#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_৪
✍️ খাদিজা আক্তার-??????? ????? (Diza)
রাত্রি রাগী চোখে দেখছে ইব্রাহিমকে। দেখছে এক পুরুষকে যার মুখনিঃসৃত বাক্য নিজ কানে কত কুৎসিত মনে হচ্ছে। রাগে অন্তর জ্বলে গেলেও কেবল তিন শব্দে রাত্রি উত্তর করল,
—শাড়ি পরা অপছন্দ।
শব্দ করে হেসে ওঠল ইব্রাহিম। বলল,
—শুধু কি শাড়ি অপছন্দ না কি আমাকেও?
রাত্রি প্রতুত্তরে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তার সমস্ত মুখ ঘৃণায় ভরে ওঠেছে আর তা দেখে ইব্রাহিম শক্ত চোয়ালে বলল,
—এ এলাকায় না থাকলেও আমাকে অন্ধ মনে করার কোনো কারণ নেই। আদী নামক গুণ্ডার সাথে ঢলাঢলি করার খবর কিন্তু আমার কানে ঠিকই যায়। আমি সামান্য শাড়ি পরার কথা বলতেই এত ঘৃণা ভাসছে মুখে। তোমার নাগরের সাথে ঢলাঢলি করার সময় এমন ঘৃণা মুখে ভাসে না? দুই দিন বাদে বিয়ে অথচ এখনো সেই গুণ্ডার সাথে এত কীসের মহব্বত? ভেবেছিলাম তোমাকে বিয়ে করব না। আজকে সেটি বলতেই এসেছিলাম, কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি তোমাকেই বিয়ে করব। দেখব বিয়ের পর আমার প্রতি কত ঘৃণা আসে আর ওই আদী প্রতি কত মহব্বত।
এ কথা বলে ইব্রাহিম উঠে দাঁড়াল। মোশাররফ হোসেনের সাথে দেখা করার চিন্তা বাতিল করে বেরিয়ে পড়ল অজানা গন্তব্যে। মনে রাগ থাকলে মানুষ তার নিজ গন্তব্য চট করে ঠিক করতে পারে না; ইব্রাহিমের ক্ষেত্রেও তাই হলো। এদিকে রাত্রির সমস্ত দেহ রাগে কেঁপে ওঠল আর চোখ ভিজে এলো আদীর প্রতি অভিমান করে। রাত্রি বুঝতে পারছে না কেন তাকে এবং আদীকে এক করে ইব্রাহিম এমন নোংরা কথা বলে গেল। রাত্রির সাথে তো আদীর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই যেখানে অন্যের মুখে এমন কটুকথা শুনতে হবে। দিশেহারা অবস্থায় রাত্রি নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করল,
—চারদিকে এত বিতৃষ্ণা কেন ছেয়ে আছে?
*
—অসময়ে বৃষ্টি নামল। এমন চৈত্র মাসে অঝোর ধারায় বৃষ্টি যদি হয় তবে আষাঢ় শ্রাবণ কাকে নিয়ে বাঁধবে ঘর?
যেন নিজেকে প্রশ্ন করল আদী আর কেউ একজন উত্তর দিবে সেই আশায় চুপ করে গেল। ভেজা বারান্দায় এক মগ কফি নিয়ে ব্যস্ত হলো। কালকে ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যাওয়ার পর প্রচুর পানি মাথায় ঢেলেছিল সে। প্রেশার পরে নেমেছিল, কিন্তু শরীর এত দূর্বল করেছিল যে বাকি সময়টুকু প্রায় অজ্ঞান মনে হয়েছিল নিজেকে। সকালে জেগে উঠে দেখে আকাশ মুখভার করে আছে। নিজের ক্লান্ত দেহ নিয়েও রাত্রির কথা তার মনে এসেছিল। মেয়েটি তাকে আর কল করেনি। আদীও যেচে আর খোঁজ নেয়নি, কিন্তু এমন হুট করে যোগাযোগ বন্ধ করা কি যায়? একই গ্রামে বসবাস। রাত্রির বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ঠিকই দেখা হবে আর দেখা হলে মন টালমাটাল হবে খোঁজ নেওয়ার জন্য।
রাত্রি চাপা স্বভাবের হলেও আদীর সঙ্গে তার চপলতা কিঞ্চিৎ যেন দেখা দেয়। একদিন হেসে আদী জিজ্ঞাসাও করেছিল,
—সবার সাথে একদম বোবা হয়ে থাকো অথচ আমার সঙ্গে কথা বলতে বসলেই তোমার মুখে খই ফোটে। আমার বেলায় এমন কেন?
রাত্রি মুচকি হেসে বলেছিল,
—বন্ধুর সাথে চুপচাপ থাকা যায় না। তোমার মতো ভালো বন্ধু পেলে বাকপ্রতিবন্ধীও কথা বলতে শুরু করে দিবে।
আদী পলকহীন চোখে রাত্রিকে দেখেছিল আর কেমন গলায় যেন প্রশ্ন করেছিল,
—রাত্রি, আমি কি কেবলই তোমার বন্ধু?
—না, তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির মধ্যে একজন। যার সঙ্গে কথা বললে আমার সময়-জ্ঞান থাকে না।
এ উত্তর পেয়ে আদী আর কথা বাড়ায়নি। মেয়েটি বড়ো সরল। সব কথার সোজা অর্থ বুঝে নেয় সে। এমন সরল বলেই আদীর বড়ো চিন্তা হয়। কারণ বর্তমান যুগ অতি সরল হলে টিকে থাকা মুশকিল।
সকালের নাস্তা সেরে প্রেশারের ওষুধ নেওয়া হয়েছে। বৃষ্টিও হচ্ছে ফলে আদীর কেমন শীত শীত করছে। পরনের টিশার্ট আর লুঙ্গি দিয়ে ঠাণ্ডার তীক্ষ্ণতা দূর করা যাচ্ছে না। কিন্তু এটি বড়ো উপভোগ্য মনে হচ্ছে আদীর কাছে।
উষ্ণ কফিতে ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়ে আদীর চোখ জোড়া হঠাৎ স্থির হলো পাশের বাসার উঠোনে। অচেনা এক তরুণী পা টিপে টিপে হাঁটছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে। প্রথম দর্শনে অচেনা হলেও এখন একটু একটু করে আদী চিনতে পারছে। এ মেয়েটি হলো মেঘলা। দুই দিন আগেই ওর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সমস্ত আয়োজনে চারপাশ চঞ্চল ছিল। কিন্তু হঠাৎ ঝড়োমেঘ এসে বৃষ্টি নামিয়ে দিলো।
আজ সকালেই আদী তার আম্মার মুখে শুনেছিল,
—মেয়েটার কপাল এত খারাপ হবে ভাবি নাই। বাপ ভাইয়ের কীর্তির জন্য বিয়ে হলো না। লোকের তো দোষ দেওয়ার উপায় নাই। বাপ ভাই যদি জেল খাটে বছরে দুই তিনবার। তবে কোন মা বাপে তার ছেলেকে এমন পরিবারে বিয়ে করতে দেবে?
আদী চুপচাপ শুনেছিল বিনা মন্তব্যে। তবে আজ তরুণীকে দেখতে পেয়ে তার বড়ো মায়া হচ্ছে। দূর থেকে যেই মুখাবয়ব আদীর চোখের সীমানায় ধরা পড়ছে, সে মুখে কোনো হিংস্রতা নেই; নেই কোনো অপরাধের রেশ। শুধুই স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে, ব্যথিত হৃদয় নিগড়ে বেরিয়ে আসা বৃষ্টিস্নাত চোখের জল।
আদীর মন বড়ো খারাপ হয়ে গেল। একই সাথে রাত্রির এবং মেঘলার কথা মনে এসে তাকে কেমন বিমর্ষ করে তুলল। হঠাৎ ঘরের ভেতর ফোন বেজে ওঠল। আদীর মনে হলো রাত্রির ফোন। তাই দ্রুত পায়ে ঘরে এসে ফোন হাতে নিলো, কিন্তু রাত্রি কল করেনি। আদীর মন আরও খারাপ হয়ে গেল। ফোন বিছানায় ছুঁড়ে দিতে গিয়েও রিসিভ করল,
—হ্যালো স্বর্ণালি?
ফোনের ওপাশ থেকে কান্না ভেসে এলো; বয়স্ক মহিলার কান্না। এতে আদীর কপালে ভাঁজ পড়ল,
—হ্যালো? কে বলছেন?
আদী আরেক দফা প্রশ্ন করতেই কান্না জড়ানো কণ্ঠে কেউ একজন বলল,
—বাবা আদী, আমার মেয়ে তো সুই””সাইড করেছে।
—ফুপু, তুমি এসব কী বলছ?
—আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তুমি শীগগির এসো। আমি আমার মেয়ের লা””শও খুঁজে পাচ্ছি না।
—তুমি কোথায় আছ? লা””শ না পাওয়ার কারণ কী? আর স্বর্ণালি সুই””সাইড করতে গেল কেন? পরশু দিনই ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। এমন কিছু করতে পারে বলে তো আমার মনে হয়নি।
ফুপু কেঁদেই চলেছেন আর বহুকষ্টে কান্না থামিয়ে থামিয়ে বলছেন,
—আমি কিছু জানি না। পরশু দুপুরে ওর সাথে আমার কথা হয়। ওর বিকালে স্কয়ার হসপিটালে কোন এক ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। আমাকে বলেছিল রাত হবে ফিরতে আর ফিরে এসে আমাকে জানাবে। কিন্তু কালকে দুপুর হওয়ার পরও আমি ওকে ফোনে পাচ্ছি না। এরপর ওর বোডিঙে চলে এসে জানতে পারলাম ও না কি পরশু রাতে সুই””সাইড করেছে। ওর লা””শ পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ আমাকে বলতে পারছে না কোন মর্গে ওকে পাঠানো হয়েছে। বাবা, আমি চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। তুমি চলে এসো ঢাকায়। আমার মেয়ের লা””শ না পেলে আমি…
পুরো কাহিনি শুনে আদীর মাথা ধপধপ করছে। এতক্ষণ যে শীতলতা তাকে কাবু করছিল। এখন ক্রমশ তা সরে গিয়ে উষ্ণতা অনুভব হচ্ছে। আদীর মনে হচ্ছে তার ব্লাডপ্রেশার বাড়তে পারে, কিন্তু এটি হলে এখন সে ফুপুকে কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না। তাই যথাসম্ভব নিজেকে সংযত করে ফুপুকে নিশ্চিত করল নিজের যাওয়ার ব্যাপারে।
পুরো প্রস্তুতি নিয়ে আদী বেরিয়ে পড়ল ঢাকার উদ্দেশ্যে। আপন ফুপাতো বোন সুই””সাইড করেছে— এ বিষয়টি আদীকে পীড়িত করলেও দূরসম্পর্কের ফুপাতো বোনের জন্য আদীর সবচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে। সে ভেবেছিল বৃষ্টি থামলে ছুটে গিয়ে একবার দেখে আসবে রাত্রিকে। কিন্তু বৃষ্টি মাথায় করে ঢাকা যেতে হবে তা সে কল্পনা করেনি। আসলে প্রকৃতির নিয়ম বড়ো অদ্ভুত। প্রকৃতি যখন যা চাইবে, আমাদের তখন তাই করতে হবে।
(চলবে)