#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
শেষ পর্ব
প্রিয় অন্বেষা,
হয়তো অবাক লাগছে তোমার কাছে, সহসা কেন আমার এই অন্তর্ধান তা ভেবে! সেই কারণটা নাহয় পরেই বলি, সবার আগে কোনোরকম ভাণ ছাড়া সবচেয়ে জরুরি কথাটাই নাহয় বলে ফেলি। সেই কথাটা ছাড়া বাকি সব বড্ড অর্থহীন আর অন্তঃসারশূন্য!
আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এটাই এখন আমার কাছে ধ্রুব সত্য। আর ভালোবাসি বলেই দূরে চলে যাচ্ছি। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো, তোমার ভালোবাসা তুমি যত সন্তর্পণেই লুকিয়ে রাখ না কেন, এর টান কোনো এক মায়া বলে ঠিকই আমাকে টানে। আকাশে মেঘ গর্জালে যেমন পুরো জগৎ কেঁপে উঠে, তোমার প্রলয়ঙ্কারী ভালোবাসাও তেমনই আমার হৃদয়ের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে!
প্রতি রাতে ঘুম ভেঙে যেত দুঃস্বপ্ন দেখে, তোমার সাথে বন্ধুত্বের পর থেকে সেই দুঃস্বপ্ন আমাকে আর তাড়া করে ফেরে না। বহুকাল পরে খুঁজে পেয়েছি হারিয়ে ফেলা আমাকে।
তোমার মধ্যে অদ্ভুত একটা স্পার্ক আছে, এই স্পার্কটা সবসময় ধরে রেখো। একগুঁয়ে, নাছোড়বান্দা, উদ্ভাসিত হাসিমুখ সবটা মিলিয়েই এক প্রাণোচ্ছল তুমি। এসবই তোমার সৌন্দর্যকে আরও ধারালো করেছে, শৌর্য এনে দিয়েছে তোমাতে! এর সবটাই আমি ভালোবাসি। আমি পাশে থাকি বা না থাকি নিজের মধ্যে এই দ্যোতনা আজীবন ধরে রাখবে।
বড্ড ইচ্ছে ছিল ভোরের শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের চাদরে খালি পায়ে তোমার হাত ধরে হাঁটব, দিনের প্রথম সূর্যালোক গায়ে মাখব। বর্ষার নবধারা জলে হাত ধরাধরি করে ভিজব! চাঁদের আলোয় যখন পৃথিবী ভেসে যাবে, সেই জোৎস্নার জলে অবগাহনে মাতব! আমার বয়সী একজনের জন্য এসব হয়তো নিতান্তই ছেলেমানুষী চাওয়া কিংবা মেয়েলী ইচ্ছে মনে হতে পারে! কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে বয়স শুধুই সংখ্যা মাত্র, আমার মনের বয়স মাঝে কিছুটা বুড়িয়ে গেলেও আবার কমিয়ে পঁচিশে নিয়ে এসেছি! আর চাওয়া বা ইচ্ছেদের ছেলেমেয়েতে বিভেদ হয় না বলেই আমার বিশ্বাস। সবটাই মনের ব্যাপার।
শব্দের সাথে শব্দ জুড়ে দিয়ে তাতে প্রাণের সঞ্চার ঘটানোই আমার কাজ। আর দেখলে তো তোমাকে লিখতে বসে কেমন করে সব গুলিয়ে ফেলছি! শব্দেরা বারবার জট পাকিয়ে আসছে। প্রসঙ্গ থেকে ছুটে যাচ্ছে বারবার।
আমার জীবনে বারবার বসন্ত এসে উঁকিঝুঁকি মারে, ধরাও দেয় হয়তো, কিন্তু আমি এমনই ভাগ্য বিড়ম্বিত একজন যার কাছে রঙিন বসন্ত আসি আসি করেও ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। আমার বসন্ত চিরকাল বিবর্ণই থেকে যায়। কী যে বিবর্ণ, ধূসর সে বসন্ত! আর চারপাশে থেকে যায় শুধুই শূন্যতা! আমার যে চিরটাকালই শূন্যতায় বসবাস!
সময় আবর্তিত হতে থাকবে তার গতিতেই, ঋতু চক্রের পালা বদল ঘটবে, এখনকার মতই শীতে সবুজ ঘাসের দ্বীপ শিশিরে ভেজা থাকবে, শরতের কাশফুলেরাও তাদের পশরা সাজিয়ে আসবে নিয়ম করেই, আসবে জোৎস্নালোকিত সহস্র রাত আর ঝুম বৃষ্টির সহস্র দিন। এসবের সাথে তুমিও থাকবে, চির অমলিন৷ কিন্তু সেসব দেখার জন্য আমি হয়তো থাকব না! ঘুমিয়ে যাব, হারিয়ে যাব, ফুরিয়ে যাব, একেবারে নিঃস্ব হয়ে, এক পৃথিবী শূন্যতা নিয়ে!
বাঁচা মরায় যখন কোনো কিছু আসত যেত না, জীবনে কোনো পিছুটান ছিল না, সেই সময় তুমি এলে। অদৃশ্য সুতোর টানে আমার হৃদয় জুড়ে আসন গাড়লে, কী যে প্রগাঢ় সে টান! সেই টানেই কিনা খুব করে বাঁচতে ইচ্ছে হলো, তখনই জানতে পারলাম আমার সময় বাঁধা পরে গেছে। তুমি বলেছিলে সাঁতার কেটে তীরে উঠতে, আমি তাই প্রাণপণে তীর খুঁজে ফিরলাম, তীরে যখন প্রায় পৌঁছে গেলাম, ঠিক তখনই আচমকা এক সর্বগ্রাসী ঢেউ আবার টেনে নিয়ে গেল সেই অতলেই। এবার বোধহয় ডুমেই গেলাম! আর হয়তো কিছুদিন, কিছু মাস কিংবা একেবারেই অল্প কিছু বছর!
আমার যা হয়েছে, একে মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় বলে ‘ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া’। সোজা কথায় বললে এক ধরনের ক্যান্সার। রিকাভার করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে সঠিক সময়ে ট্রিটমেন্ট করালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে অনেকে। নিজেকে এত ভাগ্যবান মনে হয় না, ফুটো কপাল যে, ডুবন্ত মানুষ!
আমি চাই না আমার ধুঁকে ধুঁকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরে যাওয়াটা তুমি সামনে থেকে দেখো। তোমার চোখে আমি এভার গ্রীন থাকতে চাই, সবসময়! চিরসবুজ, চির অমলিন! আর তাছাড়া শেষ সময়টা বাবা আর ছোট ভাইয়ের সাথেও কাটাতে চাই।
ভালো থেকো। নিজেকে হারিয়ে যেতে দিও না। স্পার্কটাকে বাঁচিয়ে রেখো।
চিঠি খুব দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে, আর লিখছি না। বিদায়, শেষবারের মতো, হয়তো চিরতরে!
ইতি
তোমার বিষাদপুত্র
বি.দ্র.- নামটা আমার সত্যিই ভালো লেগেছে, তবে তুমি আসার পর বিষাদ পালিয়ে শুধুই ভালোবাসায় পূর্ন আমার সমস্ত হৃদয়! দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে অন্তিম প্রহরের অপেক্ষা করার সময় অফুরন্ত সময় পাব। তখন তোমার জন্যও একটা নাম ঠিক করব।’
ঊনচল্লিশ.
চিঠিটা শেষ করেই অন্বেষা যেন তলিয়ে গিয়েছিল অতল বিষাদে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, শ্বাস টানতে পারছিল না। সোহান তো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরে আবিদের নিয়মিত চিকিৎসককে নিয়ে এসে দেখিয়ে, প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
অন্বেষা এতক্ষণ পরে যেই কথাটা প্রথম বলেছে তা হলো, “সব মিথ্যা, সব দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
ওর এসবই মনে হচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল আবিদ ওর ট্রেডমার্ক হাসি নিয়ে ওর পাশে বসে সামনাসামনি ভালোবাসার কথাগুলো বলবে। চিঠির শুরুর অকপট স্বীকারোক্তি পড়তে পড়তে মনে হাজার স্বপ্নের নানা রঙের প্রজাপতিরা উড়াউড়ি করছিল, কিন্তু যতই নিচের দিকে যাচ্ছিল, ততই আশঙ্কা ঘনীভূত হতে থাকল, আর চিঠিতে লেখা অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আসছিল। পেটের মধ্যে সব গুলিয়ে উঠে আসতে চাইছিল আর বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠেই হুহু হাহাকার তৈরি করছিল। ভেতরে যা আছে সবটা নিংড়ে আসছিল। সহ্যশক্তি হারিয়ে মূর্ছা গিয়েছিল। সম্বিতে ফিরতেই সবটা মনে পড়ল। সবে ধূসর সরে গিয়ে রঙিন হচ্ছিল আবিদের জীবনটা, এর মধ্যে আবারও বিবর্ণতার হানা! কেন এমন হয়? ফেলেই যদি যাবে তবে কেন এত মায়া, এত ভালোবাসা, কেন মিছেই বন্ধনে জড়ানো? সব মিথ্যে! মায়া, ভালোবাসা সব মিথ্যে বালুচর!
অন্বেষা জানে ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই চলে গেছে আবিদ, কেমন দেখাবে না দেখাবে, এভারগ্রীন টিন এসব ছুতো মাত্র, শুধুই বাজে অজুহাত!
অন্বেষার ভাবনা ওকে কে ভাবতে বলেছে? মুহূর্তেই অভিমান ভর করল, এত বড় সত্যিটা ওকে জানাল না, এই নাকি ভালোবাসা! উনি মহান মানুষ, আরে ও স্বার্থপর নাকি!
“আমার মধ্যে স্পার্ক দেখেছ না? একগুঁয়ে, নাছোড়বান্দা! এই বিশেষণ যেহেতু আমাকে দিয়েছ, আমিও তোমাকে খুঁজে বের করব।” ভাঙাচুরা হৃদয় নিয়ে নিজের মনেই প্রতিজ্ঞা করল ও।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে সোহান ওর সাথে ভালো করে কথা বলছে, “আপনার প্রথম দিকের জেদের জন্য আপনাকে ভালো লাগেনি আমার। ওই ইম্প্রেশন টাই সবসময় থেকে গেছে। কিন্তু যখন খেয়াল করলাম, স্যার একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছেন, উনার চেহারা ঝলমল করতে থাকত, তখনই আপনার উপর আমার সব রাগ ধুয়ে গেছে। এও বুঝতে পারি আপনি স্যারকে ভালোবাসেন। আমিও নিজের ভাইয়ের মতোই দেখি, আর স্যারতো আমাকে বলেই গেছে আমি তার ভাই।” হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সোহান, কতটা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার আবিদ ওর কাছে সে তো জানা কথাই।
অন্বেষার হৃদয় আরেকবার ভেঙে গেল, গুড়িয়ে গেল! ভেতরে কতটা ভাঙচুর হচ্ছে, চুরে ভেঙে গুড়ো গুড়ো হচ্ছে এসব কেউ বুঝতে পারবে না। কোনো শব্দে এই অনুভূতির ব্যাখ্যা দেয়া যায় না, সম্ভবই নয়!
সোহান ওকে সাহায্য করল, আবিদের ছোটভাই অন্তুর সাথে কথা বলিয়ে দিল, নাম্বারটাও দিল। অন্তুকে বলে দিল এসব আবিদকে না বলতে। অন্তু আগে থেকেই অন্বেষার কথা জানত, ভাইয়ের সাথে কথা বলার সময় ইদানীং বেশিরভাগ জুড়েই থাকত ওর কথা। ভাইয়ের শেষ সময়টা সুন্দর করতে সানন্দে রাজি হয়ে গেল অন্তু।
অন্বেষার বাবা প্রথম দিকে কিছুটা অমত করলেও, শেষমেশ রাজি হলেন অন্বেষার কথায়, “কত বছর বাঁচল বা কতবছরের সংসার হলো এসবে আমি মাথা ঘামাই না, বাবা। তুমি আর মা তো ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলে, কতদিন টিকলো? আর বাঁচা মরা এসব তো আমাদের হাতে নেই! ওর আগে আমিও তো মরে যেতে পারি! তাছাড়া আমি বর্তমানে বাঁচতে চাই, পরে কী হবে না হবে সেসব পরে দেখা যাবে।”
অন্বেষার চোখের জল মুছে দিয়ে বাবা বললেন, “তুই এখন যথেষ্ট পরিণত হয়েছিস। ভালোমন্দ বুঝিস। তুই কোনো ভুল করবি না এটা আমি জানি। আমি তোকে অস্ট্রেলিয়া যাবার সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুই চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।” মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন বাবা। সবকিছু এরকম হয়ে যায় কেন?
মাস দেড়েকের চেষ্টায় সব বন্দোবস্ত করে দিলেন ওর বাবা। এর মাঝে মায়ের সাথে সম্পর্কটাও এগিয়েছে, অভিমানের পালা কমে গেছে অনেকটাই। মাঝে মাঝেই দেখা করছে, আবার ফোনেও কথা হচ্ছে নিয়মিতই। তবুও কিছুটা দূরত্ব আছেই, বাবার সাথে ও যতটা সহজ স্বাভাবিক, মায়ের সাথে কোথাও একটা অস্বস্তির কাঁটা খুঁচিয়ে মারে। দীর্ঘদিনের অনভ্যাস সবথেকে কাছের সম্পর্কেও কী এক দ্বিধা এনে দেয়, তৈরি করে দেয় এক হিমালয় দূরত্ব! হয়তো সময়ই আবার তা ঠিক করে দেবে!
অবশেষে অন্বেষা পাড়ি জমাল অস্ট্রেলিয়া, বিষাদপুত্রের বিষাদ মুছতে!
চল্লিশ.
আবিদ শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে, তিনদিন আগে প্রথম রেডিওথেরাপিটা দেয়া হয়েছে। কিছুদিন তাই এখানেই থাকতে হবে। হাসপাতাল ওর কখনোই পছন্দের জায়গা নয়, কারোরই নয় অবশ্য। প্রথম যেদিন জেনেছে এই পৃথিবীতে ওর আয়ু ফুরিয়ে আসছে ক্রমেই, সেদিন একেবারে ভেঙে পড়েছিল ও। আগে হলে হয়তো খুশিই হতো, কিন্তু এখন যে ওর জীবনের প্রতি খুব লোভ হয়! সুন্দর ভালোবাসায় পূর্ন একটা ঘর, ভালোবাসার মানুষ এসব চাওয়াটা ওর জন্য হয়তো খানিকটা বিলাসিতাই! একবার ভেবেছিল অন্বেষাকে কিছুই জানাবে না, পরে ভাবল এটা অন্যায় করা হবে মেয়েটির সাথে। হয়তো ওর মতই ভেঙে পড়বে! তাই চিঠিতে সব বলে এসেছে, চুকিয়ে বুকিয়ে এসেছে! চোখ বন্ধ করে সেসবই ভাবছিল সহসা কোমল হাতের স্পর্শে চোখ মেলে তাকাল, আর তাকাতেই ওর পৃথিবী থমকে গেল!
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, অন্বেষা এখানে কোত্থেকে আসবে, নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশন হবে! পরমুহূর্তেই মনে হলো হ্যালুসিনেশন এত স্পষ্ট কখনো হয় নাকি, এটা তো সিনেমা নয়! তবে, নিশ্চয়ই রেডিওথেরাপির প্রভাব হবে! কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে বারবার!
“কিছু না বলেই চলে এলে কেন? বারবার চলে যাওয়াই তোমার স্বভাব নাকি?”
এইতো কথা বলছে অন্বেষা, সত্যিই তবে…
“তুমি…”
আর বলতে পারল না আবিদ, তার আগেই ওকে থামিয়ে অন্বেষা বলতে শুরু করে, “আমি এখন থেকে তোমার সাথেই থাকব, একেবারে ছায়া সঙ্গী হয়ে, চাইলেও আর পালাতে পারবে না। আর আপনি আপনি করতে পারব না। কেন যেন বড্ড দূরের মানুষ মনে হয়।” একদমে কথাগুলো বলল অন্বেষা, রিনরিনে গলায় কিশোরীর উচ্ছলতা।
আবিদের ঘোর যেন কাটছেই না, একের পর এক চমকে বেচারা বিপর্যস্ত! সম্বিতে ফিরতেই কঠোর হলো কিছুটা, “তুমি কেন এসেছ এখানে? সব তো শেষ!”
“আমার মধ্যে নাকি একটা স্পার্ক আছে! একজন সেটা খুব ভালোবাসে। সেই স্পার্কটা তাকে আরেকবার দেখাতে এসেছি। তোমার খুশি হওয়া উচিত কিন্তু!”
“তোমার মাথায় আসলেই…”
” গণ্ডগোল আছে, তাইতো? সে আমি জানি। আগেও কয়েকবার বলেছ। আর শেষ বললেই সবটা শেষ হয়ে যায় নাকি, সমস্ত হৃদয়ের অনুভূতি একটা চিঠিতেই শেষ হয়ে যায় নাকি? আমরা এখান থেকেই শুরু করব সব।” কাতর গলায় বলল অন্বেষা।
“আমি আছিই আর কয়দিন! কেন করছ এসব পাগলামি?” আবিদের গলা ভেঙে এলো।
“হোক কয়েক মাস, কয়েকদিন, কিংবা কয়েক মুহূর্ত! যে কটা দিন আছি, একসাথে বাঁচতে চাই। বাঁচার মত বাঁচতে চাই, ভালোবাসায় বাঁচতে চাই। সামনে কী হবে না হবে আমরা তো জানি না! ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে সেসব ভেবে বর্তমান কেন নষ্ট করব? তার থেকে যে ক’টা দিন সব ঠিকঠাক থাকবে সেই মুহূর্তগুলোকে রঙিন করি, নিজেদের ভালোবাসার ঘর সাজাই। অতসীকে ফিরিয়ে দিয়ে যে ভুলের অনুশোচনায় পুড়েছ আবার সেই ভুল করো না, আবিদ।”
অন্বেষার কথাগুলো আবিদকে একটা অন্য পৃথিবীতে নিয়ে গেল যেন! মোহাবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে রইল। এত প্রগাঢ় ভালোবাসার আহবানকে আরেকবার এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য শক্তি কোনোটাই আবিদের নেই। অসম্ভব মায়াবতী এই মেয়েটির হাতছানি কিছুতেই পায়ে দলতে পারবে না ও। তবুও, সময়টাই যে নেই! তাই শেষ চেষ্টা ঠেকাবার,
“তোমার সামনে সারাজীবন পরে আছে…”
“এক মুহূর্তের ভালোবাসা নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেবো নাহয়। ভালোবাসাহীন অনন্ত জীবন কাটানোর চাইতে ভালোবাসাময় কিছু মুহূর্তই না হয় আমার সারাজীবনের রসদ হোক।”
অদ্ভুত এক হাহাকার ফুটল গলায়, কী যে আকুলতা তাতে! কী যে প্রগাঢ়তা ভালোবাসার! চোখে, মুখে, হৃদয়ে, মননে, মস্তিষ্কে!
আবিদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই অন্বেষার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল, গড়াতেই থাকল, এতক্ষণ মনের সমস্ত জোড় খাটিয়ে যে অশ্রু চেপে রেখেছিল চোখেই! আবিদেরও তাই, কাঁদছে আকুল হয়ে। এই কান্নায় কোনো ক্লেদ নেই, ক্ষোভ নেই, হতাশাও নেই! এই কান্নায় আছে প্রাপ্তি আর কিছু অদ্ভুত হাহাকার! বুকে একইসাথে প্রশান্তি আর নিগূঢ় বিষাদ! সুখ আর কষ্টের কী এক অদ্ভুত সহাবস্থান!
আবিদ হাসপাতাল থেকে বাসায় এলো কিছুদিন পরেই, অন্বেষার বাবাও এলেন অস্ট্রেলিয়ায়। তার দু’দিন পরে ওকে অবাক করে দিয়ে ওর মা-ও এলেন! মেয়ের বিয়ে বলে কথা!
সব হারানো এক বিষাদপুত্রের সাথে এক মায়াবতী রাজকন্যার বিয়ে হয়ে গেল। খুব একটা ধুমধাম অবশ্য হলো না, ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলো একটা ছোটখাটো।
এরপর দু’জন দু’জনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার প্রাণান্তকর চেষ্টা। হাসিমুখেই প্রাপ্তিটাকে গ্রহণ করল দু’জন।
সেই রাতে আবিদ অন্বেষাকে বলল, “আমি কখনো ভাবিইনি আমার জীবনে এত প্রাপ্তি ধরা দেবে। জীবনের একেবারে সন্ধিক্ষণে এসে এত সুখ, এত ভালোবাসা আমার জীবনে আসবে আমি জানতামই না। তুমি আমার জীবনে একটা পরশ পাথর।”
ওর মুখাবয়ব শুভ প্রাপ্তির আনন্দে বিমোহিত হয়ে আছে, এক অদ্ভুত আচ্ছনতা খেলা করছে সেই সুন্দর অবয়বটায়! ভালোবাসার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল আবিদ, শেষটাও তাই ভালোবাসাময় হোক, রঙের বৃষ্টি হোক, হোক সুখের বৃষ্টি!
আর অন্বেষার চাওয়া, “আমাকে সারাজীবন বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন দাও, যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে পারি!”
আবিদের সেই অদ্ভুত সারল্য মাখা হাসিতে বুঁদ হয়ে অন্বেষা মনে মনে দোয়া করল, “আল্লাহ, ওকে সুস্থ করে দাও, আমার সব আয়ু ওকে দিয়ে দাও।”
পরিশিষ্ট.
বিষাদপুত্র আর মায়াবতী রাজকন্যার বিয়ের পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। অন্বেষার চুলে কিছুটা সাদাটে রঙের উঁকিঝুঁকি, বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় গা এলিয়ে তাকিয়ে ছিল শূন্যে। ভীষণ সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজ, বিশ্বচরাচর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যেন আলোয় আলোয়!
“আম্মু, এখনো এখানে বসে আছ? চল ঘুমাবে এখন, অনেক রাত হলো।”
ছেলের দিকে পূর্ণ নয়নে তাকাল অন্বেষা, সেই চোখ, সেই অদ্ভুত সুন্দর সরল হাসি, অবিকল আবিদ যেন! কিশোর আবিদ! মাঝে মাঝে বুকটা ধ্বক করে উঠে ওর। ছেলে এসে ওর পাশে বসতেই হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলালো, বেশ বড়ো হয়ে গেছে দেখতে দেখতে।
স্মৃতির আয়না হাতড়ে ছেলের জন্মের সময়ে চলে গেল ও। আবিদ কী যে খুশি হয়েছিল! যখন ওর অন্তঃসত্ত্বা হবার কথা জানল সেদিন থেকেই কী উচ্ছাস! কী ছেলেমানুষী পেয়ে বসেছিল আবিদকে! খুশি অবয়বে ঠিকরে পড়ছিল যেন! তবুও কোথাও একটা শূন্যতা অন্বেষার নজর এড়াতো না।
আবিদ মাঝে মাঝে বলেও ফেলত, “আমি দেখে যেতে পারব তো ওকে। কোলে নিয়ে একটু আদর, একটু স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে পারব তো?”
অন্বেষার হৃদয় কেঁপে উঠত, আবিদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে থাকত। এমনভাবে আঁকড়ে থাকত যেন কিছুতেই যেতে দেবে না ওকে!
নিয়মিত বিরতিতে থেরাপি চলতে থাকত। সুন্দর চেহেরা মলিন হয়েছিল, শারীরিক অনেক পরিবর্তন দেখা দিচ্ছিল আবিদের মধ্যে। বুঝতে পারছিল সময় নেই আর খুব বেশি!
যেদিন ওদের সন্তান পৃথিবীর আলোতে এলো সেদিন আবিদের শীর্ণকায় হয়ে আসা মুখটায় কী যে উদ্ভাসিত হাসি ফুটেছিল! কী আশ্চর্য! হাসিটা তখনও কী অদ্ভুত সুন্দর ছিল!
ছেলেকে আঁকড়ে বসে থাকত সারাক্ষণ। এই যে নিজের অংশকে আদর করতে পারছে, নাড়াচাড়া করছে, মায়াময়ী এক স্ত্রী আছে, এত ভালোবাসায় মোড়ানো চারপাশ, কোথায় বিবর্ণতা? সবই তো রঙিন! আর কী চাইবার আছে একজীবনে! এখন মরলেও খুব একটা আক্ষেপ থাকবে না, শুধু একটাই আক্ষেপ ভালোবাসার সময়টা বড়ো ক্ষণস্থায়ী হলো, এই ভালোবাসা দীর্ঘসময় পাবার একটা লোভ হতো আবিদের খুব করে!
পাঁঁচবছর না টিকলেও ওদের প্রায় সাড়ে তিনবছরের ভালোবাসার চাদরে মোড়া সংসার ছিল। একেবারেই না পাবার চাইতে এই কী অনেক বেশি নয়!
আবিদ চলে যাবার পরে ওর লাশ দেশে নিয়ে এসেছিল ওর ইচ্ছানুযায়ী। প্রিয় লেখককে শেষ বিদায় জানাতে জনসমুদ্র হয়েছিল প্রায়, ওকে সিক্ত করেছিল ভালোবাসায়। কে বলেছে ওর ভালোবাসার অভাব ছিল, এত ভালোবাসা লোকটা কখনো খুঁজেও দেখেনি আগে!
অন্বেষার জীবনের হিসেবের খেরোখাতায় প্রাপ্তির অঙ্কটাই তাই যোজন যোজন এগিয়ে, অপ্রাপ্তি শুধু আরেকটু সময়ের! আরেকটু ভালোবাসা পাবার! বাকিটা পরিপূর্ণ, ভরাট!
ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই চোখ বন্ধ করে বাতাস টেনে নিল বুক ভরে! এখন যদি আবিদ ওর পাশে থাকত, প্রাপ্তির খাতাটা পুরোটাই পরিপূর্ণ হত! “ভীষণ মিস করছি তোমায়, বিষাদপুত্র।”
অন্বেষার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা জল, কষ্ট, বিষাদ আর কিঞ্চিৎ হলেও হয়তো সুখের!
(সমাপ্ত)
(এতদিন ধরে আপনারা এই লেখার পাশে ছিলেন, ভালোবেসেছেন সবার প্রতি রইল অশেষ কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা। এটা আমার দ্বিতীয় ধারাবাহিক লেখা। এই অপরিপক্ক লেখাকে সাপোর্ট করার জন্যও অফুরন্ত ভালোবাসা। শেষটা নিয়ে অনেকের কিছু চাওয়া ছিল, পাঠকের প্রত্যেকটা মন্তব্যই আমার কাছে বিশেষ, সেই চাওয়া অবশ্যই আমি পরবর্তী লেখায় মাথায় রাখব। আপনাদের শেষটা কেমন লাগল এক দু বাক্যে জানাবেন আশা করি। আপনাদের প্রতিক্রিয়া জানার অপেক্ষায় রইলাম। ভালোবাসা)