#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_শেষ
✍️ খাদিজা আক্তার (Diza)
আদী ঘৃণায় আর কথা বাড়াতে পারল না। ওকে আচমকা থেমে যেতে দেখে সাজ্জাদ এবার বলতে শুরু করল,
—এরপর পালা করে দুই ডাক্তার যথাক্রমে রফিক আর সাইফুল ভোগ করত আর সঙ্গী হতো জহির। জীবিত অবস্থায় জহির ভোগ করত আর মৃত লা””শকে ভোগ করত সাইফুল। এদিকে রফিকের এসবে নেশা নেই। সে মানুষের মগজ খেতে ভালোবাসত। ফলে তিনজনে চুক্তি করে এসব কাজ করত৷ এদের তিনজনের কীভাবে সাক্ষাৎ হলো সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এদের রহস্য উদঘাটন করা সহজ হতো না যদি ইব্রাহিম সাহায্য করত।
ইব্রাহিমের নাম শুনে চমকে তাকাল রাত্রি। তার চোখে অবিশ্বাসের ছায়া দেখে সাজ্জাদ মাথা নাড়িয়ে বলল,
—হ্যাঁ, ইব্রাহিমের সাহায্যে আমরা এদের ধরতে পেরেছি। ইব্রাহিমের শিক্ষক ছিল রফিক। ছাত্র অবস্থায় স্যারকে সন্দেহ করার কারণে ওকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়েছিল। এমনকি ডাক্তার হিসাবে যখন হাসপাতালে যোগ দিলো, তখন নিজের প্রেমিকাকে তাদের হাতে বলী হতে দেখল।
এমন করুণ কাহিনি শুনে রাত্রির মন যেন নিজের অজান্তেই কেঁদে ওঠল। এ প্রথম রাত্রি ইব্রাহিমের দিকে মায়ার দৃষ্টি দিলো। ইব্রাহিম মুগ্ধ হয়ে সে দৃষ্টি নিজের অন্তরে সঁপে নিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। এদিকে সাজ্জাদ বলে গেল,
—ছন্দার সাথে ইব্রাহিমের পরিচয় হয় কলেজ জীবনে। একে অপরকে কবে ভালোবাসতে শুরু করে তা তারাও জানত না। তবে ইব্রাহিমকে ডাক্তার হিসাবে দেখার জন্য মেয়েটি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিল। কিন্তু ভাগ্য মেয়েটির সাথে কেমন প্রতারণা করল। মৃত্যু আগে এবং পরে তাকে…
—সাজ্জাদ স্যার, ওর কথা আর নাই বা বললেন। আশা করি সব শোনার পর রাত্রি আর আমাকে ঘৃণা করবে না। আমি ছন্দাকে আজও ভালোবাসি। তাই অন্য মেয়েকে বউ করতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু এ কথা আমার বাপকে বোঝাতে পারিনি। ব্যর্থ হয়ে এ পথ অবলম্বন করেছিলাম। জানি এমন নোংরা পথ বেছে নিয়ে আমিও ছোটো মনের পরিচয় দিয়েছি। কিন্তু এতদিনে যে শাস্তি আমি তাদের দিতে পারিনি। আজ তারা তা পাচ্ছে বলে আমার বুকের ওপর থেকে সমস্ত বোঝা হালকা হয়ে গেছে। ছন্দার সাথে এমন হওয়ার পর আমি সবটুকুই জেনে ফেলেছিলাম, কিন্তু তারা বলেছিল পুলিশের কাছে মুখ খুললে ছন্দার লা””শ আমার হাতে দিবে না৷ তাই আমি বিবেক বিক্রি করেছিলাম তাদের কাছে। আমার বিবেকের বিনিময়ে তারা ছন্দার লা””শ তুলে দিয়েছিল আর আমি সেখান থেকে চলে এসেছিলাম। পত্রিকায় একের পর এক ঘটনা দেখেও চুপ করেছিলাম। কিন্তু জহির শেষ যে মেয়েটির সাথে কাণ্ড করল সেটি আমি আর নিতে পারিনি। তাছাড়া স্বর্ণালির ব্যাপারে জেনেও ভাবলাম, ছন্দা তো এখন আর নেই। আমার হারানোর মতোও কিছু নেই। তাহলে চুপ করে থেকে আর কী হবে? এরপর সাজ্জাদ স্যারের সাথে দেখা করে সব বলি। তার সাথে দেখা করে ফেরার পথেই আদীর সাথে দেখা হয় আর আদী…
আদী এতক্ষণ চুপ ছিল এবার ইব্রাহিমের মুখ থেকে কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল,
—ভুল বুঝে মারপিট করি এবং আপনাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি। আসলে রাত্রির হঠাৎ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া আবার সে চিঠি…
—কিন্তু তোমার তো আইসিইউতে থাকার কথা।
হঠাৎ রাত্রির এমন কথায় আদী ভড়কে গেল আর ইব্রাহিম হালকা হেসে বলল,
—নিন আদী। এবার ধানিলঙ্কাকে সামলান। আমি আর সাজ্জাদ স্যার বরং আসি৷
এ বলে ইব্রাহিম সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
—চলুন।
—আদী, ধরে রাখিস।
সাজ্জাদ আদীর কাঁধে হাত রেখে রাত্রিকে ইঙ্গিত করে কথাগুলো বলল। এরপর ইব্রাহিমকে নিয়ে রুম ছেড়ে দিলো। ইব্রাহিম রুম ছাড়ার আগে রাত্রিকে মন ভরে একবার দেখে নিলো; দেখো নিলো এমন এক রমণীকে যে কিনা তার থমকে যাওয়া বুকে ক্ষণিকের জন্য তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।
—কী হয়েছিল তোমার? আর এসব কী?
সবাই চলে যেতে রাত্রি আবার প্রশ্ন করল। আদী অপরাধী মুখ করে মিটমিট হাসছে আর ধীরে ধীরে রাত্রির ডান হাত দুই হাতে চেপে ধরে বুকের বাঁ পাশে রেখে দিলো। এরপর গাঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করল,
—কিছু অনুভব করছ?
—তোমার হৃৎস্পন্দন।
বিনা প্রতিক্রিয়ায় রাত্রি উত্তর দিয়েছে বলে আদী সন্তুষ্ট হতে পারল না। ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
—তুমি চলে যাওয়ার পর এখানে বড়ো ব্যথা হতো। ব্যথায় রাতে ঘুম হতো না। প্রতি মুহূর্তে তোমাকে হারানোর বেদনায় আমি জিন্দা লা””শ হয়ে দিনাতিপাত করতাম। এমন করে চলে গেলে যে তোমাকে খুঁজে বের করার পথও আমি…
আদী থেমে গেল। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে যখন আবার বলতে চাইল, তখন রাত্রি বলল,
—তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না।
—বাসি না কে বলল?
—তুমি বলেছ, বুশরা বলেছে আর…
—আর?
—আর আমার মন বলেছে।
—তোমার মন ভুল বলেছে রাত্রি। এই শোনো না, আজ না তোমাকে সব বলব। তুমি কি শুনবে?
হঠাৎ আদী কেমন বাচ্চাদের সুরে কথা বলে ওঠল৷ এতে রাত্রি হালকা হেসে ওঠলেও মিষ্টি স্বরে জবাব দিলো,
—শুনব।
—আমি হয়তো ছোট্টবেলা থেকেই তোমাকে ভালোবাসি। তবে ছোট্টবেলায় তো এসবের মানেই জানতাম না। কিন্তু স্কুল কলেজ পেরিয়ে এসে কিছু কিছু বুঝতাম। যখন ইউনিভার্সিটি শেষ হলো, তখনো তোমাকে মনের কথা জানাইনি। আমি তোমার আব্বাকে জানাই আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং বিয়ে করতে চাই। তিনি হালকা রাজি ছিলেন, কিন্তু তার ছোটো ভাই এ বিষয়ে দ্বিমত করল আর বলল, গুণ্ডার হাতে মেয়ে তুলে দিবে। ব্যাস! তোমার জীবন থেকে সরে যেতে লাগলাম। কিন্তু যাকে ভালোবাসি তাকে কি আর বন্ধু করে রাখা যায়? তাই তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করতে শুরু করলাম যেন তুমি আমাকে ঘৃণা করো। কিন্তু তুমি তো উলটো আমাকে ভালোবেসে ফেললে।
এ বলে আদী হেসে ওঠল আর রাত্রি লজ্জায় যেন গুটিয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে রাখা রাত্রি হাত এবার ধীরে ধীরে মুখের সামনে এনে আদী জিজ্ঞাসা করল,
—রাত্রি, আজ যদি তোমার হাতের উলটো পিঠে প্রেম এঁকে দিই। তবে কি আপত্তি করবে?
রাত্রি জবাব দিলো না। লজ্জা মাখা বদনে নিঃশব্দে হেসে ওঠল৷ এ হাসিতে আপত্তি নেই তা আদী বুঝতে পারল। কিন্তু চট করে কিছু করার দুঃসাহস তার হলো না। হঠাৎ কালকে রাতের কথা মনে পড়তেই বলল,
—কালকে তোমার মেসেজ পেয়ে এত কষ্ট লাগল মনে যে সইতে পারিনি। এদিকে অনিয়ম করে প্রেশারের যাচ্ছেতাই অবস্থা। প্রেশার অনেক বেড়েছিল আর কালকে রাতে হঠাৎ সাজ্জাদ আমার বাসায় গেল। এসব অবস্থা দেখে ও নিজেই ইব্রাহিমের সাথে এসব পরিকল্পনা করল। তোমাকে খুঁজে বের করার চেয়ে তুমি যদি ছুটে আসো তাহলে ভালো হয় না?
প্রশ্ন করে আদী তাকাল রাত্রির দিকে। এদিকে রাত্রি এসব শুনে রেগে আছে। বাঁকা চাহনিতে সে জিজ্ঞাসা করল,
—এমন দুইনম্বরি কাজ তুমি করতে পারলে?
—আমি তো কিচ্ছু করিনি গো। আর এসব যদি না করতাম তবে তোমাকে কি পেতাম?
—আবার যে আষাঢ়ি পূর্ণিমা হবো না সেটি কেন ভাবছ?
—এবার আষাঢ়ি পূর্ণিমা হতে দিবো না আর যদি হতেও চাও তাহলে আমায় নিয়ে হবে। তোমার বাপ চাচাকেও সাজ্জাদ পটিয়ে ফেলেছে। সামনের সপ্তাহে বিয়ে আর…
হঠাৎ আদীকে থামিয়ে রাত্রি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল,
—আমাকে কখনো কেন বললে না তোমার মনে কথা? সরাসরি আব্বাকেই কেন জানালে? আমি যদি না বলতাম তবে কী…
—তোমার আমার সম্পর্কে আমি কখনো চাইনি ত্রিকোণমিতির ছোঁয়া লাগুল, চাইনি সম্পাদ্য আর উপপাদ্যের ন্যায় মেপে ঝেঁপে সম্পর্কের স্থায়ীত্ব আঁকতে, আমি সত্যিই চাইনি আমাদের অনুভূতিগুলোর পরিসংখ্যান করতে, চাইনি বীজগণিতের মতো বারংবার আমার অব্যক্ত অনুভূতি তোমার সম্মুখে প্রমাণ করতে। আমি তো চেয়েছিলাম সরল বাংলায় তোমার জীবনের সাথে মিশে যেতে; একাকার হতে কিংবা তোমার তরে মরে যেতে।
একটু থেমে আদী আবার বলল,
—রাত্রি, আমি তোমায় ভালোবেসে আষাঢ়ি পূর্ণিমা হতে চাই। সম্মতি দিবে?
শান্ত স্বভাবের রাত্রি আজও শান্ত রইল তার ভালোবাসার মানুষের সম্মুখে। তবে লজ্জায় রক্তিম মুখ নিয়ে বসে থাকা যে দায়। তাই সমস্ত লজ্জা পুঁজি করে জায়গা নিলো সে মানুষের বুকে, যে তার কথার জাদুতে ঘায়েল করছে অবিরত।
মনের আকাশে আষাঢ়ের ঘনঘটায় আজ ভেসে উঠল পূর্ণিমার একফালি চাঁদ। কত সহস্র আশঙ্কার ভিড়ে প্রেমের জয় হলো। জিতে গেল দু’টি মনের অব্যক্ত আর নিশ্চুপ ভালোবাসা।
(সমাপ্ত)