টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১) পর্ব ১৭

0
315

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১৭
লেখা: ShoheL Rana শামী

সুফিয়া পা ছুঁয়ে সালাম করলে, জমিদার সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আমি তো চিনছি না তোমাদের। আমাকে দাদামশাই বলছো কেন?’ জমিদার সাহেবের চোখে এখনও বিস্ময়। তার বিস্ময় কাটাতে রিহান প্রশ্ন করলো, ‘আপনার বড়ো ছেলে জাফরের কথা মনে আছে?’

‘জাফর!’ নামটা শুনেই চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠলো যেন জমিদার সাহেবের। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার ছেলে, আমার ছেলে কোথায় এখন?’ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন তিনি। চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু বেরিয়ে এলো। হঠাৎ যেন আবেগ ধরে রাখতে পারেননি।

রিহান কণ্ঠটা নিচু করে বললো, ‘জাফর আংকেল মারা গেছেন প্রায় দু’মাস হতে চললো। এই যে সুফিয়া, জাফর আংকেলের একমাত্র মেয়ে।’

‘না, তোমরা মিথ্যা বলছো। আমার ছেলে মরেনি। আমার ছেলে অভিমান করে চলে গেছে আমার বাড়ি থেকে। ও আবার ফিরে আসবে।’ হু হু করে কেঁদে ওঠলেন এবার বৃদ্ধ। রিহানের কথা যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না উনি। সুফিয়া তাঁকে দু’হাতে ধরে অসহায় কণ্ঠে বললো, ‘আমার মাকে বন্ধ্যা অপবাদ দিয়েছিলেন সবাই মিলে, আমার মা বন্ধ্যা ছিল না। এই যে আমাকে দেখুন, আমি আমার মায়ের মেয়ে।’

‘ওরে থাম, থাম রে আমার দাদাভাই। আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছিল। সেই ভুলটা আর মনে করিয়ে দিস না। আয় আমার বুকে আয়।’ বলেই সুফিয়াকে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন জমিদার সলিমুদ্দিন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর মা জাহানারা এখন কোথায়? ও আসেনি সাথে?’

‘মা মারা গেছে আরও অনেক আগে। আমি এখন এতিম হয়ে গেছি।’ দাদার বুকে কান্নায় ভেঙে পড়লো সুফিয়া। ভেতর থেকে আরও বেশ কয়েকজন এসে উপস্থিত হলো। সবাই বুঝতে চেষ্টা করছে ঘটনাটা। পরে জমিদার সলিমুদ্দিন নিজেকে সামলিয়ে পরিবারের সবাইকে ঘটনাটা বুঝিয়ে বললেন। সবাই অনেক খুশি হলেও সুফিয়ার বাবা-মার মৃত্যু হয়েছে শুনে কষ্টও পেল অনেক। কিন্তু, সবই তো আল্লাহর ইচ্ছে। যা পেয়েছে তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে সুফিয়া এবং রিহানকে ঘরে তুলে নিলো। একফাঁকে সুফিয়া সবাইকে জানিয়ে দিলো, রিহান তার স্বামী।

জমিদার বাড়িতেই কাটতে লাগলো সুফিয়ার পরবর্তী দিনগুলো। সুফিয়া অবশ্য বিশ্বাস করতে পারছিল না পুরো ঘটনাটা। এটা কি আসলেই তার দাদাবাড়ি? তার দাদা কি আসলেই এতবড়ো জমিদার? বেঁচে থাকতে বাবার মুখে কখনও দাদাবাড়ির গল্প শুনেনি সে। তাছাড়া এটা তার দাদা বাড়ি না হওয়ারও কোনো ফুরসত নেই। সবাই যেভাবে কান্নাকাটি করে তাকে গ্রহণ করেছে, তখন বিশ্বাস হতেই পারে এটাই সুফিয়ার দাদাবাড়ি। কিন্তু, রিহান কী করে জানলো এতকিছু? সে কী করে জানলো জমিদার সলিমুদ্দিন সুফিয়ার দাদামশাই? প্রশ্নটা অবশ্য রিহানকে করতে ভুলেনি সুফিয়া।

‘আচ্ছা, আপনি কী করে জানলেন আমার দাদাবাড়ি এখানে? জমিদার সলিমুদ্দিন আমার দাদা?’

রিহান জবাব দিলো, ‘আমি আংকেল থেকেই জেনেছি। আংকেল তো প্রায় কলকাতায় বোনের কাছে পাঠানোর জন্য চিঠি লিখতেন। আরও একদিন উনি চিঠি লিখছিলেন, ঐ সময় আমি গিয়ে উনার সাথে কথা বলি। তুমি কখনও খেয়াল করেছো কি-না জানি না, চিঠি লেখার সময় আংকেলের মনটা অনেক স্মৃতিকাতর থাকে। ঐ সময় যদি পরিবার-পরিজন নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, উনি সব বলে দিতেন। আমি ঐ সময় তোমার দাদাবাড়ি সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জেনে নিই। কারণ একবার তুমি বলেছিলে, দাদাবাড়ি সম্পর্কে কিছুই জানো না তুমি। সেদিন তোমার কথা শুনে খারাপ লেগেছিল।’

‘পৃথিবীতে সেই মেয়ে ভাগ্যবতী, যার স্বামী স্ত্রীর মনের অব্যক্ত কথা বোঝার শক্তি রাখে।’ মন্তব্য করলো সুফিয়া।

‘আমি কি ভাগ্যবতীর স্বামীর দলে পড়ি?’ দুষ্টুমি করে প্রশ্ন করে রিহান। সুফিয়া জিভ দেখিয়ে হেসে চলে গেল ভেতরে।

সুফিয়ার আগমনে জমিদার বাড়িতে সাত দিন উৎসব হওয়ার ঘোষণা দিলেন জমিদার সলিমুদ্দিন। সাতদিন ধরে গরিব-মিসকিনদের খাওয়ানো হবে। আর পরবর্তী দুমাস সকল জমির খাজনা মাফ। গ্রামবাসীও খুব খুশি এতে।

প্রতিদিন বড়ো বড়ো গরু-মহিষ জবাই করে খাবারের আয়োজন করা হয়। সাতদিন ধরে গ্রামে কারও বাড়িতে খাবার রান্না করতে হয়নি। সবাই জমিদার বাড়িতে দলবেঁধে এসে খেয়ে যায়। এসে গল্প করে, মজা করে, সুফিয়া আর রিহানকে দোয়া করে যায়। উৎসবের শেষের দিন জমিদার বাড়িতে এলাকার সব লোক উপস্থিত হলে, রিহান তাদেরকে খাবার শেষে চলে না যাওয়ার অনুরোধ করে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। উপস্থিত সবাই কিছুটা অবাক হলেও, রিহান কী কথা বলবে শোনার জন্য আগ্রহ দেখালো তারা। জমিদার সলিমুদ্দিন ডাকলেন রিহানকে। তিনিও অনবগত এ ব্যাপারে। রিহানকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

‘আচ্ছা দাদুভাই, বলো তো, কী নিয়ে কথা বলতে চাও তুমি?’

‘দাদামশাই, তার আগে আমাকে একটা ওয়াদা করতে হবে।’

‘বলো, তুমি যা চাও, পাবে।’

‘সত্যি তো?’

‘হ্যাঁ, সত্যি।’

‘আমি চাই, আপনি আগামী এক বছরের জন্য কারও কাছ থেকে খাজনা নিবেন না।’

‘এক বছরের জন্য? কেন বলো তো?’

সুফিয়াও এসে দাঁড়ায় ওখানে। বাড়ির বাকি সদস্যরা আসে। সুফিয়া ভয় পাচ্ছে, রিহান হুট করে সবার সামনে বলে বসবে না তো সে ভবিষ্যতের লোক? রিহানের দিকে তাকালো সে। রিহানও তাকালো। মাথা নেড়ে, চোখের ভাষায় সুফিয়া তাকে মিনতি করলো ওসব যেন না বলে। রিহান তারদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জমিদার সাহেবকে বললো, ‘দাদামশাই, আমি এই বাংলার ভবিষ্যত আন্দাজ করতে পারছি। খুব বড়ো ধরনের একটা দুর্ভিক্ষ আসতে চলেছে। বাংলা সং ১৩৫০-এ দুর্ভিক্ষটা হবে, তাই দুর্ভিক্ষের নাম হবে পঞ্চাশের মনন্তর। অনেক লোক খাদ্যের অভাবে মারা যাবে। আমি চাই, আপনি জমির খাজনা মাফ করে দিন, আর ঘোষণা করুন, সবাই যেন জমিতে ধান, গমসহ নানাজাতের ফসল ফলায়। আফসোসের বিষয়, খুব কম ফসল হবে জমিতে। নিজের যা ফসল আছে, তা যেন এখন থেকে সংরক্ষণ করে রাখে সবাই, কেউ যেন খাবার অপচয় না করে।’

‘কিন্তু, পরের বছর দুর্ভিক্ষ হবে, তুমি এখন থেকে জানলে কী করে?’ প্রশ্নটা করলেন বখতিয়ার উদ্দিন। সুফিয়ার একমাত্র চাচা। ‘তুমি কি অন্তর্যামী?’

রিহান মুখটা বিবর্ণ করে পুনরায় তাকালো সুফিয়ার দিকে। সুফিয়া সবার আড়ালে হাত জোড় করলো রিহানের উদ্দেশ্যে, যেন উলটাপালটা কিছু না বলে। রিহানও নিজের তথ্যটা গোপন রেখে বললো, ‘এটা পুরোটাই আসলে আমার আন্দাজ। আমার এই আন্দাজের পেছনে কিছু কারণ হচ্ছে, এবছর বৃষ্টি খুব কম হচ্ছে, তাই ভালো ফসল হবে না। বার্মা থেকে চাল আমদানি হতো, কিন্তু এখন চাল আমদানি বন্ধ, আর ব্রিটিশদের পক্ষে যেসব সেনারা জাপান-জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে, তাদের প্রচুর খাদ্যের প্রয়োজন হবে, তাই ব্রিটিশ সরকার বেশিরভাগ খাবার মজুদ করে রাখবে। বাংলার মানুষ খাবার মতো কিছুই পাবে না। খাবারের অভাবে মারা যাবে। আমরা যেন মৃত্যুর মিছিলটা একটু কমাতে পারি, সেই চেষ্টা কি করতে পারি না?’

‘ভবিষ্যতে কী হবে সেটা আন্দাজের উপর নির্ভর করে আমরা এতকিছু করতে যাবো কেন?’ বখতিয়ার উদ্দিন এখনও একমত হতে পারছেন না রিহানের সাথে। তাঁকে থামিয়ে সলিমুদ্দিন বললেন, ‘বেশ, তাই হবে। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা আমি জানি না। শুধু তোমার আবদার রাখার জন্য, আর আমার দাদুভাই সুফিয়াকে খুশি করার জন্যই আমি তোমার কথাগুলো জনগণের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করবো। আগামী একবছর কারও কাছে জমির খাজনা নেয়া হবে না।’ বলেই হাতের ইশারায় তিনি সুফিয়াকে ডাকলেন। সুফিয়া দৌড়ে গিয়ে তাঁর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। রিহানও অন্য পাশে গিয়ে জমিদার সাহেবের কাঁধে মাথা রেখে মৃদু হাসলো। জমিদার সলিমুদ্দিন দুজনকে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিলেন গায়ে।

সেদিন জমিদার সলিমুদ্দিন ঠিকই ঘোষণা করলেন রিহানের কথাগুলো। অল্প লোকে কথাগুলোর গুরুত্ব দিলেও, বেশিসংখ্যক লোক কথাগুলো বিদ্রুপ করেই উড়িয়ে দিলো। অনেকে বিরক্ত হয়ে বললো, ‘এটা কি সাতদিন ধরে খাওয়ানোর শাস্তি? এতক্ষণ ধরে এভাবে দাঁড় করিয়ে এসব কী শুনানো হচ্ছে, উদ্ভট কথাবার্তা!’

তবে খাজনা মওকুফের মেয়াদ বাড়ায় সবাই খুশিমনেই ফিরে গেল ঘরে।

এই ঘটনার ঠিক সাত মাস পর ঐ লোকগুলোই আবার এসে হাজির জমিদার বাড়িতে, যারা সেদিন বিদ্রুপ করেছিল। সবার হাতে ভিক্ষার থলি, শুকনো চেহারা দেখে বোঝা যায় বেশ কয়েকদিন ধরে এরা অভুক্ত। পরনের কাপড়ের ভেতর শরীরটাকে তাদের মনে হলো যেন একটা কঙ্কাল। ওরা এসে একবেলা খাবার চাইলে, রিহান তাদেরকে সাতমাস আগের ঘটনা মনে করিয়ে দিলো। তখন সবাই কান্না করতে করতে বললো, ‘আমরা ভুল করেছি। আমাদের মাফ করে দিন। আমরা সেদিন আপনার কথাগুলো বিশ্বাস করিনি।’

রিহান বললো, ‘যারা ভবিষ্যতের কথা ভেবে পূর্বেই প্রস্তুতি নেয়, তাদের ভবিষ্যতের প্রায় অর্ধেকের বেশি বাধা-বিঘ্নতা কেটে যায়। আপনারা সেদিন আমার কথাগুলো বিশ্বাস করেননি, তারপরও যদি একটু আপনাদেরকে দেয়া জমিগুলোতে ফসল ফলাতেন? খাজনা মাফ পেয়ে কী করেছেন এই সাত মাসে? বেশিরভাগ জমি খালি রেখে দিয়েছেন।’

জমিদার সলিমুদ্দিন এসে দাঁড়ালেন। এবার তিনি মন্তব্য করলেন, ‘এই লোকগুলোর এটাই প্রাপ্য ছিল। রিহান দাদুভাই, তোমার উপর ছেড়ে দিলাম, এদের কী করা যায়, তুমিই বলো।’

‘আমি যা বলি, অনুরোধ রাখবেন তো?’

‘আগে কি কখনও রাখিনি?’

‘রেখেছেন। আজও রাখবেন, বিশ্বাস করি। আমরা তো কিছুটা হলেও ধান, গম সংরক্ষণ করতে পেরেছি জমিদার বাড়িতে। এই অসহায় লোকগুলোকে অল্প অল্প করে কি দিতে পারি না?’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই পারি।’

রিহান মৃদু হাসলো। হেসে বললো, ‘তবে এই লোকগুলোকে একটু সন্তুষ্ট করার ব্যবস্থা করুন।’ রিহান কথাটা বলেই ভেতরের দিকে হাঁটলো। সুফিয়া তার হাঁত ধরে নিজেদের কক্ষে টেনে নিয়ে গেল। তারপর অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো সে রিহানের দিকে বেশ কিছুক্ষণ। রিহান মাথা দুলিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কী?’

‘সত্যি আপনি এসব আগে থেকে জানতেন?’

‘এখনও অবিশ্বাস?’

‘আমার পেটের বাচ্চা ছুঁয়ে বলুন।’

রিহান সুফিয়ার পেটের উপর আলতো করে হাত রাখলো। কয়েকমুহূর্ত দম নিয়ে বললো, ‘এই যে ছুঁলাম আমাদের অনাগত সন্তানকে। আমি কোনো মিথ্যা বলিনি। সব তো দেখতেই পেলে।’

সুফিয়ার মুখ দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছিলো না। এবার সেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, রিহান আসলেই ভবিষ্যতের লোক। অনেকক্ষণ পর সে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘সত্যিই কি ঐদিন বিমান দুর্ঘটনায় রস গ্রেগরিও ছিলেন?’

সুফিয়ার প্রশ্নের মুহূর্তেই জবাব না দিয়ে এক নজরে তার চেহারার দিকে চেয়ে থাকে রিহান। খুব অসহায় লাগছে সুফিয়াকে…’

[[চলবে….]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here