#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_৫
✍️ খাদিজা আক্তার-??????? ????? (Diza)
বোডিঙে গিয়ে আদী জানতে পারল লা”শ পোস্ট””মর্টেম করার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে। বড়ো আশ্চর্যের বিষয় এ কথাটি প্রথমে কেউ বলতে রাজি হয়নি। আদী যখন শাসিয়ে বলল,
—নিজেদের ভালো চাইলে বলে দিন স্বর্ণালিকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নয়তো আমি সাজ্জাদকে খবর দিবো। সাজ্জাদ কে তা নিশ্চয়ই জানেন না। পুলিশ ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ, আমার বন্ধু। একবার যদি খবর দিই আর ও এখানে আসে। তবে আসল খবর বের করতে বেশি সময় লাগবে না।
এসব বলেও কাজ হয়নি। কিন্তু একবারে বিফলেও যায়নি। আমতা আমতা করে বোডিঙ সুপার বলল,
—আসলে তাড়াহুড়ো ছিলাম। তাছাড়া আমাদের বোডিঙে এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। তাই আমরা সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
এত বিশদ বক্তব্যে আদী বিরক্ত হয়ে বলল,
—আঃ! এত লম্বা পেচাল শুনতে চাই না। আসল কথা বলুন; জাস্ট কুসুমটুকু।
বোডিঙ সুপার মধ্য বয়স্ক মহিলা। উত্তেজিত আদীকে দেখে বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডার দিনেও প্রচুর ঘামছেন। চোখেমুখে তার অস্বস্তি ভাসছে; চোখের দৃষ্টিতে কেমন চোর চোর ভাব। কপালের ঘাম হাতের উলটো পিঠে মুছে জবাব দিলেন,
—মনে হয় ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গেছে।
—মনে হয়! এত কিছুর পর আপনি কেবল বলছেন মন হয়? এত বড়ো একটা বোডিঙের সুপার হয়ে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলতে আপনার অবাক লাগছে না?
—না মানে… ঢাকা মেডিক্যালেই নিয়ে গেছে।
—তো সেটা এত কাণ্ডের পর বলছেন কেন? সত্যি করে বলুন তো আসল ঘটনা কী? স্বর্ণালির সুই””সাইডের পিছনে আপনার কোনো হাত নেই তো?
আদীর প্রশ্ন শুনে বোডিং সুপার যেন আঁতকে ওঠল। ক্রমাগত হাত নেড়ে বলল,
—এসব কী বলছেন? না না, এসবের মধ্যে আমি নেই। তাছাড়া স্বর্ণালি খুব ভালো ছিল। আমি তাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করতাম। তাহলে কোন কারণে… না না, আপনি অন্যায় অভিযোগ করছেন। আমার বয়স হচ্ছে। আজ পাঁচ বছর ধরে ডায়াবেটিস হয়ে বসে আছে। ভুল গিয়েছিলাম হসপিটালের নাম। এখন ভালো করে মনে পড়েছে।
বয়সে বড়ো হওয়া সত্ত্বেও আদীকে আপনি সম্বোধন করা সুপারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আদী কঠিন গলায় বলল,
—ঠিক জায়গায় ঠিক জিনিস পড়লে আরও অনেক কিছুই মনে পড়বে। যদি ভুলেও ওর সুই””সাইডের সাথে কারো সম্পর্ক পাই। তবে সব শালাকে জ্যান্ত পুঁতে দিবো।
বোডিং সুপার ভয়ের চোটে আর কিছু বলার সাহস পায়নি। আদীও কথা না বাড়িয়ে ক্রন্দনরত ফুপুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঢাকা মেডিক্যালের উদ্দেশ্য। কিন্তু এখানে এসে আদী জানতে পারল লা””শ পুনরায় বোডিঙে পাঠানো হয়েছে। পোস্ট””মর্টেমের পর লা””শ সাধারণত পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু স্বর্ণালির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ আদীর মাথায় ঢুকছে না।
আদীর ঢাকা পৌঁছাতে দেরি হয়েছে— এ কারণে এমন হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে ফুপুর বলল,
—আমি মাথায় কিছুই ঢুকছে না। পুরো একটা দিন শেষ হতে চলল অথচ আমার মেয়ের মরা মুখটাও এখনো দেখতে পেলাম না। আমি কোন পাপের জন্য এমন শাস্তি পাচ্ছি বলতে পারো? আমার মেয়েই বা কী অপরাধ করল যার জন্য মন বদলে তাকে…
আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে ফুপু কেঁদে ওঠল। কিন্তু আদীর সব কিছুতে কেমন গোলমাল লাগছে। তবে এসব নিয়ে এখন ভাবার সময় নেই। আগে স্বর্ণালির লা””শ পেতে হবে। এরপর গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। তারপর মাটির ঘরে পরম যত্নে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে; এ ঘুম ভাঙবে না হাজার বছর পরেও।
*
—রাত্রি আপু, ছাদে কী করছ গো? এমন বৃষ্টির মধ্যে অকারণে নিজেকে ভিজিয়ে দিচ্ছ কেন?
কারো কণ্ঠ শুনে চমকে মুখ ফেরালো রাত্রি। উদাস দুপুরের ন্যায় রাত্রি মুখের আকাশে এক ফালি জ্যোৎস্নার মতো হাসি ফুটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেও থেমে গেল সে। সোজা হয়ে মাথা নামিয়ে কী যেন ভাবল, কিন্তু চুপচাপ থেকে গেল। রাত্রির এমন মুখ ভার দেখে অভি আবার জিজ্ঞাসা করল,
—এই আপু, কী হয়েছে? তোমার কি মন খারাপ?
রাত্রি তাকাল ১৮ বছর বয়সী তার চাচাতো ভাইয়ের দিকে; নামটি হলো অভি। কোমল চেহারার মাঝে ভাসা দুটি চোখ ছেলেটির৷ দেখলেই কেমন মায়া মায়া লাগে; মন ভরে যায় স্নিগ্ধতায়।
—না রে। মন কেন খারাপ হবে?
—এই, তুমি আমাকে মিথ্যা কেন বলছ? আমাকে বোকা মনে হয় তোমার? আমি কিন্তু ঠিক বুঝতে পেরেছি তোমার মন খারাপ।
এবার রাত্রি ম্লান হেসে ওঠল। কিন্তু তর্ক না করে পুনরায় চুপ করে গেল। চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে ভেজা আকাশ দেখতে ব্যস্ত হলো। সবার সাথে যেমন কথা বলা যায় না, তেমন সবার সাথে চুপ থাকাও যায় না। অভির সাথে রাত্রি চুপ থাকতে পারে না বরং মাঝেমধ্যে মনে হয়, এ ভাইটি আছে বলেই তার সাদাকালো জীবন কালেভদ্রে রঙিন হয়ে ওঠে।
—এই আপু, বলো না কী হয়েছে? আদী ভাইয়া কি বকেছে?
অভির এরূপ প্রশ্ন শুনে রাত্রি চমকে গেল। গোল গোল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
—তোর আদী ভাইয়া আমাকে কেন বকতে যাবে রে? আমি কি তার গরম ভাতে পানি দিয়েছি?
—তা দাও নাই। তবে তোমার বেশিরভাগ মন খারাপের কারণ যে আদী ভাইয়া তা কিন্তু আমি জানি।
একটু যেন পরিহাসের সুর ভেসে ওঠল অভির কণ্ঠে। সেটি টের পেয়ে রাত্রি এবার হালকা রাগ প্রকাশ করে অভির কান টেনে বলল,
—দুষ্টু ছেলে, বোনের ওপর নজরদারি বসিয়েছিস? পড়াশোনার নাম নেই। টেনেটুনে পাশ করিস আবার এখানে পাকা পাকা কথা বলা হচ্ছে আমাকে?
—উহ্! আপু লাগছে গো। কান ছাড়ো।
—কেন ছাড়ব? দুই ভাইতে মিলে আমার জীবনকে করলা ভাজি করছিস। আমি ছাড়ব কেন রে?
অভি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে আর বলছে,
—প্লিজ আপু। ছেড়ে দাও না গো। আর এমন করব না।”
রাত্রি ছেড়ে দিলো। তার এ মুহূর্তে কিছুই ভালো লাগছে না। তাই বড়ো বড়ো পা ফেলে নিচে নেমে এলো। আনমনে রাত্রি ভাবছে আদীর কথা আর তখনই আদীর কণ্ঠ শুনতে পেল। আদী তাকে ডাকছে ভেবে সে খুশি হলো। কিন্তু চারধারে আদীর অস্তিত্ব না পেয়ে বুঝতে পারল এটি তার মনের ভুল। রাত্রি নিজের ঘরে পা বাড়াল, কিন্তু পুনরায় ডাক শুনতে পেল,
—রাত্রি?
সত্যিই কেউ তাকে ডাকছে। তবে সেটি ময়না বেগম। মলিন মুখে ছুটে এসে বললেন,
—স্বর্ণালি না কি সুই””সাইড করেছে।
রাত্রি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
—কোন স্বর্ণালি?
—আরে আমাদের স্বর্ণালি। তোমার রেশমি ফুপুর মেয়ে।
—কিন্তু তুমি জানলে কী করে?
—জানার জন্য আটকে থাকে না কি? মেয়েটা ঢাকায় বোডিঙে থেকে পড়ত। তোর বাবা কত নিষেধ করেছিল মেয়ে মানুষকে ঢাকায় না দিতে। সুই”””সাইড করে এখন বসে আছে। একটা মাত্র মেয়ে। একবার চিন্তা করো তোর ফুপু এবার কীভাবে থাকবে?
ময়না বেগমে বলে চলেছেন, কিন্তু রাত্রির মাথা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিজেকে সামলে সে কোনোমতে বলল,
—এসব না বললে কি নয়?
—তো বলব না? মেয়েটার লা”শের পর্যন্ত খবর নেই। আদী তার দুইটা বন্ধু নিয়ে খোঁজ করতে গেছে। এমন মেঘলা দিনে ছেলেটার কত কষ্ট হচ্ছে ভাবো।
আদীর নাম শুনেই রাত্রির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। হঠাৎ আসা রাগের অর্থ রাত্রি বুঝতে পারছে না। তবে এ বুঝতে তার অসুবিধা হচ্ছে না, রাত্রি এখন আদী সম্পর্কিত কোনো কথা শুনতে চাইছে না। ফলস্বরূপ সে তার আম্মাকে বলল,
—আমি ঘরে যাচ্ছি, আম্মা।
অবাক চোখে মেয়েকে দেখে ময়না বেগম জিজ্ঞাসা করলেন,
—কী হয়েছে তোমার? দুই দিন ধরে কেমন যেন দেখছি অবশ্য তুমি আজকাল এমনই হয়ে থাকো। পেটে ধরলেও আমি আজকাল তোমায় কেন জানি বুঝতে পারি না।
(চলবে)