#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১৮
লেখা: ShoheL Rana শামী
পঞ্চাশের মনন্তর সম্পর্কে ইতিহাসে যা লেখা আছে, তার চেয়ে বাস্তব জগতটা যে কতটা ভয়াবহ তা পদেপদে অবলোকন করে যাচ্ছে রিহান। এইতো আজ সকালেও কিছু লোককে ময়লা-আবর্জনার স্তুপে কুকুরের সাথে ভাগাভাগি করে খেতে দেখা গেছে। কুকুরগুলোও খেতে না পেয়ে হিংস্র হয়ে গেছে। তাই তাদের খাবারে কেউ ভাগ বসাতে গেলেই হিংস্র দাঁত বের করে তেড়ে যায়। অভুক্ত লোকগুলোও হার মানতে নারাজ। পেটের ক্ষুধার সাথে লড়াই করার চেয়ে কুকুরের সাথে লড়া অনেক সহজ। দুপক্ষের লড়াইয়ে বিজয়ীরাই খেতে পারবে ময়লার স্তুপের সেই খাবার।
হঠাৎ করে বাজারেও চাল, গম জাতীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে আকাশ সমান। বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা এসব দ্রব্য মজুদ করে রাখে, তারপর ধীরে ধীরে বাজারে ছেড়ে চাহিদা আরও বাড়িয়ে দেয়।
গবাদি পশুগুলোর অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। পথে পথে মরে পড়ে থাকে এসব অবুঝ পশুগুলো। চারণভূমিগুলো শূন্য। গবাদি পশুরা সারাক্ষণ খুঁজেও চারণভূমিতে কোনো ঘাস পায় না। অনেকে জমিতে ধান, গম চাষ করেছে। তবে সাইক্লোন আর ঝড়ে সব ভেসে গেছে। যারা পূর্বে একটু সতর্ক হয়েছিল, তারা অল্প কিছু ধান, গম পেয়েছে। সাইক্লোন-ঝড় থেকে তাদের ফসল রক্ষা পেলেও, রক্ষা পায়নি ব্রাউন স্পট নামক রোগ থেকে, যা প্রায় সব ফসল নষ্ট করে ফেলে।
এই ভূখণ্ডে যখন খাদ্যের এমন অবস্থা, সেই মুহূর্তে সরকার ব্রিটিশ ভারত থেকে ফসল সংগ্রহ করতে শুরু করে। কারণ, সরকার আশঙ্কা করছে জাপানি সেনারা ভারতে আক্রমণ করতে পারে। তাই সরকারি লোকেরা অল্প দাম দিয়ে সব ফসল নিয়ে যায় ব্রিটেনে। বাংলার তখন অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই ফসল তেমন উৎপাদন হয়নি। তার উপর যা আছে তা কম দামে ব্রিটেনে নিয়ে গেছে সরকার।
চারপাশে চলতে লাগলো লাশের মিছিল। মানুষ, গবাদিপশু যেন প্রতিযোগিতা করে মরতে লাগলো। যে ঘটনাটা সবচেয়ে বেশি আজ রিহানকে ভাবাচ্ছে, তা হলো আজ দুপুরেই একই পরিবারের দশজন সদস্য একসাথে আত্মহত্যা করেছে খাবার না পেয়ে, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে। এভাবে ক্ষুধা নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে একেবারে মরে যাওয়াটাই হয়তো তারা ভালো মনে করেছে।
প্রতিদিন জমিদার বাড়িতে অভুক্ত লোকগুলো এসে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু, তাদেরকে আর কত দেয়া যায়? এভাবে দিতে থাকলে নিজেদেরকেই একসময় খাদ্যের অভাবে ভুগতে হবে। একদিন সবাইকে ডেকে সুফিয়ার চাচা বখতিয়ার উদ্দিন বিশাল এক ভাষণ দিলেন। তিনি ভাষণে বললেন, ‘ভাইয়েরা, আমরা প্রতিদিন লড়াই করছি ক্ষুধার সাথে। কিন্তু আমাদের এই ক্ষুধা মেটানোর দায়িত্ব কার? সরকারের উচিত দুর্ভিক্ষে আমাদের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু সরকার কী করছে? তারা আমাদের জন্য খাবার পাঠাচ্ছে না। উলটো আমাদের খাবারগুলো তারা নিয়ে গেছে। এই ভক্ষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হোক। ভারতে যে ব্রিটিশ উৎখাতের আন্দোলন চলছে তাকে সমর্থন করুন। রাজপথে নামবেন তো আপনারা?’
অভুক্ত জনতা চিৎকার করে উঠলো, ‘রাজপথে আছি আমরা।’ ব্রিটিশদের কথা শুনে হঠাৎ গায়ে আগুন ধরে গেল জনতার। সকল শক্তি যেন ফিরে পেল তারা দুর্বল গায়ে।
বখতিয়ার উদ্দিন তখন স্লোগান ধরলেন, ‘ইংরেজদের হায়েনা, ভারত ছেড়ে পালিয়ে যা।’
জনতা তখন স্লোগানটি সমস্বরে উচ্চারিত করে নেমে পড়লো রাজপথে। তাদের নেতৃত্ব দিলেন বখতিয়ার উদ্দিন। তাদের মিছিলে যোগ দিলো রিহানও।
একটা ব্রিটিশ সেনার গাড়ি এসে রুখলো মিছিলটাকে। ইংরেজিতে একজন গর্জন করে বললো, ‘হোয়াট দ্য ফাক আ(র) ইউ ডুয়িং হেয়া(র)?’
সবার পক্ষে বখতিয়ার উদ্দিন ইংরেজিতেই জবাব দিলেন, ‘আমরা আমাদের অধিকার চাই। বাংলার মানুষ অনাহারে মরছে, তা দেখে আপনাদের সরকার আরও মজা লুটছে। আমরা আর মৃত্যুর ভয় করি না। প্রতিদিনই আমরা মৃত্যু দেখি। মৃত্যুর সাথেই আমাদের বসবাস।’
ব্রিটিশ সেনাটা জবাব দিলো, ‘সরকারও এই মুহূর্তে অপারগ। দেখুন, যুদ্ধের কারণে বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটা খারাপ। তাই এই মুহূর্তে সরকার খাবার পাঠাতে পারছেন না। আর জার্মান-জাপানদের সাথে আমাদের যেসব যোদ্ধারা যুদ্ধ করছে, তাদের অনেক খাবারের প্রয়োজন।’
‘আপনাদের ব্রিটেনে তো দুর্ভিক্ষ হয়নি। দুর্ভিক্ষ হয়েছে আমাদের এই বাংলায়। আমাদের বাংলার মানুষ মরছে, তাই কষ্টটাও আমাদের।’ বলেই বখতিয়ার উদ্দিন আবারও স্লোগান ধরলেন। তাঁর সাথে গলা মিলালো উত্তেজিত জনতা। ব্রিটিশ সেনারা তখন গুলি ছুড়লে, বেশ কয়েকজন জনতা বুক পেতে লুপে নেয় সেই গুলি। রক্তাক্ত হয়ে পড়ে রাজপথ। বখতিয়ার উদ্দিন সামনের ব্রিটিশ সেনাকে ধাক্কা দিয়ে আহত একজনকে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘শামছু, শামছু, চোখ খোল ভাই। কিচ্ছু হবে না।’ তারপর বাকিদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এই, আহত সবাইকে ধরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো।’
যে সেনাটাকে বখতিয়ার উদ্দিন ধাক্কা দিয়েছিলেন, সে এসে এবার লাথি মারলো তাঁকে। তা দেখে রিহানের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। ব্রিটিশ সেনার বন্দুকটা কেড়ে নিয়ে ‘ঠা রা রা’ করে গুলি চালালো কয়েক রাউন্ড। সাতজন ছিল ওরা ব্রিটিশ সেনা। ছয়জন গাড়ি থেকে নেমেছিল। চালকের সিটে একজন বসা ছিল। সঙ্গীদের মরতে দেখে সে পালিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে।
নিজেদের আহত লোকগুলোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনজন ইতোমধ্যে মারা গেছে। ব্রিটিশ ছয়জনও ছটফট করতে করতে মারা গেছে। বখতিয়ার উদ্দিন রিহানের কাঁধে হাত রাখলেন। আফসোস করে বললেন, ‘এ তুমি কী করলে রিহান? ওরা তো এখন আবার আসবে। এবার প্রস্তুতি নিয়ে আসবে। তোমার উচিত হয়নি এভাবে মাথা গরম করার।’
রিহান জবাব দিলো, ‘আপনার মতো সম্মানিত একজনকে ওরা লাথি মেরেছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে তো চেয়ে থাকতে পারি না।’
‘কিন্তু একটা নতুন বিপদ ডেকে আনলে। তুমি কিছুদিন পালিয়ে থাকো।’
‘আপনি যা বলেন, তাই হবে। তবে সুফিয়ার সাথে একবার দেখা করতে চাই আমি।’
জমিদার সলিমুদ্দিনও পরামর্শ দিলেন রিহানকে পালিয়ে যেতে। পুরো ঘটনাটা শুনে সুফিয়া তো কেঁদে একাকার। তাকে কক্ষে ডেকে নিয়ে রিহান বলে, ‘এভাবে কেঁদো না, তোমার স্বামী ব্রিটিশ মেরেছে। ব্রিটিশ মারলে তো খুশি হওয়ার কথা।’
‘সেজন্য আমি কাঁদছি না। আপনাকে যে আমি সবসময় কাছে পাবো না, তাই আমি কাঁদছি। ধ্বংস হোক ব্রিটিশ হায়েনা।’
‘আমি গোপনে আসবো তোমার সাথে দেখা করতে।’
‘কিন্তু, একা আপনি কোথায় থাকবেন? তাছাড়া আপনি এই যুগেরও কেউ না। অনেক কষ্ট হবে আপনার। ব্রিটিশদের হাতে পড়ে গেলে আমার আর আমার সন্তানের কী হবে?’
‘ভেবো না, ব্রিটিশরা কিছুই করতে পারবে না আমার। আমার সন্তানের মুখ না দেখে আমি মরবো না।’ আলতো করে সুফিয়ার পেটে হাত বুলিয়ে দিলো রিহান। সুফিয়ার কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, ‘লাথি মারে তো পেটের ভেতরে?’
চোখের জল মুছে উপর-নিচ মাথা দুলায় সুফিয়া। রিহান তার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে অশ্রু মুছে দিলো। দূর থেকে ব্রিটিশদের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। রিহান সুফিয়ার কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করলো কয়েকটা ব্রিটিশ সেনার গাড়ি। আগের সেই গাড়িটাও এসেছে, যেটা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল একজন। সে-ই নিয়ে এসেছে সবাইকে। তারা এসে রিহানের খোঁজ করলো। পুরো বাড়ি তল্লাশি করলো। কিন্তু পেল না। শেষে একজন ব্রিটিশ সেনা সুফিয়াকে দেখে ডাকলো। সুফিয়া তাকে দেখে ভয়ে চমকে উঠলো। এ কী করে সম্ভব? এই লোকটাকে তো রিহান নিজ হাতে মেরে ফেলেছিল ওইদিন ক্যাম্প থেকে পালানোর সময়? লোকটা বেঁচে গেল কী করে?
সুফিয়া ভয়ে ভয়ে কাছে এলে ব্রিটিশ সেনাটা তাকে ধরে টেনে নিয়ে গেল ঘর থেকে বের করে। জমিদার সলিমুদ্দিন তখন গর্জে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ও কী করেছে?’
ব্রিটিশ সেনা তাঁর বাংলা কথা না বুঝলেও আন্দাজ করে জবাব দিলেন ইংরেজিতে, ‘এই মেয়েটা আমার জমজ ভাইকে খুন করে পালিয়ে এসেছে। সেদিন ক্যাম্পে আমি দেখেছিলাম এই মেয়েটাকে আমার ভাই কারাকক্ষ থেকে বের করে একটা নতুন ভবনের দিকে নিয়ে গেছিল। পরে ওখানে আমার ভাইয়ের লাশ পাওয়া যায়, এই মেয়েটাকে পাওয়া যায়নি।’ বলেই গাড়িতে তুলে নিলো সুফিয়াকে।
বৃদ্ধ সলিমুদ্দিন উত্তেজিত হয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘ও খুন করেনি। ওকে ছেড়ে দাও তোমরা। আমাকে নিয়ে যাও ওর বদলে।’
উনার কথা কানে না তুলে সুফিয়াকে নিয়ে চললো ওরা সাথে। সুফিয়া ‘দাদা, দাদা’ বলে পেছনে ফিরে চিৎকার করতে লাগলো চলন্ত গাড়িতে। আড়াল থেকেই সব লুকিয়ে দেখে রিহান। এবার সে নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারলো না। সুফিয়াকে নিয়ে যেতে দেখে পিছুপিছু সেও দৌড়ে সুফিয়ার নাম ধরে। ব্রিটিশদের গাড়ি তখন থামে। রিহান পালিয়ে গেল না, ভয় পাচ্ছে না সে আর। তার সব ভয় সুফিয়াকে ঘিরে। সুফিয়ার কিছু হলে সে সহ্য করতে পারবে না। গাড়ি থেকে আগের ব্রিটিশ সেনাটা নামলো, যে সুফিয়াকে চিহ্নিত করেছে। চালকের সিটে বসা ব্রিটিশটার নজর রিহানের উপর পড়লে, সে চিৎকার করে উঠে, ‘দিস ইজ দ্যাট গাই।’
রিহানকে বন্দুকের বাট দিয়ে কয়েকটা আঘাত করা হলো জোরে। তার ঠোঁট কেটে রক্ত বের হতে লাগলো। সুফিয়া কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘ওকে ছেড়ে দাও।’
রিহানকে মেরে দুর্বল করে ফেললে গাড়িতে তুলে বসালো সুফিয়ার পাশে। সুফিয়া কান্নার বেগ বাড়িয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে রিহানের সারা মুখ মুছে দিলো। ঠোঁটের রক্ত লেগে তার সাদা শাড়িটা রক্তলাল হয়ে ওঠলো। অভিমান করে সে প্রশ্ন করলো, ‘কেন এলে ওদের সামনে? কে আসতে বলেছে?’
রিহান জোর করে হেসে বললো, ‘তোমাকে একা ওদের সাথে পাঠাবো ভাবছো না-কি?’
‘পুনরায় যদি আমাদেরকে ওই ক্যাম্পে নিয়ে যায়, তবে কী হবে জানো?’
‘তাহলে আমরা তিনজন মারা যাবো। আমি, তুমি আর আমাদের অনাগত সন্তান।’ অসহায় শুনালো রিহানের কণ্ঠ।
[[চলবে…]]