এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব ৪২+৪৩

0
371

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৪২

-দোয়ার বাবার তৈরী করা ফর্মুলার এন্টিডোড একমাত্র রংধনু গ্রুপই মার্কেটে লন্চ করবে। ওই ফর্মুলা সরাসরি রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসে আনার ব্যবস্থা করো আরাব।

ফাইল দেখতে দেখতে বাসায় ঢুকছিলো আরাব। নিজের ঘরের দিকেই যাচ্ছিলো ও। কিন্তু বাবার কথা থেমে গেলো। তৌফিক ওয়াহিদ সোফায় বসে পেপার পড়ায় মগ্ন। আরাব মুচকি হেসে ফাইলটা বন্ধ করে এগিয়ে গেলো বাবার দিকে। বললো,

-বিজনেসে কি করে টপ করতে হয়,তা কেউ তোমার কাছ থেকে শিখুক।

তৌফিক ওয়াহিদ একপলক ছেলের দিকে তাকালেন। আবারো পেপারে মনোযোগ দিলেন উনি। আরাব বললো,

-রওশন স্যারের ফর্মুলা তো এখনো স্বীকৃতি পায়নি। ওটা সবে নতুন করে রিচেইক করা হচ্ছে। এতো আগে আগেই টোপ ফেলছো বাবা?

তৌফিক ওয়াহিদ নিজের মতো ব্যস্ত থেকেই বললেন,

-রিচেইকের দরকার নেই। মিস্টার ওয়াহিদের ফর্মুলা যে প্রতিবারের মতো কার্যকরী,সেটা আমি জানি।

-তবুও পাঁচবছর আগে নিউজে তার এগেনিস্টে প্রমান দেখে একমুহুর্তেই মেনে নিয়েছিলে সে ভুল এক্সপেরিমেন্ট করেছে।

-শুধুশুধু কথা কেনো বাড়াচ্ছো আরাব? যেটা বলা হলো,সেটা করো। কালেক্ট দ্যা ফর্মুলা বাই এনিহাউ।

-পারবো না!

শক্তকন্ঠে বললো আরাব। ওর আওয়াজে মাথা তুলে তাকালেন তৌফিক ওয়াহিদ। পেপারটা সামনের টি টেবিলে রেখে দাড়িয়ে বললেন,

-পারবে না মানে?

আরাব একটা ইনোসেন্ট হাসি দিয়ে বললো,

-মানেটা খুব সিম্পল বাবা। আমি জানি না ফর্মুলা কোথায়। কিভাবে আনবো?

তৌফিক ওয়াহিদ গম্ভীরভাবে বললেন,

-ওটা বায়োমেডিতেই আছে। এটা তুমি আমি দুজনেই খুব ভালোমতো জানি আরাব!

-কিন্তু বায়োমেডির এমডি তো বলে দিয়েছে নিউজে,তারা এতো রিস্কি এক্সপেরিমেন্ট বায়োমেডিতে এলাউ করবে না। তারপরও তুমি কি করে জানলে বলোতো বাবা? বায়োমেডি আর তোমার মাঝে হেডফোনের একটা তো আমি,আরেক কানে ঠিক কোন থার্ড পার্টিকে গুজে শব্দভান্ডার মস্তিষ্কে প্রেরন করছো বলোতো?

চিন্তার ভাব নিয়ে বললো আরাব। তৌফিক ওয়াহিদ কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলে ছেলের দিকে। আরাব মৃদ্যু হেসে বললো,

-হ্যাঁ ওটা বায়োমেডিতেই আছে। ঠিকই খোজ পেয়েছো তুমি।

-আর তার দায়িত্বে তুমিই আছো। এটাই শতাংশ সঠিক। যাইহোক,ওটা সবার আগে রংধনুতেই চাই আমার।

আরাব শব্দ করে হেসে দিলো। কিছুক্ষন পর হাসি থামিয়ে বললো,

-ডোন্ট টক সিলি বাবা! এটা কি আমার দাদুর শ্যালকের বাড়ির মোয়া? যে আনতে বললে,আর এনে দিলাম? অনুমতিবিহীন তোমাকে ফর্মুলা এনে দেওয়া মানে বোঝো,আমার আর ডক্টর সুমনের মাঝে কোনো তফাৎ থাকবে না!

-অনুমতিবিহীন আনতে বলিনি তো! যখন ফর্মুলা স্বীকৃতি পাবে,তখন বায়োমেডির অনুমতি নিয়েই তুমি….

-অনুমতি বায়োমেডি না,দোয়ার কাছ থেকে নিতে হবে বাবা!

শীতল স্বরে বললো আরাব। বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন তৌফিক ওয়াহিদ। আরাবের ঠোটে বাকা হাসি। বললো,

-কি বলোতো বাবা? রওশন স্যারের স্থাবর,অস্থাবর যা আছে,সবকিছুর উত্তরাধিকারিনী দোয়া। তাই স্যারের রেখে যাওয়া ফর্মুলা ঠিক কোন ফার্মাকেমিক্যালসে সেল করবে,সেটা দোয়াই ঠিক করবে। এমনটাই বলা হয়েছে শুনানিতে।

তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লেন তৌফিক ওয়াহিদ। বললেন,

-দোয়া রংধনুতে বউ হয়ে আসছে,তোমার বউ‌ হয়ে আসছে,ও অবশ্যই চাইবে রংধনু ইন্ডাস্ট্রিজ,তোমার ব্যবসা….

-দোয়া চাইবে,যে গ্রুপ কম রেটে এন্টিডোড বাজারে লন্চ করবে,সেই গ্রুপকেই ফর্মুলা দিতে।একটা ভুল বললে কিন্তু! ব্যবসাটা আমার ব্যবসা নয় বাবা! তোমার ব্যবসা! তোমার রংধনু ইন্ডাস্ট্রিজ! আর হ্যাঁ! আরো একটা কথা,দোয়াকে যতোদুর চিনি,আমার ব্যবসা হলেও সেটাকে গুরুত্ব দিতো না ও। মানে তুমি ,কোটিকোটি টাকা ইনভেস্টের আশায় দোয়ার কাছ থেকে এটলিস্ট এন্টিডোড পাবে না!

তৌফিক ওয়াহিদ রাগ নিয়ে বললেন,

-কি বলতে কি চাইছো তুমি?

-ফর্মুলা চাইলে নিজের চিন্তাধারা বদলাও বাবা! দোয়াকে দোয়ার মতো করে ভালোবাসো। ওর অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যতকে তুলনা করে না। ছেলেকে ছেলের মতো করে ট্রিট করো। পাপেটের মতো না। পরিবারকে পরিবারের মতো হিসেব করে ভালোবাসো। বিজনেসের ডেবিট ক্রেডিট হিসাব করে তাদের সাথে আপডাউন গ্রাফ তৈরী করো না! দ্যাটস্ ইট!

কথাগুলো বলে নিজের ঘরে চলে গেলো আরাব। সব কথা মাথায় না নিলেও,এটা বেশ বুঝতে পারছেন তৌফিক ওয়াহিদ,দোয়াকে তার দরকার। যে ভাবেই হোক,ওই এন্টিডোড রংধনুই লন্চ করবে। আর এজন্য দোয়াকে খুশি রাখতে হবে। এতোদিন তো উপেক্ষা করেছে। কিন্তু আরাব যেভাবে বলে গেলো, ওই সাধারনবেশে চলাফেরা করা মেয়েটাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তার। তৌফিক ওয়াহিদের বিজনেসে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে,ওই বেরঙ চিলেকোঠার সাধারন মেয়েটি!

উজ্জল রোদ্দুরে ছেয়ে থাকা দুপুরের শহর। এ রোদকে কেউ কেউ বলবে মিছরির ছুরি। শীতের উত্তরা হিমশীতল বাতাসের জন্য ছায়ায় দাড়ালেই শিওরে ওঠে গা। আর রোদে দাড়ালে তীক্ষ্মভাবে উষ্ণ আবেশ জুড়ে দেয় শরীরে। একটু বেশিক্ষন দাড়ালেই মনে হয় জ্বলে যাবে শরীর ওই রোদে। হাটতে হাটতে দোয়া বুঝলো,ঘেমে উঠেছে ও কিঞ্চিত। গলায় থাকা ওড়নায় গলাটা মুছে নিলো একটু। রোদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আবারো চোখ নামিয়ে নিলো। শীতকাল তো কি,সুর্য তেজ দেখাতে ভুলবে না। মা ভাইয়ের ওষুধ কিনবে বলে বেরিয়েছে । দুদিন পর সবাই বিয়ে তে ব্যস্ত হয়ে যাবে,নিজের দায়িত্বগুলো নিয়ে ভাবতে গেলে ধোয়াশা দেখে দোয়া। মাকে কিছু বলতেও পারছে না ভেবে আরো দম বন্ধ লাগে ওর। অপরাধী লাগে নিজেকে।

ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে ডানেবামে তাকিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলো দেখেশুনেই। হঠাৎই কেউ হাত ধরে ফেললো ওর। পেছন ফিরে এক অচেনা মেয়েকে দেখে বিস্মিত না হয়ে পারলো না দোয়া। ওকে নিয়ে কোনো কথা না বলে হাটা লাগালো মেয়েটি। দোয়া কয়েকবার বললো,হাত ছাড়ুন আপু,মেয়েটি পাত্তা দেয়নি। পরে আর কিছু বললো না দোয়া। আপাদমস্তক দেখে নিলো মেয়েটাকে। কোটসুট পরা,ছোটছোট সোজা কালার করা চুল,যাকে এককথায় বলে বিজনেস ওমেন। পাগল তো নয়। তবে হয়তো দরকারেই হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওকে কোথাও। আশপাশ দেখে হাটলো কয়েকপা দোয়াও ওর সাথে।একটুপরেই জনবহুল জায়গা পেরিয়ে আসলো ওরা। দোয়ার হাত ছেড়ে মেয়েটি চেচিয়ে বলে উঠলো,

-হাউ ডেয়ার ইউ? তোমার সাহস কি করে হয় আরাবের বউ হবে এমনটা ভাবারও?

দোয়া অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। মেয়েটা আবারো চেচিয়ে বললো,

-লিসেন! আরাব শুধু জারার! ও আমার! কোনো বিয়ে হচ্ছে না! তুমি করছো না আরাবকে বিয়ে!

জারার কথায় দোয়া কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু জারাকে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো। জারা চুল উল্টে ধরে এদিকওদিক হেটে বললো,

-শোনো মেয়ে! আরাব আমাকে বিয়ে করবে। ওইদিন…ওইদিন যদি পাপা আমাকে জোর করে বিজনেস ট্রিপে না নিয়ে যেতো,আমি কোনোদিনও বিষয়টা এতোদুর গরাতে দিতাম না! তৌফিক আঙ্কেলের বিজনেস ওমেন পছন্দ বলে পাপার সব কথা মেনে আগে বিজনেস বুঝে নিয়েছি। পাপা বলেছিলো,ঢাকায় ফিরলেই আরাব তোমার। আজই ফিরেছি। আর সেখানে কিনা আমাকে শুনতে হলো আরাবের এনগেইজমেন্ট হয়ে গেছে! তোমার সাথে? যার কোনো যোগ্যতাই নেই আরাবের বউ হওয়ার! এই মেয়ে! কই? কই দেখি,কোন আঙুলে আংটি পরিয়েছে আরাব তোমাকে? দেখি! বের করো? বের করো!

কথা বলতে বলতেই দোয়ার হাত নিয়ে আংটি দেখতে লাগলো জারা। দোয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ়! স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো ও। জারা যেই ওর হাতের আংটি খুলতে গেছে,হুশ ফিরলো ওর। ঝারা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

-এ্ এসব কি শুরু করেছেন আপনি? পাগল হয়ে গেছেন নাকি?

জারা বড়বড় চোখে তাকালো দোয়ার দিকে। আবারো ওর হাতের দিকে হাত বারিয়ে বললো,

-কথা বাড়িও না মেয়ে! আংটিটা আমাকে দিয়ে দাও! আরাবের দেওয়া আংটি আমার আঙ্…

-আরাব আমাকে আংটি পরিয়েছেন আপু। আংটি আমার আঙুলেই থাকবে!

-ইউ…!

জারার রাগ বেড়ে গেছে। চেচিয়ে এগোলো ও দোয়ার দিকে। দোয়া শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থেকে বললো,

-দেখুন আপু। প্লিজ ঝামেলা করবেন না! প্লিজ!

-ইউ! আগে আমাকে আংটি টা দাও! কোনো আংটিবদল হয়নি তোমাদের! কোনো বিয়ে হবে না বলছি তো!

-আজব তো! কেনো পাগলামি করছেন? বুঝতে কেনো চাইছেন না আমি…

-এই মেয়ে! তুমি কেউ নও! ইউ আর নো বডি!

জারা ওর হাত চেপে ধরলো। নখ বসে যাওয়ায় ব্যথা পেয়েছে দোয়া। ঠোট কামড়ে দ্বিতীয়বারের মতো হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

-আমি তাহসানুল আরাবের হবু বউ আপু! আমার যোগ্যতা কি,সেটা আপনার কাছে বলার প্রয়োজনবোধ করছি না। আরাব ভালোবাসেন আমাকে। দুই পরিবারের সম্মতিতে আংটিবদল হয়েছে আমাদের জারাপু। শুনেছি আরাবও নাকি আপনাকে আপু বলে ডেকেছিলো তাইনা? তো এইসব পাগলামি বাদ দিয়ে ভাই আর ভাইয়ের হবু বউকে সম্মান করতে শিখুন। আফটার অল,সম্মান করতে শিখলে তবেই সম্মান পাবেন। বিশ্বাস করুন,তৌফিকা আপুর মতোই আপনাকে ভালোবেসে মাথায় তুলে রাখবো ননদীনি!

রাগে জারার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো। ওর চোখের জল দেখে নিমিষেই নুইয়ে গেলো। বেশিবেশি বলে ফেলেছে ভেবে ওর মনে আত্মগ্লানি জমার আগেই কেউ পাশ থেকে ওর হাত আলতোভাবে ধরে বললো,

-আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি জারা। নিজের পাগলামি ভালোলাগাকে ভালোবাসার নামে বাড়াবাড়িটা করাটা এবার থামাও।

আরাবের কন্ঠ শুনে শ্বাস আটকে পাশ ফিরলো দোয়া। হাসিমুখে ওর পাশেই দাড়িয়ে আরাব। মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো দোয়া। আরাব ওর দিকে তাকালো। মাঝেমধ্যে রাগের পরিবর্তে আদর আসে বাবার প্রতি ওর। অফিসে পাঠানো নিয়ে। ভাগ্যিস অফিসের কাজে বেরোতে হয়েছিলো ওকে। নইলে জারা আরো ঝামেলা করতো দোয়ার সাথে। এমনটা ভেবে ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললো ও। আরেকটু চেপে ধরতেই দোয়া কিঞ্চিত আর্তনাত করে উঠলো। হাত উচিয়ে জারার নখের দাগ স্পষ্ট চোখে পরলো আরাবের। দোয়া মাথা নাড়িয়ে ওকে মানা করলো রিয়্যাক্ট না করার জন্য। আরাব গুরুত্ব দেয়নি। রক্তচক্ষু করে জারার দিকে তাকিয়ে দেখে ও ওভাবেই কাদছে। আরাব চোয়াল শক্ত করে বললো,

-আজ তুমি একটা মেয়ে বলে ছাড় পেয়ে গেলে জারা। দোয়ার যোগ্যতা,আমাদের ভালোবাসা,আংটিবদল বা বিয়ে,এসবের কোনো বিষয়ে তোমার অভিমত চাইনা আমার। দোয়ার এতোটুকো কষ্টের কারন তুমি হয়ো না প্লিজ। এতোদিনের চেনাজানা আমাদের। কোনো বাজে পরিস্থিতি তৈরী হোক,এমনটা চাইনা আমি! গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার রাইট নাও! গেট লস্ট!

আরাবের ধমকে চমকে উঠলো দোয়া। জারার দিকে তাকালো। অনবরত চোখ‌ দিয়ে পানি পরছে ওর। আর সবটাই রাগে। এটাও বুঝলো দোয়া। জারা বললো,

-সুখি হতে দেবোনা আরাব! এই মেয়েকে আমি শান্তিতে থাকতে দেবো না! আমাকে এইভাবে ঠকিয়ে তোমার ভালো হবে না আরাব! এই সড়কছাপ,নিঃস্ব মেয়েটাকে নিয়ে কোনোদিন সুখী হবে না তুমি! কোনোদিনও না!

আঙুল ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে কথাগুলো বললো জারা। রাগ নিয়ে কাদতে কাদতে চলে গেলো ওখান থেকে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়লো আরাব। কোনো মেয়ের সাথে প্রথমবার এতো বাজে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে আজ ও। দোয়ার দিকে তাকাতেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো ওর। দোয়ার চোখে জল। পাগলের মতো ওর দুগাল ধরে বললো,

-দোয়া? তুমি কাদছো? কি হয়েছে তোমার?কেনো কাদছো? এই দোয়া? তোমাকে না বলেছি কোনোদিনও কাদবে না? হাতে বেশি লেগেছে? নাকি তুমি জারার কথায় কাদছো? হ্যাঁ? ও্ ওর কথাকে কেনো…

আরাবের হাতে হাত রাখলো দোয়া। শান্ত গলায় বললো,

-না আরাব। আমি জারার কথায় কাদছি না। আমি তো খুশিতে কাদছি। সুখে কাদছি। আমার জীবনে আপনি আছেন,সেই সুখে কাদছি। এ যে আনন্দঅশ্রু। সুখের কান্না।

মৃদ্যু হেসে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলো আরাব। বললো,

-এটাও আমার কাছে মন্জুর নয়। খুশিতে হাসবে তুমি। খুশিতে উচ্ছ্বল রবে তুমি। খুশিতে আমাকে জরিয়ে ধরে ভালোবাসি বলবে তুমি। আর তোমার খুশিতে আরো সুখ হিসেবে আদর এটে দেবো আমি।

কান্না লজ্জায় পরিনত হলো দোয়ার। চোখ নামিয়ে নিলো ও। এই লোকটার কথাবার্তা সবসময় ওকে অস্বস্তিতে ফেলতে বাধ্য। আরাব উকি দিয়ে ওর মুখচোখ দেখে বললো,

-ওইযে! আমাকে পাগল করা সেই লাজুক হাসি!

দোয়া সরিয়ে দাড়ালো আরাবের কাছ। চোখ মুছে নাক টেনে আঙুলে ওড়না পেচাতে পেচাতে লাগলো। আরাব বললো,

-থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। জারাকে তো বেশ শুনালে শুনলাম। এটা বলো,ওকে আপু বলার ঘটনা তুমি কি করে জানলে? ওর বিষয়ে তো আমি কিছু বলিনি তোমাকে!

দোয়া ইতস্তত করতে করতে বললো,

-আব্ আমি জানতাম কিছুটা। তৌফিকা আপু আমাকে আগেই বলেছিলো জারা আপুর বিষয়ে। আপনার লাইফের বিরক্তিকর অধ্যায় শিরোনামে। এ্ এখন যে আপনার সাথে যেমন,আমাকেও তো তার সাথে তেমন হতে হবে তাইনা?

আরাব হেসে দিলো। পকেটে দুহাত গুজে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো দোয়ার দিকে। আজ দোয়া যেভাবে জারাকে কথা শুনিয়েছে,এমনটাই চাই ওর। আর কারো জন্য না হোক,তৌফিক ওয়াহিদের জন্য দোয়ার এই রুপটাই পার্ফেক্ট। নিজের বাবার ভবিষ্যত ভেবে কেনো যেনো হাসি পেলো ওর।

#চলবে…

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৪৩

গাড়ি থেকে নেমে মুখার্জীবাড়ির বাইরে দাড়াতেই থমকে গেলেন তৌফিক ওয়াহিদ। আগেরবার দেখা ‌বেরঙ চিলেকোঠাটা আজ যেনো রাজ্যাভিষেকে মেতে থাকা রাজবাড়ির মতো দেখাচ্ছে। রঙ চটে যাওয়া দেওয়ালগুলোতে উজ্জল রঙের স্পর্শ,বড়বড় গাদা ফুলের ঝালড় ঝুলানো বারান্দাতে,দেয়ালে দেয়ালে ফুলের সাজসজ্জা,মরিচবাতি,উঠোনের একপাশে ফুলে ফুলে সাজানো বর বসানোর স্টেজ। সাজ দেখে অবাক না হয়ে পারলেন না তৌফিক ওয়াহিদ। গাড়ির ভেতর থেকে ফাইলটা নিয়ে ভেতরে এসে আরো বিস্ময়ে দেখতে লাগলেন চারপাশ। আজ দোয়া আরাবের গায়ে হলুদ। সেই সাজে সেজেছে পুরো মুখার্জীবাড়ি। বলা বাহুল্য,মুখার্জীবাড়ির এই সাজ,দোয়ার হলুদে এতোএতো খরচ,সবটাই কল্পনাতীত ছিলো তৌফিক ওয়াহিদের।

বাড়িতে উপস্থিত সবার পরনে হলুদ পোশাক। সবাই কথা বলছে নিজেদের মতো,ছেলেরা কাজে ব্যস্ত,তবুও হাসি আড্ডায় মেতেছে,বাচ্চারা সারি বেধে রেলগাড়ির মতো ছুটোছুটি করছে। রংধনুর কথা মনে পরে গেলো তৌফিক ওয়াহিদের। ইভেন্ট ম্যানেজারকে দায়িত্ব দিয়ে সকালেই অফিসে চলে গিয়েছিলেন উনি। পরে আরাব জানালো ওর গায়ে ছোয়ানো হলুদ আর দোয়ার বিয়ের যাবতীয় জিনিস এখানে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব নাকি ছেলের বাবার। এমনটাই নিয়ম দোয়াদের। প্রথমে দ্বিমত রেখেছিলেন তৌফিক ওয়াহিদ। পরে ফর্মুলার অনুমতি নেওয়ার দিকটা বিবেচনা করে ফাইল নিয়ে চলে এসেছেন চিলেকোঠায়। তৌফিকা হলুদের ডালা এগিয়ে দিয়ে বললো,

-এইটা তোমার হাতে নাও বাবা?

-আরে আরে বেয়াইসাহেব? এসে গেছেন আপনারা? কেমন আছো তৌফিকা? এই সবাই এদিকে আয়! ছেলেপক্ষ হলুদ নিয়ে এসেছে যে!

অরুনাভ মুখার্জীর কথায় চার পাঁচজন মিলে ব্যস্ত হয়ে পরলো তৌফিকা,টুইঙ্কেল,তৌফিক ওয়াহিদসহ বাকিদের নিয়ে। দোয়া বাদে বাকি সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো ওরা। জোরপুর্বক হাসিতে কিছুক্ষন আতিথেয়তা স্বীকার করে তৌফিক ওয়াহিদ অরুনাভ মুখার্জীকে বললেন,

-বলছিলাম দাদা,দোয়া কোথায়?

অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-ও দোয়া? ও তো ওর ঘরে। আসুন আপনাকে আমি…

-না না। আমিই চলে যাবো।

-চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে নানুভাই!

টুইঙ্কেল নানুভাইয়ের আঙুল ধরে হাটা লাগালো। ওর সাথেই ভীড় থেকে বেরিয়ে আসলেন তৌফিক ওয়াহিদ। যেনো হাফ ছেড়ে বাচলেন উনি। দোয়ার ঘরে এসেই টুইঙ্কেল চেচিয়ে বললো,

-উইশমাম দেখো কে এসেছে!

বিছানায় বসে কুচি গোছাচ্ছিলো দোয়া। তৌফিক ওয়াহিদকে দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে মাথায় আচল তুলে দিলো ও। এগিয়ে এসে সালাম দিলো। সালামের উত্তর নিলেন তৌফিক ওয়াহিদ। টুইঙ্কেল নানুভাইয়ের হাতে থাকা ডালাটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

-তুমি এই শাড়ি পরেছো উইশমাম? এই দেখো,নানুভাইও শাড়ি এনেছে তোমার জন্য!

দোয়া হাসিমুখে মাথা নিচু করে নিতে যাচ্ছিলো ডালাটা। তৌফিক ওয়াহিদ ডালার উপর স্বচ্ছ মোড়ক থেকে দেখলেন,ওনাদের কেনা শাড়িটার চেয়ে দোয়ার গায়ের শাড়িটা বেশি ভালো,বেশি দামি দেখাচ্ছে। কিন্তু তৌফিকাও যথেষ্ট ভালোভালো ব্রান্ডেড জিনিসই কিনেছে দোয়ার জন্য। তবুও দোয়ার শাড়ি,সর্বপরি এখানকার ব্যবস্থাপনায় এক আলাদাই জাকজমকতা। আরেকবার মনে পরে গেলো তৌফিক ওয়াহিদের,দোয়া সাফাত রওশনের মেয়ে। ডালাটা দোয়ার হাতে না দিয়ে পাশের টেবিলে রাখলেন তৌফিক ওয়াহিদ। ফাইলটা তুলে ধরে বললেন,

-এখানে তোমার একটা সাইন চাই দোয়া।

কিঞ্চিত বিস্ময়ে তাকালো দোয়া। পরপরই ওর তৌফিকার বলা কথাটা মনে পরে গেলো। বিজনেস ছাড়া কিছুই বোঝেন না তৌফিক ওয়াহিদ। টুইঙ্কেলের দিকে তাকালো একবার। ও বিছানার উপর রাখা উপহার,শাড়ি,গয়নার বক্সগুলো আঙুল ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে গুনছে। নিজেকে সামলে ফাইলটা হাতে নিয়ে দোয়া পড়লো ওটা। মুচকি হেসে বললো,

-আমাকে হলুদ ছোয়াতে না,ফর্মুলা রংধনুর নামে করবেন বলে আজ এখানে এসেছেন স্যার?

-দেখো দোয়া….

-দেখুন স্যার,ফর্মুলা এখনো পুরোপুরি স্বীকৃত না। রিচেইকের এক্সপেরিমেন্ট এখনো চলছে। তাই এ বিষয়ে এই মুহুর্তে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

বিস্ময়ে তাকালেন তৌফিক ওয়াহিদ। দোয়ার মতো সাদামাটা মেয়েটার মুখে এমন উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না উনি। বললেন,

-দেখো দোয়া,তুমি রংধনুতে বউ হয়ে আসছো। আরাবের বউ হতে চলেছো। আর রংধনু গ্রুপসের উত্তরাধীকার তো আরাব,এটাও জানো তুমি। তাই রংধনু গ্রুপসের জন্য এটুকো তো করতেই পারো তাইনা?

দোয়া মৃদ্যু হাসলো। বললো,

-রংধনুর জন্য আমার শুভকামনা সবসময় আছে আর থাকবে। আমি রংধনুর ভালোর জন্যই মানা করছি স্যার। যদি এখানে মত দেওয়ার পর কোনোমতে ফর্মুলায় কোনো ভুল ধরা পরে,দিনশেষে বদনামটা এন্টিডোড লন্চ করা সেই রংধনু গ্রুপসেরই হবে তাইনা?

তৌফিক ওয়াহিদ নিস্পলকভাবে তাকিয়ে রইলেন দোয়ার দিকে। যুক্তিতে একবর্নও ভুল নেই ওর। দোয়া ফাইলটা ওনার হাতে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,

-আপনার বিজনেস ওমেন পছন্দ তাইনা স্যার? কথা দিচ্ছি,একদম মনের মতো বউমা হবো আপনার। যেমনটা আপনি চান!

-আপুনি?

দরজা থেকে বললো দিয়ান। দোয়া ইশারায় ভেতরে আসতে বললো ওকে। তন্নি তৃষা আর কয়েকটি মেয়ে ভেতরে ঢুকলো। ফাইলটা নিয়ে আর কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলেন তৌফিক ওয়াহিদ।
দোয়াকে আরাবদের বাড়ি থেকে দেওয়া হলুদ শাড়ি আর ফুলের গয়নায় সাজিয়ে স্টেজে বসানো হলো। টুইঙ্কেল এসে কোলে বসেছে ওর। চোখ মেলে চারপাশ দেখে নিলো দোয়া। ভরে উঠলো ওর চোখ। কে বলবে ওর কেউ নেই? ওর মনে হচ্ছে,পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিবারের আদরের মেয়ে ও। উঠোন কোনায় কোনায় ভর্তি মানুষজনে। আশেপাশের সব বাসার আন্টিরা এসেছে হলুদ শাড়ি পরে। মেসের ছেলেগুলো হলুদ পান্জাবি পরে এ কাজ ও কাজে ছোটাছুটি করছে। অরুনাভ মুখার্জী,দিয়ান,স্বস্তিক,নিরব চেনা মুখগুলোও আছে। এককোনে মাকে ধরে দাড়িয়ে তাজীন। তন্নি তৃষা আর তৌফিকা মিলে তৌফিক ওয়াহিদের আনা হলুদের ডালা এনে ওর সামনে রাখলো। সবার আগে ডাকা হলো দোয়ার মাকে। উনি এসে দোয়ার দুগালে হলুদ ছোয়ালেন। ওনার মুখে হাসি,চোখে জল। দোয়ার ছড়িয়ে রাখা আঁচলে একটা চাবি দিয়ে বললেন,

-এতে আমার আর তোর বাবার তরফ থেকে তোর জন্য রেখে যাওয়া কিছু উপহার আছে মা।

দোয়া কেদেই দিলো। নিজেকে সামলে চলে গেলেন সালমা বেগম। দোয়াকে থামাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো তন্নি,তৃষা। তৌফিকা দোয়াকে হলুদ ছুইয়ে ওর আঁচলে একটা গয়নার বাক্স রেখে ওর গালে হাত রেখে বললো,

-দোয়ার জন্য দোয়া আর ভালোবাসা। এটা তো শুধু দেখানোর জন্য।

তৌফিকার হাতে হাত রেখে মুখে হাসি ফুটালো দোয়া। তৌফিকা বাবাকে ডাক লাগিয়ে বললো,

-বাবা? এখন তুমি হলুদ ছোয়াও। তারপর আমরা ফিরে যাই রংধনুতে। ওদিকের হলুদপর্বও তো বাকি। এদিকে বউয়ের গোসল দেরি না হয়,জ্বর না হয়,এজন্য আরাব শুধু একটু ছুইয়ে পাঠিয়েছে হলুদ। ওকেও তো হলুদ দিতে হবে!

দোয়া মাথা নামিয়ে নিলো। এককোনে দাড়িয়ে তৌফিক ওয়াহিদ ফোন স্ক্রল করছিলেন। তৌফিকার ডাক শুনে ইশারায় বোঝালেন ব্যস্ত আছি। সালমা বেগম বললেন,

-যান না মিস্টার ওয়াহিদ? ছেলের বিয়ের চেয়ে বড় ব্যস্ততা কিসের?

বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলেন না তৌফিক ওয়াহিদ। এগিয়ে এসে হলুদ হাতে নিলেন। দোয়া চুপচাপ চেয়ে রইলো তার দিকে। সবে হলুদ ছোয়াবেন, ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠলো তৌফিক ওয়াহিদের। টুইঙ্কেল তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে দোয়ার আচলে দিয়ে বললো,

-এই নাও উইশমাম! এইটা নানুভাইয়ের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস! এইটা গিফট করলাম তোমাকে!

উপস্থিত সবাই ঠোট টিপে হাসছে। তৌফিক ওয়াহিদ ব্যস্তভাবে ফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,

-না টুইঙ্কেল। এটা….

দোয়া এবার ফোনটা হাতে নিলো। সৌজন্য হাসি রেখে বললো,

-হলুদ আঁচলে দেওয়া জিনিস ফেরত নিতে নেই‌ স্যার। অমঙ্গলজনক ধরা হয় এটাকে। আর আমি থাকতে আপনার বা আপনার ছেলের কোনোরকম অমঙ্গল কি করে হতে দেই বলুন?

-বাট মাই ফোন….

-এখানে সবার চাওনির চেয়ে আপনার ফোনটাই কি বেশি দামি?

আস্তেধীরে বললো দোয়া। আশপাশ দেখে ওকে হলুদ ছুইয়ে সরে আসলেন তৌফিক ওয়াহিদ। রংধনুর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো তৌফিকারা। ছেলেগুলো বাদে অরুনাভ মুখার্জী আর একে একে চিলেকোঠার প্রায় মেয়েরা হলুৃদ ছোয়ালো দোয়াকে। তারপর ছেলেগুলোকে বের করে দেওয়া হলো। পাশের বাসার সব মহিলারা মিলে দোয়াকে উঠোনের কলতলায় বসাবে বলে এগোচ্ছিলো। হঠাৎই তন্নি বলে উঠলো,

-রাতে মেহেদী আর সঙ্গীত হবে। তখন তো মেহেদি আমরাও পরবো। তো এখন হলুদ শুধু দোয়াপু কেনো মাখবে?

কথা শেষ করেই তৃষার মুখ ভর্তি করে হলুদ মাখিয়ে দিলো ও। তাজীনসহ বাকি সবাইও নিজেদের মাঝে হলুদ ছোয়ানো শুরু করে দেয়। দোয়াকে ছেড়ে মেয়েরা সবাই যে যার মতো হলুদ মাখামাখি করছে। ভীরে ধাক্কাধাক্কিতে একটু সরে দাড়াতে যাচ্ছিলো দোয়া। হঠাৎই এক অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে জমে গেলো ও। শ্বাস আটকে কম্পিত হাত ছোয়ালো শাড়ির নিচে কোমড়ের দিকটাতে। হলুদ লেগে আছে সেখানে। আশপাশে তাকালো দোয়া। হলুদ শাড়ির মেয়ের দল ছাড়া কোনো পুরুষের ছায়াও নেই। একচুলও নড়লো না ও আর। বিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো শুধু। কোনো ছেলে নেই এখানে,কোনো মেয়ে কেনো ওভাবে হলুদ লাগাতে যাবে ওকে? নাকি সবটাই কাকতলীয়?

কিছুক্ষন পর ওকে ধরে কল তলায় বসালো সবাই মিলে। কয়েক কলসি জল মাথায় ঢেলে ওকে উপরে পাঠিয়ে দিলো চেন্জ করার জন্য।শাড়ি পাল্টে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো দোয়া। ভেজা চুল থেকে গামছাটা খুলে ফেললো। নিজের দিকে তাকালো একপলক। ভেতরটায় অজানা কষ্ট জেকে বসেছে। ওই অচেনা তিন আঙুলের স্পর্শ ভুলতে পারছে না কোনোমতেই। কোনো পুরুষের স্পর্শ নয় ওটা। তবুও এভাবে কোনো মেয়ে ছুয়েছে ওকে,মানতে পারছে না ও। চোখ ভরে উঠলো ওর। দরজায় নক পরায় তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে গলা স্বাভাবিক করে বললো,

-ক্ কে?

-আমি স্বস্তিক।

দোয়া মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। স্বস্তিক বাইরে থেকেই ওর ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

-আরাব দাদা ফোন করেছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায় দিভাই।

অস্বস্তিতে পরে গেলো দোয়া। ইতস্তত করে ফোনটা হাতে নিলো ও। স্বস্তিক হেসে চলে গেলো। আস্তেধীরে ফোনটা কানে নিলো দোয়া। আরাব বললো,

-কল রেকর্ড অফ করো দোয়া।

কথাটা শুনে তৎক্ষনাৎ কান থেকে ফোন নামিয়ে নিলো দোয়া। স্ক্রিন অন হতেই কল রেকর্ড অন দেখে হতবিহ্বল হয়ে ওটার দিকেই তাকিয়ে রইলো ও। আরাব বলে উঠলো,

-দোয়া? আছো?

কল রের্কড অফ করে ফোন কানে নিলো দোয়া। বিস্ময়েই বললো,

-আপনি কি করে জানলেন কল রেকর্ড অন করা?

-বর বউয়ের কথার কাবাবে হাড্ডি হওয়া,স্বস্তিকের ওই ক্লাসের টপার ছিলাম আমি। তৌফিকা আপু আর মুফতাহির ভাইয়া জানে।

দোয়া মৃদ্যু হাসলো। পরপরই মন খারাপ হয়ে গেলো ওর আবারো। যা থেকে যাই হয়ে যাক,বারবার কেউ ওর কোমড়ে হলুদ ছুইয়েছে ভাবতেই মন বিষিয়ে উঠছে ওর। আরাব বললো,

-কি হলো? চাঁদমুখের হাসিটা গায়েব কেনো?

বড়বড় চোখে আশপাশে তাকালো দোয়া। ওপাশ থেকে আরাব বললো,

-এইতো! এইদিক! জানালা দিয়ে ঠিক বাইরে,সেলুনের সামনে!

ছুটে এসে জানালার গ্রিল ধরে দোয়া বাইরে উকিঝুকি দিলো। চোখে পরলো সেলুনের পাশে বাইকে হেলান দিয়ে সত্যিই কেউ দাড়িয়ে। বাইকের সিটে হলুদ শাড়ি এলোমেলোভাবে রাখা। মানুষটার পরনে হলুদ বর্ডারের সাদা পান্জাবী। একহাতে কানে ফোন ধরে আরেকহাতে দুরবীন ধরে ঠিক ওর জানালার দিকেই তাকিয়ে আছে কেউ। দোয়া তৎক্ষনাৎ ঘুরে উঠে পর্দার আড়ালে দাড়ালো। শ্বাস আটকে আরাবের পাগলামীগুলো মাথায় ঠিকঠাকমতো বসাতে লাগলো। কানে ধরা ফোনে আরাব বললো,

-ওইযে তোমার কোকড়া চুলের ডগায় পানিকনা দেখা যায়।

চোখ বন্ধ করে ঠোট টিপে নিশব্দে হাসলো দোয়া। আরাব বললো,

-আমার গায়ে ছোয়ানো হলুদ তোমার গায়ে ছোয়ানোর পর তোমাকে ঠিক কেমন দেখায়,তা দেখার লোভ সামলাতে পারিনি দোয়া। চলে এসেছি।

-একে চলে আসা বলে না। পাগলামি বলে।

-তবে আরেকটা পাগলামি শোনো?

-ম্ মানে?

-এসেছি যখন,তোমাকে হলুদ ছোয়াবো না,তা কি করে হয় বলো? আপু জানে এটা। তাই বারবার করে বলে দিয়েছে,দোয়ার গায়ে তোর লাগানো হলুদ যেনো কেউ না দেখে আরাব! বাধ্য হয়ে শাড়ির আড়ালেই তিন আঙুলের হলুদ স্পর্শ একে দিয়ে এসেছি তোমার গায়ে।

লজ্জায় লালাভ হয়ে উঠলো দোয়া। যে স্পর্শকে ঘিরে ওর এতোক্ষন খারাপ লাগা ছিলো,তা নিমিষেই শিহরনে পরিনত হয়েছে। নিমিষেই ভালোলাগার বহর জুড়ে বসেছে মনেপ্রানে। চোখ বন্ধ করেই তা অনুভব করতে লাগলো ও। আরাব বললো,

-বলেছি না তোমাকে? কোনো কষ্টকে ছুতে দেবো না তোমায়। আমার ভালোবাসার স্পর্শে ভরিয়ে রাখবো তোমাকে। এভাবেই! না না! এরচেয়েও বেশি ভালোবাসায়! আদরে!

দোয়া ওড়না খামচে ধরে দেয়ালে মিশে রইলো। আরাব আবারো বললো,

-হেই মেয়ে? আড়ালে দাড়িয়ে লজ্জা পাও ঠিকাছে। তবে কালকের বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর এই লজ্জা….

আর সহ্য হচ্ছিলো না দোয়ার। জানালায় এসে দাড়ালো সাথেসাথে। আরাব আটকে গেলো। লজ্জা ভুলে দোয়া এভাবে জানালায় এসে দাড়াবে,আকাঙ্ক্ষিত ছিলো না এর। দোয়া চেহারায় গম্ভীর ভাব আনার ভঙিমা করে বললো,

-আমাকে তো খুব লজ্জা নিয়ে কথা শোনাচ্ছেন মহাশয়! আমার না হয় ওটা একটু বেশিই। তা বলে আপনি এতোটা নির্লজ্জ কেনো বলুনতো?

-অপোজিট এট্রাক্টস্! সিম্পল!

-হুম। জানি! তবে ভাবিনি আপনি এতোটা বেপরোয়া যে,আমাকে হলুদ লাগাবেন বলে,শাড়ি পেচিয়ে,আন্টিবেশে চিলেকোঠায় চলে আসবেন! সাইকো সাইন্টিস্ট কোথাকার!

দুরবীন চোখ থেকে নামিয়ে কিছুক্ষন বিমুর্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো আরাব। পেছনে বাইকের উপরে রাখা এলোমেলো শাড়িটা হাতে নিয়ে হেসে দিলো ও। ফোনের এপাশ থেকে ওর হাসির শব্দ শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো দোয়াও।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here