#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
অষ্টাদশ পর্ব
তেইশ.
আজকের বিকেলটা কেমন যেন ভীষণ গুমোট হয়ে আছে, বাতাসের ছিটেফোঁটা নেই, গোধূলির লালচে আভা ফুটে আছে যদিও। আবিদের ভেতরটাও আজ দুদিন থেকে এমনই গুমোট হয়ে আছে। এসময় সাধারণত ছাদে আসে না ও, মনের মেঘ কিছুটা হালকা করতেই উঠে এসেছে ছাদে। কিন্তু মরা আবহাওয়ায় মনের মেঘটা কেটে যাবার বদলে যেন আরও বেড়ে চলেছে! আকাশ জমে থাকা মেঘ বৃষ্টিতে ঝরিয়ে দেয়, কিন্তু ওর ভেতরটায় জমে থাকা মেঘ কীভাবে ঝরাবে সেই উত্তর ওর কাছে নেই!
আবিদের তীব্র অনুশোচনা সহস্র গুন বেড়ে গেছে অন্বেষার কথায়। টানা দুই রাত ঘুম কুমারীর সাথে সাক্ষাৎ হলো না একেবারেই। আগে তবুও যা একটু আধটু দেখা দিত, কিছুটা হলেও কৃপা করত ওর উপর, সেদিনের পর থেকে ঘুম কুমারী আর এমুখো হচ্ছেই না! হৃদয়ে ভাংচুর হচ্ছে অনবরত, পুরোনো ক্ষত নতুন জ্বালানি পেয়ে অনবরত গনগনিয়ে বাড়িয়ে চলছে দহন জ্বালা! ভেতরটা পুড়ে পুড়ে কয়লা এখন! সেখানে না আছে প্রাণ আর না আছে রং, বড্ড বেশি ফিকে! ভেতরটায় কোনো রং নেই, রস নেই, আছে শুধুই অন্ধকার, ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার!
সোহান এসে জানাল অন্বেষা এসে বসে আছে।
“স্যার, জার্নালিস্ট মেয়েটা এক্কেবারে জ্বালিয়ে মারল, দুই দিন ধরে ফোন টোন করে করে এক্কেবারে পাগল বানায়ে ফেলতেছে। আমি এতবার না করলাম, শুনলই না। এখন বাসায় এসে বসে আছে, স্যার। এই মেয়ের মনে হয় মাথায় সমস্যা আছে!”
“ওকে গিয়ে বলো আমি দেখা করব না। আর ফর গড সেইক, তুমি কথা বলাটা কমাও! অতিরিক্ত কথা বেশিরভাগ সময় বিরক্তিকর!” বিরক্তি চোখে মুখে ফুটে বেরোচ্ছে!
আবিদের অগ্নিমূর্তিতে অবশ্য সোহানের কোনো হেলদোল বোঝা গেল না, একঘেয়ে স্বরে বলতেই থাকল,
“স্যার, আগেই বলছিলাম, এদের থেকে সাবধান, এদের আস্কারা দিতে নাই। মাথায় চড়ে বসে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া শুরু করে! এখন ফলল তো আমার কথা!” সামনের সব দাঁত বের করে বলল সোহান, যেন নিজের ভবিষ্যতবাণী ফলে যাওয়ায় অত্যন্ত খুশি ও। আবিদের সহসা ভীষণ রাগ হলো, নির্বুদ্ধিতা সবসময় ভালোলাগে না।
কঠিন গলায় বলল, “ওকে গিয়ে বলো আমার এখন একেবারেই কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমার যখন কথা বলতে ইচ্ছে হবে আমি নিজেই ওকে জানাব। আমি এখন কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।”
আবিদের রাগ দেখে সোহান কিছুটা নিরস্ত হয়,
আর কোনো কথা না বলে পা বাড়ায়।
এখন কথা বলতে গেলে দূর্বল হয়ে পড়বে আবারও। আরেকবার ওই মেয়ের সামনে নিজেকে ভঙ্গুর হিসেবে উপস্থাপন করতে চায় না ও। হৃদয়ের ভাংচুর হৃদয়েই লুকিয়ে রাখতে চায় সযত্নে! এতদিন যেমন রেখেছে!
আবিদ আগে থেকেই কথা কম বলে, তবুও সোহান ওকে এতটা রূঢ়ভাবে কখনো কথা বলতে দেখেনি। কিছুটা চিন্তিত হলো সোহান, নিশ্চয়ই এই মেয়েটাই কিছু বলেছে, নইলে এরকম তো হয় না, আর ওর স্যারও কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। এই মেয়েকে বিশাল একটা রামধমক দিতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু আবিদের জন্য পারে না, নইলে এসব হাঙ্কিপাঙ্কি কবেই ছুটিয়ে দিত ও। এসব ভাবনা থেকে বেরিয়ে আন্বেষাকে আবিদের মনোভাব জানিয়ে বিদায় করে ও।
বসার ঘরে অপেক্ষা করছিল অন্বেষা, সোহান এসে আবিদের মনোভাব জানাতেই নিমেষে কালো ছায়া পড়ল চোখে মুখে! দু’দিন আগে আবিদকে এলোমেলো কথা বলে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে, এটা বুঝতে পারার পর থেকেই অস্বস্তির একটা কাঁটা ওকে অনবরত খুঁচিয়ে মারছে, স্বস্তি দিচ্ছে না কিছুতেই। অনবরত ফোন করে গেছে, কয়েকবার সোহান ধরে আবিদের অনিচ্ছার কথা জানিয়েছে, আবার অনেক সময় কল রিসিভ হয়নি। তাই আজ সশরীরে এসেছে নিজের ভুলটা স্বীকার করে স্যরি বলবে বলে। এতে যদি অনুশোচনার ভার কিছুটা কমে, কিন্তু এখন তা উল্টো বেড়ে গেল।
ফেরার পথে গাড়িতে বসে সহসা চোখ ঝাপসা হলো, শুধু একবার, দু’বার নয় বারংবার, বুক নিংড়ে কান্না উথলে উঠে আসছে। প্রায় অচেনা এক লোকের জন্য এত কান্না কেন আসছে জানা নেই ওর!
চব্বিশ.
রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে রইল অন্বেষা, আবিদের সাথে কথা বলার উপায় খুঁজছে হয়তো। আজ কৃষ্ণপক্ষ কিনা জানা নেই ওর, আকাশ ঘনকালো মেঘে আচ্ছন্ন। তবুও হাসনাহেনা আর কাঁঠালচাঁপার গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ।
অন্যদিন এই মনমাতানো ফুলেল সৌরভ উপভোগ করে ও, কিন্তু আজ সেদিকে নেই ওর বিষন্ন মনটা। মন পড়ে আছে কিছুদিনের পরিচিত এক বিষাদ পুত্রের কাছে! এক পৃথিবী বিষাদ জমা আছে যার হৃদয়ে! কীভাবে সে বিষাদ পুত্রের হৃদয় সেঁচে কষ্টগুলো বের করে ছুড়ে ফেলে দেবে সহস্র আলোকবর্ষ দূরে, আনমনে সেই উপায় খুঁজে চলছে অন্বেষা!
ওর মা ওকে রেখে চলে যাবার পর থেকেই ভীষণ একা ও। বাবা অবশ্য নিজের সামর্থ্যের সবটা দিয়ে ওর এই একাকিত্ব ঘোচাতে চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেননি, তবুও মায়ের শূন্যস্থান তো আর পূরণ হয় না। তাছাড়া বাবা দিনের প্রায় পুরোটা সময় ব্যস্ত থাকতেন নিজের কাজ নিয়ে, সন্ধ্যা থেকে রাতটুকু বাবাকে কাছে পেত অন্বেষা। বাবাই ওর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু।
এজন্যই ছোটবেলায় কারোর সাথে বন্ধুত্ব করেনি ও। সবাইকে ওদের মা দিতে আসত আবার নিয়ে যেত, মায়েরা কেমন স্নেহপরায়ণ হয়, তাঁদের আদরে কতটা মমতা মাখা থাকে এসব দেখত ও। সবাই মায়ের গল্প করত, কত যত্নে স্কুলের ইউনিফরম পরিয়ে দিয়েছে, চুল আঁচড়ে দিয়েছে, টিফিন বক্সে খাবার ভরেছে সযত্নে! শুধু ওর ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম। এসব করার জন্য ওর মা তখন ওর সাথে নেই। মা তখন নতুন পাতা সংসারে সদ্য জন্মানো ছেলের খেয়াল রাখায় ব্যস্ত! বুক ভারি হয়ে চোখ ভিজে যেত অজান্তেই। মায়ের প্রতি অভিমানের জন্ম তখন থেকেই। স্কুলের পরের সময়টা বাসায় একা একা কাটত, শুধু একজন পরিচারিকা ছিল ওর দেখভাল করার জন্য।
সেসময় থেকেই ওর একাকিত্ব ঘোচানোর সঙ্গী হয়ে উঠে কখনো হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, সুচিত্রা, সুনীল থেকে শুরু করে স্টিফেন কিং, সিডনি শেলডন, মারিও পুজো, ড্যান ব্রাউন কিংবা আগাথা ক্রিস্টি। আবার কখনো টম ক্রুজ, ব্র্যাড পিট, টম হ্যাঙ্কস, জনি ডেপ, আমির খান থেকে শুরু করে করে জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ পর্যন্ত! সাথে ওর কাছে সবসময়ের বিরক্তিকর টেক্সট বই তো ছিলই। বই, সিনেমা, নাটক, গান, পড়াশোনা আর সবচেয়ে প্রিয় বাবা এই নিয়েই গড়ে উঠে ওর একান্ত পৃথিবী।
স্কুলে লাইফের একেবারে শেষের দিকে কোচিং এর সুবাদে কিছু বন্ধু জুটে যায়, আনন্দও ওদের মাঝে একজন। ওর সাথেও বন্ধুত্ব হয়েছিল তখনই। অল্প হলেও যে দু’চার জন বন্ধু জুটেছে সবাই দারুণ মিশুক আর বন্ধুভাবাপন্ন।
বাবার প্রাণপণ চেষ্টায় একাকিত্ব কখনোই আসন গেড়ে বসেনি ওর মনে কিংবা মস্তিষ্কে! তবুও কোথাও একটা হাহাকার বোধহয় রয়েই গিয়েছিল হৃদয়ের গোপন কোনো প্রকোষ্ঠে!
অন্বেষার ধ্যান যখন আকাশ পানে, সহসা বাবার ডাকে কিছুটা চমকায় ও।
“কী রে, ঘুমাবি না?”
“হ্যাঁ, বাবা। তুমি ঘুমাওনি কেন এখনো? কয়টা বাজে?”
“সাড়ে বারোটা, কয়েকদিন ধরে তোকে ভীষণ অন্যরকম লাগছে। কী এত ভাবিস?” চিন্তিত গলায় প্রশ্ন বাবার।
“কই কী ভাবছি? কিছু না তো!”
আশ্চর্য, বাবার কাছ থেকে কথা লুকালো কেন ও! আগে তো কখনো এমন হয়নি। বাবা ওর জীবনের সবথেকে কাছের বন্ধু, নির্দ্বিধায় যার সাথে সব শেয়ার করা যায়। এমনকি ও যে একবার রিলেশনশিপে জড়িয়েছিল, তারপরের ব্রেকআপটা পর্যন্ত বলেছিল বাবাকে। তবে কোন সে সংকোচ অবচেতনে ওর মনের আর মুখের রাশ টেনে ধরল?
“খুব অন্যমনস্ক আর মনমরা লাগছে তোকে, দু’দিন ধরে খেয়াল করছি। কী হয়েছে আমাকে বলবি না?” কাতর গলায় বাবার প্রশ্ন।
“বাবা, তুমি অযথা চিন্তা করছো, কিছুই হয়নি। আর কিছু হলে তোমাকেই আগে বলব।”
বলেই বাবার কাঁধে মাথা রাখল, অনেকটা নিশ্চিন্তবোধ করল এখন। সব বাবাই কী মেয়েদের জন্য এরকম মন ভালো করার ম্যাজিক বক্স জমা রাখেন নিজেদের কাছে? বাবা মাথায় হাত বুলালেন আলতো করে, পরম মমতায়! ইশ! কী যে প্রশান্তি মেশানো সে ছোঁয়া! কতটা ভরসার!
মুহূর্তেই মন খারাপ ভাবটা কেটে গেল। রাতেও খুব ভালো একটা ঘুম হলো ওর, সকালে উঠেই খচখচানি অনুভূতি আবার ফিরে এলো। নাহ্! এভাবে আর থাকা যায় না, যেভাবেই হোক দেখা করে ‘স্যরি’ বলতেই হবে। নয়তো স্বস্তি ফিরবে না। কিন্তু আজ যাবে না, দুদিন নাহয় যাক, আবিদ নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিক নাহয়। আর তাছাড়া আবিদ নিজেই যেহেতু বলেছে যোগাযোগ করবে, তাতেই নাহয় ভরসা করা যাক!
বইপোকা হলেও আবিদের বই বেশি পড়েনি ও, মোটে তিনটা পড়েছে কেবল। অফিস থেকে আসার পথে এ পর্যন্ত প্রকাশিত সব বই কিনে নিয়ে এলো ও। ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে ঠিকই পড়ে ফেলল প্রায় সবই। প্রত্যেক বইতেই নিজের ভেতরকার বিষাদ ঢেলেছে আবিদ। কলমের কালিতে যেন উগড়ে দিয়েছে ভেতরের চাপা যন্ত্রণা! প্রতিটা বই পড়েই একটা ভালোলাগার সাথে সাথে সূক্ষ্ম এক বিষাদের রেশ যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেল পুরো হৃদয়ে! যে বইটাই পড়েছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে ফেলেছে পুরোটা। একই সাথে মন ভালো করার এবং খারাপের অপূর্ব মিশেল লেখায়! বিষাদপুত্রের লেখা বলে কথা! দুঃখ, ব্যথা আর বিষাদ না থাকলে তা পরিপূর্ণতা পায় কী করে!
এত সুন্দর করেও বুঝি অনুভূতির প্রগাঢ়তা বোঝানো যায়! শব্দের মাধ্যমে কী যে প্রগাঢ়তা ফুটে উঠেছে তাতে! অন্বেষা আবিদের লেখায় মন্ত্রমুগ্ধ, মোহাবিষ্ট!
পঁচিশ.
ওদিকে পাঁচদিনের মাথায়ও আবিদের সাড়া না পেয়ে অস্থিরতা অনুভব করতে থাকে ও। প্রতীক্ষার প্রহর নিজেকেই কাটাতে হবে, বড্ড বেশিই আঘাত দিয়েছে ও, তাই তার মোচনও ওকেই করতে হবে। মরিয়া হয়ে কাজে নেমে পড়ে অন্বেষা। কল করা শুরু করল, প্রথম দুবার ধরা হলো না, তৃতীয়বার কেটে দিয়েছে ওপাশ থেকে। চতুর্থ বারের সময় রিসিভ হতেই অন্বেষা হন্তদন্ত হয়ে বলা শুরু করল,
“সোহান সাহেব, আপনি আজ আপনার স্যারের সাথে কথা বলিয়ে দেবেন, এক্ষুণি। আর নইলে…”
“নইলে?”
অন্বেষার পৃথিবীটা মুহূর্তের জন্য থমকে গেল, অদ্ভুত এক আড়ষ্টতা পেয়ে বসল ওকে। সাতদিন পর সেই আকাঙ্ক্ষিত স্বর কানে যেতেই ঢিপঢিপ করতে থাকল হৃৎপিণ্ড। অন্বেষার মনে হচ্ছিল ফোনের ওপ্রান্ত থেকে আবিদ ওর হৃদস্পন্দন না শুনে ফেলে! ওর সাতাশ বসন্ত পেরিয়ে আসা জীবনে এরকম কিশোরী সুলভ আড়ষ্টতা পেয়ে বসেনি কখনো, কখনোই না! এটুকু ভীষণ জোড় গলায় বলতে পারে অণ্বেষা।
“কী হলো, এরকম চুপচাপ থাকার জন্য কল দিয়েছ তুমি?”
আবিদের কথায় ঘোর কাটিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে অন্বেষা বলল,
“আমার কিছু কথা ছিল আপনার সাথে, না করবেন না, প্লিজ। ভীষণ জরুরী।”
“আমি তো তোমাকে সব বলেই ফেলেছি, এখন আবার কীসের কথা?” আবিদের নির্লিপ্ত গলা।
“দেখুন, আমি সামনাসামনি বলতে চাই ফোনে এসব বলা ভীষণ অস্বস্তিকর। সেদিন আমি খুব আজেবাজে কথা বলে ফেলেছি…”
অন্বেষার কাতর গলা থেমে যায় আবিদের গুরুগম্ভীর আওয়াজে,
“যা সত্যি তাই বলেছ, এখানে সেটার এক্সপ্লেনেশন দেবার কোনো দরকার নেই।”
“আমি কিচ্ছু সত্যি বলিনি। আমার হুটহাট চিন্তা ভাবনা ছাড়াই কথা বলে ফেলার বদ অভ্যাস আছে। সেটা ধরে বসে থাকবেন না। প্লিজ, একবার দেখা করি, এই হয়তো শেষবার!”
“আচ্ছা, কাল আমি ঢাকার বাইরে থাকব, পরশু বিকেলে ফ্রী থাকলে এসো।”
অন্বেষার কাতর গলা আবিদকে স্পর্শ করল। অপরাধবোধের পীড়ন ওর থেকে বেশি আর কে উপলব্ধি করেছে?
শেষবার শব্দটা বলার সময় অন্বেষার গলা ধরে আসে, ভেতরটা হুহু করে উঠে! এর কারণ কী ও জানে না। কারণ ভাবতে গিয়ে যেন চমকে উঠে থমকে যায় ও। এই অনুভূতির পরিনতি ভাবতেই শিউরে ওঠে ও! এক বিষাদপুত্রের প্রতি জন্ম নেওয়া অনুভূতিটা একেবারেই নতুন ওর জন্য। কিন্তু বিষাদপুত্র তো তার সমস্ত হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রেখেছে প্রায় দেড় দশক আগে অন্য ভুবনে হারিয়ে যাওয়া অতসীর ছবি! অন্বেষার হৃদয়ে একরাশ তীব্র হাহাকার জমা হয়, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে অজান্তেই!
………
বাকিটা পরের পর্বে
#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
ঊনবিংশ পর্ব
ছাব্বিশ.
আজ আবিদের সাথে দেখা করার দিন। খুব সকালে ফুরফুরে মনে ঘুম থেকে উঠল অন্বেষা। রাতে জানালার পর্দা ভালোভাবে টেনে দিতে ভুলে গিয়েছিল, একরাশ সোনালী রোদ ওর মাথার কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। শান্ত, মিষ্টি রোদ! ঘড়ি জানান দিচ্ছে এখন সময়টা সবে ছয়টা আটচল্লিশ, এত সকাল সকাল কখনোই ঘুম ভাঙে না ওর, আজ ব্যত্যয় ঘটল। রোদ মুখে পড়ায় জেগে গেছে। সময়ের ব্যবধানে শুধুমাত্র মানুষই বদলায় না, প্রায় সবই বদলে যায়। এই যেমন সকালের রোদ খুব মিষ্টি মায়ামাখা হয়, রোদের প্রতিটি কণা উপভোগ করতে ইচ্ছে হয়, আবার ক্ষণেক পরেই তা রূপ বদলে কী ভীষণ রুক্ষ! কিছু সময়ের ব্যবধানে শেষ বিকেলেই আবার কী অদ্ভুত মায়াময় স্নিগ্ধতা মাখা লালচে রোদ্দুর! সময় সবকিছুই বদলে দেয়, মানুষের অনুভূতিগুলোই হয়তোবা সবথেকে বেশি বদলায়। কিছুদিন আগে আবিদের প্রতি ধারণা আর সদ্য জন্মানো অনুভূতির কী আকাশ পাতাল ফারাক! আনমনেই মিষ্টি একটা হাসি খেলে গেল মেয়েটার মুখাবয়বে।
এলোমেলো ভাবনা থেকে বেরিয়ে বিছানা ছাড়ল ও, আজ কেমন আলসেমিতে পেয়ে বসেছে ওকে। অফিসে আজ তেমন কাজের চাপ নেই, একদিন ছুটি কাটানোই যায়। ছোটবেলায় স্কুলে যাবার আগেও এরকম আলসেমি চাপত ওর উপরে, স্কুলে না যাবার কতরকম বাহানা খুঁজে নিত তখন! মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, জ্বর, সর্দি আরও কতরকম ছুতো! বাবা ঠিক বুঝে ফেলতেন সেসব, অনেকভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তবেই পাঠানো হত! কখনো বা ওর একরোখা জেদই জিতে যেত। আবারও হাসল ও, আনমনেই। আজ কেমন যেন ভাবালুতা পেয়ে বসেছে ওকে!
এত স্নিগ্ধতায় যে সকালের শুরু, তার স্থায়িত্ব অবশ্য খুব বেশি সময়ের হলো না, ছুটি নেয়া পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল, বিপত্তিটা ঘটল সকালের খাবার শেষে রুমে আসতেই মা’র কল পেয়ে।
“কী ব্যাপার, তোমাকে ফোন দিলে কখনই ধরতে চাও না কেন? সবসময় হাজারটা কল দেবার পর ধর!”
কল ধরতেই এরকম কথা বলায় অন্বেষার মেজাজ গেল বিগড়ে,
“আমি তো আর সারাদিন ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকি না, নানারকম কাজ থাকে। যখন দেখেন ধরছি না, তারমানে আমি নিশ্চয়ই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু তবুও আপনি কন্টিনিউয়াসলি কল করতেই থাকেন। এটা নিশ্চয়ই আমার সমস্যা নয়।” অণ্বেষা রুক্ষ গলায় বলল।
মায়ের গলা কিছুটা মিইয়ে গেল, “আচ্ছা, বাদ দাও। কেমন আছ?”
“আমি ভালোই থাকি। এখন শিখে গেছি ভালো থাকতে! আপনি যে সময় করে আমাকে কল করেছেন এতেই আমি ধন্য হয়ে গেছি।” নির্লিপ্ত গলায় তাচ্ছিল্যের সুর!
“তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? আমি বরাবরই তোমার খোঁজখবর নেই, তুমিই বরং এড়িয়ে চল সবসময়। দেখা করতে চাইলেও কর না…”
এটুকু বলতেই অন্বেষা বলল, “এখন দেখা করে আমি কী করব, যখন আপনাকে আমার প্রয়োজন ছিল তখন তো আপনি ছিলেন না?” গলায় অভিমান ঢেলে অন্বেষার জবাব।
“আমি তোমাকে সাথে করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, তুমিই গোঁ ধরে বসে রইলে বাবার সাথে থাকবে। বাবার জন্যই তোমার আজন্ম টান, চিরকাল আমাকে ভুলই বুঝে গেলে। আমি দূরের মানুষই রইলাম তোমার কাছে!” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক বেয়ে।
“আপনি নিজেই দূরত্বটা তৈরী করেছেন, আমাদের কোনো দায় নেই এখানে। যেটুকু দায় সবটা আপনার! আপনি তো ঠিকই আপনার জীবন সাজিয়ে নিয়েছেন, বাবাতো পারেনি…”
ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল অন্বেষা।
নীরবতা নেমে এল কিছু সময়ের জন্য, সহসা কথা বলতে পারল না কেউ।
সম্পর্ক ভাঙ্গার দায় হয়তো দুজনেরই, তবুও ভুলের পাল্লাটা কারও দিকে বেশিই হেলে যায়। মা হয়তো আর তা নিয়ে কথা বাড়াতে চাইলেন না, তাই অন্য প্রসঙ্গ টানলেন,
“কার দায় কার নয় সেসব থাক, সবকিছুর পরও আমি তোমার মা, জন্ম দিয়েছি তোমাকে। আমারও ইচ্ছে করে তোমার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। তোমাকে একটা ট্যুরের ব্যপারে বলেছিলাম, শুধু তুমি আর আমিই থাকতাম। যাবে আমার সাথে?”
এক অদ্ভুত হাহাকার ফুটে উঠল গলায়। অন্বেষাকে সেটা স্পর্শ করল, কিন্তু অভিমানের পাহাড় যে বড্ড বেশি উঁচু, ডিঙাতে তাই অনেক সময় লাগবে হয়ত! তবে কিছুটা নরম হলো ও,
“দেখি, ডিসিশন চেইঞ্জ করলে আপনাকে জানাব। রাখছি।”
ফোন রেখে কিছুক্ষণ বসে রইল চুপচাপ, সুন্দর সকালটায় সহসা মেঘের ছায়া দেখা দিল। চোখ বন্ধ করতেই টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল।
সাতাশ.
দুপুরের পর থেকেই আবিদের বাসায় যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল অন্বেষা, সকালের মন খারাপ এখন আর নেই। হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত ইচ্ছে হলো। সবসময় তো অফিসের পরেই আবিদের সাথে দেখা হয়েছে, ফরমাল গেটআপেই দেখা গেছে সবসময়। আজ নাহয় কিছুটা ব্যতিক্রমই হোক। মনে হতেই কিছু সালোয়ার কামিজ বের করল, নীল রঙের একটা বেছে নিল। এটা এর আগে যেদিন পরেছিল সেদিন বাবা বলেছিলেন, এটাতে নাকি ওকে ভীষণ মানিয়েছিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছুটা রাঙিয়েও নিল। শেষবার আয়নায় নিজেকে পরখ করে চমকে উঠল অণ্বেষা! ভালোবাসা চিরকাল ওর কাছে গালগপ্পো ছাড়া অন্যকিছু মনে হয়নি, হয়ত বাবা মায়ের ভালোবাসায় বাঁধা সংসার টেকেনি বলেই। নিজের একমাত্র রিলেশনশিপেও কোনো টান অনুভব করেনি বলেই তা ভেস্তে দিয়েছে। তবে আবিদের জন্য এত টান, এত মায়া আর বিশ্বাস কীকরে জন্মাল?
অণ্বেষা নিজের মনেই ভাবল, এত সাজ এত রং কীসের জন্য? বাহ্যিক রূপ তো চোখ ভোলায় শুধু, মন ভরায় না!
ওই বিষাদপুত্রের মনের রাস্তা যে বড্ড পিচ্ছিল, পারবে তো ও ওই মানুষটার হৃদয় প্রাচীর ভেঙ্গে তাতে প্রবেশ করতে? কেঁপে উঠে সমস্ত হৃদয়, প্রথম প্রেমে পড়া কিশোরীর মত থরথরিয়ে কেঁপে উঠল অন্তরাত্মা!
আবিদের বাসায় পৌঁছার পর দেখল সোহান দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজায়, মুখ দেখে মনে হচ্ছে কেউ ওকে এইমাত্র এক গ্লাস চিরতার রস খাইয়ে দিয়েছে। অন্বেষা খেয়াল করে দেখেছে এই লোক কেন যেন ওকে সহ্য করতে পারে না, ওকে দেখলেই ওর মুখ আপনা আপনি তেঁতো হয়ে যায়। কারণটা জানা নেই ওর, হয়ত শুরুর দিকে ওর নাছোড়বান্দা আচরণের কারণে! বিরক্তি চেপে রাখার কোনো চেষ্টাও নেই, যথারীতি আজও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। নিরস গলায় জানাল,
“স্যার ছাদে। আপনি এলে ওখানেই পাঠাতে বলেছে।”
অণ্বেষা ছাদে উঠে আসতেই বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল, হৃদস্পন্দন বাড়ছে আলোর গতিতে! নিজের মনের উপর ওর একবিন্দুও নিয়ন্ত্রন নেই যেন! সহসা মেজাজ গেল চটে, ওর মন আর ওরই কিনা কথা শুনছে না!
ওইতো দেখা যাচ্ছে বিষাদপুত্রকে, বরাবরের মতোই গুরুগম্ভীর! ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাল,
“কেমন আছ, অন্বেষা?”
“ভালো, আপনি?”
জবাবে ম্লান হাসল আবিদ, মুখে কিছু বলল না। নয়দিন পর কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখতে পেল অণ্বেষা, কয়েকদিনের ছটফটানি বিদায় নিল অবশেষে, তবে এর পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে ঢিপঢিপানি!
দুরুদুরু কম্পমান হৃদয়ে অন্বেষা বলল, “আপনাকে ধন্যবাদ, আজকে সময় দিয়েছেন বলে। আসলে আমি সেদিন আপনাকে হার্ট করে কথাগুলো বলতে চাইনি। আমি অনেক সময় কী বলে ফেলি নিজেও জানি না। সত্যি বলতে…”
অণ্বেষাকে থামিয়ে দিয়ে আবিদ বলল, “দেখো, যা হবার সে হয়ে গেছে। তোমাকে এতবার স্যরি বলতে হবে না। তোমার গিলটি ফীল করার কোন কারণ নেই। সত্য সবসময় কঠিন হয়। আমি রিয়্যালিটির সাথে নিজেকে অ্যাডপ্ট করে নিয়েছি!”
“আপনি ভুল বললেন, আপনি কোনোভাবেই অ্যাডপ্ট করতে পারেননি, বরং গা ভাসিয়েছেন স্রোতে। গভীর পানিতে নেমে সাঁতার না কেটে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন, স্রোতের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন নিজের অদৃষ্টকে। এভাবে ডুবে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না। তার থেকে সাঁতরে তীরে উঠার চেষ্টা করুন, দেখবেন জীবন সত্যিই ভীষণ সুন্দর!”
একদমে কথাগুলো বলে থামল অণ্বেষা।
আবিদের চোখে কি কিছুটা মুগ্ধতা খেলে গেল নাকি ওর দেখার ভুল!
চোখে মুখে বিষন্নতা ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি নেই যেন আবিদের! অণ্বেষার মনে হচ্ছিল রূপকথার সেই জীয়ন কাঠি আর মরণ কাঠির মতো বাস্তবে যদি কোন কাঠি থাকত, ‘আনন্দ কাঠি আর দুঃখ কাঠি’ নামে! দুঃখ ভর করলে কাঠির অদলবদলে নিমিষেই পৃথিবীর সকল আনন্দ ধরা দিত হাতের মুঠোয়, দুঃখ বেদনা বলতে তখন যা থাকত তা হত কেবলই বিলাসিতা! তা তো কখনোই সম্ভব নয়, তাই ও নিজেই আবিদেরর জীবনের আনন্দ কাঠি হতে চায়, পরশ পাথর হতে চায়!
“হয়তো তুমি ঠিক, তবে এখন আর তীরে আসার ইচ্ছে নেই। সাঁতার কাটতে ভুলে গেছি কবেই!” অতি সন্তর্পনে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল আবিদ।
“অন্তত হাত পা ছুড়ে চেষ্টা তো করুন, নয়ত বুঝবেন কী করে ভুলেছেন কিনা?”
অণ্বেষা ভাবছে এই লোক হাসতে কেন পারে না? আবারও বলল অণ্বেষা, “জানেন আপনাকে দেখে এখন আমার একটা ছড়া মনে পড়ল!”
আবিদ বিস্ময় চাপতে না পেরে বলল, “মানে কী?”
অন্বেষা ছোট বাচ্চাদের মত মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলতে লাগল, “রামগরুড়ের ছানা
হাসতে তাদের মানা।”
অন্বেষার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল আবিদ, ওর সেই ভুবন ভুলানো হাসি! হাসির শব্দ প্রতিফলিত হচ্ছে যেন পুরো বাড়ি ছাদে, আশেপাশের গাছপালা আর ফুল ফলে! খোলামেলা জায়গা বলে হয়ত দুঃখের বাষ্প বেরিয়ে যাচ্ছে আকাশ পানে, বদ্ধ জায়গায় তা আরও গেঁথে যায় মনে, মস্তিস্কে!
অন্বেষা শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ওর এইসব নিতান্ত ছেলেমানুষী কথায় আবিদ হেসে ফেলবে এটা ওর কল্পনাতেও ছিল না। এতসুন্দর হাসিও বুঝি কোনো ছেলের হয়! এত অদ্ভুদ সুন্দর হাসি যে ছেলের সে নাকি হাসতে ভুলে গেছে! এটা কখনো হয়?
অন্বেষা মনে মনে দোয়া করল, “বিষাদপুত্রের এই হাসি যেন চিরস্থায়ী হয়।”
মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল সেই অপার্থিব হাসি!
…….
বাকিটা পরের পর্বে