তবু সুর ফিরে আসে পর্ব ২৮

0
469

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

২৮ তম পর্ব

নিশাল নিজের রুমে এসে চুপচাপ বসে আছে ! তার খুব কষ্ট হচ্ছে ! সেদিন রাতে বীথির কথা গুলো শুনার পর থেকে সে অসহ্য এক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ! তার জন্য তার খালামনি এত বড় একটা অপরাধ করলো ! একটা অসহায় মেয়েকে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে এলো এটা তো মেরে ফেলার মত অপরাধ ! আবার জুসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে সে জন্য মামনি এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে ! এই কথা সবার সামনে বললে বীথি খালামনির জন্য পুরো নানুবাড়ির লোকজন ছোট হবে ! মাম্মা কে ছোট করা হবে কিন্তু এত বড় কথাটা সে লুকিয়ে রেখেও শান্তি পাচ্ছে না ! কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে ?
ভাইয়া ! তুমি এখানে বসে আছো স্যার খুঁজে তোমারে ! আনারের মা এসে ঢুকলো ! কি হ‌ইছে ভাইয়া ?
কিছু না । মামনি কি করে ?
মেঝ আম্মা আর ছোট আম্মা সঙ্গে গল্প করে !
ঠিক আছে !
তোমার কি হ‌ইছে ভাইয়া ? মনডা খারাপ চ‌ইলা যাইবা দেইখা !
না সে জন্য না । ভালো লাগছে না কিছু ।
আমি তোমারে চিনি না তোমার মনে কেউ কষ্ট দিসে ?
আনারের মা আমি চলে গেলে তোমরা সবাই মামনির খেয়াল রেখো সহজ সরল মানুষ তো বুঝে না কিছু ।
চিন্তা ক‌ইরো না তোমার পাপা আম্মারে কারো সাথে আর যাইতে দিব না । এখন চলো ডিনার করো ।
যাও আমি আসছি !
নিশাল চিন্তা করছে বীথি খালামনি যা করেছে সে তার নানুকে জানাবে ।কালকে ফোন দিবে অস্ট্রেলিয়াতে !

ন‌ওশাদের খুব ইচ্ছে করছে হেরা কে দেখে আসতে কিন্তু নাদিয়া, মিলা এখন বুবু আর যুথীও ওখানে গিয়ে গল্প করছে ওরা কি ভাববে কে জানে ?
তারপরও সে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো ! বুবু নাদিয়া, মিলাকে রান্না বিষয়ে কিছু একটা বলছে !
ওকে দেখে দুই ভাইয়ের ব‌উ একটু নড়েচড়ে বসলো ! হেরার দিকে তাকিয়ে দেখে ও কাত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে !
হেরা তো দেখি ঘুমাচ্ছে !
ভাইয়া মাত্র ই তো তাকিয়ে ছিল , মিলা বলল !
ন‌ওশাদ হেরার কপালে হাত দিতেই দেখে জ্বর বেড়েছে আবার !
মিলা হেরার গায়ে হাত দিয়ে দেখে অনেক জ্বর ! ভাইয়া ঘুমাতে দেন উঠলে ওষুধ খাইয়ে দিয়েন । আমরা ওদিকে যাই । ওরা সবাই উঠে গেল ।
বাবু তুই ওর কাছে থাক , সবাই ঘর খালি করে যাওয়ার দরকার নেই কিছু লাগে যদি ।
ন‌ওশাদ নাদিয়া, মিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাদের সঙ্গে ও কি কোন কথা বলেছে ?
শুধু বলল, ঘর এলিন নাহিন সাজিয়েছে এর বাহিরে আর কোন কথা বলেনি তাই না মিলা ?
আমি ঘটনা জানতে চেয়েছিলাম তখন‌ও চুপ করে ছিল !
ঠিক আছে ।
যুথী ন‌ওশাদের পাশে এসে দাঁড়ালো, আসি দুলাভাই ।
খাওয়া দাওয়া করে যাও ।
পরে একদিন আসব হেরা সুস্থ হোক ।
ঠিক আছে !
ওরা সবাই বের হয়ে গেল । ন‌ওশাদ হেরার গা ঘেঁষে বসলো কপালে হাত দিয়ে দেখলো আবার ! মুখের উপর ঝুঁকে বলল, ঠিক হয়ে যাবে তুমি আমি আছি তো ।
দরজায় নক করার শব্দে তাকালো , ন‌ওশাদ ।
আয় রেজোয়ান ভেতরে আয় ।
হেরার নাকি আবার জ্বর এসেছে ? রেজোয়ান ঘরে ঢুকে বলল!
হুম । ঠান্ডা জ্বর তো এই যায় এই আসে ।
চলে যাচ্ছি আমি একটা কথা বলতে এলাম ।
বস না।
রেজোয়ান সোফায় বসতে বসতে বলল, বীথি কি এসেছিল ?
কোন মুখে আসবে বল ? শোন ঘটনাটা ও ইচ্ছে করে ঘটিয়েছে শুধু হেরার কাছে মোবাইল নেই সেই সুযোগে আর আমার নাম্বারটা হেরা জানে না এটা সে কোন ভাবে আন্দাজ করেছে ! রেজোয়ান এত বছরে মানুষ চিনা হয়ে গেছে আমার । আমি তো নানান ধরনের মানুষ নিয়েই থাকি সারাটা দিন । বীথি অনেক অংকের একবারে সমাধান করতে চেয়েছিল ।
কোন অংক ?
সেই আগের সব , তুই তো জানিস সব কিছু ।
ও তো অনেক পুরোনো ব্যাপার ! ওর বিয়ে হয়েছে, হাসিবের সঙ্গে তো ভালোই আছে !
সমস্যা তো সেটা না ওর সমস্যা হলো হেরা । যেখানে সে থাকতে চেয়েছিল পারেনি তাই আর কাউকে সেখানে সহ্য করতে পারছে না ।
তুই ওর সঙ্গে কথা বল , বীথি যা করেছে এটাতো ক্রিমিনাল অফেন্স হেরার সঙ্গে কত বড় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো !
দোস্ত কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না । কেন জানিস, গীতির জন্য । সবার সামনে গীতির পরিবার কে লজ্জায় ফেলা হবে ! সবচেয়ে বেশি ছোট করা হবে হেরার সামনে ! নিশাল বীথিকে এতটা ভালোবাসে কিভাবে পারি বল বীথির প্রতি কঠিন হতে ?
তুই ভালো মানুষ বলেই কষ্ট বেশি পাস ।
ভালো মানুষের কিছু নেই ।এটা আমার অসহায়ত্ব । গীতি যাওয়ার পর আমি কি বুঝিনি বীথি কি চাইতো ? ওর চোখের ভাষায় সব বোঝা যেত । আর একবার তো সরাসরি কি করলো তুই তো জানিস ই সবকিছু ।
তারপরও তো তুই তোর বাসার রাজত্ব বীথির হাতে দিয়ে রেখেছিলি !
কিছুই করার ছিল না তখন , আমার রাজত্ব তো দেইনি বাসার টা নিয়েই শান্তিতে থাকুক তাই ভেবেছিলাম । আর সব কিছু নিশালের জন্য বাধ্য ছিলাম ! তখনকার ঘটনা সব‌ই মনে আছে আমার ।
ঠিক আছে এখন আর পশ্রয় দিবি না ,এখন তোর রাজত্বের রাণীকে আগে সুস্থ কর তারপর তার হাতে পতাকা তুলে দিয়ে দাসত্ব টা সাদরে গ্রহণ কর এতেই পুরুষ জাতির মঙ্গল বন্ধু ।
তোকে দেখে শিখতে হবে ভাবছি দাসত্ব টা কিভাবে আনন্দের সাথে এনজয় করা যায় !
কি বলে আমি তো এই বিষয়ে সবাই কে বলি আমার গুরু ন‌ওশাদ আজমী ! গীতির একান্ত বাধ্যগত স্বামী ছিলি তুই ।
যাহ্ শালা ভাগ ।
এখন ভাগবো তুমি আগামী কিছুদিন তোমার রাণীর সেবায় নিয়োজিত থাকো অফিস নিয়ে চিন্তা করোনা ।
ঠিক আছে চিন্তা করছি না !
আমি উঠি আমার রাণী আজ মাইগ্রেনের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন !
সুমনা সুস্থ হয়ে উঠলে নিয়ে আসিস । তোরা আসলে ভালো লাগে ।
আজ‌ই আসতো কিন্তু অসুস্থ হয়ে গেল ! হেরা কে দেখার জন্য অস্থির হয়ে ছিল !
আমি জানি মাইগ্রেন কি কষ্টের জিনিস ।
রেজোয়ান কে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো ন‌ওশাদ ।
আনারের মা কে দেখে জিজ্ঞেস করল, নিশাল কোথায় ?
নিজের ঘরে !
আসতে বলো আমার কাছে ।
বলছি , ভাইয়ার মনডা খারাপ স্যার !
কোথায় দেখি, ন‌ওশাদ ছেলের ঘরের দরজায় নক করলো ।
ভেতর থেকে নিশাল বলে উঠলো , পাপা ড্রেস চেঞ্জ করছি ।
ঠিক আছে ড্রেস চেঞ্জ করে আমার কাছে এসো , পাপা অপেক্ষা করছি তোমার জন্য ।
ঠিক আছে ।
ছেলের গলাটা শুনে সত্যিই মনে হচ্ছে সামথিং রং ! ন‌ওশাদ চিন্তিত মনে নিজের ঘরে ঢুকলো ।
হেরা তখন‌ও ঘুমিয়ে আছে ।
পাপা , মামনি এখনো ঘুমাচ্ছে ? নিশাল এসে পাশে দাঁড়ালো।
জ্বর বেড়েছে ঘুমাক, তোমার মন খারাপ মনে হচ্ছে ?
কিছু না পাপা । নিশাল বেডের সাইডে বসলো ।
চলে যাবে দেখে মন খারাপ ?
বাসার পরিস্থিতি এরকম রেখে যেতে ভালো লাগছে না পাপা !
ন‌ওশাদ ছেলের হাত ধরলো, বাবা বাসার পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে ঐ ঘটনা টা ভুলে যাই আমরা আর মামনির জ্বর দুই তিন দিনেই ভালো হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আমরা তোমার নেক্সট পেরেন্টস ডে তে আসব । তোমার মামনি কেও সঙ্গে নিয়ে যাব ! সমস্যা নেই তো ?
সমস্যা কিসের আবার ? সবাই জানে ব্যাপার টা !
তাহলে মন খারাপ করো না ।
পাপা আমার শুধু মনে হচ্ছে যদি মামনি কে খুঁজে পাওয়া না যেত ?
সেরকম কিছু হতো না বাচ্চা পুলিশ খুব তৎপর ছিল ওরা খুব চেষ্টা করছিল !
যাদের বাসায় মামনি আশ্রয় নিয়েছিল ওরা যদি খারাপ লোক হতো‌ ?
হয়েছে বাবা যা হয়নি আমরা যদি , কিন্তু , হয়তো ভেবে খারাপ কিছু চিন্তা করবো না ঠিক আছে !
একটা কথা বলব পাপা , তুমি দেশের বাহিরে গেলে মামনি খালি বাসায় যেন না থাকে তুমি সুমনা আন্টির কাছে রেখে যাবে তবু এখানে রেখে যেও না ।
নিজের বাসায় থাকবে মামনি এতে ভয় কিসের ?
না পাপা প্লিজ ।
আচ্ছা ঠিক আছে ।ন‌ওশাদ ছেলের মাথায় হাত রাখলো ।
নিশালের খুব ভয় হচ্ছে বীথির জন্য।
হেরা চোখ খুলে দেখে নিশাল পাশে বসে আছে , মাথার কাছে ন‌ওশাদ !
নিশাল তোমার মামনির মোবাইল কোথায় ?
দাঁড়াও নিয়ে আসছি আমার রুমে । নিশাল নিজের ঘরের দিকে দৌড় দিল ।
ন‌ওশাদ হেরার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে ছেলে ! আমাকে সাবধান করছে তোমাকে একা রেখে যেন দেশের বাহিরে না যাই ! তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে কেমন হবে হেরা ! ন‌ওশাদ হেরার গালের সঙ্গে গাল ছুঁয়ে দিলো ।তোমার আবার জ্বর এসেছে ! টেনশন হচ্ছে আমার !
নিশাল দরজায় নক করে ঢুকলো । এই যে মামনি র মোবাইল । পছন্দ হয় কিনা দেখো ?
তুমি যখন এনেছো তোমার মামনির পছন্দ হবেই কি হেরা পছন্দ হয়েছে ?
হেরা মাথা ঝাকালো ।
নিশাল একটা ফ্যামিলি ছবি তুলো তো ।
এভাবে মামনি তো রেডি না শুয়ে আছে ?
তোমার মামনি সব সময়ই সুন্দর যেভাবেই তুলবে ছবি ভালো আসবে । দাঁড়াও ওকে ধরে বসাই । হেরা নিজেই উঠে বসলো । ন‌ওশাদ দুই হাতে দুইজনকে কাছে নিয়ে ছবি তুলল ।
সুন্দর এসেছে ছবিটা দেখো পাপা !
হুম অনেক সুন্দর ! নিশাল মন খারাপ করে কলেজে যাবে না । তুমি মন খারাপ করে থাকলে পাপার কষ্ট হয় ! ন‌ওশাদ ছেলের গালে চুমু খেল।
তোমরা দুজন খারাপ থাকলে পাপা কিভাবে ভালো থাকবে বলো ?
নিশাল পাপাকে বলতে পারছে না বীথির কথা । এটা তাকে আরও বেশি অপরাধ বোধে ভুগাচ্ছে ।
পাপা আমি যাই তোমরা রেস্ট নাও । মামনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হ‌ও আমি পরশুদিন চলে যাব তার আগে তোমাকে সুস্থ দেখতে চাই ‌। সাইকেলের একটা রেস হলে ভালো লাগতো কি বলো ?নিশাল হাসছে!
এবার আমিও তোমাদের সঙ্গে রেসে জয়েন করব কিন্তু ।
চিন্তা করে দেখি পাপা তোমাকে নিব কিনা ? কি বলো মামনি ?
হেরা নিশালের গালে হাত ছুঁয়ে দিলো । তুমি জানো মামনি তোমার চোখ দুটো ঠিক আমার মাম্মার মত ! তাই না পাপা ?
হুম ।
মাম্মা র চোখ তোমার মত এতটা গ্রীনিশ গ্রে ছিল না ! কিন্তু তোমার চোখের দিকে তাকালে মাম্মার কথা মনে পড়ে যায় । আমার চোখ পাপার মত হয়েছে মাম্মার মত হলে ভালো হতো তাই না ?
হেরা নিশালের হাত ধরে আছে ।
ন‌ওশাদ চোখ জুড়িয়ে দেখছে ! জীবন এভাবেও তার গতিপথ বদলাবে সে কোনদিন ভাবে নাই । তার একটা মানুষ হবে আবার , নিশাল তাকে এতটা আঁকড়ে ধরবে এটাও কল্পনা করতে পারতো না একটা সময় ! আজ সব তার হাতের নাগালে । জীবনটা আবার সুন্দর সুরে ফিরে আসছে ! নিশাল হেসে হেসে কথা বলছে হেরার সঙ্গে, ন‌ওশাদ উঠে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো ।
একটা সময় এই ঘরটাতে শুধু ফিরতে হবে বলেই ফিরতো । শূন্য ঘরে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করতো না । কোন চুড়ির রুনঝুন শব্দ হতো না , কোন চোখ তাকে দেখার জন্য খুঁজে ফিরতো না , কোন মিষ্টি গলায় স্বর কোথাও শোনা যেত না । কাঁচ ভাঙ্গার মত হাসির আওয়াজ পাওয়া যেত না এই বাড়ির কোথাও ! এক বুক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে রাত গুলো গুমড়ে পার হতো ! আজ রাত টা এগিয়ে আসছে সে জানে কেউ অনেক অনেক রাতের পর এই বুকের ওমে আশ্রয় খুঁজে নিবে । কেউ তার মন তার শরীরের প্রতিটি রোমকূপকে শিহরিত করবে ! পরম নির্ভরতায় আঁকড়ে ধরবে ! এই রাত পার হয়ে যাবে কারো হৃদস্পন্দন শুনে !
ন‌ওশাদ দূর থেকে তাকিয়ে দেখছে নিশাল কতটা সহজ হয়ে হেসে হেসে তার মা মনি কে নতুন মোবাইলের ফাংশন গুলো শিখিয়ে দিচ্ছে ! জীবনটা বুঝি এতটা ছন্দময় হ‌ওয়ার অপেক্ষায় ছিল ? আমি কি কোন মধুর স্বপ্ন দেখছি ? হঠাৎ ভোরের আলোর সঙ্গে সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাবে না তো ? ন‌ওশাদের বুকের ভেতরে ভালোলাগা , আনন্দ, ভয় সব মিলিয়ে এক অন্য রকম সুরের শব্দ বাজচ্ছে আজ !
পাপা ! এই পাপা !
নিশালের ডাকে ফিরে তাকায় সে !
তুমি ওখানে কি করছো ? দেখো মামনি কে আমি গেমস ডাউনলোড করে দিয়েছি । ভালো সময় কাটবে মামনির ।
ন‌ওশাদ ছেলের পাশে এসে দাঁড়ালো । নিশাল খাটে উঠে হেরার পাশে আধা শোয়া হয়ে শুয়ে মোবাইলে কি দেখাচ্ছে । গীতি যাওয়ার পর নিশাল এই ঘরের বেডে কি এভাবে বসেছিল কখনো ? ন‌ওশাদ মনে করতে পারছে না ! একটা সময় গীতি আর ওর মাঝে নিশাল থাকতে এলে ন‌ওশাদ করুন চোখে তাকাতো গীতির দিকে । কারণ গীতির গা ঘেঁষে ছাড়া ন‌ওশাদ ঘুমাতেই পারতো না ! ছেলে বায়না করতো পাপা , মাম্মার মাঝখানে ঘুমাবে অগত্যা ন‌ওশাদকে তার জায়গা ছেড়ে দিতে হতো ! গীতিও চলে গেছে সঙ্গে নিয়ে গেছে সেই সব অভ্যাস । আজ নিশাল ষোল বছরের কিশোর এখন পাপা একটু আদর দিলেই তার লজ্জা করে । সময় কত দ্রুত পাল্টে যায় !
ন‌ওশাদ ছেলের পাশে এসে বসলো । ডিনার করেছো নিশাল ?
হ্যাঁ চাচীদের সঙ্গে করেছি । তুমি তো খেলে না পাপা ?
আমি আর মামনি সন্ধ্যায় খেলাম এখন আর আমার খেতে ইচ্ছে করছে না । হেরার নতুন মোবাইলে গেমস খেলায় মগ্ন নিশাল । ছেলের মন ভালো হয়েছে দেখে ন‌ওশাদের ভালো লাগছে ! মামনি তোমার মোবাইল টা আমি নিয়ে গেলাম আমি এই গেমসটা খেলব । নিশাল উঠে গেল ।
বেশি রাত জেগো না বাবা।
আজকে এবং কালকে জেগে থাকি পাপা তারপর তো আবার সেই রুটিনের জীবন ।
ঠিক আছে যাও ।
মামনি কালকে কিন্তু তুমি ফিট হয়ে যাবে প্রথম দিনের মত একসঙ্গে ডাইনিং এ বসে খাব আমরা কেমন ।
হেরা ঘাড় কাত করলো ।
গুড নাইট পাপা বলে নিশাল রুম থেকে বের হয়ে গেল ।

ন‌ওশাদ হেরার পাশে শুয়ে আছে। আমার দিকে তাকাও হেরা ।তুমি নিশালের সঙ্গে কথা বলছো , নাদিয়া, মিলার সঙ্গে বলেছো শুনলাম কিন্তু আমার সঙ্গে কথা বলছো না কেন ? ন‌ওশাদ হেরার গালে হাত রাখলো । তুমি কথা বলছো না আমার খারাপ লাগছে ! কি হয়েছে হেরা ?
আমার ভালো লাগছে না কিছু ।
কি ভালো লাগছে না ?
আমার সঙ্গে কেন এমন হয় , কি সমস্যা আমার?
তোমার কিসের সমস্যা , ন‌ওশাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ?
আমার সঙ্গেই কেন এমন হয় বারবার , আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম হেরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ! বারবার মনে হচ্ছিল আমি আর কখনো আপনার কাছে আসতে পারবো না ! এই শহরে আমি হারিয়ে গেছি ! আমার ঘরে , আপনার কাছে আসা হবে না আপনাকে দেখা হবে না ! আমি একবার ভেবেছিলাম এমন কিছু হলে এবার সত্যি সত্যি একটা ট্রাকের নিচে ঝাঁপ দিব !
ন‌ওশাল হেরা কে বুকে টেনে নিলো ! সেরকম কিছুই ঘটতে দিতাম নাকি আমি ! আমি এই শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজে তোমাকে আমার বুকে নিয়ে আসতাম ।
ঐ মহিলা আমাকে তার বাসায় নিয়ে না গেলে আমি ভয়ে রাস্তায় বেহুঁশ হয়ে পরে থাকতাম ! এত বড় শহর লাখ লাখ মানুষ আমি কাউকে চিনি না , কোন পথ চিনি না যে পথটা আমাকে আপনার কাছে নিয়ে আসবে আমি অসহায়ের মত ছুটে যাচ্ছি আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে , দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল ! একটা কথাই মনে হচ্ছিল আমি আপনাকে আর দেখতে পাবো না ! আমি মরে যেতাম আপনাকে খুঁজে না পেলে !
কিছু হতো না তোমার । একদম চুপ আর বলতে হবে না । হেরা ন‌ওশাদের বুকে জড়িয়ে কাঁদছে !
প্লিজ কান্নাকাটি বন্ধ করো হেরা ! এখন থেকে আর কান্নাকাটি হবে না । ন‌ওশাদ হেরার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো ।
আমাকে বীথি আপু যেখান দাঁড় করিয়ে রেখে গেছে আমি সেখানেই ছিলাম । একটা ঘন্টা আমি সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলাম কিন্তু উনি আসেননি ! আমি উনাকে কোথাও পেলাম না ! আমি একবার ভেবেছিলাম আমি গেটে দাঁড়িয়ে থাকি আপনি তো আমাকে খুঁজতে আসবেন‌ই ! কিন্তু ওখানে কিছু ছেলে কিভাবে তাকিয়ে ছিল ভয়ে আমি রাস্তা পার হয়ে গেছি ! আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না কোথায় যাচ্ছি । এত গাড়ি মনে হচ্ছিল ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে আমাকে । ভাবছিলাম হয়তো মরেই যাবো ! হেরা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে।
চুপ হেরা চুপ একদম চুপ ন‌ওশাদ ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো ! হেরার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে ! প্লিজ ভুলে যাও ঘটনাটা !
খারাপ ঘটনা যত বেশি মনে করবে তত বেশি কষ্ট পাবে তুমি ! তারচেয়ে আমরা ভুলে যাই ওসব !
নিশাল তোমাকে মামনি ডাকছে তোমার কেমন লেগেছে ?
হেরা চোখ মুছতে মুছতে হেসে দিল ! ভালো লাগছে ! সত্যি নিজেকে মা মা লাগছে বলেই লজ্জা পেলো !
তাই ?
হুম !
আমার এত ভালো লাগছে শুনে কি বলবো তোমাকে ! তোমার পাশে শুয়ে গেমস খেলছিল যখন আমার ইচ্ছে করছিল ওর পাশে আমিও শুয়ে পড়ি ! ছবিটা আগের মত হোক । গীতি যখন ছিল নিশালকে ব‌ই পড়ে শোনাতো শুয়ে শুয়ে। আমিও ওদের পাশে শুয়ে শুনতাম গল্প ! আজ মনে হচ্ছিল আগের মত ছবিটা তৈরি হচ্ছে !
জানো হেরা এই যে তোমাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আছি কি যে ভালো লাগছে ! একা না হলে কখনো বুঝতাম‌ই না সঙ্গী কি জিনিস ! প্রতিটা মানুষের একটা মানুষ লাগে হাত ধরে থাকার জন্য , নিজের বলে ডাকার জন্য, ভালোবাসার জন্য, রাগ-অভিমানের জন্যেও ! আমি যখন গাজীপুরে আমার সিরামিকস ফ্যাক্টরি তে যাই । আসার সময় প্রায় দিনই জ্যামে বসে রাস্তার পাশে একটা কাপল কে দেখি ভিক্ষুক কিংবা রিক্সা চালায় হয়তো । কখনো হাজব্যান্ড ওয়াইফ গল্প করছে , কিংবা বসে হাসছে একদিন দেখি হাজব্যান্ড টা ওয়াইফের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে ! এত ভালো লাগে ওদের দুজনকে দেখে ! ওদের দেখলে আমার মনে হতো দামি গাড়িতে বসেও আমি শুন্য , আমি নিঃস্ব ! আমার‌ও একসময় এরকম একটা ছবি ছিল সেই ছবিটা ভেঙে গেছে !
হেরা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ন‌ওশাদ কে । আজ তোমাকে, নিশালকে দেখে আমার আর নিজেকে শূন্য মনে হয় নাই ! এখন মনে হচ্ছে ছবিটা আবার তৈরি হচ্ছে ! প্রকৃতি আমাকে আবার কেড়ে নেয়া সব ফিরিয়ে দিচ্ছে হেরা !
তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। এত গুলো বছর নিজের কথা গুলো বলার একটা মানুষ ছিল না ! রাতের বেলা অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম ঘরের নির্জনতা টা আমাকে খুব কষ্ট দিতো ! শূন্য ঘরে ফেরার মত কষ্টের আর কিছু নেই !
হেরা ন‌ওশাদের ঠোঁট দুটো হাত দিয়ে ছুয়ে দিলো চোখের পানি মুছিয়ে দিলো !
তোমার গায়ে তো আবার জ্বর বাড়ছে হেরা ! সারা শরীর থেকে আগুন বের হচ্ছে !
চিন্তা করবেন না ঠিক হয়ে যাবে ।
ন‌ওশাদ উঠে হেরার ওষুধ গুলো খাইয়ে দিল । তুমি ঘুমাও আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই ।
না আপনি ঘুমান । আপনাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে আপনি অনেক ক্লান্ত !
আমার ক্লান্তি অনেক কমে গেছে । শারীরিক ক্লান্তি মন ভালো থাকলে এমনিতেই দূর হয়ে যায় । তোমাকে,নিশাল কে দেখে আমার সব ক্লান্তি কমে গেছে! বিশ্বাস করবে না হেরা নিজেকে আজ কতটা সুখী মনে হচ্ছে !
কিন্তু আমার জন্য আপনি কত মানসিক টেনশনে ছিলেন !
তুমি প্লিজ একথা বলে আমাকে লজ্জা দিও না যা একটা ঘটনা ঘটলো সব আমার বেখেয়ালি হ‌ওয়ার জন্য !
কথা বলতে বলতে ই হেরা একটু পর ঘুমিয়ে গেল । জ্বর ওষুধ খাওয়ার পর‌ও কমেনি !
ন‌ওশাদ হেরাকে বুকের কাছে নিয়ে জেগে আছে। তার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না মনে হচ্ছে ঘুমালে এই সময় টা আর সে অনুভব করতে পারবে না !
বেড সাইড ড্রয়ার খুলে গীতির ছবি টা বের করলো । আগের মতই মনে মনে গীতির ছবির সঙ্গে কথা বলছে ন‌ওশাদ,
গীতি মেয়ে টাকে বুকে না টেনে পারলাম না আমি । আমি এগিয়ে যাচ্ছি গীতি। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার চেয়েও বেশি এগিয়ে গেছে নিশাল ও হেরাকে মামনি ডাকে ! আমি জানি আমাকে ভালোবাসে বলেই ডেকেছে ! ছেলেটা এত নরম মনের হয়েছে বুঝতেই পারিনি কখনো ! তুমি দেখলে বীথি কি করলো ! বীথি বারবার তোমাকে লজ্জায় ফেলে দেয় আর শুধু তোমার জন্য আমি ওকে বারবার এড়িয়ে যাই ! গীতি আমার রাতটা এখন আর দীর্ঘ শ্বাস ভরা নেই ,কেউ একজন নিঃশ্বাস ফেলছে আমার বুকের উপর ! আমিও তাকে টেনে নিচ্ছি নিজের দিকে তুমি কষ্ট পাচ্ছো কিনা জানিনা ! কিন্তু আমার ভেতরে কেন এত দ্বিধাবোধ ? মনে হচ্ছে তুমি কষ্ট পাচ্ছো ! মনে হচ্ছে তুমি বলছো আরও একটু সময় নাও ন‌ওশাদ !

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here