#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৮
✍️ খাদিজা আক্তার (Diza)
বুশরার কথার প্রেক্ষিতে আদী নিশ্চুপ থেকে এসেছে বরাবরই। মাসখানেক আগে যা ঘটে গেছে রাত্রিকে ঘিরে এরপর বুশরার কথা নয়, পৃথিবীতে কারো কথাই আদী কানে তুলতে চায় না।
একমাস আগে যখন শর্মি কল করে আদীকে তার বাড়ি ডেকেছিল, আদী তখন ছুটে গিয়েছিল। ব্যাকুল মন নিয়ে শর্মিকে জিজ্ঞাসা করেছিল,
—কী হয়েছে? আমাকে এবার সব বলুন।
শর্মি কোনো উত্তর দেয়নি শুধু একখানা চিঠি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। চিঠি হাতে নিয়ে আদী পাথর প্রায় হয়ে পড়তে শুরু করেছিল,
আব্বা,
সরাসরি এসব কথা বলার সাহস কোনোদিন হতো না আমার। আজকেও হয়তো বলতে পারতাম না। কিন্তু জীবনের অন্তিম সময়ে একটি প্রশ্নের উত্তর চাই, মেয়ে হয়ে শিক্ষকতা করতে চাওয়া কি অনেক বড়ো অন্যায়? আমি বাণিজ্যে পড়তে চাইনি, বাংলায় অর্নাস করে প্রাইভেট স্কুলে চাকরি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার অমতে আমাকে বাণিজ্যে পড়তে হলো। আমি বাংলা ভাষাকে বড়ো ভালোবাসতাম আর এখনো। এ ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে রক্ত ঝরেছে— এটি জানার পর বাংলা ভাষার প্রতি একটি গোপন ভালোবাসা আমার অন্তরে জন্মেছিল। আমি চেয়েছিলাম আমার মাঝে বাংলাকে সবদিক দিয়ে আঁকড়ে রাখতে। তাই বাংলার ছাত্রী হয়ে বাংলার শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম; চেয়েছিলাম নিজের হাতে বাংলা মায়ের জন্য কিছু যোগ্য ছাত্র তৈরি করতে। কিন্তু তুমি দিলে না আমায় সে অনুমতি। আম্মার কাছে যখন বললে, প্রাইভেট স্কুলে মাস্টারি করলে তোমার মানসম্মান যাবে। আমি খুব কেঁদেছিলাম; আমার বিজন ঘরে একাকি।
তুমি আমার জন্য অনেক করেছ আব্বা। তাই এ শেষ মূহুর্তে তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ আমার ভাগ্যের প্রতি, কেন এ ভাগ্যে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাটি লেখা নেই?
আম্মা,
তোমাকে নিয়ে কিছু বলার নেই। আজ পর্যন্ত আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন তুমি ছিলে। আমি জানি, আমার মৃত্যুর সংবাদে তুমি অনেক ভেঙে পড়বে। কিন্তু আমি আর পারছি না। তোমাদের সবার মনের মতো চলতে গিয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
খুব বড়োলোক বাড়িতে আমার বিয়ে-থা ঠিক করলে। কিন্তু একবারও জানতে চাইলে না, এতে আমার মত আছে কিনা। ওই ইব্রাহিমকে বিয়ে করলে আমি জীবন্ত লা””শ হয়ে যেতাম। সারাক্ষণ কুদৃষ্টি আর কটুকথা শোনাত আমাকে। মুখ ফুটে আমি কাউকে কিচ্ছু বলতে পারতাম না। কান্না পেত আমার; খুব বেশি কান্না পেত। কিন্তু শুকনো বালিশে আর কত চোখের জল ঢেলে দিবো? ভেবেছিলাম মরে যাব। কিন্তু কেন মরব আমি? কোনো পাপ তো করিনি। তাই তোমাদের সবাইকে ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি আমাকে তোমরা খুঁজে বের করতে পারবে। কিন্তু যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাও তাহলে ভুলেও আমার খোঁজ করো না। আল্লাহ সাক্ষী তোমরা যদি আমাকে খুঁজে বের করো আর ওই ইব্রাহিমের সাথে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো। তাহলে আত্ম””হ””ত্যা করতে আমি একবারও ভাবব না। তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।
রাত্রি।
এমন চিঠি পড়ে সেদিন আদী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেছিল আর ইব্রাহিমের প্রতি আক্রোশ জন্মেছিল। যার ফলশ্রুতিতে সে কয়েকদিন আগে ইব্রাহিমকে বেদম প্রহার করেছিল এবং আহত ইব্রাহিমকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।
রাত্রিকে যেদিন শর্মির বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল আদী, সেদিন ভেবেছিল হয়তো রাত্রির সাথে তার সমস্ত সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু রাত্রি পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে আদী অনুভব করেছে, বুকের ভেতর একটু একটু করে নতুন সম্পর্কের জন্ম হয়েছে।
রাত্রিকে খুঁজে বের করা কোনো কঠিন কাজ নয়, কিন্তু রাত্রি জেনে শুনে এমন প্রতিজ্ঞা করেছে যে আদী চাইলে এখন আর রাত্রির সামনে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু বুকের ভেতরের জ্বালা যে আর সহ্য করা যায় না। হঠাৎ বুকপকেটে থাকা ফোন কেঁপে ওঠল। মৃদু কম্পন টের পেয়ে আদী বুঝতে পারল মেসেজ এসেছে। আদী মেসেজ ওপেন করে দেখল অপরিচিত নম্বর। ভ্রুকুটি করে তবুও পড়তে শুরু করল,
ভালোবাসা, ভালো লাগা— এসব মন ঘটিত ব্যাপার। কিন্তু ভালোবাসার জন্ম হয়েও মনের মধ্যে তা কখনোসখনো ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমন্ত মনের ভালোবাসাকে তাই জাগিয়ে দিতে হয়, যেমন তোমার উষ্ণ স্পর্শ আমার মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা ভালোবাসাকে জাগিয়ে তুলেছে। হ্যাঁ আদী, যেদিন জ্বরের ঘোরে তুমি অবচেতন প্রায়, সেদিন আমি তোমার ঘরে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে এলোমেলো পা ফেলে ছুটে এসেছিলে, আমাকে তোমার তপ্ত গায়ের স্পর্শ দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, “রাত্রি, আমি কি তোমায় ভালোবাসি?” বিশ্বাস করো আমি তখন অর্ধেক যেন মরে গিয়েছিলাম। এমন অনুভূতি আর হৃদয়ে কম্পন জীবনেও অনুভব করিনি। আর এটিও বুঝতে পারিনি আমি কখনো তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। হ্যাঁ আদী, আজকে বলতে আর কোনো বাঁধা নেই যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। হয়তো অনেক আগে থেকেই ভালোবাসতাম, কিন্তু সেটি কোনোদিন প্রকাশ পায়নি। আমিও জানতাম না সে কথা কিন্তু তুমি আমাকে জানিয়ে দিলে।
তোমাকে ভালোবাসি যখন জেনে গিয়েছি, তখন তোমার সাথে চব্বিশ ঘণ্টা কাটাতে আপত্তি কোথায়? তবে যেদিন মতামত জানিয়েছিলাম, সেদিন ইব্রাহিম আমাকে নোংরা কথা শুনিয়েছিল। তাই রেগে গিয়ে তোমাকে হ্যাঁ বলেছিলাম। তবে বিশ্বাস করো এমনিতেও বলতাম। আর বিষ কেন নিয়ে গিয়েছিলাম জানো? চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার পর তোমাকে জিজ্ঞাসা করতাম, “আদী, আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে?” তুমি যদি এ প্রশ্ন ‘না’ উত্তর দিতে তবে তোমার সম্মুখে আমি বিষ পান করতাম। তুমি নেশা করে উলটো পালটা করলেও যাকে ভালোবাসি সে খু””নী হলেও বা কী এসে যায়? তাই এসব জেনেশুনেও আমি পরোয়া করিনি, কিন্তু তোমাকে সেদিন মিথ্যা যুক্তি দেখিয়েছিলাম।
আদী তোমার সাথে আমি চব্বিশ ঘণ্টা হয়তো পার করিনি, কিন্তু যতটুকু সময় কেটেছে তা আমার মনের মধ্যিখানে সাজিয়ে রেখেছি। যখনই মনে পড়ে, তখন মনের মধ্যে আনন্দ জাগে। কিন্তু তুমি তো আমায় ভুল বুঝলে আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না আদী। বুশরা তো বড়ো গলায় বলেছে, “আদী বলেছে রাত্রির মতো কাউকে না পেলে আমি বিয়ে করব।” কেন আদী? আমার মতো মেয়ে কেন? বলতে পারোনি যে আমাকে না পেলে বিয়ে করবে না? তোমরা ছেলেরা অরিজিনাল নিয়ে তৃপ্তি পাও না তোমাদের ডুপ্লিকেট প্রয়োজন হয়। তোমরা সবাই এককথাই বলো, “তোমার মতো লাগবে, তোমার মতো লাগবে।” তোমাকেই লাগবে এটি আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে শুনলাম না।
আদী, আজকে সত্যি করে একটি কথা জানতে চাই, আমি কি কারো প্রেমিকা হওয়ার যোগ্য নই? আমি কি কারো বউ হওয়ার যোগ্য নই৷ অন্যদের কথা বাদ দিই। যদি সরাসরি তোমার বিষয়ে জানতে চাই, তাহলে আজকেও একই কথা বলবে?
আমি তোমাকে ভালোবাসি আদী। যে আমি মুখ ফুটে দু’টি কথা বলি না। সে আমি নির্লজ্জের মতো হাজারবার ভালোবাসি ভালোবাসি বলছি। তোমার জন্য নিজের পরিবার ছেড়ে আজ কোথায় পড়ে আছি। সেরাতে তোমার কথাগুলো শুনে আমার মরতে ইচ্ছে করেছিল। মনের মধ্যে শুধু প্রশ্ন জেগেছে, “আদী কি আমাকে ভালোবাসে না?”
লজ্জার মাথা খেয়ে আজ কত কথা বলে দিলাম। আজ আমি পারিনি নিজের অন্তরে জমা তোমার প্রতি ভালোবাসা লুকিয়ে রাখতে। তাই চোখ বুজে যা পেরেছি ভেবেছি আর কাঁপা হাতে আমার অগোছালো ভাবনাগুলো লিখেছি। তোমাকে আমি কোনোদিন জের করব না আর দোষও দিবো না। কিন্তু আমার জীবন থেকে তোমার নামটি কোনোদিনও মুছতে পারব না। যার জন্য গৌতম বুদ্ধের মতো আষাঢ়ি পূর্ণিমায় বৈরাগী হয়েছে আমার মন, তাকে এ হৃদয় থেকে তাড়াই কী করে?
রাত্রি।
(চলবে)