#বিবর্ণ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter
৩.
— হ্যালো???
— কেমন আছেন, আপনি?
ওপাশ থেকে ক্ষীণ সুরে রুদ্রের বাবা জবাব দিলেন।
— ভালো। আম্মা কোথায় আছেন? উনাকে কল দিয়েও পাচ্ছি না!
— আম্মা, নিজের কামরায় আছেন। ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাসের সুর ভেসে আসে।
রুক্মিণী মনে মনে সাহস সঞ্চয় করছে যেন রুদ্রের বাবা রায়হান আজাদকে রুদ্রের দ্বিতীয় বিবাহের ব্যাপারে বলতে পারেন। কিন্তু, যতটা উৎসাহ নিয়ে কল রিসিভ করেছিলেন এখন সেই উৎসাহটুকু নেই বললেই চলে।
— রাখছি তবে। রুদ্র এবং আম্মার প্রতি খেয়াল রেখো।
রুক্মিণী কথাটি শোনার পরপরই টুট টুট শব্দ শুনে কান থেকে মোবাইল সরিয়ে এনে চোখের সামনে মেলে ধরল।
পঞ্চাশর্ধ্বো এক পুরুষের গম্ভীর মুখখানি মোবাইল স্ক্রীণে ভেসে ওঠেছে। গাল ভর্তি কালোসাদা দাঁড়ি গজিয়ে উঠেছে। বয়স যখন ত্রিশের কাছাকাছি ছিলেন। তখন রায়হান আরও সুন্দর ছিলেন বটে। এখন, রুদ্রকে দেখতে যেমন দেখায় ঠিক তেমন।
—বুবু???
বোনের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন রুক্মিণী। হাতের মোবাইল খাটের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালেন। বোনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— তুই কি বলবি আমি জানি। তাই আমি আবারও বলছি আমি ঠিক আছি।
রুক্মিণী ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রুক্মিণীর বোন সুষমা উদাস পানে তাকিয়ে রয় বোনের গমনের পথে। মনে কে যেন হাহাকার করছে? আজ যদি রুদ্রের মতো একটি সন্তান রুক্মিণীর কোলে বিধাতা দান করতো। তবে, রুক্মিণীর জায়গায় এসে ঊশমি দখল করতে পারত না। সুষমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হাতের ব্যাগটা নিয়ে ঘর ছেড়ে রওনা হলেন নিজের বাড়ির পথে।
সালেহা নিজের ঘরে এসে দেখলেন, তনুজা ভেজা চুল পিঠে ছড়িয়ে রৌদ্রের দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে। সালেহা ঘরের দরজায় খিল এঁটে এগিয়ে যায় তনুজার দিকে। তনুজা সালেহার উপস্থিতি টের পেয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
— নানীজান, আপনি কোথায় ছিলেন? জানেন মামাজান বারবার আপনার মোবাইলে কল দিচ্ছিলেন।
— তুই কল রিসিভ করেছিস??? সালেহার কণ্ঠে উৎকন্ঠা।
— না।
স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করে সালেহা তনুজার সামনাসামনি বসলেন। তনুজা লজ্জা পেয়ে আরও আড়ষ্ট হয়ে যায়। সালেহা তনুজার হাতে নিজের ডানহাত রেখে বললেন,
— সত্যি করে বল তো তনু , রুদ্রের সঙ্গে তোর বিয়ে হলো কি করে?
সালেহার কথায় তনুজার চোখে গতকাল সন্ধ্যার সেই সময়টা চোখের সামনে দৃশ্যমান হতে থাকে। সালেহা ফের তনুজাকে অনুরোধের সুরে জিজ্ঞেস করে, জানতে চায় গতকাল সন্ধ্যায় তাদের বিয়ে কিভাবে হলো? তনুজা দুই হাঁটুতে মাথা রেখে শুয়ে বলতে শুরু করে,
” গতকাল বিকেলে আমি আর টগর মিলে আমাদের আমবাগানে লুকোচুরি খেলছিলাম। জানোই তো শহরে থেকে সবে পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসেছি। খেলার জন্য মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে ছিল! টগরের পালা এলো। ও যখন এক-দুই গুনতে শুরু করল। তখন আমি আমাদের বাগানের দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া বড়ো কমলা গাছের পেছনে লুকাতে গিয়েছিলাম। লুকানোর আগেই সেখানে একটি মানুষের কালো অবয়ব দেখে আমার প্রাণআত্মা উড়ে যায় যায় এমন অবস্থা। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার নাকে কি দিয়ে যেন চেপে ধরে! ব্যস, চোখে মুখে ঝাপসা দেখছিলাম। টগরকে ডাক দিব সেই সাহসটুকু হচ্ছিল না। গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হচ্ছিল না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে যে কি হলো আমার কিছুই স্মরণে নেই।
জ্ঞান ফিরে পেলাম দুজন বয়স্ক মানুষের ডাক শুনে। বহু কষ্টে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি টুপি এবং পাঞ্জাবি পরনে দুজন হুজুর আমাকে ডাকছেন। আমি উঠে বসি। মাথায় কাপড়টা টেনে দিয়ে প্রশ্ন করি তাদের,
— কে আপনারা? আমাকে কে এনেছে এখানে?
— মাগো, তুমি এখন আমাদের কাজী বাড়িতে আছো। তোমার হবু স্বামী তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তোমাকে বিবাহ করবার জন্যে।
লোক দু’টোর কথা শুনে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। এভাবেও কি কারো বিয়ে হয়! তাছাড়া, মা-বাবা সবাই আমার জন্য দুশ্চিন্তা করছিল বোধহয়। এই কথাটি যখনি আমার মস্তিষ্কে আসছিল ঠিক ততবারই আমি মরমে মরে যাচ্ছিলাম। আমাকে বারবার অনুরোধ করা হচ্ছিল যেন আমি কবুল বলি। কিন্তু, আমি নাকচ করে দেয়ায় তারা হার মেনে পাশের ঘরে গিয়ে কার সাথে যেন ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করছিল? আমি তখনও চোখের জল ফেলতে ব্যস্ত। এমন সময়, কে যেন এসে আমার চুলের মুঠি ধরে বলছে,
— তুই কবুল বলবি নাকি তোর ভাই টগরের লাশ দেখবি?
অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে চিরচেনা মানুষের সুর শুনে আমি হতবিহ্বল দুর্বল চোখে তাকিয়ে দেখি রুদ্র ভাই আমার অতি নিকটে অবস্থান করছেন। তার নিঃশ্বাস এসে আমার ঠোঁটে এসে আছড়ে পরছে। তার রক্তজবা চোখ দেখে যে কেউই সে-সময়ে ভয় পাবে। কিন্তু, আমার ভয় হচ্ছিল না। আমি শুধু মনে মনে হিসেব কষছিলাম। যেই মানুষটা কখনো কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি। সেই মানুষটা আজ আমার চোখের গভীরে তাকিয়ে আমার রক্তের আপন ভাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। অবশ্য, জমিদার বাড়ির লোকেরা এই স্বভাবটা হয়তো জন্মের পূর্বেই ওদের রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে তবেই এই স্বার্থপর পৃথিবীতে জন্ম নেয়।
জানতে ইচ্ছে করছিল খুব যাকে একসময় পাগলের মতো চাইতাম তখন সে আমাকে অবজ্ঞা করছিল। কিন্তু, আজ যখন আমি তাকে আমার জীবনের কোনো সীমানায় চাই না। ঠিক তখনি কেনই বা আমাকে হুমকির তোপে রেখে বিয়ে করতে হচ্ছে তার। জানা হলো না। পুরনো সেই অবজ্ঞায় হারিয়ে ফেলা ভালোবাসার মানুষটাকে এমন পরিস্থিতিতে এনে আমাকে ফেলার দায়ে এক আকাশ রাগ এবং ঘৃণা আমার মনে জায়গা নিয়ে ফেললো। গতরাত কবুল বলেছিলাম ঠিকই কিন্তু মনের কোনো এক কোণে তার কাছ থেকে পাওয়া ক্ষতগুলো যেন বারবার আন্দোলন করছিল। কেন অপমানের শোধ নিচ্ছি না? কেন তাকে আবারও প্রশ্রয় দিচ্ছি! মনের গহীনে লুক্কায়িত ভালোবাসা হারিয়ে আজ অপমানের শোধ নিতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে, নানীজান ”
কথাগুলো বলতে বলতেই ভারাক্রান্ত মনে তনুজা ওর নানীজানের বুকে মাথা রেখে চোখের পানি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। সালেহা দেখতে পেয়েছিলেন তনুজার চোখের কোণে জমে থাকা চিকচিক করা জলকে। তনুজাকে ফের বিভ্রান্ত না করতেই সালেহা আর প্রশ্ন করলেন না। তবে মনে মনে আসন্ন ঝড়কে কি করে সামাল দিবেন সেই ভাবনায় কাতর হয়ে যাচ্ছেন সালেহা। মনে মনে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করছেন যেন আসন্ন পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় মোকাবেলা করতে পারেন তিনি।
—————
পুরনো পুকুর ঘাটে বসে আছে রুদ্র। রাতের আঁধার ছেঁয়ে আছে পাশের লিচু বাগানে। দক্ষিনা হাওয়ায় বাগানের গাছগুলো যেন বাতাসের হুংকারে ভয়ে বারবার এদিক-সেদিকে এলিয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো হাজার মাইল দূর থেকে আসছে। তবুও যেন তীব্র আলোর কমতি নেই। দূর থেকে ভেসে আছে বুনো শেয়ালের হাঁক। একঝাঁক ঝিঁঝিঁ পোকার আগমনে পুরো ঘাটে যেন প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া আলোর কিরণে ঝলমলিয়ে উঠেছে।ঝিঁঝি পোকার ডাক, শেয়ালের হাঁক, রাতের ঘণ কালো আঁধার, পুকুরে আকাশের চাঁদের প্রতিবিম্ব, দক্ষিনা ক্রব্ধ প্রবল হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে বাগানের সকল গাছপালাকে।
এমন পরিস্থিতিতে ঘাটে একলা বসে থাকা কেউ হয়তো ভয়ে পরি মরি হয়ে দৌঁড় লাগাতো। কিন্তু, রুদ্রের মাঝে ভয়ের কোনো লক্ষণই নেই। যেন কিছু একটা নিয়ে সে গভীর ভাবনায় ব্যস্ত। সারাদিন আজ এই ঘাটে বসেই কেটেছে তার। কেউ ডাকতে আসেনি। কারণ, বাড়ির সকলেই জানে রুদ্রের পদধূলি যখনি এই ঘাটে পরে তারমানে রুদ্রের হয়তো আজ মন ভীষণ ভালো নয়তো মন্দ।
রুদ্র আজ নিজেও জানে না আজ তার মন ভালো নাকি মন্দ। মেঘলা জানে রুদ্র বাংলাদেশে ফিরে এসেছে বিয়ে করবে বলে। রুদ্র জানে তনুজাকে কেন বিয়ে করেছে? কিন্তু, তনুজা? সে তো জানে না। কেন রুদ্র তাকে বিয়ে করেছে? রুদ্রের প্রথম পক্ষের স্ত্রী আছে। এই কথাটি কি যথার্থ নয় তনুজাকে হতবিহ্বল করার জন্য। তনুজা যখন জানতে পারবে শুধুমাত্র রুদ্র তার কার্যসিদ্ধি করবার জন্য তনুজাকে স্ত্রী নামক সম্পর্কে আবদ্ধ করেছে। তখন তনুজার পক্ষ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া আসবে?
সবটা ভাবতে ভাবতে রুদ্র আজ ক্লান্ত। ভীষন ক্লান্ত। এতটা ক্লান্ত হয়তো তনুজাকে ভুলে গিয়ে মেঘলা নামক মেয়েটাকে বিয়ে করতেও হয়নি। তনুজা রুদ্রের প্রথম ভালোবাসা। কিন্তু, প্রথম ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়ার পরও কেন এত অস্থিরতা! জানা নেই রুদ্রের। তবে, একদিন না একদিন এমন একটা পরিস্থিতির মাঝে যেতে হবে রুদ্র, তনুজা এবং মেঘলাকে। কি হবে সেদিন যেদিন আসল সত্যটা তনুজা জানতে পারবে?
#চলবে