ছায়া সঙ্গিনী পর্ব ১৫+১৬

0
722

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১৫
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

একটু পর পর বাজ পরার শব্দ, তাছাড়া শিলাবৃষ্টির কারণে টিনের চালে ধরাম ধরাম শব্দ হচ্ছে। এদিকে কারেন্ট নেই,সৌর বিদ্যুৎ এর বাল্ব জ্বলছে ঠিকই কিন্তু মিনমিন করে। বাল্ব গুলো কালো হয়ে গেছে,যার কারণে আলো অনেক কম, চেঞ্জ করা প্রয়োজন।
ভয়ে শিউরে যাচ্ছি,ইয়া আল্লাহ আমাকে হেফাজত করুন আমীন। এরকম পরিস্থিতিতে কখনো মোকাবেলা করতে হয়নি আমাকে। বাসায় কেউ না কেউ সাথে ছিল। মা যে কেন আজকেই গেল? অবশ্য যাবেই না বা কেন? মামা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।ভাই যদি এতো অসুস্থ হয় তাহলে কোন বোন কি শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারে? একদম ই পারে না। মোবাইল টাও অন করতে পারছি না যে মাকে কল করবো।আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে মোবাইলের
সুইচ বন্ধ করে দেওয়া বা এরোপ্লেন মোড করে দেওয়া উচিত। কারন মোবাইল এবং বজ্রপাত দুটোই বিদ্যুৎ সম্পর্কিত। বিদ্যুৎ লাইনের মধ্যে দিয়ে বজ্রপাতের ফলে সৃষ্টি উচ্চমাত্রার কারেন্ট প্রবাহের ফলে টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যেতে পারে অনেকক্ষেত্রে পুড়েও যেতে পারে।তাই বন্ধ করে রেখে দিয়েছি মোবাইল, হয়তো মা ও আমাকে কল করে চলেছে।
ভয়ে জড়সড় হয়ে খাটের মধ্যখানে বালিশ জড়িয়ে ধরে বসে আছি আর জিকির করছি।
রাসূল (সা:) যখন বৃষ্টি হতে দেখতেন তখন বলতেন,
– “আল্লাহুম্মা সাইয়েবান নাফিআ”
অর্থ- হে আল্লাহ মুষলধারে উপকারী বৃষ্টি বর্ষাও।
(বুখারী-১০৩২)

তাই আমিও এই দো’আ পড়লাম “আলহামদুলিল্লাহ”।
হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত শুরু করে কে যেন! ভয়ে চুপসে গেলাম আমি,কে হতে পারে? এতো ঝর ঝাপটার মধ্যে মা কি আসতে পারে?যদি মা না হয় তাহলে তো সর্বনাশ! আমি একা একটা মেয়ে, না না কিছুতেই দরজা খুলা যাবে না।যদি চোর হয়ে থাকে?ওরে বাবা।ইয়া আল্লাহ রক্ষা করো আমাকে আল্লাহ।

কিছুক্ষণ বন্ধ ছিল দরজা ধাক্কানো। এখন আবার শুরু হয়েছে। কোন সময় জানি দরজাই ভেঙে ফেলে! তখন আমি কি করবো?
আইডিয়া খাটের নিচে লুকিয়ে থাকবো! আগে নিজে সেইফ থাকবো, তারপর ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে ভাববো। আচ্ছা দরজার সামনে কাঠের চেয়ার টা টেনে দিলে কেমন হয়? হুম তাই করি তাহলে আরেকটু জোড়ালো হবে দরজাটা।যেই ভাবা সেই কাজ, কাঠের ভারি চেয়ার টা খুব কষ্ট করে বয়ে নিয়ে গেলাম দরজার সামনে। তখন কানে এলো,
– মা’গো দরজা খুলো ভিজে যাচ্ছি!

বহু পরিচিত সেই কন্ঠস্বর! মুহূর্তেই শরীরে ভালো লাগার শিহরণ খেলে গেল। নিজের কান কে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যেন। তাড়াতাড়ি করে চেয়ারটা সরাতে নিলে পায়ে লেগে ব্যাথা পেলাম। সে দিকে তোয়াক্কা না করে দ্রুত পায়ে দরজা খুলে সাইটে সরে দাঁড়ালাম। সে যে এতো সময় যাবত কাকভেজা হয়ে গেছে। কি সব আবোল তাবোল চিন্তা ভাবনা করে মানুষটাকে এতোক্ষণ কষ্ট দিলাম দূর এখন নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে, প্রচুর পরিমাণে। হাতে একটা মাইর দিতে পারলে রাগটা কমতো! কিন্তু সেই উপায় তো নেই।যাই হোক, রাব্বুল আলামীন আমার বিপদের দিনে, আমার প্রিয় মানুষ’টাকেই
পাঠিয়ে দিয়েছেন”আলহামদুলিল্লাহ”। রাহাত ভেজা সার্ট খুলে মাথার চুল গুলো নেড়েচেড়ে পানি ফেলছে। আমি দরজা বন্ধ করে, আলমারি খুলে রাহাতের গামছা আর লুঙ্গি বের করে নিয়ে আসলাম। রাহাত পিছন ফিরেই বললো,
– প্রায় পনেরো মিনিট যাবত দরজার কড়াঘাত করেছি। দরজা কেন খুলছিলে না মা? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, একলা ঘরে থাকো। দুশ্চিন্তা হয় না বলো?

বুঝলাম তিনি এখনো তার ব‌উ’কে দেখেন নাই।তাই দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় আসতেই, পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে লুঙ্গি গামছা দিলাম।সে হাতে নিয়ে যেই ঘুরবে, অমনি আমিও ঘুরে তার পিছনে চলে গেলাম। এরকম কয়েকবার হ‌ওয়ার পর সে স্থব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ভাবনায় পরে গেলাম,ও এরকম স্থব্দ হয়ে গেল কেন?
আমার ভাবনার মাঝেই ও ঘুরে গেল,যার ফলে আমি পিছন যাওয়ার সুযোগ পেলাম না। তবে মজার ব্যাপার হলো ও আমাকে দেখে কোমায় চলে গেছে! মানে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।ভুত দেখলেও হয়তো কেউ এভাবে চমকাবে না,ও যেভাবে চমকে গেছে।যাই এখানেই আমার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি।এ দিনটার জন্যই তো অপেক্ষা করে ছিলাম আমি।ও বাড়ি আসবে আর আমাকে দেখে চমকে যাবে।সব কিছু বাদ দিয়ে ওকে নরমাল করতে ঠান্ডা শরীর টাকে আঁকড়ে ধরলাম আমি। তারপর বললাম,
– কেমন দিলাম বলো?

– আমি কখনোই ভাবিনি তুমি আমার এই ভাঙ্গা ঘরে আসতে পারো?

– আমার নয় বরং আমাদের। ছায়া সঙ্গিনী আমি তোমার এমনি এমনি তো বলিনি। তোমার ঘরেই যদি না থাকি তাহলে কি আর ছায়া সঙ্গিনী হ‌ই বলো?

তুমি দূর্গম পথে চললে,
সেই পথের পথিক আমিও।
তুমি ফুলে ফুলে সজ্জিত পথে চললে,
সেই পথের পথিক আমিও।
কজ আমরা একে অপরের ছায়া সঙ্গিনী?

আমার বউ’টা আমাকে এত্তো ভালবাসে! আমি তার সম ভালোবাসা দিতে পারবো তো?

আমি মাথা তুলে তাকিয়ে বললাম,
– আমি জানি তুমি নিজের থেকেও বেশি আমায় ভালোবাসো।তাই এই নিয়ে কোন দুশ্চিন্তার কারণ নেই অকে? এবার তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নাও। আমার জন্য তোমাকে এতো সময় ভিজতে হলো। আসলে আমি ভয়ে দরজা খুলার সাহস পাইনি। ভেবেছিলাম যদি কোন চোর ডাকাত হয়ে থাকে।

– তুমি তোমার দিক থেকে ঠিক‌ই আছো। সত্যি ই তো আমার জায়গায় অন্য কেউ ও তো হতে পারতো। আচ্ছা মা কোথায়? তুমি বাড়িতে একা কেন?

– মামা অসুস্থ বলে মা দেখতে গিয়েছে, হয়তো বৃষ্টির জন্য আসতে পারছেন না।
এখনো মাগরিব এর আযান হয়নি, আমি একা আছি ভেবে বৃষ্টি একটু কমে আসলেই হয়তো র‌ওনা হবে।আমি কল করে বলে দিচ্ছি আজকে যেন কষ্ট করে না আসে।

– হুম তাই করো, বৃষ্টিতে রাস্তা ঘাট পিচ্ছিল হয়ে আছে।পরে আবার ব্যাথা পাবে।

রাহাত ভিজে কাপড় চেঞ্জ করেছ, আর আমি মাকে কল করে বলে দিলাম আজকে যেন কষ্ট করে না আসে। রাহাত এসেছে শুনে মা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। কথা শুনেই বুঝতে পারলাম এতোক্ষণ আমার জন্য খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
_______
বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে এখন, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পরছে। চারিদিকে অন্ধকারে ডুবে আছে, কোন মানুষের গতানুগতি নেই। সবাই সবার ঘরে অবস্থান করেছে। আমার এখন বিন্দু মাত্র ভয় নেই কারণ সবচেয়ে ভরসার হাতটা যে আমার হাতে আছে। “আলহামদুলিল্লাহ”।

আলহামদুলিল্লাহ অর্থ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার।তাই বান্দা যখন আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহ তা’আলা অনেক খুশি হন।আমরা যেই পরিস্থিতিতে থাকি না কেন, আলহামদুলিল্লাহ বলবো ইনশা আল্লাহ।১২৪

মাগরিব এর আযান হতে, দু’জনে মিলে নামায পড়ে এসে বসে রইলাম।ওর মাথায় হাত রাখতেই বুঝলাম পানি আছে এখনো।তাই গামছা নিয়ে এসে ভালো করে মুছে দিতে লাগলাম। তখন ও বললো কবে এসেছো তুমি?
– আজকে তিন দিন হলো।

– আচ্ছা সেই জন্যই মা বললো আমি যেন ছুটি হলেই বাড়ি আসি।

আমি রাহাতের গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
– আমিই মাকে বলেছি, তোমাকে যেন এখানে আসতে বলে। নতুবা তুমি যদি নারায়ণগঞ্জ চলে যাও তখন আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে পারতাম না।

– আচ্ছা তাহলে আমার দুষ্টু ব‌উ আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছে।

– ইয়েস আর্মি সাহেব।

– আচ্ছা এশার এর আযান হতে তো আর সময় আছে তাই না?

– হুম, কিন্তু কেন?

– খুব ক্লান্ত আমি,একটু ঘুমাবো।চলো?

– আমি কেন! তুমি ঘুমাও।

– না তুমি সহ।

তারপর আর কি আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো।তার ডান হাতে আমার মাথা রাখলো, বললাম ব্যাথা পাবে তা-ও শুনলো না।তার লোমশ বুকে আঁকিবুঁকি করছি আমি, তখন সে বললো,
– জানো আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি গ্রামে আসতে পারো।

আমি মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
– আমি কিন্তু গ্রামের মেয়ে ভুলে যেওনা। গ্রামের মতো এতো শান্তি আর কোথাও আছে নাকি। তুমি যদি আমার পাশে সবসময় থাকতে তাহলে আমি গ্রামেই সারাজীবন কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু তুমি ছাড়া থাকতে পারবো না আমি।

– তো ম্যাডাম গ্রামে থাকতেন ভালো কথা, মাটির চুলায় রান্না করতে পারবেন তো?

– পারি কিন্তু খুব ঝামেলা। বিশেষ করে কালি গুলো একদমই ভালো লাগে না। পুরো শরীর কালি মাখিয়ে ফেলি। গতবার এসে যখন রান্না করেছিলাম তখন মুখে কালি লেগেছিল বলে তোমার চাচাতো বোন রোজিনা হাসতে হাসতে শেষ। আমি তো প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না ও এভাবে হাসে কেন পরে,,,

– এক মিনিট! গতবার মানে? তুমি কি এর আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিলে নাকি?

– আর্মি সাহেব শ্বশুরবাড়ি না আসলে কোথায় আসবো বলেন?

– ক‌ই আমাকে তো একবার ও বললে না।মা ও তো কিছু বললো না।

– মাকে আমি বলতে নিষেধ করেছিলাম তাই বলে নাই। এখানে আসার পর ই তোমার এক্সিডেন্ট হয়, তারপর আমরা সবাই যাই তোমার কাছে।

– আমার অগোচরে এত কিছু হয়ে গেল অথচ আমি কিছু জানি না, দুষ্টু মেয়ে।সরি দুষ্টু ব‌উ আমার,,,,

তারপর,,,

নিজের অধরে অধৈর্য অধরের স্পর্শ পেতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।
________
আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে রাহাত বললো, আমার সাথে কোয়ার্টারে যাবে আয়রা মেহেনূর? তোমাকে সবসময় আমার সাথে মিশিয়ে রাখবো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু পর পর এসে তোমাকে মন ভরে দেখতে পারবো আমি।যাবে আমার সাথে?পারমানেন্টলি আমার সাথে থাকবে তুমি, তবে মাঝে মাঝে বাবা’র বাসায় বা এখানে বেড়াতে আসবে।

রাহাতের কথা শুনে একটু ভেবে বললাম,
– এর জবাব টা অন্য ভাবে প্রকাশ করি?,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here