে, মা-বাবা আর ছোট দুটো ভাই বোন আছে। অবশ্য আমার আপন মা নয়, আমার মা মারা গেছে আমি তখন চার বছরের ছোট। তখন থেকেই সৎ মায়ের সংসারে মানুষ, বাবার দ্বিতীয় সংসারে এক ছেলে এক মেয়ে আছে। আমি চট্টগ্রাম ভার্সিটি থেকে অনার্স কমপ্লিট করে বর্তমানে চাকরির ব্যবস্থা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
আপাতত তিনটি টিউশনি আছে, আর দিনের বেলা এক পরিচিত বন্ধুর দোকানে ফ্লেক্সিলড, মেমোরি কার্ড লোড ইত্যাদি করে হেল্প করি। ওর সাথে সকাল আর দুপুরের খাবার হোটেলে খাই, রাতের বেলা শুধু সৎ মা’কে কষ্ট দিতে হয়। আমার সৎ মা আমাকে সেই রাতের একবেলা খাবার থেকে কীভাবে বঞ্চিত করবেন দিনরাত সেই প্রচেষ্টা করছেন। আশা করি তিনি খুব তাড়াতাড়ি সফল হবেন কারণ হুট করে একটা চাকরি হয়ে গেলে হারিয়ে যাবো তাদের চোখের আড়ালে।
যেই ছাত্রীর কাছ থেকে মাত্র আসলাম সে ক্লাস টেনে পড়ে, পড়াশোনায় মনোযোগী খুব তাই তেমন কষ্ট করতে হয় না। দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ, তবে এখনো কারো সাথে রিলেশনে জড়ায়নি, কিংবা হয়তো সে জড়িয়েছে আমি জানিনা। আমার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, মারিয়া বাদে বাকি দুটো টিউশনির দুটোই ছেলে মানে ছাত্র।
যার সাথে দেখে করতে যাবো তার নাম সানজিদা, আট মাস আগে তার সাথে আমার ফেসবুকে পরিচয় হয়েছে। দুই মাস ফ্রেন্ডশিপ তারপর সানজিদা নিজে আমাকে প্রপোজ করেছে। আমিও তার প্রতি দুর্বলতা অনুভব করেছি তাই হ্যাঁ বলে দিয়েছি। কিন্তু আমি আজও সানজিদাকে দেখিনি তবে সে আমাকে দেখে নিয়েছে অনেকবার। কারণ ফেসবুকে আমার অনেক ছবি পোস্ট করা আছে, কিন্তু সানজিদা কখনো ছবি দেয় নাই। আমিও কখনো জোর করিনি, নাম্বারে, ইমোতে, হোয়াটসঅ্যাপ এ প্রায় সবগুলোতে কথা হয়েছে আমাদের। কিন্তু কখনো দেখা হয়নি তাকে, তবে এবার আমি জোরপূর্বক তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আগামীকাল।
আসলে সত্যি বলতে, আমি আট মাসে তাকে যখন দেখি নাই তখন এসব নিয়ে আমার বন্ধুরা আমার সাথে উপহাস করে। তাদের দাবি হচ্ছে মেয়ে হয়তো দেখতে খুব কালো, কিংবা বয়স অনেক বেশি বা বিবাহিতা কোন মহিলা। ওদের কথা আমি কখনো গুরুত্ব দিতাম না কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ করে আমি নিজেই ভাবতাম যে কেন সানজিদা দেখা করতে চায় না? কেন সে তার কোন ছবি দিতে চায় না? আসলে কি তাহলে বন্ধুদের কথা সঠিক?
ইত্যাদি নানা কারণে আমারও কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে তবে সানজিদার প্রতি তীব্র ভালবাসা রয়েছে। এতটা ভালবেসে ফেলেছি যে সে যত কুৎসিত চেহারার হোক তবুও তাকেই চাই।
আগামীকাল দেখা করতে সানজিদা রাজি হতে চায় নাই, কিন্তু আমার জোরাজোরিতে সে আর না করতে পারে নাই। আমি রাতের গাড়িতে খুলনা যাবো, আর সেখানে গিয়ে রেস্ট নিয়ে তারপর আগামীকাল বিকেলে তার সাথে দেখা করার কথা রয়েছে। আমি ভার্সিটিতে পড়ার সময় খুলনার একটা বন্ধু ছিল আমার সাথে পড়তো, তার নাম রকি। রকি এখন খুলনাতে আছে, সেও আমার মতো আপাতত চাকরি খুঁজে দিন অতিবাহিত করে দিচ্ছে। তার সাথে কথা হয়েছে, খুলনা গিয়ে ওর বাসাতেই থাকবো, তারপর সেখান থেকেই দেখা করতে যাবো।
বাসায় গিয়ে নিজের সামান্য কাপড় ব্যাগের ভেতর নিয়ে গুছিয়ে প্রস্তুত হলাম। ছয়টা পার হয়ে গেছে তাই এখনই বেরিয়ে পরতে হবে, রাস্তায় সন্ধ্যা বেলা জ্যাম থাকে প্রচুর তাই আধা ঘণ্টা আগে টার্মিনালে গিয়ে অপেক্ষা করাই ভালো।
– বাসা থেকে বের হবার সময় মা বললো, কোথায় যাচ্ছ তুমি?
– আমি একটু খুলনা যাচ্ছি একটা জরুরি কাজ আছে, ফিরতে দু তিনদিন দেরি হবে।
– হঠাৎ করে খুলনা কেন?
– বললাম তো কাজ আছে।
– তা বাবার কাছ থেকে কত টাকা নেয়া হয়েছে?
– বাবার কাছ থেকে কোন টাকা নেই নাই, আমার টিউশনির টাকা দিয়ে যাচ্ছি।
– পাও তো মাস শেষে সামান্য কিছু টাকা, তা দিয়ে আবার বড়াই করা হচ্ছে? চাকরি বাকরি কিছু কি কপালে আছে নাকি এভাবে শুধু বসে বসে খাবে?
– জ্বি চেষ্টা করছি আমি।
– চেষ্টা চেষ্টা করে তো এতদিন গেল, পরনের কাপড় গুলো পর্যন্ত গন্ধে ভরা। বলি সবকিছু বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি একটা চাকরি নিয়ে বাবার সঙ্গে সংসার হাল ধরো। এভাবে ছেড়া কাপড় পরে আর কতকাল ঘুরে বেড়াবে?
– আপনার যদি সমস্যা হয় তাহলে আপনি কিছু নতুন কাপড় কিনে দিয়েন। এ কথা বলে আমি দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে গেলাম, কারণ এখন আস্তে আস্তে তার সাথে ঝগড়া বৃদ্ধি পাবে।
★★
বাস ছাড়তে এখনো বিশ মিনিট বাকি আছে, আমি মোবাইল বের করে সানজিদার কাছে কল দিলাম। তিনবার কল বেজে কেটে যাবার পর চতুর্থ বারে সে রিসিভ করলো। আমার মনের মধ্যে চঞ্চলতা বিরাজ করছে কারণ এতদিন পরে তার সাথে দেখা হবে। কতদিন ওর জন্য পাগলের মতো করেছি, আজও হঠাৎ করে তার কথা ভাবলে মনটা ভালো হয়ে যায়।
– হ্যালো, সজীব বলো।
– কি করো তুমি?
– একটু বিজি ছিলাম, তুমি কি করো?
– আমি তো বাসের জন্য অপেক্ষা করছি, আর বিশ মিনিট পর বাস ছাড়বে।
– তুমি সত্যি সত্যি আসবে?
– হ্যাঁ সত্যি সত্যি তো, কেন তুমি চাও না?
– না না চাইবো না কেন?
– তাহলে?
– আসলে হয়েছে কি জানো? মা-বাবা আমাকে তো খুব শাসন করে, তাদের ধারণা কালকে ভালবাসা দিবসে আমি যদি কারো সাথে ঘুরতে যাই? তাই বিকেলে বড় আপু এসেছে খুলনায়। আপু এখন আমার রুমে আছে আর আমি তোমাকে কল পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছি।
– তাহলে কি আগামীকাল দেখা হবে না?
– আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তোমার সাথে দেখা করার জন্য,।
– আচ্ছা ঠিক আছে সমস্যা নেই, তোমাকে বলেছি না আমার একটা বন্ধু আছে? আমি ওর বাসায় গিয়ে উঠবো। যতদিন তোমার সাথে দেখা না হবে ততদিনে আমি চট্টগ্রামে ফিরবো না। দরকার হলে কলেজের সামনে গিয়ে দেখে চলে আসবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আসো।
– রাতটা শুধু অপেক্ষা করো আমি আসছি।
★★
নির্দিষ্ট সময়ে বাস যাত্রা শুরু করেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গ্রান্ট ট্রাংক্ট রোড দিয়ে গাড়ি সো সো করে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি ফেনী, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা যাত্রাবাড়ী হয়ে মাওয়া ঘাটে যখন আসলো তখন রাত দুইটা বাজে।
ফেরির মধ্যে উঠে বাস থেকে বেরিয়ে গেলাম খুব চাপ এসেছে তাই চাপ কমাতে হবে। আমি বাথরুমের সামনে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ অবস্থা কারণ ৭/৮ জন মানুষ সিরিয়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার সম্মুখে যিনি দাঁড়িয়ে আছে তিনি একজন হুজুর, পাঞ্জাবি পাজামা পরিহিত ভদ্রলোক বারবার এদিক সেদিক তাকিয়ে উসখুস করছে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তার অবস্থা সিরিয়াস, কিন্তু ভিতরের ব্যক্তি বাহির হবার নাম গন্ধ নেই। আমি তার সামনে গিয়ে আস্তে করে আলাপ জমানোর চেষ্টা করছি কারণ যদি তার মাধ্যমে সিরিয়াল ছাড়া ঢুকতে পারি!
ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বললাম, ভাইজান দরজাটা জোরে একটু নাড়াচাড়া দেন ভিতরে ঢুকে মারা গেছে নাকি? এদিকে সবাই সিরিয়াস অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, সমস্যা কি ভিতরের?
ভদ্রলোক আমার দিকে রাগান্বিত অবস্থায় তাকিয়ে থেকে বললেন, ভদ্র ভাবে কথা বলুন ভিতরে কিন্তু আমার স্ত্রী। আপনি কার নামে কার কাছে কি বলেন বুঝতে পারছেন?
আমি হিরো হতে গিয়ে সম্পুর্ন জিরো হয়ে বেরিয়ে এলাম, মুখ দিয়ে টু শব্দ বের করলাম না। আমার চাপ কোথায় উধাও হয়ে গেছে বুঝতে পারছি না।
|
|
খুলনার সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে যখন নামলাম তখন বাজে সকাল সাড়ে ছয়টা। একটা রিক্সা নিয়ে রকির বাসায় রওনা দিলাম, রকি বলে দিয়েছে ‘জোড়াগেট’ বললেই যেকোনো রিক্সায় নিয়ে যাবে। নিউমার্কেট পেরিয়ে নাকি সামান্য সামনে গিয়ে নামতে হবে, তাই আমিও পঞ্চাশ টাকা দিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে রওনা দিলাম।
বাসায় গিয়ে সানজিদার সাথে কথা হয়েছে, তার কথা হচ্ছে সে সুযোগ পেলেই আমাকে কল করবে। আমি গোসল করে ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর জন্য বৃথা চেষ্টা করছি কিন্তু দুচোখের ঘুম নিরুদ্দেশ।
সারাদিন পেরিয়ে গেল, দুপুরের খাবার খেয়ে আমি আর রকি অনেকক্ষণ টিভি দেখলাম। তারপর রকি বললো, বইমেলায় যাবে। যেহেতু ফেব্রুয়ারী মাস আর তাছাড়া আজকে ভালবাসা দিবস তাই দুজন মিলে বের হলে ভালোই লাগবে।
সাড়ে চারটার দিকে হঠাৎ করে সানজিদা কল দিয়ে বললো, বয়রা খুলনা বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের সামনে বইমেলায় দেখা করতে। আমি তো খুশিতে একদম আত্মহারা হয়েছিলাম, রকিকে সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে পরলাম। জোরাগেট থেকে মাহিন্দ্রা করে আমরা গিয়ে বইমেলায় নামলাম। সানজিদার নাম্বারে কল দিয়ে দেখি নাম্বার বন্ধ, মনটা খারাপ হয়ে গেল। বারবার কল দিয়েও খোলা পেলাম না।
মন খারাপ করে রকি আর আমি আধা ঘণ্টার মতো হাঁটাহাঁটি করলাম আর একটু পর পর সানজিদার নাম্বারে কল দিচ্ছিলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ।
হঠাৎ করে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো, আমি কল রিসিভ করলাম কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে কোন কথা বলছে না। আমি কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে কল কেটে দিলাম, পিছনে গ্রন্থাগার থেকে কমিটির পক্ষ থেকে আয়োজন করা অনুষ্ঠান চলছে। একে একে মাইকে বক্তৃতা কিংবা কবিতা আবৃত্তি করছেন। আমি সবার পিছনে দাঁড়িয়ে একটা কবিতা আবৃত্তি শুনছিলাম হঠাৎ একটা মেয়ে পিছন থেকে বললোঃ-
– আপনার নাম সজীব?
আমি পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি সম্পুর্ণ সাদা ড্রেস পরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো হালকা বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, ঠোঁটে মিস্টি কালার এর লিপস্টিক, দুহাত ভর্তি চুড়ি, চোখে কাজল, কপালে ক্ষুদ্র কালো টিপ, দুধে আলতা বর্ণের চেহারা দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
– বললামঃ- জ্বি আমার নাম সজীব, আপনি?
– আমি সানজিদা।
– আমি সাথে সাথে বাচ্চাদের মতো একটা হাসি দিয়ে দিকশূন্য হয়ে সবার সামনে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। চারিদিকে অনেকে হয়তো তাকিয়ে আছে কিন্তু আমার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সানজিদা হয়তো কল্পনা করতে পারেনি যে আমি তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরবো।
– সানজিদা বললো, প্লিজ ছাড়ুন সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে অপরাধীর মতো তার দিকে মুগ্ধ নেত্রে তাকিয়ে আছি। আমি ঠিক যতটা কল্পনা করেছি তারচেয়ে অনেক অনেক সুন্দরী সানজিদা। এতদিনের সন্দেহ দূরীভূত হয়ে গেল।
আমরা দুজনেই অবাক হলাম কারণ স্টেজ থেকে মাইকে বলা হচ্ছে, পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা নীল শার্ট পরা ছেলে আর সাদা ড্রেস পরা মেয়েটা মঞ্চে আসুন তাড়াতাড়ি।
আমি সামান্য ভয় পেলাম, আমার সাথে রকি ছিল সে সামনে সামনে গেল। সবার সামনে রকি তারপর আমি তারপর সানজিদা হাঁটছে, উৎসুক জনতা সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রকি মঞ্চে গিয়ে আস্তে করে কি যেন বললো বোঝা যাচ্ছে না।
– মাইক্রোফোন হাতে থাকা লোকটা বললো, তুমি কি জানো একটু আগে তোমরা দুজন একটা অপরাধ করেছো?
– বললাম, জ্বি জানি আমি এবং সেজন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী এবং অনুতপ্ত।
– ক্ষমা করতে পারি কিন্তু তোমাকে একটা সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতে হবে। সবার কাছে যদি সেই কবিতা ভালো লাগে তাহলে তোমরা মাফ পাবে।
– বললাম, আমি যদি আমার নিজের লেখা একটা কবিতা আবৃত্তি করি তাহলে সমস্যা হবে?
– তোমার নিজের কবিতা লেখা আছে?
– জ্বি মাঝে মাঝে লিখি ডায়েরিতে।
– তাহলে তাই হোক।
আমার হাতে মাইক্রোফোন তুলে দেয়া হয়েছে, আমি একবার সানজিদার দিকে তাকিয়ে আবারও সামনে তাকালাম। ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি অনেকবার স্টেজে কবিতা আবৃত্তি করেছি তাই সাহস আছে। কিন্তু নতুন পরিবেশ নতুন শহর তাছাড়া আজকে সানজিদা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও নিজ হাতে লেখা প্রিয় একটা কবিতা আবৃত্তি করা আরম্ভ করলাম।
কবিতার নামঃ- এক ফাগুনের গল্প।
পেয়েছি তোমাকে আমি
অনেক সাধনার পরে।
হারাতে দেবো না কখনো আর
রাখবো বুকে ধরে।
না দেখেই বেসেছি ভালো
বেঁধেছি হাজার বাসা।
তোমায় নিয়ে হারিয়ে যাবো
অনেক দিনের আশা।
মনের কুটিরে অনেক কথা
বলবো সবই আজ।
পেরিয়ে যাবে গোধূলি বিকেল
ফুরিয়ে যাবে সাঝ।
ফাগুনের বসন্ত নেমেছে
কোকিল ডেকেছে ডালে।
মাঝরাতে আজ জোৎস্না দেখবো
পদ্মফুলের বিলে।
কবিতার ছন্দে ডাকছি তোমায়
সময় অনেক স্বল্প।
আজ দুজনে তৈরি করবো
এক ফাগুনের গল্প।
উপস্থিত অনেকে হাততালি দিচ্ছে, প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে কবিতা আবৃত্তি তাদের পছন্দ হয়নি। কিন্তু তাতে আমার কোন সমস্যা নেই কারণ আমার সাথে সানজিদা আছে, এবং তার সাথে আমার সত্যি সত্যি অনেক কথা জমা।
স্টেজ থেকে বেরিয়ে আমরা এদিকের বইয়ের দোকান গুলোর দিকে আসলাম। রকি বললো, সে আশেপাশে থাকবে, এবং কোন সমস্যা হলে আমি যেন তাকে কল করি। আমি আর সানজিদা তখন পাশাপাশি হাঁটছি, আমার মনে আনন্দ ধরে না কিন্তু সানজিদার মুখে কোন হাসি নেই। একরাশ বিষন্নতা তাকে ঘিরে রেখেছে মনে হয়, আমি তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বললামঃ-
– কিছু বলছো না যে?
– এমনি প্রথম দেখা তাই কেমন লাগছে, তবে একটা কথা না বললেই নয়। আপনি কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন খুব সুন্দর করে, সত্যি সত্যি আমার অনেক ভালো লেগেছে।
– একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
– করুন।
– তুমি তো মোবাইলে সবসময় আমাকে তুমি তুমি করে ডাকতে তাহলে এখন সামনাসামনি আপনি করে বলছো কেন?
– আসলে সরাসরি কথা বলতে কেমন যেন লাগছে তাই সমস্যা হচ্ছে, কিছু মনে করবেন না সবকিছু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
– না না কি মনে করবো? সত্যি বলতে তোমাকে দেখে আমি এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে গেছি যে আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এতদিন পরে যে তোমার সাথে এভাবে পাশাপাশি হাঁটছি সেটা বিশ্বাস করতে পারি না।
– আপনাকে তো আমি আগেই দেখেছি তাই নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে সত্যি সত্যি আপনি ছবির চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর, আগে জানলে অনেক আগে থেকে নিজে দেখা দিতাম।
– এখন থেকে সবসময় ভিডিও কলে কথা বলবে তো?
– আচ্ছা চেষ্টা করবো।
– তুমি মোবাইলে কথা বলার সময় কত চঞ্চল এবং দ্রুত আর রাগান্বিত হয়ে কথা বলতে কিন্তু এখন সম্পুর্ন আলাদা। সেই চঞ্চলতা নেই, রাগের কোন চিন্হ নেই, শান্তশিষ্ট ভাবে খুব গুছিয়ে আস্তে আস্তে কথা বলছো। তোমার এই পরিবর্তন আমাকে অবাক করে দিচ্ছে সানজিদা, সত্যি আমি মুগ্ধ। আমার ভালবাসা স্বার্থক হয়েছে, আমি ঠিক যেভাবে একটা মানুষ চেয়েছিলাম সেরকম একজন পেয়েছি।
– হাহাহা হাহাহা।
– তোমার হাসিটাও অনেক সুন্দর, কোই মোবাইলে তো এভাবে কখনো হাসতে শুনিনি?
– হয়েছে হয়েছে, এবার চলুন আপনাকে একটা বই উপহার দেবো। আমি আমার পছন্দের একটা বই উপহার দিতে চাই নিবেন আপনি?
– হ্যাঁ নেবো।
– হুমায়ুন আহমেদ এর “কোথাও কেউ নেই” এটা পড়েছেন আপনি?
– না পড়া হয়নি।
– ঠিক আছে তাহলে সেটাই দেবো।
সানজিদা আমাকে দিল “কোথাও কেউ নেই” আর আমি তাকে দিলাম বিভূতিভূষণের “আরণ্যক”। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, বইমেলা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে কারণ সানজিদা বাসায় চলে যাবে। আমি রকির কাছে কল দিলাম, রকি একটু পরে আমাদের সামনে হাজির হলো। আমরা সামান্য কিছু খাবার জন্য মেলার মধ্যে একটা চটপটির দোকানে গেলাম।
চটপটি অর্ডার করে তিনজনে টেবিলে বসে আছি, হঠাৎ করে দুটো মেয়ে সানজিদাকে ডাক দিল। কিন্তু কি নাম ধরে ডাকলো ঠিক বোঝা গেল না তবে সানজিদা বলে ডাকেনি সেটা নিশ্চিত। সানজিদা টেবিল থেকে উঠে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে কথা বলছে, আমি আর রকি বসে আছি। হঠাৎ করে টেবিলের পাশে রাখা সানজিদার ব্যাগের পাশে মোবাইল বেজে উঠলো। সানজিদা টেবিলে বসে মোবাইল আর হাতের ব্যাগ রেখে দিয়েছে।
দুইবার কল বেজে কেটে গেল, তৃতীয় বারে যখন কল এলো তখন আমি সানজিদার দিকে তাকালাম। তাই সানজিদা এখনো কথা বলছে, আমি মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে অবাক হলাম। কারণ স্ক্রিনের মধ্যে সানজিদার সঙ্গে আমি যে নাম্বার দিয়ে সর্বদা কথা বলতাম সেই নাম্বার থেকে কল এসেছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কল কেটে গেল আবারও। আবারও যখন কল এলো তখন আমি রিসিভ করে কানের কাছে নিলা, আর ওপাশ থেকে একটা মেয়ে বলছেঃ-
” কিরে কল রিসিভ করিসনা কেন? তুই এখন কোন যায়গা আছো? দেখা হয়েছে তার সাথে? ”
আমি কল কেটে দিয়ে মোবাইল রেখে দিলাম, মনে মনে এই রহস্যের সমাধান খুজতে লাগলাম কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। সানজিদা আসলো, সঙ্গে সঙ্গে চটপটি এলো, আমরা চুপচাপ খাওয়া আরম্ভ করলাম।
বইমেলার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সানজিদা এখন চলে যাবে। আমি তার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে দেখি তার চোখ ছলছল করছে, মনে হয় সেই চোখ অনেক কিছু বলতে চায়।
– বললাম, আগামীকাল কি দেখা হবে? আজকে তাড়াহুড়ো করে ফুল আনতে পারিনি, যদি সুযোগ দাও তাহলে আগামীকাল ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিতে চাই তোমাকে।
– সানজিদা বললো, আমাদের আর কখনো দেখা হবে না সজীব ভাই।
– আশ্চর্য হয়ে বললাম, মানে কি?
– আমাকে ক্ষমা করবেন প্লিজ, আমি সানজিদা না, আমি সানজিদার বান্ধবী এবং রুমমেইট। আমি আপনাকে শুরুতে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু যে আমি সানজিদার বান্ধবী। কিন্তু আপনার কাছে আমি সানজিদা বলার সাথে সাথে আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন তাই “আমি সানজিদার বান্ধবী” এই বাক্যের বান্ধবী শব্দটা আর উচ্চারণ করতে সুযোগ পাইনি।
– তাহলে সানজিদা কোথায়?
– ও আসবে না, আপনি কিছু মনে করবেন না ভাই। সানজিদা আপনার সাথে এতদিন এমনিতেই টাইম পাস করেছে। ও এমন আরো কয়েকজনের সঙ্গে রিলেশন করে, আপনার সাথে কথা বলতে আমি সবসময় দেখতাম। আপনার ছবি দেখাতো আমাকে, তাই আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি, তবুও কিন্তু শিওর হওয়ার জন্য কল করেছিলাম। সানজিদা আপনার সাথে দেখা করবে না, ওর ইচ্ছে ছিল যে আপনার সাথে কথা বলা সিমটা বন্ধ করে দেবে। কিন্তু আমি বললাম যে সবকিছু বলে তারপর সম্পর্ক ইতি করতে, তবে ও রাজি হলো না। তাই জানিনা কেন যেন নিজেই ওর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে আমি আপনাকে বলতে এসেছি। কিন্তু বলার আগেই আপনি আমাকে সানজিদা ভেবেছেন তাই এতক্ষণ ঘোরাঘুরি হলো। আপনি অনেক ভালো একটা মানুষ তাই আপনাকে বলছি, সানজিদাকে ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন আরম্ভ করুন।
চলবে….
এক_ফাগুনের_গল্প
পর্বঃ-০১
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)