#দেবী
লেখিকাঃ #Srotoswini_স্রোতস্বীনি (ছদ্মনাম)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
২০ঃ
বেশ হাসি খুশি ভাবেই কেটে যাচ্ছিলো কাকনের সংসার। কিন্তু বলে না সুখ বেশি দিন টিকে না। হয়তো রুহুল-কাকনের ভালোবাসায় ও কারো নজর লেগেছিল। দিন দিন যেন রুহুলের উপর কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছিলো। আগের তুলনায় কাকন কে সময় দিতে পারে না। প্রায় ই ঢাকা যেতে হয় এবং সেখানে ব্যবসার নানা কাজ করতে হয়।আর এদিকে কাকন সংসারের কাজ কর্ম করেই সময় কাটায়।
সিরাজপুরের নিচু ভুমি গুলো তে বন্যা হয়েছে। ঘাটে ঘাটে পানি আর এই পানির জন্যই ২ সপ্তাহ হলো রুহুল কাকন এর মহিলা শালায় যাওয়া বারন। কাকনের মন ভালো করার জন্য রুহুল কাকন কে মহিলাশালায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। নিজে না যেতে পারলেও সামিয়াকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। সামিয়ার ও মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে তাই সেও পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী হয়ে উঠেছে। আর কাকন সংসারের কাজ সামলায় আর রুহুলের অপেক্ষা করে।
গত সপ্তাহে রানুর বিয়ে হয়েছে লতিফের সাথে। মুলত লতিফ রুহুলের কাছে প্রস্তাব দেয় আর দুজন ই যেহেতু একই বাড়িতে কাজ করে তাই রুহুল বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। ঘরোয়া ভাবেই ওদের বিয়ে হয়।সব কিছু যেন গুছানো লাগে কাকনের কাছে। কোথাও কোনো কিছু অগোছালো নয়। তবে কাকন কাজ করে আর রানুর বৈবাহিক জীবনের নানা কার্যকলাপ শুনে হাসে। লতিফ একটু ঠাট্টা করলেই রানু ক্ষেপে লতিফ কে মারতে যায়। সেই সাথে লতিফের কাছেও যায় না। এসব নিয়ে বেশ হাসাহাসি করে সিরাজী মঞ্জিলের গৃহিণীরা। (লেখিকাঃ #Srotoswini_স্রোতস্বীনি)
কিন্তু সব কিছুর মাঝে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে বিলাল সিরাজীর। আজকাল তার চোখ বেয়ে শুধু পানিই পড়ে।তার ভিতরে বোধহয় অনেক কষ্ট, কিছু না বলতে পারা আক্ষেপ। রুহুল অনেক চিকিৎসা করিয়েছে কিন্তু ডাক্তার বলে দিয়েছে যে সব কিছু এখন আল্লাহ তায়লার হাতে। সবাই তাই বিলাল সিরাজীর বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছে। লেখিকা স্রোতস্বীনি। কিন্তু রুহুল হার মানে না। প্রত্যেক সপ্তাহে শহর থেকে গাড়ি দিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসে।আর ডাক্তারের পরামর্শ মতো সুভা আর কাকন মিলেই বিলাল সিরাজীর সকল কাজ করে।
আজকেও কাকন রন্ধনশালার কাজ সেড়ে বিলাল সিরাজী কে সুভার সাথে খাওয়াতে গেছে। খাওয়ানো শেষে কাকন জিজ্ঞেস করলো, “আম্মা, আব্বাকে কি আগে আপনি একাই খাওয়াতেন?”
সুভা ছোট করে উত্তর দিলো,”হুম”
–“কেন বাড়ির আর সদস্য রা কেন কাজ করে না”
–“খোকার নিষেধ তার আব্বাজানের কাছে আমি ব্যতীত কেউ আসতে পারবে না। গোসল করানো আর ভারী কাজের সময় মালেকা সাহায্য করতে পারবে ”
–“কিন্তু কেন সবাই তো নিজেদের লোক। নিজের রক্ত,নিজের আপনজন”
–” আপন বললেই তো সবাই আপন হয় না। আত্মার সাথে আত্মার বন্ধুত্ব যাদের তারাই প্রকৃত আপন”
–“কিন্তু উনি এমন করেন কেন আম্মা। আপনি, দাদাজান, দাদিমা আর আমি ছাড়া বাড়ির সবাইকে কেবল আব্বাকে দূর থেকে একপলক দেখার অনুমতি দিয়েছেন। এটা তো ঠিক না আম্মা”
সুভা কাকনের চোখে চোখ রেখে বললো,”আমার খোকা কখনো ভুল কাজ করে না কাকন। তোমার আব্বা কে কোনো জিন বা ভুত আহত করে নি বরং মানুষ তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে উনি আজ এখানে। তবে রুহুল ওর বাবার মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছে ওর বাবার এই অবস্থা যে করেছে রুহুল তাকে নিজ হাতে হত্যা করবে। ”
হত্যার কথা শুনে কাকন ভয় পেলো। তার স্বামী কাউকে হত্যা করবে একজন স্ত্রী হয়ে কিভাবে মেনে নেবে।কাকন বললো, “কিহ উনি হত্যা করবেন?”
কাকনের অবস্থা সুভা বুঝতে পারলো তাই বললো, “ভয় নেই আমার খোকা আর যাই করুক হত্যা করবে না। কিন্তু শাস্তি ঠিকই দেবে আসলে ওর বাবার ভীষণ আদরের ছিল খোকা। ”
কাকন বিলাল সিরাজীর দিকে চেয়ে বললো, ” নিজের বাবার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি অবশ্যই দেওয়া উচিত। তবে আজ আমি ওনাকে বলবো পরিবারের সবাই কে আব্বার কাছে আসতে দিতে দেখবেন আব্বা ও খুশিই হবে।”(লেখিকাঃ #Srotoswini_স্রোতস্বীনি)
সুভা কাকন কে বললো,” একটা কথা কি জানো পর কখনো শত্রু হয় না, শত্রু আপন মানুষ ই হয় বুঝলে মা। এই জন্যই আমার খোকা এক কক্ষে সচারাচর কারো আসা নিষেধ করে দিয়েছে । ”
–“কিন্তু ছোটাম্মা চাইলেও তো আসতে পারে উনি কেন আব্বার কাছে আসে না। ওনার ও তো স্বামী”
–” মালেকা স্ত্রী হলেও স্বামীর দুঃসময়ে থাকার মতো নয়। আর থাকবেই বা কেন স্বামী হিসেবে সে তো মালেকা কে ভালোই বাসে নি ”
–“আপনাকে বোধহয় অনেক ভালোবাসতো তাই না”
সুভা বিলালের দিকে চেয়ে থেকে বললো, “হ্যাঁ একসময় অনেক ভালোবাসতো আমায়। এক দিন না দেখলে তার নাকি রাতে ঘুম ই হতো না।”
–“হ্যাঁ আমি বুঝেছি আপনিও বাবা কে এইজন্যই
এত ভালোবাসেন। আপনার সেবা যত্নেই প্রমানিত আপনিও আব্বাকে অনেক ভালো বাসতেন। ”
তারপর কাকন আবার মাথা নিচু করে বললো, ” উনিও বোধহয় আব্বার মতোই হয়েছে তাই না আম্মা ”
সুভা কাকনের পানে চেয়ে বললো, “না আমার খোকা তার আব্বার মতো হয় নি । সে তার আম্মার মতো হয়েছে। সে আমার মতো নিজের জীবনসঙ্গীকে বিনা স্বার্থে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। ”
কাকন কিছু টা অবাক হলো। তার এখন মনে হচ্ছে বিলাল সিরাজী সুভাকেও ভালোবাসতো না।তাহলে কি বিলাল সিরাজী তার কোনো স্ত্রী কেই ভালোবাসতো না।
কাকন শাশুড়ির হাত ধরে বললো, “আব্বা কি আপনাকেও ভালোবাসতো না আম্মা?”
সুভা সাধারণ ভাবেই বললো, “বললাম তো ভালো বাসতো। সে বাদ দেও আমায় কথা দাও দুনিয়ার সবাই আমার খোকা কে ছেড়ে গেলেও তুমি কোনোদিন ছেড়ে যাবে না। জানো আমার ছেলেটা এখন হাসে। অনেক হাসিখুশি থাকে। গত দেড় বছর যাবৎ একেবারে মন মরা হয়ে থেকেছে। ও ওর আব্বার কলিজা ছিল। ওর আব্বার এই অবস্থা ওর সহ্য হয় নাই দেখে বিদেশ চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই দুলাল সিরাজী খুব চালাক। নিজের বংশ রক্ষার জন্য জন্য সব করতে পারে। আর রুহুল এ বংশ রক্ষার্থের জন্য যোগ্য সন্তান। এই যে তোমাকে সে ঘরের বধু করে নিয়ে এসেছে সেটা কেবল বদনামের জন্য নয় বরং রুহুল কে সিরাজপুর আটকে রাখার জন্য ও। কারণ তোমার মতো রূপবতী এই সিরাজপুরে আর নাই। আর এখন তো রুহুল তোমায় ভালোবাসে। সিরাজপুর ছেড়ে আরো কোথাও যাবে না। এই সিরাজী মঞ্জিলে মানুষের চেয়ে বড় মনে করা হয় মান-সম্মান কে।সব অসতের মাঝে আমার খোকা সৎ।”
সুভার কথা গুলো কাকন প্রায় স্তব্ধ। সুভার মনে যে এই সিরাজী মঞ্জিলে নিয়ে ক্ষোভ সে তা উপলব্ধি করতে পারলো।সেই সাথে সুভার ভিতরে যে কষ্ট আছে তা কল্পনাও করতে পারে নি। আসলে বাস্তবতা বোধহয় এমন ই হাসির আড়ালেই লুকিয়ে থাকে হাজারো মানুষের কান্না। আর মিথ্যের আড়ালে থাকে সত্যতা।
(লেখিকাঃ #Srotoswini_স্রোতস্বীনি)
________________
বৈশাখ পেরিয়ে আষাঢ়ের আগমন হয়েছে তিনসপ্তাহের বেশি। রোজ ই কম বেশি বৃষ্টি হয়। আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হচ্ছে, আর এ বৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করবে না এমন মানুষ বোধহয় খুব কম ই আছে। আজ ও রাতে তাড়াতাড়ি রুহুল আসছে না। কাকন ঘড়ির কাটা দেখলো রাত ১১ টার বেশি। এদিকে বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। কক্ষের সকল জানালা বন্ধ। কেবল বাড়ান্দার দরজায় দাড়িয়ে আছে কাকন।
খোলা বাড়ান্দায় পড়া প্রতিটি বৃষ্টির ফোটা দেখছে কাকন। খুব ইচ্ছে করছে বৃষ্টিতে ভিজতে। ছোট বেলায় কত ভিজেছে বৃষ্টিতে। আর এই বৃষ্টিতে ভেজার জন্যই মা কতই না মে’রেছে। একবার তো খুন্তি নিয়ে পুরো বাড়ি ছুটেছিল। বাবা বাড়িতে ছিল বলে রক্ষে হয়েছিল। কাকনের সকল আবদার যে তার বাবাই পুরণ করতো। সর্বদা বলতো আমার মা এর আবদার সবার আগে, যা চাইবে তাই পাবে। কাকন বলতো বাবা আমি যদি বলি আমাকে আকাশ থেকে তারা এনে দাও দিতে পারবে।বাবা বলতো তুই আগে বড় হ মা তোকে তারার রাজ্যে বিয়ে দেবো। সেখানে তুই যতখুশি তারা নিয়ে খেলতে পারবি। কাকন মুখ গোমড়া করে বলতো আমি বিয়ে করতে চাই না বাবা। আজীবন তোমার কাছে থাকতে চাই। আমাকে বিয়ে দিলে আমি খুব কাদবো খুব।তারপর বাবা বলতো, “বেশ আমার মা কে বিয়ে দেবো না।খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরতো কাকন। সারাবাড়ি নেচে বেড়াতো। অথচ সেই দুষ্ট, চঞ্চল কাকন আজ এত শান্তশিষ্ট। সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে প্রানোচ্ছল সত্তা।
যেদিন কাকন বাবা-মাকে হারিয়ে ছিল সেই দিন ও তো বৃষ্টি হয়েছিল আর আজ ও বৃষ্টি হচ্ছে। পার্থক্য শুধু এটাই, সেদিন ছিল ভয়াবহ দুর্বিক্ষ আর আজ শান্তির বৃষ্টি। কাকন কে আর একটা বার পৃথিবী সুযোগ দিলে সে বোধহয় নিজের বাবা মাকে নিয়ে আরেকটা বার চাইতো।
জোরে নিশ্বাস ফেললো কাকন। তার কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। কাকন নিরবে হেটে বাড়ান্দায় গেলো। আজ হঠাৎ করে আবার তার শুন্য অনুভব হচ্ছে। কাকন আনমনে কক্ষ থেকে বাড়ান্দায় চলে এলো। বৃষ্টির প্রত্যেক টা ফোটা তার শরীরে যেন লোম কুপ ভেদ করে শরীরে প্রবেশ করছে এমন অনুভব হচ্ছে। কাকন দুই হাত মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টিবিলাশ করতে লাগলো। বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় হৃদয়ের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। ধীরে ধীরে অস্থির চিত্তে শান্তি অনুভব করলো। বেশ অনেকক্ষণ এভাবেই দাড়য়ে রইলো বৃষ্টিতে নিজের সুখ খুজে নিতে।
রাত প্রায় ১২ টা ছুই ছুই। আমলাপাড়ায় গিয়েছিল রুহুল।বৃষ্টিতে পথে পানিতে টইটম্বুর। সিরাজপুরর আসতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে।ছাতা থাকা সত্ত্বেও ভিজে গেছে। তবুও এই ঝড়ের রাতে বিবিজান কে একা রাখা তার পক্ষে সম্ভব না। তার বিবিজান যে বড্ড ভীতু স্বভাবের। যদি একা থাকতে ভয় পায়। তাই রুহুল ভিজতে ভিজতেই চলে এলো সিরাজী মঞ্জিলে। সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। প্রহরী রা দরজা খুলে দিলো। রুহুল সন্তর্পণে অন্দরমহলে ঢুকলো।তার উদ্দেশ্য বিবিজানের ঘুম না ভাঙিয়েই বুকে জড়িয়ে ঘুমানো। এমন সুন্দর রাতে বিবিজান কে বুকে নিয়ে ঘুমালে ঘুম বেশ ভালো হবে তার।
(লেখিকাঃ #Srotoswini_স্রোতস্বীনি)
রুহুল কক্ষে প্রবেশ করলো। কিন্তু কক্ষে কাকন কে না দেখে ভাবল সামিয়ার কক্ষে হয়তো। কিন্তু বাড়ান্দায় উকি দিয়েই যেন থমকে যায়। ঘরের আলোতে কাকন কে আবছা দেখা যাচ্ছে।পিছন থেকে এমন অবস্থায় কাকন কে যেন আবেদনময়ী লাগছে। রুহুল নিজের বিবিজান কে এমন অবস্থায় দেখে পাগলপ্রায়।
কাকন বৃষ্টির মাঝে ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে খোপা হালকা খুলে ঢিলে হয়ে গেছে। খোপা কিছুটা নিচে নেমে এসেছে। হালকা গোলাপি রঙের সুতি শাড়ি ভিজে শরীরের প্রতিটি ভাজ দৃশ্যমান।
রুহুল নিজের সামনে থাকা চুলো গুলো হাতের সাহায্যে সরিয়ে নিলো। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো কাকনের দিকে। পিছন থেকে কাকনের কোমড়ে হাত রাখলো। কাকন হঠাৎ কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পাওয়া মাত্রই কেপে উঠলো।লেখিকা স্রোতস্বীনি। কাকন রুহুলের দিকে ফিরে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। কাকন বোধহয় রুহুল কে এখন আশা করে নি। কিন্তু রুহুল যেন ঘোরে চলে গেছে সে আজ ধরণীর কোনো বাধা মানবে না। রুহুল এগিয়ে গিয়ে কাকনকে নিজের নিকটে নিয়ে এলো। বাম হাত দিয়ে কাকনের কোমড় ধরে রাখলো।আর ডান হাত দিয়ে কাকনের থুতনি উচু করে ললাটে অধর ছুয়ালো। তারপর পরম আবেশে নিজের বক্ষে জড়িয়ে পাজাকোলে তুলে কক্ষে নিয়ে গেলো ভালবাসার অর্ধাঙ্গিনী কাকন কে।
বোধহয় এই রাতেই পৃথিবীর বুকে আষাঢ় মাসে বিরহের সর্বনাশ ঘটেছিল আর রুহুল কাকনের পবিত্রবন্ধনের প্রণয়লীলা শুরু হয়েছিল।
চলবে….
#দেবী
#Srotoswini_স্রোতস্বীনি
বিদ্রঃ দয়া করে কেউ কপি করবেন না। ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ।
®️ Srotoswini-স্রোতস্বীনি ✍️