#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-০৬
লেখা: ShoheL Rana শামী
সুফিয়া খাবার এনে সামনে রাখতে রাখতে কিছুটা রাগ নিয়ে তাকালো রিহানের দিকে। তবে কিছু বললো না। রিহান মুখ নিচু করে ফেললো। জাফর মাস্টার খাবারটা রিহানের দিকে আরেকটু এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খাও।’
‘আপনি খাবেন না?’
‘আমি খেয়েছি। তুমি খাও।’
রিহান খেতে বসলো। আজ ঢেঁড়স আর আলু দিয়ে চিংড়ি রান্না করেছে সুফিয়া। সাথে ছিল শিম ভর্তা। শিম ভর্তাটাই রিহানের বেশ সুস্বাদু লাগলো। রিহান মজা করে খেতে লাগলো। বাইরে তখন এক হকার সাইকেলের হর্ন বাজিয়ে ‘পত্রিকা পত্রিকা’ বলে শব্দ করে যাচ্ছিল। জাফর মাস্টার মেয়েকে বললেন, ‘মা, যা তো দুইটা পত্রিকা নিয়ে আয়।’
সুফিয়া দ্রুত বের হলো। জিজ্ঞেস করলো না কোন কোন পত্রিকা নিতে হবে। সে জানে। কিছুক্ষণ পর সে নবযুগ আর বেগম পত্রিকা নিয়ে ভেতরে আসলো। বাবার হাতে দিতে দিতে বললো, ‘দেখো কী লিখেছে বেগম পত্রিকায়। জাপানিরা গত দুদিনে সাত হাজার সেনা আটক করেছে। তার মধ্যে তিন হাজার ব্রিটিশ ভারতের। আহ্, কবে যে থামবে এ যুদ্ধ! পুরো নিউজটা পড়ো তো বাবা।’
জাফর মাস্টার পত্রিকা হাতে নিয়ে প্রথমে নিউজটাতে চোখ দিলেন। নীরবে পড়তে লাগলেন নিউজটা। রিহান তার মতো করে খেতে লাগলো। এসবে তার মাথাব্যথা নেই। কারণ সে জানে এর শেষ পরিণতি কী হবে। খেতে খেতে হঠাৎ তার গলায় খাবার আটকে গেল। সুফিয়া তখন মাটির একটা কৌটায় পানি ঢেলে রিহানের হাতে দিয়ে বললো, ‘পানি খান। আস্তে আস্তে খান খাবার। তাড়াহুড়া করতে হবে না।’
রিহান পানি পান করে বাকি খাবারটুকু শেষ করলো। তখন জাফর মাস্টার পত্রিকা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলতে লাগলেন, ‘বার্মার রেঙ্গুন শহরটা দখল করে ফেলেছে জাপানিরা। ওরা প্রথমে কাউকারেইক এবং মৌলাম্যায়াইন এই শহর দুটোতে আক্রমণ করেছিল। দুটো শহর সহজেই ওরা নিজেদের করে নেয়। এরপর উত্তর দিকে আক্রমণ চালায়। রেঙ্গুন শহরের দিকে। তখন তাদের বিরুদ্ধে লড়ছিল চীন ও অস্ট্রেলিয়ার সেনারা। পরে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সেনাদের পাঠায়। কিন্তু তার আগেই জাপানিরা গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্রিজ যুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে দখল করে নেয়। ভারতীয় সেনারা গিয়ে আর পেরে ওঠে না ওদের সাথে৷ অনেক সেনাদের বন্দী করে জাপানিরা। বেশিরভাগ ব্রিটিশ ভারতের।’
‘আমার মনে হয় বাবা বার্মা ব্রিটিশ সরকারের হাতছাড়া হয়ে যাবে। আজ রেঙ্গুন হাতছাড়া হলো। একদিন পুরো বার্মা জাপনিরা দখল নেবে। ওরা দিন-দিন আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠছে।’
‘হুমম, বার্মা দখল হওয়ারই কথা। বার্মার লোকেরা-ই তো ব্রিটিশ সরকার থেকে মুক্তি চায়। ওরা গোপনে সেনাবাহিনী গঠন করে ব্রিটিশদের বিপক্ষে চলে গেছে। জাপানিদের দলে যোগ দিয়েছে। বার্মা দখলের পর জাপানিরা হয়তো ভারত দখলের চেষ্টা করবে।’
‘কিন্তু পারবে না।’ বলে ওঠলো রিহান। ‘ওরা বার্মা দখল করে ফেলবে এই বছরেই। কিন্তু ভারত কখনও দখল করতে পারবে না।’
‘তুমি কেমনে জানো? ভবিষ্যত থেকে জেনে এসেছো না-কি?’ ধমকের সুরে প্রশ্ন করলো সুফিয়া।
রিহান চুপ হয়ে গেল। সুফিয়ার সামনে ভবিষ্যতের কথা বলা নিষেধ। জাফর মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিষয়টার সমাপ্তি টানলেন, ‘কী হয় আল্লাহ-ই জানেন। এসব যুদ্ধ-বিগ্রহ আর ভালো লাগছে না। সবাই নিজ নিজ অধিকার নিয়ে একটু শান্তিতে থাকুক। আহ্! আর কতদিন চলবে এই ক্ষমতার লড়াই?
রিহান ঐদিন আর ফিরে যায়নি জাকারিয়া সাহেবদের বাড়িতে। সুফিয়ার কথা রেখেছে সে। বিকেলে সুফিয়াদের বাড়ির উঠোনে বেশকিছু ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে এসে হাজির খেলার জন্য। ওদের উঠোনটা বড়ো। তাই খেলার জন্য বাচ্চা ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন চলে আসে বিকেল হলে। খেলা চলে রাত পর্যন্ত। নানারকম খেলা চলে ওদের ধাপে ধাপে। হাডুডু আর লুকোচুরি খেলা চলে রাতে, শুক্লপক্ষ আর পূর্ণিমার রাতগুলোতে। এখন অবশ্য শুক্লপক্ষ চলছে। তাই খেলা চলবে অনেক রাত পর্যন্ত।
কয়েকটা বাচ্চা এসে সুফিয়ার হাত ধরে টানতে লাগলো খেলার জন্য। সুফিয়া মনে হয় প্রতিদিনই খেলে বাচ্চাদের সাথে। কিন্তু আজ খেলতে লজ্জা পাচ্ছে রিহান আছে বলে। তবুও বাচ্চারা তার হাত ধরে টানতে টানতে বললো, ‘আসো বুবু আসো, তুমিও আসো। তুমি ছাড়া খেলায় মজা পাই না।’
সুফিয়া একবার আড়চোখে রিহানকে দেখে নিতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে সে বাচ্চাদের বললো, ‘তোরা খেল আজ। আমি খেলবো না।’
কিন্তু বাচ্চাগুলোও নাছোড়বান্দা, সুফিয়াকে ছাড়া খেলবে না ওরা। রিহান তখন সুফিয়ার উদ্দেশ্যে বললো, ‘আমি আছি বলে যদি কেউ লজ্জায় খেলতে না পারে, তবে আমি ভেতরে যাচ্ছি।’ বলতে বলতে রিহান ঘরের ভেতর চলে যাচ্ছিল। দৌড়ে গিয়ে সুফিয়া তার একটা হাত ধরে বললো, ‘এখানেই থাকুন। আমি কি বলেছি আপনাকে আমি লজ্জা পাচ্ছি?’ কথাটা বলতে গিয়েও সুফিয়ার ঠোঁট জোড়া হালকা কেঁপে ওঠলো। লজ্জা ভাব তার পুরোপুরি কাটেনি। রিহান নরম স্বরে বললো, ‘এখনও তো লজ্জা পাচ্ছেন।’
‘আপনার মাথায় সমস্যা ছিল, এখন চোখেও সমস্যা। বেশি দেখেন আপনি। এখানেই থাকুন বলছি।’ বলেই ঘুরে গিয়ে রিহানের আড়ালে মুখ কুঁচকিয়ে লজ্জাভাব কাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো সুফিয়া। পরে সাহস নিয়ে বাচ্চাদের বললো, ‘চল, খেলবো। উনি নিজেকে কী ভাবছেন? উনার জন্য আমি খেলবো না না-কি? এই মিন্টু, যা তো তোর মিনুবুকে খেলার জন্য ডেকে নিয়ে আয়।’
মিন্টু নামের ছেলেটা জবাব দিলো, ‘মিনুবু আইতে পারবো না। মিনুবুরে মা কাজ দ্যাছে। পুকুরে গ্যাছে চাউল নিয়া।’
‘হ্যাঁ, বিকেল হলেই ওদের কাজ বেড়ে যায়।’ বলেই আরেকটা মেয়ের নাম ধরে চিৎকার করলো সুফিয়া, ‘ঐ খুশি, খেলবি?’
পাশের বাড়ি থেকে একটা মেয়ের গলায় জবাব এলো, ‘না..আ..আ। রান্না করছি। সন্ধ্যায় আসবো।’
সুফিয়া পুনরায় চিৎকার করে বললো, ‘আসতে হবে না তোর।’
বাচ্চাদের নিয়ে সুফিয়া খেলা শুরু করে দিলো। ইচিং-বিচিং খেলা। সুফিয়া এবং আরেকটা বাচ্চা মাটিতে পা টেনে মুখোমুখি বসে পায়ের গোড়ালি দিয়ে একটা উচ্চতা তৈরি করলো। সেই উচ্চতার উপর লাফিয়ে পার হতে হবে বাকিদের। লাফানোর সময় কারো পা লাগতে পারবে না ঐ উচ্চতায়। বাচ্চারা ছড়া কাটতে কাটতে লাফ দিচ্ছিলো, ‘ইচিং-বিচিং চিচিং ছা, প্রজাপতি উড়ে যা।’
মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো রিহান ওদের খেলা। বিকেল হলে এরা কী সুন্দরভাবে একত্র হয়ে খেলা করে। এই মুহূর্তগুলো যদি আজীবন একইরকম থাকতো! আফসোস থাকবে না। একটা সময় জীবনটা যান্ত্রিক হয়ে যাবে। এক নজরে চেয়ে থাকলো রিহান সুফিয়ার দিকে। ওকেও মনে হচ্ছে শাড়ি পরা একটা বাচ্চা। শাড়ির আঁচল দিয়ে কোমরটা প্যাঁচিয়ে নিয়েছে সে। খোলা চুলগুলো মাটি স্পর্শ করছে। দুহাত দিয়ে চুলগুলো খোপা করতে করতে সে নজর দিলো রিহানের দিকে। রিহানকে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে মাথা দুলিয়ে প্রশ্ন করে, ‘কী…ই?’
‘কিছু না।’ হেসে চোখ সরিয়ে নেয় রিহান। সুফিয়া আবার খেলায় মন দেয়। দূরের একটা মাঠ থেকে কিছু ছেলেদের চিৎকার ভেসে আসে। রিহান এগিয়ে যায় দেখতে। সুফিয়াদের বাড়ির প্রবেশপথ হলো টিনের একটা গেইট। গেইটটা পার হয়ে সে দূরের মাঠটার দিকে দৃষ্টি দিলো। অনেকগুলো ছেলে ওখানে ক্রিকেট খেলছে। ওদিকে খেলা ফেলে সুফিয়া দৌড়ে এলো। গেইট দিয়ে মুখ বের করে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছেন না বলে?’
‘কোথাও না। ঐ যে ক্রিকেট খেলছে। ওগুলো দেখছি।’
‘খেলতে পারেন?’
‘খুব পারি।’
‘দাঁড়ান আমিও আসছি।’ বলেই সে গেইট থেকে বের হলো বাচ্চাদেরকে খেলতে বলে। বাচ্চাদের মন খারাপ হয়ে গেল সুফিয়াকে হারিয়ে। আবার শুরু থেকে খেলা শুরু করতে হবে তাদের।
বালির উপর বসায় সুফিয়ার পেছনে ধুলো লেগে গিয়েছিল। ধুলো ঝেড়ে সে রিহানের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। আঁচলটা এখনও কোমরে প্যাঁচানো তার। ওভাবেই দেখতে ভালো লাগছে তাকে। তার সকল চঞ্চলতা যেন প্রকাশ পাচ্ছে।
‘আপনার ভবিষ্যতে আছে তো এই খেলা?’
‘হ্যাঁ আছে। আমাদের নিজস্ব একটা দেশ হবে বাংলাদেশ নামে। নিজেদের একটা ক্রিকেট টিম হবে।’
সুফিয়া হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কোমরে দুহাত দিয়ে গম্ভীরভাবে তাকালো রিহানের দিকে। রিহান তার এই আচরণ হুট করে ধরতে না পারলেও পরক্ষণে বুঝতে পেরে বললো, ‘আপনিই তো জিজ্ঞেস করলেন। তাই-ই তো বললাম।’
সুফিয়া এবার গলা ছেড়ে হাসতে লাগলো রিহানের অবস্থা দেখে। হাসতে হাসতে যেন পড়ে যাবে সে। রিহান বোকার মতো চেয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ হেসে সুফিয়া হাসি থামালো। তারপর বললো, ‘আপনি এত ভীতু কেন? আমাকে ভয় পান না-কি?’
‘হুহ! ভয় পাবো কেন? আপনি বাঘ না ভাল্লুক?’
‘বাঘ বা ভাল্লুক কিছুই না, তবুও এত ভয় পান কেন? ভয় পান বলেই তো আপনার সাথে এমন করি।’
রিহান চুপ হয়ে থাকলো। সুফিয়া আবার বললো, ‘ঠিক আছে, বলুন আপনার যত ভবিষ্যতের কথা। আপনার মতো করে বলুন। তবে আমাকে বিশ্বাস করাতে চাইবেন না প্লিজ।’
‘বলবো না।’ মুখটা গম্ভীর করে ফেললো রিহান।
‘গম্ভীর মুখটা আপনার প্যাঁচার মতো লাগছে।’ বিলের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো সুফিয়া।
‘তাতে আপনার কী?’
‘আমার কী হবে? কিছুই না। জানেন, আমার প্রিয় খেলাও ক্রিকেট। কিন্তু মেয়েদের জন্য এই খেলা নিষেধ। তাই খেলতে পারি না। আমার একজন প্রিয় ক্রিকেটার আছে। কে জানেন?’
‘কে?’
‘রস গ্রেগরি। চিনেন তো?’
‘হুমম, শুনছি নাম। অস্ট্রেলিয়ান।’
‘আপনার প্রিয় ক্রিকেটার আছে?’
‘আছে তো। মাশরাফি, সাকিব, তামিম।’
সুফিয়া অবাক হয়ে তাকালো রিহানের দিকে। নামগুলো সে শুনেনি। ‘এরা কারা?’
‘এরা বাংলাদেশের ক্রিকেটার হবে আমাদের সময়ে এসে। মানে ভবিষ্যতে।’
‘আপনাকে সুযোগ দিয়েছি বলে দেখি থামছেন না। বলেই যাচ্ছেন ভবিষ্যতের কথা।’
রিহান আর জবাব দিলো না। সুফিয়া তখন হাঁটার গতি কমিয়ে বললো, ‘এখান থেকেই দেখি ওদের খেলা। আর না যাই সামনে।’
‘কেন?’
‘আমি মেয়ে। বুঝেন না? ওখানে খেলছে সবাই পুরুষ।’
‘ঠিক আছে।’
বিলের মাঝে একটা আইলের উপর বসলো দুজন। তারপর কিছুটা দূর থেকে ছেলেদের ক্রিকেট খেলা দেখতে লাগলো দুজন মিলে।
[[চলবে…]]
(গল্পটা পছন্দ হলে দয়া করে একটু প্রমোট করবেন। আমাকে না। গল্পটার প্রমোট করবেন। পাঠকদের জানাবেন। লেখার আগ্রহ বাড়বে।)