টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১) পর্ব ১৬

0
290

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১৬
লেখা: ShoheL Rana শামী

ক্যাম্পের যে জায়গাটায় নতুন ভবনের কাজ চলছে, ওখানেই আনা হয়েছে সুফিয়াকে। দুর্বল হয়ে নিচে পড়ে আছে সে। ইতোমধ্যে অনেক চড় থাপ্পড় চলেছে তার উপর। ব্রিটিশ সেনাটা এবার তার শাড়িতে হাত রাখলো। চোখেমুখে কামনা নিয়ে আঁচল ধরে টানতে লাগলো। নির্বাক সুফিয়া কেবল চেয়ে থাকলো তার দিকে। বাধা দেয়ার মতোও শক্তি নেই তার। চোখ দিয়ে কেবল অশ্রু ঝরতে লাগলো। তার প্রতিটা অশ্রুফোঁটা যেন মিনতি করে বলছে, ‘আমার সর্বনাশ করো না প্লিজ।’

ব্রিটিশ সেনাটা সুফিয়ার শাড়িটা খুলে নিয়ে ছুড়ে ফেললো। পৈশাচিক এক হাসি দিয়ে সে এবার তার ব্লাউজে হাত দিলো। বাহিরে ‘খুট’ করে একটা শব্দ হলো তখন। হাত সরিয়ে পেছনে তাকালো ব্রিটিশ সেনা। তাদের পোশাক পরা একজন অপরিচিতকে দেখে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলো, ‘কে তুমি?’

সুফিয়ার দৃষ্টি গেল এবার আগন্তুকের উপর। আগন্তুককে দেখে সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। সে জানতো রিহান তাকে ঠিকই বাঁচাতে আসবে। হাসি ফুটে ওঠলো সুফিয়ার মুখে। তার হাসি দেখে ব্রিটিশ সেনাটার সন্দেহ হলো। তাই দৌড়ে গিয়ে মারতে গেল রিহানকে। তার আগেই রিহান পাশ থেকে একটা ইট তুলে নিয়ে ক্ষিপ্র বেগে আঘাত করলো ব্রিটিশ সেনাটার মাথায়। তারপর তার মুখটা চেপে ধরলো যাতে চিৎকার করতে না পারে। সুফিয়ার দিকে চোখ গেল রিহানের। সাথে সাথে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো সে। সুফিয়ার এই অবস্থা সে দেখতে পারবে না। তার সকল রাগ গিয়ে পড়লো ব্রিটিশ সেনাটার উপর। এক হাতে সে ওর মুখ চেপে ধরে অন্য হাত দিয়ে ইটের আঘাত করতে লাগলো মাথায়। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল ব্রিটিশ সেনাটা। তারপরও থামলো না রিহান। যতক্ষণ তার রাগ মিটেনি ততক্ষণ সে ইট দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে রক্তাক্ত করে দিলো ওকে। শেষে মৃত্যু নিশ্চিত করে থামলো। তারপর শাড়িটা খুঁজে নিয়ে সুফিয়ার শরীর ঢেকে দিলো, শেকলের বাঁধনটাও খুলে দিলো। দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সুফিয়া। পাশে একটা মশাল জ্বলছিল, ওটা নিভিয়ে দিয়ে রিহান বললো, ‘শাড়িটা পরে নাও, আমাদের এখনই পালাতে হবে এখান থেকে।’

কয়েক মিনিট সময় নিয়ে শাড়িটা পরে নিলো সুফিয়া। তারপর রিহানের হাত ধরে পালানোর জন্য বের হলো। আর কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি তাদের। শুধু ক্যাম্পের প্রবেশ পথে বড়ো তালা ঝুলানো ছিল বলে দেয়াল টপকে পার হতে হয়েছে। দুর্বল শরীর নিয়ে সুফিয়া প্রথমে দেয়াল টপকাতে পারছিল না, পরে রিহান তাকে সাহায্য করে।

ব্রিটিশ সেনার পোশাক খুলে, ফেলে দিলো রিহান। তারপর ব্যাগ থেকে নিজের একটা পোশাক বের করে পরে নিলো। ক্যাম্প থেকে সে ব্যাগটাও নিতে পেরেছে। প্রথমে যে ব্রিটিশ সেনাটাকে গলায় তার প্যাঁচিয়ে হত্যা করেছিল, তার কক্ষেই ছিল ব্যাগটা।

অন্ধকারে হাঁটতে লাগলো দুজন। হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে ওঠলো সুফিয়া। রিহানের একটা হাত ধরে থেমে গেল সে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আমি আর হাঁটতে পারছি না।’

দ্বিতীয়বার না ভেবে সুফিয়াকে কোলে তুলে নিলো রিহান। সুফিয়া চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললো। আলতো করে সে দু’হাতে রিহানের গলা জড়িয়ে ধরলো। রিহান তাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে লাগলো অন্ধকারে। নিজেও সে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে তা বুঝতে দিলো না সুফিয়াকে। এই মুহূর্তে তাদের একটা নিরাপদ দূরত্বে সরতে হবে। ক্যাম্প থেকে অনেকটা দূর সরে আসার পর একটা মসজিদ নজরে পড়লো ওদের। মসজিদের ভেতরে আলো জ্বলছে। উঠোনে গিয়ে রিহান সুফিয়াকে কোল থেকে নামালো। সুফিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘আমরা এখানে এসেছি কেন?’

‘আজ রাতটা এই মসজিদে কাটাবো আমরা।’ জবাব দিলো রিহান। একটু পর ভেতর থেকে ল্যাম্প হাতে এক লোক বের হলেন। উনি হয়তো মসজিদের ইমাম। মসজিদেই থাকেন। বাইরে তাদের আওয়াজ শুনে দেখতে বের হয়েছেন কারা কথা বলছে। ইমাম সাহেব ল্যাম্পটা উপরে তুলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কারা আপনারা?’

‘হুজুর আমরা বিপদে পড়েছি। আজ রাতটা আমাদের একটু আশ্রয় লাগবে।’ এগিয়ে গিয়ে বললো রিহান। তারপর সে সবকিছু খুলে বললো ইমাম সাহেবকে। শুনে ইমাম সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, আশ্রয় নেবেন। কিন্তু, আপনারা কি স্বামী-স্ত্রী?’

পরস্পরের দিকে তাকালো রিহান এবং সুফিয়া। তারপর আমতা আমতা করে রিহান বললো, ‘আমাদের এখনও বিয়ে হয়নি। আপনি আমাদের বিয়েটা পড়ায় দিবেন?’ কথাটা বলেই রিহান তাকালো সুফিয়ার দিকে। সুফিয়া বেশ অবাক হলো হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে। তবে তার চোখের ভাষায় প্রকাশ পেল বিয়েতে সে রাজি। এবার ইমাম সাহেব বললেন, ‘বিয়ে পড়াবো, তা ঠিক আছে। তবে দুজন সাক্ষী তো লাগবে। আচ্ছা, সাক্ষী আমার কাছে আছে।’ বলেই ইমাম সাহেব বাচ্চু এবং কালাম নামে দুজনের নাম ধরে ডাকলেন। ঘুম-ঘুম ভাব নিয়ে ভেতর থেকে দুজন বের হলো। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে ইমাম সাহেব তাদেরকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন। এরপর ওখানেই বিয়ে হয়ে গেল রিহান এবং সুফিয়ার। ওদেরকে ভেতরে থাকতে দিয়ে বাকিরা বারান্দায় রাত কাটালো।

পরদিন যখন ওরা চলে যাচ্ছিলো, ইমাম সাহেব নব্য দম্পতির হাতে অল্প কিছু পয়সা দিলেন, যাতে তাদের কাজে লাগে। এর আগে দুজনকে পেটভরে খাওয়ালেন। উনার এই আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলো রিহান সুফিয়া দুজনই। যাওয়ার আগে রিহান ইমাম সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আপনার কাছে আমর ঋণী হয়ে গেলাম।’

‘ইমাম সাহেব হেসে জবাব দিলেন, ‘ঋণের কথা আসছে কেন এখানে? এটা আমার কর্তব্য। বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেকের কর্তব্য।’

‘দোয়া করবেন আমাদের জন্য।’ সুফিয়াকে নিয়ে বের হয়ে এলো রিহান। একটা ট্যাক্সি ডাকলো সে। সুফিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘তোমার স্বামী তোমাকে যেখানে নিয়ে যাবে, যেতে পারবে না?’

মৃদু হেসে মাথা কাত করে সুফিয়া হ্যাঁসূচক সম্মতি জানালো।

ট্যাক্সিতে উঠে রিহান ড্রাইভারকে একটা ঠিকানা দিলো। সেই ঠিকানায় চললো ট্যাক্সি। রিহানের গা ঘেঁষে বসে তার কাঁধে মাথা রেখেছে সুফিয়া। রিহান তার কোমর জড়িয়ে ধরেছে আলতো করে। মাথা তুলে রিহানের দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হাসলো সুফিয়া। আলতো কণ্ঠে বললো, ‘আপনার কাঁধে মাথা রেখে যে সুখটা এখন পাচ্ছি, এমন সুখ কবে পেয়েছি মনে করতে পারছি না।’

‘আমাকে কি আপন করতে পারোনি? না-কি হুট করে বিয়ে করে নিয়েছি বলে পর পর মনে হচ্ছে?’

‘এমন কথা বলছেন কেন?’

‘এই যে আমাকে আপনি আপনি করছো।’

‘আমি আপনি করেই বলবো। আপনি আমার আপনি। তবে আমার খুব আপনজন।’ বলেই লজ্জা পেল সুফিয়া। আবারও মাথা রাখলো সে রিহানের কাঁধে। রিহান তার মুখটা পুনরায় তুললে সুফিয়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। হঠাৎ যেন সব লজ্জা এসে ভর করছে তার উপর। রিহান ফিসফিস করে বললো, ‘চোখ খুলো।’

ধীরে ধীরে চোখ খুললো সুফিয়া। তবে রিহানকে সতর্ক করলো যেন কিছু করে না বসে। হঠাৎ ড্রাইভারের চোখে পড়ে গেলে লজ্জার সীমা থাকবে না। রিহান প্রশ্ন করলো, ‘আমাকে বিয়ে করে খুশি তো?’

‘অনেক খুশি।’

‘আর আমি যে ভবিষ্যতের লোক, এটা বিশ্বাস করতে পেরেছো?’

‘এখনও না।’

‘বিশ্বাস হবে। পরের বছর বাংলায় বড়ো একটা দুর্ভিক্ষ হবে। যেই দুর্ভিক্ষটা ইতিহাসে পঞ্চাশের মনন্তর নামে লেখা থাকবে। সেই সময় বাংলার অনেক মানুষ মারা যাবে খাবার না পেয়ে। পথেঘাটে যেন মৃত্যুর মিছিল হবে। ভালো ফসলও হবে না। বার্মা থেকে চাল আসবে না। কারণ, বার্মা জাপানের দখলে। আর বাংলার মানুষ অনাহারে মারা যাবে, এতে সবচেয়ে বেশি দায় থাকবে কার জানো?’

‘কার?’

‘ব্রিটিশ সরকারের। এরা ফিরেও তাকাবে না বাংলার মানুষের দিকে। খাদ্যও পাঠাবে না।’

চুপ করে শুনলো সুফিয়া রিহানের কথাগুলো। বিশ্বাস করবে কি করবে না দ্বিধায় পড়ে গেল। রিহান আবারও বলে উঠলো, ‘আমি ঐ সময় আংকেলের কথায় বিয়েতে রাজি হইনি, কারণ একটা ভয় ছিল, হুট করে যদি আমি আমার যুগে ফিরে যাই, তবে তোমার কী হবে? তুমি তো খুব কষ্ট পাবে। কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে আমি কখনও আর আমার যুগে ফিরতে পারবো না। আর তুমিও বাবাকে হারিয়ে খুব একা হয়ে পড়েছো। তাই বিয়ে করে তোমার জীবনের সঙ্গী হয়েছি।’

‘সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম জানেন, যখন বাবার কথায় আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হোননি। আমি তো আপনাকে চাইতাম মনে মনে খুব।’

‘এখন তো জীবনসঙ্গী হয়ে গেছি তোমার। এখনও আফসোস আছে?’

‘না। আফসোসের মৃত্যু হয়েছে কাল রাতেই।’

প্রায় আড়াই ঘন্টা পর ট্যাক্সি এসে থামলো একটা গ্রামে। রিহান ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নামলো সুফিয়াকে নিয়ে। একটা গ্রাম এলাকা। সুফিয়া আগে কখনও আসেনি এখানে। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘এ কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে? আপনার এলাকায় না-কি? আমার শ্বশুরবাড়ি কি এখানে তবে?’

‘তারমানে এখনও বিশ্বাস করোনি আমি যে ভবিষ্যতের লোক। আমি বাড়ি কোথায় পাবো এই যুগে, বলো? কোথায় নিয়ে এসেছি দেখতে পাবে, চলো।’ সুফিয়ার হাত ধরে হাঁটলো রিহান। কিছুদূর হেঁটে এক লোককে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাই, সলিমুদ্দিন সাহেবের বাড়ি কোনটা বলতে পারেন?’

‘সলিমুদ্দিন মানে আমাগো জমিদার সলিমুদ্দিনের কথা কচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, উনি’

‘ঐ যে বড়ো প্রাসাদ-বাড়িটা দ্যাখতাছেন, ঐডায় জমিদার সাবের বাড়ি। ঐহানে আপনাগো কী কাম?’

‘আছে একটা কাজ। আপনাকে ধন্যবাদ।’ বলেই পুনরায় হাঁটতে লাগলো ওরা প্রাসাদটার দিকে। সুফিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘কে এই সলিমুদ্দিন? আপনি কী করে চিনেন?’

‘ওখানে গেলেই জানতে পারবে।’

প্রাসাদটার ভেতরে ঢুকতে চাইলে দুজন পাহারাদার পথ আটকালো ওদের। একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘কী চায়?’

‘সলিমুদ্দীন সাহেব আছেন? উনার সাথে দেখা করতে চাই।’ বললো রিহান।

‘আমাদের জমিদারের নাম মুখে নিছেন? আপনার তো অনেক সাহস! বের হয়ে যান এখনই।’ চিৎকার করে বললো অন্য পাহারাদার।

প্রাসাদের বারান্দায় এক বৃদ্ধ বসে তখন একটা বই পড়ছিলেন। চিৎকার শুনে তিনি তাকালেন। তারপর গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে ওখানে? ওদেরকে পাঠিয়ে দাও।’

পাহারাদার দুজন পথ ছেড়ে দিলো এবার। রিহান সুফিয়াকে নিয়ে বৃদ্ধের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলো, ‘কারা বাছা তোমরা? কী চাও?’

‘আপনি কি জমিদার সলিমুদ্দিন?’

‘হ্যাঁ।’ ভ্রু কুঁচকালেন বৃদ্ধ।

রিহান গিয়ে উনার কদমবুসি করলো। তারপর সুফিয়াকে বললো, ‘সালাম করো। উনি তোমার দাদামশাই। আর এটা তোমার দাদাবাড়ি।’

‘দাদাবাড়ি? আমার দাদামশাই!’ বিস্ময়ে কথা যেন বের হচ্ছিল না সুফিয়ার মুখ দিয়ে।

[[চলবে…]]

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here