#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১৫
লেখা: ShoheL Rana শামী
কোনো জবাব দেয় না রিহান। সুফিয়াকে টেনে বসায় সে পাশে। সুফিয়া নীরবে কেঁদে চলেছে। রিহান অন্ধকারে তার চোখের অশ্রু মুছে বলে, ‘আমাদের এখন ভেঙে পড়লে হবে না। শান্ত হোন। শুনুন একটা কথা বলি।’
‘বলুন।’ নিজেকে সামলালো সুফিয়া।
‘আজ একজনের ফাঁসি হয়েছে। তার কক্ষটা হয়তো খালি হয়েছে। আপনাকে তার কক্ষে নিয়ে যেতে পারে।’
‘না না, আমি যাবো না। আমি ওখানে মরে যাবো গেলে।’
‘শুনুন, শক্ত হোন। এতদিন এই বন্দী জীবনে ভাবতাম- যা হবার হবে, সব ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিবো। ওরা আমাকে ফাঁসিতে ঝুলাবে আপত্তি নেই। কিন্তু, আপনাকে এখানে পেয়ে আমি মত বদলে নিয়েছি।’
রিহানের হাত শক্ত করে ধরে সুফিয়া। রিহান দম নিয়ে গলায় জোর দিয়ে বলে, ‘আমি ওদের হাতে আপনাকে একা ছেড়ে দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলবো না।’
‘তাহলে? কী করবো আমরা?’ রিহানের কথায় যেন ভরসা খুঁজে পায় সুফিয়া।
রিহান জবাব দিলো, ‘পালাবো এখান থেকে। আপনার জন্য আমি সব ঝুঁকি নেবো। অন্য কক্ষে নিয়ে গেলে একদম ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে যেকোনো সময় নিতে আসবো। আপনি কি একা ভয় পাবেন?’
‘না, আমি সারাক্ষণ আপনাকে অনুভব করবো ঐ কক্ষে। আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন তো এখান থেকে?’
‘সেটা জানি না। তবে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবো।’
সুফিয়ার ভয়টা কাটতে লাগলো রিহানের কথা শুনে। আলতো করে মাথা রাখলো সে রিহানের কাঁধে।
দুপুরে খাবারের সময় আবার সব শেকলপরা বন্দীরা এক হলো বাইরে। এবার খেতে দিলো ভাত আর অল্প একটু ডাল। সামনের মাঠে কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ফাঁসির মঞ্চটা অপেক্ষা করছে নতুন কোনো অতিথির আশায়। রিহানের খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। কয়েকজন সেনা এসে তার উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে ডাকলো, ‘কয়েদি নং ১১৭।’
রিহানের খাবার আর মুখ দিয়ে গেল না। সুফিয়াও থমকে গেল। ভয়ে ভয়ে তাকালো সে রিহানের দিকে। রিহান চোখ টিপে ভরসা দিলো তাকে। তারপর উঠে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগলো ব্রিটিশ সেনাদের দিকে। সুফিয়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিচু স্বরে সুফিয়া বললো, ‘আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।’
ক্যাম্পে ব্রিটিশদের একটা বড়ো দালান তৈরির কাজ চলছে। এজন্য তারা বাইরের কোনো শ্রমিক নিয়োগ করেনি। বন্দীদের কাছ থেকেই পুরো শ্রমটা ওরা আদায় করে। খাবার শেষে সুফিয়ারও ডাক পড়লো। কখনও এত কঠিন কাজ করেনি সে। আজ তাকে ইট ভাঙতে হচ্ছে বসে বসে। অনেকক্ষণ ইট ভাঙার পর যখন একেবারেই হাঁপিয়ে উঠলো, তখন একটু পানি চাইলো সে। একজন ব্রিটিশ সেনা তাকে অল্প একটু পানি এগিয়ে দিয়ে শরীরে অশ্লীলভাবে হাত দিলে সুফিয়া ‘থু’ করে একগাদা থুথু ছুড়লো তার দিকে। ব্রিটিশ সেনাটা তখন রেগে গিয়ে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় বসালো সুফিয়ার গালে। হাত থেকে নিচে পড়ে গেল পানি। তৃষ্ণা আর মেটাতে পারলো না সে।
সন্ধ্যার আগে আগে কাজ থেকে বিরতি নিতে পারলো সব বন্দীরা। সুফিয়াও চলে এলো কক্ষে। ততক্ষণে রিহানও চলে এসেছে আদালত থেকে। যা ভেবেছিল সে তাই হয়েছে। আদালতে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। রায় শুনে রিহান নিজেকে সামলাতে পারলেও, সেই থেকে কেঁদে চলেছে সুফিয়া। রিহান তাকে কাঁদতে নিষেধ করে বললো, ‘আপনি এভাবে কাঁদলে আমিও মনোবল হারিয়ে ফেলবো। আমাদের পালাতে হবে, মনে আছে তো?’
‘যদি পালাতে না পারি, তবে তো মৃত্যুদণ্ড দেবে।’
‘পালাবো। আমি আজ আদালতে যাওয়ার সময় পুরো পথটা দেখে এসেছি। বন্দীদের সবার শেকল পরা, তাই রাতে খুব বেশি পাহারা থাকবে না।’ বলতে বলতে রিহান সুফিয়ার দুহাত ধরলো। সুফিয়ার হাতে বড়ো বড়ো ফোসকা অনুভব করে জিজ্ঞেস করলো, ‘এসব কী করে হলো আপনার?’
‘ইট ভাঙতে দিয়েছে ওরা আজ সারাদিন। ফোসকা পড়ে গেছে হাতে।’
‘শুধু আজ রাতটা ধৈর্য ধরুন। আজ হয় ওদের হাতে মরবো, নয়তো পালাবো এখান থেকে।’
‘আমি আপনার সাথে মরতেও রাজি আছি।’
কক্ষের দরজা খোলার শব্দ হলো। দুজনেই চুপ হয়ে গেল তখন। ভেতরে প্রবেশ করলো দুজন গার্ড। ওরা এসে সুফিয়াকে আলাদা কক্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের করলো। রিহান জানে ওরা সুফিয়াকে কোন কক্ষে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা বের হয়ে গেলে অন্ধকারে বসে বসে রিহান পরবর্তী পরিকল্পনার ছক আঁকতে লাগলো।
রাতে খাবার দেয়ার জন্য এলো দুজন গার্ড। যথারীতি, একজন খাবার রেখে চলে গেল, অন্যজন মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকলো। রিহান চুপচাপ খাবার খেতে লাগলো। তখন গার্ডটা বললো, ‘অনেকদিন ধরে তোমাকে এই কক্ষে পাহারা দিচ্ছি। এবার মনে হয় নতুন কোনো বন্দী আসবে তোমার জায়গায়। শুনলাম, তোমার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে।’
গার্ডের দিকে ঘৃণাভরে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো রিহান। তার মাথায় এখন অন্য পরিকল্পনা ঘুরছে। গার্ডকে উত্তেজিত করা যাবে না এই মুহূর্তে। নিজেও শান্ত থাকার চেষ্টা করলো। খাওয়া শেষ হলে গার্ড বেরিয়ে যেতে চাইলে, রিহান পেছন থেকে বলে উঠলো, ‘আমি একটু বের হবো।’
‘কেন?’ ঘুরে প্রশ্ন করলো বাঙালি গার্ড।
রিহান ইশারায় বুঝালো প্রাকৃতিক কাজে বের হতে হবে। গার্ড নিশ্বব্দে বের হয়ে গিয়ে এক মিনিট পর আবার ফিরে এলো। রিহানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আসো। শেষবারের মতো জ্বালিয়ে নাও আমাকে। কয়েকদিন পর তো জ্বালানোর জন্য আর তুমি থাকবা না মিয়া।’
প্রত্যুত্তর করলো না রিহান। গার্ডের পিছুপিছু সে হেঁটে চললো। শৌচাগারটা মাঠের ও-প্রান্তে। সেখানে পৌঁছতে কয়েক মিনিট লাগলো। তারপর গার্ডকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘শেকলের বাঁধনটা একটু হালকা করে দিন।’
গার্ড হেসে বললো, ‘দুঃখিত! ভেতরে তো হাতের কাজও আছে মনে ছিল না।’
‘হুমম।’ অস্ফুটে শব্দ করলো রিহান।
গার্ড রিহানের হাতের শেকলটা আরেকটু হালকা করলো। রিহান শৌচাগারের দিকে একপা বাড়িয়ে পুনরায় গার্ডের দিকে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। লোহার শেকলটা গার্ডের গলায় প্যাঁচিয়ে জোর বাড়াতে লাগলো। গার্ডের মুখ দিয়ে ‘গোঁৎ’ করে একটা শব্দ বের হলে কেবল। একটু পর ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পড়লো। রিহান সাবধানে তাকে নিচে শুয়ে দিয়ে হাত থেকে চাবির গোছাটা নিলো। তারপর শেকলের বাঁধনটা পুরো খুলে ফেললো। মশালটা আগেই নিভে গেছে গার্ডের হাত থেকে পড়ে। অন্ধকারেই রিহান নিজের কাজ চালাতে লাগলো। গার্ডের পোশাকটা খুলে নিয়ে নিজে পরলো। তারপর মুক্ত বাতাসে জোরে একটা শ্বাস টেনে ছেড়ে দিয়ে, মুখটা নিচু করে হাঁটতে লাগলো কক্ষের দিকে। করিডোরে এসে পৌঁছালে একজন ব্রিটিশ সেনা তাকে থামালো। কিন্তু সন্দেহ করলো না গার্ডের পোশাক দেখে। গার্ড বা বন্দীদের চেহারা এরা মনে রাখে না। বন্দীদেরকে নির্দিষ্ট একটা নাম্বার দিয়ে ডাকে এরা। যেমন রিহানের নাম্বার ১১৭। ব্রিটিশ সেনাটা রিহানকে একটা আলিশান কক্ষে নিয়ে গেল। তারপর নরম বিছানায় শুয়ে রিহানকে ইংরেজিতে তার শরীরটা টিপে দিতে বললো। রিহানও যেন এই সুযোগটা চেয়েছিল। বাধ্য ভৃত্যের মতো সে ব্রিটিশ সেনার গা টিপতে লাগলো। একপা দূরে পড়ে আছে কিছু বৈদ্যুতিক তার। ভবনটাতে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ চলছে। এখনও সংযোগ আসেনি, তাই মশাল জ্বেলেই আঁধার কাটানো হয়। পা দিয়ে বৈদ্যুতিক তারগুলো টেনে নিলো রিহান। তারপর হাতে তুলে নিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে ব্রিটিশ সেনার গলায় প্যাঁচিয়ে জোরে টান দিলো। কেবল মুখ দিয়ে তার জিবটায় কয়েক ইঞ্চি বের হতে পারলো। এরপর অসাড় হয়ে গেল ছটফটিয়ে। রিহান আবারও পোশাকটা পালটিয়ে নিলো। গায়ে ব্রিটিশ সেনার পোশাক থাকলে কাজটা সহজ হবে তার। পোশাকটা পরে সে ব্রিটিশ সেনার বেশ ধরে হাঁটতে লাগলো সুফিয়াকে উদ্ধার করতে। সবকিছু সে এমনভাবে করছে যেন হাতে সময় খুব কম।
প্রতিটা কক্ষে একজন করে গার্ড থাকে। সুফিয়ার কক্ষের সামনেও একজন গার্ড হাতে মশাল ধরে ঝিমোচ্ছে। রিহান গিয়ে তাকে ইংরেজিতে দরজা খুলতে বললো। গার্ড দ্রুততার সাথে আদেশ পালন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কোনো সন্দেহ করলো না। গায়ের পোশাকটা দেখেই সে ব্রিটিশ সেনা ভেবে নিয়েছে। এরাও সব কক্ষের বন্দীর খবর রাখে না, কার চেহারা কেমন।
গার্ড দরজা খুলে দিলে ভেতরে প্রবেশ করলো রিহান, কিন্তু ভেতরের কক্ষটা খালি দেখে চমকে উঠলো সে। এবার সে উত্তেজিত হয়ে বাংলায়, জিজ্ঞেস করলো, ‘এই কক্ষে একটা মেয়ে ছিল, সে কই?’
রিহানের মুখে বাংলা শুনে সন্দেহ হলো গার্ডের। ভীতি কণ্ঠে গার্ড জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কে?’
রিহান সজোরে ঘুষি চালালো গার্ডের মুখে। একইসাথে পা চালালো দু’পায়ের মাঝখানে। পরপর দুটি আঘাত সামলাতে পারলো না গার্ড। চিল্লানোর সুযোগও দিলো না রিহান তাকে। একহাতে তার পুরো শরীরটা শক্ত করে ধরে, অন্য হাত দিয়ে গলা চেপে ধরলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘মেয়েটা কোথায় বল?’
‘বলছি বলছি। গলাটা ছেড়ে দেন।’ চোখ মুখ দিয়ে পানি বের হলো গার্ডের। রিহান তার গলায় চাপ কমালো। গার্ড তখন বললো, ‘মেয়েটাকে একজন ব্রিটিশ সেনা নিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে।’
‘কেন নিয়ে গেছে?’ গলায় পুনরায় একটু চাপ বাড়ালো রিহান। গোঁৎ করে ঢোক গিলে গার্ড জানালো, ‘খারাপ উদ্দেশ্য হতে পারে। দুপুরে দেখেছিলাম মেয়েটা ঐ ব্রিটিশ সেনার মুখে থুথু মারছিল। তখন রেগে গিয়েছিল ঐ ব্রিটিশ সেনা।’
রিহানের সারা শরীরে যেন আগুন ধরে গেল এবার। গলার চাপ আরও বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোনদিকে নিয়ে গেছে ওকে, বল?’
গার্ড ইশারায় দেখিয়ে দিলে রিহান তার ঘাড়টা মটকে দিয়ে ধাক্কা দিলো। তারপর দ্রুত বের হয়ে পড়লো ঐ গার্ডের হাত থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে। সুফিয়ার কিছু হয়ে যাওয়ার আগেই তাকে বাঁচাতে হবে।
[[চলবে…]]