#বিবর্ণ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akther
৭.
রুদ্রের আকুতিভরা অনুরোধ ফেলতে পারেনি তনুজা। মাথা নাড়িয়ে রুদ্রকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে তনুজা তার সঙ্গে যাবে। রুদ্র শ্লেষের হাসি দিলো। মনে মনে তখন হাজারও প্রশ্নের আন্দোলন। মনটা ভীষণ খুশি এই ভেবে যে, তনুজা এখন থেকে ওর চোখের সামনে থাকবে। মস্তিষ্ক বলছে, তনুজা যখন মেঘলার মুখোমুখি হবে তখন তনুজা কি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে? সেই প্রতিক্রিয়া হয়তো রুদ্র কিংবা মেঘলার জীবনে সুসংবাদ বয়ে আনবে না।
তনুজা রুদ্রকে নিজের জবাব দেবার পর একমিনিটের জন্যেও অপেক্ষা করেনি। দৌঁড়ে এ ঘর ছেড়ে বের হয়ে চলে যায় নিজের ঘরে। রুদ্র চলে যাবার পর থেকে যেখানে তনুজা থাকতে শুরু করে।
স্নান শেষ করে স্নান ঘর থেকে বের হতেই তনুজা দেখল ওর পালঙ্কের ওপর বসে আছে রুদ্র। গায়ে ধূসররঙের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা আর মাথায় সাদা টুপি। হয়তো, যোহরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাবে।
তনুজাকে স্নানঘর থেকে বের হবার শব্দ রুদ্রের কানে আসা মাত্র রুদ্র চকিত নজরে একটিবার তনুজার মুখশ্রী পানে তাকায়। তনুজা তাকায় রুদ্রের পানে। ব্যস মূহুর্তের মধ্যে দুটো চোখ এক হলো। একে অপরের দিকে তাকিয়ে তনুজা-রুদ্রের দৃষ্টি স্থীর হয়ে যায়।
প্রেয়শীর অর্ধভেজা অঙ্গ দেখে রুদ্রের চোখে তখন কামনা জেগেছে। লাল টকটকে শাড়িতে তনুজার পুরো দেহ থেকে যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বঙ্কিম ভ্রু যুগল, টানাটানা আঁখি, জবা ফুলের ন্যায় টকটকে ঠোঁট। কালো মেঘ বর্ণের ভেজা কেশরাশি এলোমেলো হয়ে কপালে লেপ্টে আছে। উন্মুক্ত উদরের কাছে শাড়ির অংশটা ভিজে থাকার দরুন লেপ্টে আছে। রুদ্রের ভীষন লোভ হচ্ছে একটিবারের জন্য উদরের সেই ভেজা অংশ যদি নাক ছুঁইয়ে তনুজার গায়ের সুগন্ধি প্রাণ ভরে নিশ্বাসের সাথে মিশিয়ে ফেলতে পারত! ইশশ্, এই ক্ষণ কেন ভুল সময়ে এলো?
রুদ্রের এমন নেশাক্ত চাহনি দেখে তনুজা মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে নড়লেই ঝামেলা পাকিয়ে যাবে।
রুদ্র বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এরপর, এক কদম, দুই কদম এগিয়ে যাচ্ছে তনুজার সামনে। তনুজা মাথা নিচু করে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র তনুজার খুব কাছে গিয়ে স্থীর হয়ে দাঁড়ালো। একহাত বাড়িয়ে তনুজার থুতনিতে ধরে অবনত মস্তকখানি উঁচু করে ধরলো। তনুজার দুচোখ বন্ধ। হয়তো, রুদ্রের চোখের দিকে সরাসরি তাকানোর সাহস হচ্ছে না।
দুচোখের মাঝে ভেজা স্পর্শ পেয়ে তনুজা শাড়ির আঁচলের কোণা শক্ত করে চেপে ধরলো। মনের ভেতরে তখন কি যেন চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে! হয়তো মনের সকল সংকোচ কাটিয়ে ভালোবাসা জাহির করার যুদ্ধ চলাকালীন এতো চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে। তনুজা বাকহীন হয়ে রইলো৷ রুদ্র এবার তনুজার কপালে দীর্ঘ সময় নিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।
রুদ্র সরে এলো তনুজার কাছ থেকে। তনুজার সেই আগের ন্যায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র তনুজার কান্ড দেখে কামরার বাইরে পা বাড়িয়ে যেতে যেতেই তনুজাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
— মসজিদে যাওয়ার আগে স্ত্রীর কপালে চুমু দেয়া নাকি সুন্নাত। সুন্নাত পালনের চেষ্টা আর তোমার ওই কপালে নিজের অধর ছুঁয়ে দেবার অদম্য ইচ্ছেকে একসঙ্গে মিটিয়ে নিলাম।
রুদ্র চলে যায় আর তনুজা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রুদ্রের বলা কথাগুলো শোনার পর লজ্জ্বায় লাল হচ্ছে। ভাগ্যিস লজ্জার রঙ চুইয়ে পরে না। নয়তো, লোকে দেখলে কি ভাবতো?
———-
টানা একসপ্তাহ পর তনুজার সময় ঘনিয়ে এলো এই সোনার বাংলা ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে পাড়ি দেয়ার জন্য। সালেহা সহ রুক্মিণী সকলের মন খারাপ। তনুজা এই বাড়িতে আসার পর থেকে তাদের সাথে খুব ভালো সময় কাটিয়েছি।
রুদ্র নিজের এবং তনুজার ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে লনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তনুজা সালেহাকে ধরে তখন চোখের পানি ফেলতে ব্যস্ত। সালেহা নানানভাবে তনুজাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন কিন্তু তনুজার যেন এই স্বান্তনা পেয়েও কিছুই হবে না।
অদূরে দাঁড়িয়ে আছে টগর। বোনের বিদায়ীক্ষণে বোনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না টগর। মনে হচ্ছে যেন তনুজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মেয়ে মানুষের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে সে। নাহ্, বোনের সামনে তো আর এভাবে কাঁদা যাবে না। নয়তো, বোনের যে আরও মন খারাপ হবে।
তনুজা সালেহাকে ছেড়ে রুক্মিণীর গলা জড়িয়ে ধরে বিদায় নিয়ে এবার টগরের কাছে এগিয়ে যায়। টগর বোনকে নিজের কাছে আসতে দেখে, নিজের মন এবং চোখকে কঠিন ধমক দিলো যেন ওরা নিজেদের কাবু করে রাখে।
— নিজের প্রতি খেয়াল রাখবি। নানীজান তোর পড়াশোনার ব্যবস্থা ঢাকায় করেছে। তিনদিন পর তোকে নিয়ে ঢাকায় যাবেন বড়ো মামীজান। আর..
কথাটি সম্পুর্ণ করতে পারেনি তনুজা। তার আগে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠলো। টগর এবার নিজেকে সামলাতে পারল না। বোনের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। দুই ভাইবোনের বিচ্ছেদের কান্নার দৃশ্য যেই মানুষটা অবলোকন করেছে তারই চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে।
রুদ্র এগিয়ে এসে টগরকে স্বান্তনা দিলো যেন বোনের জন্য চিন্তা না করে। ঠিকমতো পড়াশোনা যেন করে। টগর হেঁচকি তুলতে তুলতে রুদ্রের আদেশ শুনে ঘাড় কাত করে সায় জানিয়ে দেয়।
গাড়ি চলে এলো। রুদ্র গাড়িতে উঠে বসে। তনুজা গাড়িতে উঠে বসে। সবার উদ্দেশ্যে হাত নাড়িয়ে দেখায়। বাকি সবাই হাত নাড়িয়ে তাদের বিদায় জানায়। গাড়ি চলতে শুরু করে। তনুজার চোখ থেকে তখনও পানি ঝরছে। কখনো এই গ্রাম ছেড়ে থাকেনি। তনুজার মাঝের পাঁচ বছর পড়াশোনার বদৌলতে ঢাকায় হোস্টেলে গিয়ে থাকতে হয়েছে। আর আজ কিনা এই দেশ , তার জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে!
কখনো কি ঘাসের ঘ্রাণ নেয়া হবে? কখনো কি সুরেলা পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙবে? কখনো কি নদীর ধারে বসে নদীর জলের কলকলে সুর শোনা যাবে? নাকি শীতের সকালে ধোঁয়া ওঠা গরম গরম পিঠা খাওয়া যাবে? যাবে না। আর কখনোই পারবে না তনুজা।
নিজের হাতের পিঠে কারো স্পর্শ পেয়ে ভেজা চোখ তুলে তাকায় তনুজা। রুদ্র তনুজার হাতের হাত রেখে তনুজাকে বলছে,
— আমরা আবারও ফিরে আসব। শুধুমাত্র সঠিক সময় এলে সেই ক্ষণ খুব একটা দূরে নয়।
রুদ্রের কথার পিঠে তনুজা কিছুই বলে না। তনুজার নিরবতা দেখে রুদ্রের দীর্ঘশ্বাসের সূর বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়।
এয়ারপোর্টে দুইঘন্টা অপেক্ষার পর অবশেষে প্লেনে চড়ে বসে তনুজা-রুদ্র। দীর্ঘ ছয়ঘন্টা মালদ্বীপ এয়ারপোর্টে এসে ওদের প্লেন ল্যান্ড করে। ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত ব্যাপার শেষ করে দুজনেই বের হয়ে আসে এয়ারপোর্ট থেকে।
এয়ারপোর্টের বাইরে রুদ্র আর তনুজার জন্য গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে মেঘলা। হাতে একতোড়া টকটকে লাল গোলাপ। মেঘলার ঠোঁটের কোণায় আজ হাসি লেগেই আছে। রুদ্র আর মেঘলা সবে বের হলো গেইট দিয়ে। রুদ্র এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিজেদের গাড়ি আর ড্রাইভারকে খুঁজতে ব্যস্ত। মেঘলা গাড়ির বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলো রুদ্রকে আর রুদ্রের পাশে দাঁড়ানো এক অপরুপ সুন্দরীকে। যার ওপর একবার নজর পরলে নজর সরানো দ্যায় পরে যায়।
মেঘলা কারের ডোর খুলে বের হয়ে আসে ফুলের তোড়া নিয়ে। হাসিমুখে এগিয়ে যায় রুদ্রদের দিকে।
রুদ্রের চোখ যখন মেঘলাকে দেখতে পায়, তখনি রুদ্রের মনে হলো হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে!
—মেঘলা এখানে কি করছে?
মনে মনে কথাটি বলে পরিস্থিতি কি করে সামলাবে তা ভাবতে ভাবতে তনুজার হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে এগিয়ে যায় মেঘলার সামনে।
চলবে….