#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৯
✍️ খাদিজা আক্তার (Diza)
ঘুম ভাঙতেই ফোন হাতে নিলো রাত্রি। আগের সীমকার্ড বদলে সে নতুন সীমকার্ড নিয়েছে। এ নম্বর আপাতত শর্মি ছাড়া কেউ জানে না৷ তবে গতকাল রাতে আদীকে মেসেজ পাঠিয়েছিল। মেসেজ পাঠিয়ে রাত্রি জেগেছিল, রাত দু’টো অব্দি। কিন্তু আদী কোনো জবাব দেয়নি। খুব কান্না পেয়েছিল। তবে সে নিজের মনকে শক্ত করে বুঝিয়েছিল,
—কেউ ভালোবাসতে না চাইলে তাকে জোর করা যায় না।
ফোনের স্ক্রিন ওপেন করতেই রাত্রি দেখতে পেল শর্মির নম্বর থেকে অনেকগুলো কল এসেছে। এত কল করার তো কথা নয়। তাই রাত্রি অবাক হলো এবং প্রায় সাথে সাথে শর্মিকে কল করল,
—কী হয়েছে? এত কল করলি কেন?
—কোথায় ছিলি তুই? আমি তোকে…
—আরে এত উত্তেজিত কেন হচ্ছিস? আমি তো বোডিঙেই ছিলাম। আসলে কালকে রাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়েছে। তাই ঘুমানোর আগে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম যেন সাতসকালে ফোন আমাকে তুলে না দেয়।
—রাত্রি থাম প্লিজ। ওদিকে যে কী অঘটন ঘটেছে সে খবর কি তোর আছে? তুই এক্ষুনি স্কয়ার হসপিটালে যা।
—হসপিটালে যাব মানে?
হতভম্ব হয়ে গেল রাত্রি। শর্মির অবস্থাও বেশ করুণ মনে হচ্ছে। ফলে রাত্রির মনে অজানা ভয় কাজ করছে।
—আদী… আদী…
—আদী! কী হয়েছে আদীর?
—গতকাল রাতে আদী স্টোক করেছে। তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে; আইসিইউ আছে। ডাক্তার জানিয়েছে অবস্থা ভালো নয়। তুই প্লিজ নিজেকে শক্ত কর আর এক্ষুনি হসপিটালে যা। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
স্তব্ধ হয়ে গেল রাত্রি। নিজের কানকে সে বিশ্বাসই করাতে পারছে না। এমন খবর শুনে কী রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে হয় তাও রাত্রি বুঝতে পারছে না।
—রাত্রি? নিজেকে শক্ত কর। ভেঙে পড়িস না।
শর্মি বলেই যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কথাই রাত্রির কানে যাচ্ছে না। নিস্তেজ হওয়া শরীর যেন আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। ফলে রাত্রির হাত থেকে ফোন পড়ে গেল আর সে নিজেও দুম করে মেজেতে বসে পড়ল। দুই হাতে মুখ ঢেকে রাত্রি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল আর একটিই শব্দই উচ্চারণ করল,
—আদী!
*
বাস থেকে নেমে রিকশা নিলো রাত্রি। বাড়ি ছেড়ে সে তার ইউনিভার্সিটির পাশেই একটি বোডিঙে সিট নিয়েছিল। বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি ছিল এক ঘণ্টার পথ। বাসে আসাযাওয়া করার অভ্যাস তার আগে থেকেই ছিল। কিন্তু আজকে স্কয়ার হসপিটালে আসতে গিয়ে সে অনুভব করল যেন পথঘাট তার কিচ্ছু চেনা না।
এখন দ্বিপ্রহর চলছে। মাথার ওপর কড়কড়ে রোদ। কিন্তু এসব নিয়ে তো আর চিন্তা করার সময় নেই। অন্তর জ্বলছে অবিরাম। রাত্রি বিশ্বাসই করতে না পারলেও সে জানে আদী নিজের প্রতি কতটুকু অবহেলা করে। ব্লাডপ্রেশারের রোগী হয়েও আদী নিজের প্রতি খেয়াল রাখেনি। এমন অযত্নে একটি অঘটন হওয়া আর কী এমন বড়ো ব্যাপার? কিন্তু কালকে রাতেই কেন এসব হলো? তাহলে কি রাত্রির মেসেজ আদীর এ অবস্থার জন্য দায়ী? এমন চিন্তা মাথায় আসতেই রাত্রি পাগলপ্রায় হয়ে পড়ছে।
বুকের ভেতর সাগর সমান দুঃখজল নিয়ে রাত্রি ছুটছে আদীর কাছে। রাত্রি জানে না আদী কোথায় আছে অর্থাৎ কত নম্বর রুমে তাকে পাওয়া যাবে। এখানে আসার আগে রাত্রি একবার ভেবেছিল,
—বাসায় ফোন করে কি জেনে নিবো?
কিন্তু সাথে সাথে এ চিন্তা বাদ দিয়ে শর্মিকে বলেছে আদীর সম্পূর্ণ তথ্য যোগাড় করতে। শর্মি বলেছে,
—তুই আগে হসপিটালে পৌঁছে যায়। আমি এর মধ্যেই তোকে সব টেক্সট করে দিবো।
—ঠিক আছে।
রাত্রি ছুটতে ছুটতে থেমে গেল। অবাক আর রাগ এ মূহুর্তে তাকে ঘিরে ধরল। কারণ সাদা কোর্ট পরে ইব্রাহিম দাঁড়িয়ে আছে তারই চোখের সামনে। রাত্রি ভুলেই গিয়েছিল যে কিছু দিন আগে ইব্রাহিম পাকাপাকি ভাবে স্কয়ার হসপিটালের ডক্টর হিসাবে নিয়োগ পেয়েছে। রাত্রি অবশ্য এ তথ্য জেনে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি, কিন্তু ইব্রাহিমের মুখোমুখি হয়ে তার সমস্ত শরীরে অদৃশ্য কাটা যেন ফুটছে অতিরিক্ত রাগে।
ইব্রাহিমকে পাশ কাটিয়ে রাত্রি চলে যেতে চাইল। কিন্তু ইব্রাহিম রাত্রির পথ আটকে বলল,
—তোমার সাথে আমার কথা আছে।
—আমার কারো সাথে কোনো কথা নেই।
—তোমার কথা শুনতে চাইছে কে? কিন্তু আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে।
রাত্রি তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইব্রাহিমের দিকে। তার চোখে জল টলমল করছে। কেঁদেকুটে ভারী হওয়া গলায় রাত্রি বলল,
—একটা মানুষ আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে লড়ছে আর আপনি আমার সাথে…
—রাত্রি, প্লিজ আমার…
ইব্রাহিম ভালোভাবেই রাত্রিকে বোঝাতে চাইল। কিন্তু রাত্রি নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠতেই ইব্রাহিম ধমকে ওঠল,
—চুপপপ। একদম চুপ। আমার কথা শেষ হওয়ার আগে কোথাও যাওয়া চলবে না৷ কথা শেষ হতে হতে কেউ যদি মরেও যায় আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই।
এ বলে ইব্রাহিম রাত্রির হাত টেনে হাঁটতে শুরু করল আর রাত্রি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বলে ওঠল,
—হাত ছাড়ুন আমার। হসপিটাল ভর্তি লোকের সামনে তামাশা করবেন না। হাত ছাড়ুন বলছি।
ইব্রাহিম রাত্রির কথা কানে তুলল না। হসপিটালের এক নিরিবিলি জায়গায় এনে রাত্রিকে দাঁড় করিয়ে দিলো। রাত্রির হাত এরই মধ্যে রাত্রি ছাড়িয়ে নিলো আর জীবনের প্রথম নিজের হাতের পাঁচ আঙ্গুল কোনো ছেলের গালে বসিয়ে দিলো। সশব্দে চ””ড় খেয়ে ইব্রাহিম মেঝের দিকে ঝুঁকে গিয়েছে। নিজের গালে হাত রেখে ইব্রাহিম যখন রাত্রির দিকে তাকাল, তখন রাত্রির চোখেমুখে রাগের অন্য এক আগুন দেখতে পেল। এতে আরও তব্দা খেয়ে গেল ইব্রাহিম, কিন্তু তার মাঝেও রাগের সৃষ্টি হচ্ছে। রাগে সে রাত্রির বাহু চেপে ফুঁসে ওঠল,
—এ থাপ্পড় আমি তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম বহু আগেই। কিন্তু দেওয়া হয়নি কারণ তোমার মুখের দিকে তাকালেই আমার মন কেমন করে ওঠত। তোমার মাঝে আমি ছন্দাকে দেখতে পেতাম। তাই হয়তো তোমাকে বিয়ে করব না ঠিক করেও নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘রাত্রিকে কি আমার বিয়ে করা উচিত?’ কিন্তু পরে মনে হলো একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করে কী লাভ? সারাজীবন শুধু পস্তাতে হবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমাকে নোংরা কথা শোনাতাম। আমি এমন করতাম যেন তুমি বিয়ে ভেঙে দাও কারণ আমার বাপ আমাকে বিয়ে করানোর জন্য ওঠে পড়ে লেগেছে। আর রাত্রি, তোমার ভালো চাইতে গিয়ে নিজের এমন হাল হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তুমি কী না কী চিঠিতে লিখে বাড়ি ছেড়েছ। এদিকে আদী ভেবে বসে আছে আমার জন্য তুমি বাড়ি ছেড়েছ আর সে আমাকে কুকুরের মতো মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। আর…
ইব্রাহিম আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠল। তাই সে রাত্রিকে ছেড়ে দিয়ে ফোন হাতে নিলো। কল রিসিভ করে বলল,
—সাজ্জাদ স্যার, বলুন।
রাত্রির দিকে তাকিয়ে ইব্রাহিম আবার জবাব দিলো,
—হ্যাঁ, এসেছে। আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
এ কথা শুনে রাত্রির বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে ইব্রাহিম তার কথাই বলছে। ইব্রাহিম বলে গেল,
—আপনি শিগগির আসুন। সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে… আদীর বিষয় আমার ওপর ছাড়ুন। আপনি এসে আগে এ ধানিলঙ্কাকে সামলান।
এরপর ইব্রাহিম সাজ্জাদকে বলে দিলো কোথায় আসতে হবে এবং কল কেটে দিলো।
(চলবে)