তবু সুর ফিরে আসে পর্ব ২০

0
471

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

২০তম পর্ব

( ১ম খন্ড)

হেরা এলিন আর নাহিনের সঙ্গে রেজোয়ানের পাঠানো ছবি গুলো দেখছে ! ওরা ছবি দেখে হেরা কে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছে! সব ছবি নিয়ে হুড়োহুড়ি করছে ! হেরা ওর সঙ্গে ওখানে কি ঘটনা হয়েছে সব বলল,
বৌমনি বুঝলে ভাইয়া তোমাকে ঠিক ই অনেক ভালোবাসে তাই ঐ চোর কে আচ্ছা সাইজ দিয়েছে পুলিশ কে দিয়ে !
হেরা বলল, তোমাকে বলেছে এলিন তাই না ?
বোঝাই তো যাচ্ছে !
আমার মনে হয় যে কারো সঙ্গে এই ঘটনা ঘটলে উনি এই কাজ করতেন !
সে তুমি যাই বলো আমার ধারণা ভুল না দেখে নিও !
তাহলে তো হানিমুন টা খারাপ হয়নি তোমার বৌমনি !
নাহিন তোমরা দুই বোন উনার সামনে আমাকে লজ্জা দিয়েই ছাড়বে ! ভুলেও এই কথা এই ঘরের বাহিরে বলো না প্লিজ ! বাসায় নিশাল আছে আর আগামীকাল উনার বড় বোন আসছে তোমাদের এসব দুষ্টামি কথা উনারা শুনলে কি ভাববে ?
দুই বোন হেসে গড়িয়ে পড়ছে !
দরজার ওপাশে নিশাল দাঁড়িয়ে আছে ! ভেতরের হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে ! ওর মনে হচ্ছে ,অনেক দিন পর এভাবে এই বাসায় কেউ হাসাহাসি আনন্দ করছে ! মাম্মা যখন ছিল খালামনি রা আসলে, চাচীরা আসলে এভাবে হাসাহাসি গল্প করতো !
তারপর তো সব নিরব হয়ে গেল ! যার যার ঘরে সবাই একা হয়ে রয়ে গেল ! দীর্ঘ শ্বাস ফেলল নিশাল।
নিশাল দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে নক করতে লজ্জা লাগছে তার !
আনারের মা এসে ওর পাশে দাঁড়ালো হঠাৎ!
কিছু লাগব ভাইয়া ?
তুমি আন্টি কে বলো পাপার ঘরে যেতে !
নতুন আম্মা রে ?
হ্যাঁ!
নিশাল নিজের ঘরে চলে গেল !

আনারের মা হেরার ঘরে ঢুকতেই এলিন নাহিন আনারের মা কে উদ্দেশ্য করে বলল, ছবি দেখবে আনারের মা ?
কি ছবি আফা ?
নায়ক নায়িকার ছবি !
হেরা চিৎকার করে উঠল, ভালো হবে না কিন্তু নাহিন ! প্লিজ ছবি গুলো দাও !
আনারের মা উৎসুক হয়ে উঠলো ,আফা দেখি কিসের ছবি ?
নাহিন আনারের মা কে হেরা আর ন‌ওশাদের ছবি গুলো দেখালো ! আনারের মা ছবি দেখে হাসছে ! আম্মা ছবি খুব সুন্দর আসছে !
আম্মা ভাইয়া বলল, স্যারের ঘরে যাইতে আপনারে ! স্যার মনে হয় ডাকে!
হেরা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলো ! আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ! আয়নায় একটা টিপ লাগানো ছিল সেটা নিয়ে কপালে লাগালো ! তারপর ছবি গুলো ওদের কাছ থেকে টেনে নিয়ে নিল !
এগুলো নিয়ে যাচ্ছো কেন ভালো করে দেখিনি তো বৌমনি ?
আর দেখতে হবে না দাও উনি দেখতে চেয়েছেন ! তোমরা পরে দেখো আবার !
হেরা ছবি গুলো নিয়ে দৌড় দিল ন‌ওশাদের ঘরের দিকে !
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কপালের টিপ টা একটু বাঁকা করে নিলো !
দুইবার নক করতেই ভেতর থেকে ন‌ওশাদ বলল,
এসো হেরা!
হেরা ঘরে ঢুকে অবাক হলো ঘর পুরো অন্ধকার করে বিছানায় কমফোর্টার গায়ে মুড়িয়ে শুয়ে আছে ন‌ওশাদ !
একি আলো নেভানো কেন ?
আলো দিও না মাথা ব্যথা করছে ! আলো অসহ্য লাগছে আমার !
শরীর বেশি খারাপ লাগছে কি ? মাথায় হাত বুলিয়ে দেই ?
অস্থির হতে হবে না, তেমন কিছু না হেরা !
আমি কি চলে যাব ? হেরা পাশে দাঁড়িয়ে আছে ‌!
না থাকো তুমি !
হেরা ন‌ওশাদের পায়ের কাছে বসলো !
দূরে কেন এখানে কাছে এসে বসো !
সে ন‌ওশাদের মাথার কাছে বসলো একদম ন‌ওশাদের ঘা ঘেষে বসতে হলো ওকে । অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখছে না !
আপনার কি মন খারাপ খুব ?
না !
আমার মনে হচ্ছে মন খুব খারাপ আপনার ! নিশাল নিশ্চয়ই আমাদের বিয়েটা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে তাই না ? হেরা গলা নামিয়ে বলল !
ন‌ওশাদ হেরার হাত টা ধরলো ! হেরার সেই কেমন কেমন লাগা টা শুরু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে !
হেরা আমি বুঝতে পারছি না আমার কেমন লাগছে , ভালো লাগছে আবার একটা চাপা কষ্ট‌ও আছে বুকে ।
তারমানে শরীর খারাপ লাগছে !
না !
হেরা ন‌ওশাদের কপালে হাত রাখলো ! এতটা সাহসী সে এই প্রথম হলো ! কখনও কখনও খুব সাহসী হয়ে মানুষটার বুকের পাঁজরের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করে ! কিন্তু জীবনে কখনো সে এতটা সাহসী হতে পারবে না ! মানুষ টা যদি কখনোই তাকে কাছে না ও টানে তাকে দূরে সরেই থাকতে হবে আজীবন !
হেরা বলল,খারাপ কেন লাগছে ?
জানি না হেরা !
আচ্ছা শুনি তাহলে ভালো লাগছে কেন ?
আমার ছেলেটা বড় হয়ে গেছে হেরা ! ছোট্ট বাচ্চা টা আমার এত কম বয়সে এত বুঝদার হয়ে গেছে আমি বুঝতেই পারিনি ! তুমি জানো ও আমাকে অনেক ভালোবাসে ! ওর মাম্মার চেয়েও বেশি আমাকে ভালোবাসে ! ন‌ওশাদের চোখে পানি পড়ছে ! হেরা হাত দিয়ে চোখ মুছে দিলো !
ও আমার একাকীত্ব টা নিয়ে এত ভাবতো আমি জানতাম ই না ! আমাকে কি বলল জানো , আন্টির তো কম বয়স অনেক দিন তোমার খেয়াল রাখতে পারবে !
ও তোমাকে পছন্দ করেছে হেরা !
হেরার চোখ দিয়েও পানি পড়ছে !
গীতির জন্যেও আমার বুকে কেন আজ এত কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি না ! এত কষ্ট তো অনেক দিন হয় না !
আপনি উনাকে অনেক ভালোবাসেন তাই কষ্ট হচ্ছে !
আমি সত্যিই গীতিকে অনেক ভালোবাসি !
হেরা কি বলবে বুঝতে পারছে না ! তার এত মায়া লাগছে মানুষটাকে দেখে !
হেরা তোমার আমার বয়সের ব্যবধান কত বছরের জানো ?
জ্বি চব্বিশ বছর !
চব্বিশ বছরের ব্যবধান তো অনেক ! তারপরও একটা কাজ কি তুমি পারবে করতে !
হেরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কি ?
আমাকে শাসন করতে পারবে ? অনেক দিন কেউ আমাকে আদরে, শাসনে রাখে না ।
একা জীবনটা টানতে টানতে আমি ক্লান্ত হেরা ! আমার বুকের ভেতরটাতে শুধু ফাঁকা হয়ে আছে তুমি এভাবে হাত রেখে সব ফাঁকা জায়গা গুলো ভরে দিতে পারবে না ?
খুব ক্ষীণ গলায় হেরা বলল, পারব !
ন‌ওশাদের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে অঝোরে !
নিশাল আরো কি বলল জানো, আজ আর বাসাটা খালি লাগেনি তার কাছে ! তুমি এই বাসাটা কে তোমার মত সাজিয়ে দাও হেরা !
হেরা ন‌ওশাদের সব কথার মানে যদিও বুঝতে পারছে না কিন্তু তার খুব ভালো লাগছে ন‌ওশাদ তাকে কাছে টানতে চাইছে এটা সে বুঝতে পারছে !
আপনি এভাবে মন খারাপ করে থাকলে আমার কষ্ট লাগে ভয় হচ্ছে !
ভয় হচ্ছে কেন ?
জানি না আমার আপনাকে দেখলে মনে হয় আপনার অনেক ক্ষমতা , ক্ষমতা বান মানুষ কখনও অসহায়ের মত কষ্ট পাচ্ছে দেখতে খারাপ লাগে!
ন‌ওশাদ হেসে দিল ! বোকা মেয়ে আমার কোন ক্ষমতা নেই ! আমিও কখনো কখনো খুব অসহায় !
এখন উঠেন তো ! শরীর খারাপ না হলে এভাবে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকার কোন দরকার নেই !
কি করতে হবে ?
উঠে বসতে হবে !
থাকি না এভাবে তুমি পাশে বসে থাকো আরেকটু ! আচ্ছা কি পারফিউম লাগিয়েছো হেরা এত নেশা নেশা ঘ্রাণ কেন ?
আপনি যা দিয়েছেন তাই লাগিয়েছি !
ভুলে গেছি আমি ! চোর তো চলে আসবে ঘ্রাণের টানে কক্সবাজারে র ঘটনার মত !
আপনি আছেন তো আমার সঙ্গে চোর কে শিক্ষা দেয়ার জন্য !
ন‌ওশাদ হাসছে !
আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম !
কেন ?
আপনার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না আর আমার দম বন্ধ লাগছে অন্ধকারে !
তাহলে জ্বালাও !
হেরা বেড সাইড ল্যাম্প টা জ্বালালো !
এই তোমার কপালের টিপ বাঁকা কেন , কাছে এসো ঠিক করে দেই !
হেরা ন‌ওশাদের মুখের উপর ঝুঁকে আসলো ! ন‌ওশাদ টিপ ঠিক করে দিল ! ন‌ওশাদ কে অবাক করে দিয়ে হেরা টিপটা তুলে নিয়ে আবার বাঁকা করে দিল ! দিন আবার ঠিক করে দিন !
ও রে মেয়ে তো দেখি অনেক দুষ্ট আমাকে দিয়ে বারবার টিপ ঠিক করানো হচ্ছে !
হুম !
ন‌ওশাদ হেরার টিপ আবার ঠিক করে দিল ! এখন উঠেন !
উঠে কি করব ?
নিশালের কাছে যাবেন !
নিশালের কাছে ?
হুম ওর রুমে গিয়ে ওর পাশে একটু বসে থাকেন ওর খুব ভালো লাগবে !
সত্যি বলছো তুমি ?
আমার মন বলছে ও চায় আপনি ওকে কাছে টানুন !
ন‌ওশাদ উঠে বসলো । আচ্ছা যাব !
এখুনি যাবেন উঠেন প্লিজ !
হেরা ন‌ওশাদের হাত টেনে ধরলো !
একটা জিনিস শুনাতে চাই যাওয়ার আগে তোমাকে ।
কি ?
হেরার হাত দুটো ধরেই ন‌ওশাদ নিজ থেকেই আবৃত্তি করে উঠলো,
“কতবার যে আমি তোমাকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ শুনে
জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম আমার কর্ণ যুগল।
তুমি এসে আমাকে বলবে,
এই ওঠো।”
হেরা তাকিয়ে আছে !
কি দেখো হেরা ?
কেন মেয়েরা পাগল হতো আপনার জন্য বুঝতে পারছি।
হা হা তোমার মাথায় কবিতা শুনে প্রথম এই কথাটা এসেছে ? সত্যিই তুমি অদ্ভুত হেরা !
কি আসার কথা ছিল ?
কিছু না !
এখন যান তাহলে নিশালের কাছে !
আনারের মা দরজার বাহির থেকে হেরাকে ডাকছে ,
এসো ভেতরে !
আম্মা তিন তলায় ফুফুআম্মার রুম রেডি করছি !
ঠিক আছে তোমার ভাইয়া কোথায় ?
শোয়েব ভাইয়ের ঘরে গল্প করে !
আচ্ছা যাও !
আনারের মা বের হয়ে যেতেই ন‌ওশাদ বলল, শোয়েবের সঙ্গে গল্প করছে করুক আমি পরে ওর সঙ্গে কথা বলব ! এখন তুমি বসো এখানে, যে‌ও না হেরা !
যাচ্ছি না কিন্তু আপনি বলেন , কবিতা শুনে আমার কি বলা উচিত ছিল ?
ন‌ওশাদ আবার হাসলো ! শুনতে চাও ?
হুম।
তোমার বলা উচিত ছিল এটা আমার মনের কথা কিনা ? হেরার নাক টিপে দিল ন‌ওশাদ।
ও আচ্ছা !
আমি তো জানি এটা আপনার মনের কথা না ! হেরা মাথা নিচু করে ফেলল !
এখন বলব না এটা আমার মনের কথা কিনা, তার আগে একটা গল্প শোনাই তোমাকে ! আমার আর গীতির গল্প ! শুনবে ?
অবশ্যই ! হেরা উৎসুক হয়ে তাকালো।
ঠিক আছে আরাম করে বসো তুমি !
বসেছি!
ন‌ওশাদ বেডে হেলান দিয়া বসলো ! হেরাও ওর দিকে ফিরে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে! তখন আমি ফাইনাল ইয়ারে পড়ি।
গীতি কে বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল। ওর খালাতো ভাই লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকে ওর সঙ্গে বিয়ে মোটামুটি কর্নফাম হয়ে গেল ! একদিন গীতি পালিয়ে আমার কাছে চলে এলো ! সে আর বাসায় ফিরে যাবে না। কি আর করা ওকে তো ফিরিয়ে দিতে পারবো না বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেললাম ! বিয়ে তো করে ফেললাম, এখন গীতিকে রাখবো কোথায় ? আমি থাকি হলে , আব্বা আম্মা র বাসায় নিয়ে আসব সেই সাহস নেই । অনেক ভেবে বুবুর বাসায় নিয়ে গেলাম। যত কিছুই বলুক বুবু ফেলে দিতে পারবে না গীতিকে ! সন্ধ্যার পর বুবুর বাসায় গিয়ে হাজির হলাম নতুন ব‌উ নিয়ে ! বুবু গীতিকে নিয়ে ঘরে ঢুকালো আমাকে নিজের রুমে নিয়ে অনেক বকাঝকা করলো কিন্তু গীতিকে বুকে টেনে নিল ঠিকই ! সেই রাতে গীতিকে রেখে চলে আসতে হলো হলে কারণ পরদিন সকালে আমার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু ! বাসর রাত দুজন দুই জায়গায় ! কিছুই করার নেই ! পরীক্ষার জন্য যেতে পারি না বুবুর বাসায় ! শুধু হলের কার্ড ফোন থেকে রাতে একবার ফোন দেই বুবুর বাসার ল্যান্ড ফোনে। দুই চার মিনিট কথা বলে ফোন রেখে দেই । গীতি খারাপ ছিল না ওখানে বুবু খুব আদর যত্ন করতো ! বুবুর দেবর আহসান ভাইয়ের নতুন ব‌উ বুবুর সঙ্গে থাকতো । আহসান ভাই বিয়ে করে নতুন ব‌উ রেখে ফ্লোরিডা তে চলে গেছে । রাতে গীতি আর রোমানা ভাবি থাকতো এক সঙ্গে !
পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি প্রায় দিনই সন্ধ্যায় বুবুর বাসায় যাই কিন্তু থাকা হয় না ! কারণ কেউ আমাকে থাকতে বলে না ! আগে বুবুর বাসায় গেলে বুবু, দুলাভাই রাতে থেকে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতো কিন্তু বিয়ের পর কেউ কিছু বলে না ! কি আর করা যত রাতই হোক আমি গীতির দিকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তাকিয়ে চলে আসি আমার হলে ! আমার তখন দিন কাটে তো রাত কাটেনা অবস্থা ! সারাক্ষণ গীতিকে কাছে পেতে ইচ্ছে করতো।
গীতি ইডেন কলেজে পড়তো ! কলেজ থেকে ফেরার সময় আমি রিক্সা করে ওকে দিয়ে আসতাম বুবুর বাসায় । বাসার সামনে থেকে দিয়েই চলে আসতাম । রিক্সার হুড তুলে ওর কাছ ঘেষে বসতেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতো। রেগে গিয়ে বলতো, লজ্জা করে না নিজের বিয়ে করা ব‌উ কে নিয়ে রিক্সায় হুড তুলতে ?
কেন রিক্সায় ব‌উ নিয়ে হুড তোলা যায় না ? হেরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো !
ন‌ওশাদ হেরার প্রশ্ন শুনে হতাশ চোখে তাকালো ! দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল গল্প শোনো হেরা, তারপর রিক্সায় হুড কেন ছেলেরা তোলে তার শানে নজুল আলোচনা করব তোমার সঙ্গে! ন‌ওশাদ হেরার কথায় হাসলো।
এভাবে প্রায় চার মাস পার হলো ! একদিন সন্ধ্যায় বুবুর বাসায় গিয়েছি একটু পর শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি ! সে রকম আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি । থামার কোন লক্ষণ নেই। রাত প্রায় এগারোটা আমি মনে মনে বলছি আল্লাহ এত বৃষ্টি দাও, এত বৃষ্টি দাও যেন ঢাকা শহর ডুবে যায় ! আজ যেন বুবু বলে, যেতে হবে না বাবু থেকে যা রাতে !
কিন্তু বুবুর কিছু বলার কোন লক্ষণ ই নেই ! রাতের খাবার শেষ করে বুবু বসে বসে পরদিন কাচ্চি বিরিয়ানী রান্না করবে সেই মসল্লা বানাচ্ছে । গীতি কে শিখাচ্ছে কিভাবে কি করতে হয় !
হঠাৎ বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হলো প্রচন্ড ঝড় ! ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল ! একটু পর আহসান ভাইয়ের বউ বুবুর কাছে ছুটে গেল রান্না ঘরে! গীতিকে গিয়ে বলল, তুমি একটু ও ঘরে যাও গীতি বড় ভাবির সঙ্গে জরুরি কথা আছে আমার। গীতি উঠে চলে এলো আমার কাছে আমি দুলাভাইয়ের সঙ্গে বসে গল্প করছি তখন !
রোমানা ভাবি বুবুর হাত চেপে ধরলো ! বুবু তো অবাক ,কি হয়েছে রোমানা?
বলতেই ভাবি বুবুকে বলল, ভাবি আজ রাতে ন‌ওশাদ ভাইকে চলে যেতে দিবেন না প্লিজ!
মানে ?
এই ঝড়ের রাতে উনি যেন হলে না যায় ভাবি, চার মাস হয়ে গেছে ওদের দিকে আপনি একটু খেয়াল করেন প্লিজ! আপনার পায়ে পড়ি।
বুবু কঠিন গলায় বলল, রোমানা তোমাকে কি উকিল ধরেছে বাবু ?
আল্লাহর কসম আমাকে কেউ কিছু বলেনি ! গীতির জন্য আমার খুব কষ্ট হয় ভাবি ! আপনার দেবর তো বিদেশে থাকে, কিন্তু ন‌ওশাদ ভাই তো গীতির চোখের সামনে ওর কত কষ্ট হয় আমি বুঝি ভাবি ! তাই বলছি ন‌ওশাদ ভাই কে রাতটা থেকে যেতে বলেন ভাবি , প্লিজ।
তোমরা কি আমাকে পাষন্ড ভাবো নাকি ? এই ঝড়ের রাতে আমার ভাইকে চলে যেতে দিতাম আমি ? কোথায় সেই বেয়াদব গিয়ে বলো আজ যাওয়ার কথা ভাবলো কিভাবে সে ?
রান্না ঘরে ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছে তখন‌ও আমি জানতাম না ! হঠাৎ দেখি রোমানা ভাবি আমাদের সামনে থেকে গীতিকে ডেকে নিয়ে গেল ! তার কিছুক্ষণ পর আমার কাছে বাসার কাজের মেয়ে টা এসে বলল, আমাকে গীতি ওদের ঘরে ডাকে ! কি কথা বলবে শোনার জন্য উঠে গেলাম। গিয়ে দেখি ঐ রুমে কেউ নেই। বসে রইলাম অন্ধকার ঘরে , অপেক্ষা করতে লাগলাম গীতির জন্য । একটুপর একটা ছোট মোমবাতি হাতে নিয়ে গায়ে কাতান শাড়ি , হাতে কাঁচের চুড়ি, সামান্য কিছু গয়না পড়ে ব‌উ এর সাজে গীতি এসে রুমে ঢুকল সঙ্গে রোমানা ভাবি !
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম ! কল্পনাও করতে পারিনি এরকম কিছু অপেক্ষা করছে আমার জন্য ! ভাবি গীতিকে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ন‌ওশাদ ভাই তাড়াতাড়ি দরজা লাগান এই রাত কিন্তু খুব ছোট চোখের পলকে ভোর হয়ে যায় !
বলেই রোমানা ভাবি হাসতে হাসতে চলে গেল !
বাহিরে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে ব‌উ সেজে গীতি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! দুই হাত দূর থেকে আমি গীতিকে দেখছি ! পৃথিবীতে সেই রাতে কেয়ামত হয়ে গেলেও আমি মনে হয় পাত্তাও দিতাম না !
ওকে ভালো করে দেখব ভেবে হাতটা ধরে কাছে টানতেই মোমবাতি টা নিভে গেল ! ছোট মোমবাতি গলে শেষ হয়ে গিয়েছিল। গীতি বলল, নিয়ে আসি আরেক টা মোম তুমি একটু বসো। আমি ওর হাত টেনে ধরলাম, এখন এই ঘর থেকে বের হ‌ওয়া যাবে না গীতি থাকুক অন্ধকার ! আমার আলোর দরকার নেই আমার তোমাকে চাই গীতি! চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর আলো ! সেই আলোতে কখনো গীতির লজ্জা মাখা মুখটা দেখা যায় !
হেরার খুব ভালো লাগছে গল্প টা শুনতে। ন‌ওশাদ কতটা আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে গল্প বলতে বলতে সে অবাক হয়ে দেখছে। মনে হচ্ছে মানুষটা এখনও অনুভব করছে সেই মুহূর্ত টা। চোখ মুখ কেমন চকচক করছে!
হেরা ফিসফিস করে বলল,তারপর কি হলো !
তারপর কি হলো হেরা , হাসলো ন‌ওশাদ ! অনেক কিছু হলো !
অন্ধকার কোন কিছুর বাঁধা হতে পারেনি আমাদের জন্য সেই রাতে । বাহিরে ঝড় কিন্তু আমাদের ভেতরে তখন সুনামী চলছে ভেসে যাচ্ছিলাম দুজন!
দুই সেকেন্ড চুপ থেকে ন‌ওশাদ বলল,
গীতি যে রাতে চলে গেল আমাকে ছেড়ে সেই রাতেও হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল । ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল । ওকে খাটিয়াতে করে বাসার নিচে রাখা হয়েছিল ! আমি জেনারেটর চালু করতে বাঁধা দিলাম ! অন্ধকারে কিছুক্ষণ ওর মৃত দেহের পাশে বসে র‌ইলাম ! সবাইকে বললাম শেষবারের মতো আমাদের কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও ! ওর পাশে বসে রইলাম চুপচাপ । বারবার ওকে জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি করছো গীতি ! আমাকে রেখে, নিশাল কে রেখে চলে যাচ্ছো , বাঁচব কিভাবে আমরা ? গীতি কিছুই বলেনি হেরা !
খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর কপালে হাতটা রাখি কিন্তু নিষেধ নাকি ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না ! কিন্তু আমি একবার হাতটা স্পর্শ করেছি শেষ বারের মত ! যে হাতটা ধরে একসঙ্গে এত গুলো বছর পার করলাম আনন্দে, কষ্টে !
ন‌ওশাদ চুপ করে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।
জানো হেরা আজো আমি গীতিকে খুব করে যখন ফীল করতে চাই ঘর অন্ধকার করে বসে থাকি ! মনে হয় তখন গীতি আমার আশেপাশেই আছে।
হেরা ন‌ওশাদের হাতটা স্পর্শ করে বলল, আজ উনাকে খুব মিস করছিলেন বুঝি ?
হ্যাঁ হেরা ! আজ নিশাল এর কথা গুলো শুনে গীতিকে খুব মনে পড়ছিল !
বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিল ন‌ওশাদ !
গীতি কে বিয়ের পর তিন বছর আমি কিছুই দিতে পারেনি। সেই রাতের পর বুবু আম্মা কে খবর পাঠালো আমি বিয়ে করেছি ব‌উ বুবুর কাছে। আম্মা ছুটে গিয়ে গীতি কে আম্মার কাছে নিয়ে এলো ! তখন আমি আর গীতি আম্মার সাথে থাকা শুরু করলাম । পাশ করার পর বিজনেস শুরু করলাম । আল্লাহর অশেষ রহমত ছিল আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমার প্রথম ইনকামের টাকা দিয়ে সবাই কে কিছু না কিছু কিনে দিলাম গীতিকে বললাম কি দিব তোমাকে বলো ?
ও বলল আমাকে একটা নতুন বেড কিনে দাও !
কিন্তু ভালো একটা বেড কিনতে অনেক টাকা লাগবে সেটা তো হাতে নেই ! ও বলল, যখন হবে তখন দিও !
ন‌ওশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল , তারপর হেরার হাত টা শক্ত করে ধরলো !
তারপর কি করলেন?
পরের মাসে গীতিকে নিয়ে গিয়ে ওর পছন্দের বেড কিনে দিলাম ! সে দিন ওর চোখে মুখে এত আনন্দ দেখছি বিশ্বাস করবে না হেরা ! এত আনন্দ এর পর যখন অনেক টাকার মালিক হলাম গাড়ি বাড়ি হলো, গয়না অঢেল কিনে দিতাম তবুও সেই বেড কেনার মত আনন্দ দেখি নি ওর চোখে মুখে।
এই সেই বেড হেরা ! আমার আর গীতির অনেক স্মৃতি এটাতে। আমি এই বাড়ি বানানোর পর গীতি কে বললাম সব কিছু নতুন যখন, নতুন ডিজাইনের একটা বেড কিনে দেই । ও বলতো না । এটা আমি আমার নিশাল কে দিব ওর বাসর রাত হবে এই বেডে !
আমি বলতাম, ছেলের ব‌উ এর সামনে আর মান ইজ্জত থাকবে না পুরোনো বেডে থাকতে দিলে।
ও বলতো এটা যদি ছেলের বউ না বুঝে নাই । তুমি তো জানো কত শখের জিনিস এটা আমার!
ন‌ওশাদ চুপ করে আছে ! অনেকক্ষণ পর হেরার হাত ধরে বলল , হেরা তুমি হয়তো ভাবছো আমি কেন এঘরে তোমাকে নিয়ে আসি না এখনো ! আমাকে প্লিজ একটু সময় দাও ! এই বেড টাতে আমার আর গীতির একটা জীবন পার হয়েছে ! ওর মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমরা এখানে ঘুমিয়েছি! আমার মৃত স্ত্রী কে আমি সেই সন্মান টুকু দিতে চাই ! আমি তোমাকে কি বোঝাতে পেরেছি আমি কি বলতে চাইছি ?
হেরা মাথা নিচু করে বসে আছে ! ওর চিবুক গিয়ে বুকে ঠেকে গেছে লজ্জায় ! চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সে !
ন‌ওশাদ উঠে দাঁড়ালো , হাত বাড়িয়ে হেরাকে টেনে সামনে দাঁড় করালো !
আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ হেরা । সাধারণ পুরুষ মানুষ ! কামনা , বাসনা আর সব মানুষের মতোই আমার আছে ! আমারো নিজের অধিকার নিয়ে আমার বিবাহিতা স্ত্রী র সঙ্গে জীবন যাপন করতে ইচ্ছে করে ! আদরে , ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তাকে।
কিন্তু কি জানো আমি জবরদস্তি জিনিস টা পছন্দ করি না । তোমার তো অনেক বয়স কম তুমি সব কিছু এত তাড়াতাড়ি বুঝবে না ! শুধু আমার উপর বিশ্বাস রাখো আর একটু সময় দাও আমাকে ।
কিছু বলছো না যে , হেরা ?
কি বলব ?
থাক কিছু বলতে হবে না, সময় হলে আমিই বুঝে নিব তোমার মনের কথা টা !
এখন আমার কাছে এসো দেখি টিপ টা কি আবার বাঁকা হয়ে গেল নাকি ? ন‌ওশাদ হাত বাড়িয়ে হেরাকে খুব কাছে টেনে নিলো নিজের!
হেরা চোখ বন্ধ করে তাকালো ন‌ওশাদের দিকে ।
ন‌ওশাদ টিপ টা তুলে আবার কপালে পড়িয়ে দিল হেরার গালটা দুই হাতে ধরে টিপের উপর চুমু দিল ! তারপর ঝুকে হেরার গলা আর বুকের মাঝামাঝি সেই আচরের দাগটাতেও গভীর এক চুমু খেল ! এভাবে তোমার কষ্ট গুলো হেরা আমি একটু একটু করে শুষে নিব দেখো ! একদিন এখানে আমার ভালোবাসার দাগ থাকবে কোন দুঃস্বপ্নের স্মৃতি থাকবে না !
হেরা এত কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না আজ এই মুহূর্তে। সে থরথর করে কাঁপছে ! ওর দাঁতের সঙ্গে দাঁত বাড়ি খেয়ে কটকট শব্দ হচ্ছে !
ন‌ওশাদ ওর কানের কাছে মুখ এনে সুর করে ফিসফিস করে গাইতে শুরু করলো,
“কেমন করে এমন হলো
যা হতো না আগে
ছলাত ছলাত বুকের মাঝে
কোন এক নদী জাগে ।”
কি ব্যাপার হেরা এত কাঁপছো কেন ?
কিছু না !
ঠান্ডা লাগছে তোমার, গায়ে শীতের কাপড় কোথায় ?
শীতে না ‌আপনি এভাবে ধরে আছেন বলেই …
আমার জন্য বলেই হা হা করে হেসে উঠলো ন‌ওশাদ। সেজন্যই বলছি আর একটু বড় হতে হবে তোমাকে !
ন‌ওশাদ ওড়না টা প্যাঁচিয়ে দিল হেরার গায়ে !
হেরার খুব লজ্জা লাগছে আবার ভালো লাগায় ও ভরে যাচ্ছে সবকিছু ! পরিবেশ টা সহজ করার জন্য বলল,
ভাবি ঠিক কথাই বলেছে আপনি খুব সুন্দর গান গাইতে পারেন ।
আমি অনেক গান শুনি কিন্তু গাইতে পারি না হেরা !
আচ্ছা ছবি গুলো দেখাবে না আমাকে ?
হুম দেখাব !
বের করো !
হেরা ছবি গুলো বের করলো ! যে প্যাকেট টাতে পাঠিয়েছে রেজোয়ান সেখানে কি লেখা ছিল তুমি জানো ?
কোথায় , কোন প্যাকেট?
ঐ যে বেডের পাশে ড্রয়ারে রাখা আছে বের করো !
হেরা প্যাকেট টা বের করলো !
উপরে লেখা ‘ন‌ওশাদ এবং তার বালিকা বধূ ‘
হেরা আরও লজ্জা পেয়ে গেল !
ওর এক একটা কাজ বুঝলে ইউনিক । তোমাকে আমার বালিকা বধূ বলবে ! কালকে থেকে শুরু করেছে এই ডাক।
হেরা হাসছে !
অবশ্য খারাপ বলে নাই সত্যিই তো তুমি আমার বালিকা বধূ । অনেক অবুঝ ।
হেরা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে , চোখ তুলতে পারছে না লজ্জায় !
আনারে মা আবার এসে দরজায় টোকা দিল !
ন‌ওশাদ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল !
স্যার ভাইয়া ডিনার দিতে বলছে দিয়ে দেই ?
অবশ্যই, আমার ছেলে খেতে চাচ্ছে যখন এখন‌ই খাব । আব্বা খেয়েছে ?
দাদার খাওয়া শেষ !
সবার খাওয়া এক সঙ্গে দাও শোয়েব, এলিন, নাহিন দের ডাকো এক সঙ্গে খাব !
জ্বি স্যার !
চলো হেরা ঐ দিকে যাই !
হুম চলেন !
কি রান্না করেছো নিশালের জন্য ও বলল ভালো হয়েছে ?
হাঁসের মাংস । ও পছন্দ করে বুয়া বলল !
আমি জানি না শুধু জানি আমার বাঘের বাচ্চা মাছ খায় না !
সবাই একসঙ্গে ডিনার করতে এলো।
কিন্তু হেরা খুব চুপচাপ । সে আড় চোখে ন‌ওশাদ কে দেখছে । চোখে চোখ পড়তেই ওর গা কাঁপছে !

খাওয়া শেষ করে সবাই ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে ! অনেক দিন পর ন‌ওশাদ নিশালকে নিয়ে বসে খেলা দেখছে ! শোয়েব ও আছে ওদের সঙ্গে।
এলিন হঠাৎ হেরার কাছে বসে ফিসফিস করে বলল, ঘটনা ঘটে গেছে ফাইনালি বৌমনি !
কি ঘটনা ? হেরা অবাক হয়ে তাকালো!
তোমার কে আর ভাইয়াকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে দুজনের মধ্যে !
হায় হায় কি বলো এসব !
হুম সত্যি বললাম কিনা সেটা বলো ?
পায়ে পড়ি এলিন এসব বলো না ছিঃ ।
আরে তুমি খেতে বসে তাকাতে পাড়ছো না লজ্জায় আবার বারবার দেখছো ঠিকই । অন্য দিকে ভাইয়া একটু পর পর তোমাকে খেয়াল করছে ! কখন এরকম চোখ খুঁজে একজন আরেকজনকে জানো ! যখন প্রথম প্রেমে পড়ে নয়তো প্রথম বার …
হেরা এলিনের মুখ চেপে ধরলো ! আসো আমার সঙ্গে !
এলিন কে টেনে দূরে নিয়ে গেল হেরা !
কি আমার ধারণা ঠিক তো বৌমনি ?
এলিন সত্যি সেরকম কিছু হয়নি হবেও না !
হবে না কেন ?
যখন হ‌ওয়ার তখন হবে কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি যে কিছু হবে মোটেও না ! তবে হ্যাঁ উনি আমাকে অনেক পছন্দ করেন !
সেটা তুমি এতদিনে টের পেলে , টিউব লাইট কোথাকার ! তুমি এক কাজ করো বৌমনি রাতে ভাইয়ার ঘরে গিয়ে বলো একা ভয় পাচ্ছো ঘুমাতে !
জীবনেও না , ভয়ে যদি মরেও যাই তবুও না !
তাহলে থাকো অপেক্ষা করে !
থাকব প্রয়োজনে সারাজীবন !
বোকা মেয়ে !
ন‌ওশাদ হেরাকে ডাকছে ! হেরা ন‌ওশাদের দিকে ছুটে গেল !
জ্বি !
আমি ভাবলাম তুমি ঘুমাতে চলে গেছো !
না আমি এলিনের সঙ্গে কথা বলছিলাম !
ও !
নিশাল বলল,পাপা আমি রুমে যাচ্ছি !
কালকের কি প্ল্যান তোমার ?
বাসায় থাকবো রুমী ভাইয়া আসবে হায়ার ম্যাথ আর ফিজিক্স টা দেখাবে !
শেষ হয়নি এখনও সিলেবাস তোমার ?
শেষ কিছু হেল্প লাগবে তাই ভাইয়াকে আসতে বলেছি !
তোমার ফুপি আসবে চাচ্চুরা সবাই আসবে রাতে !
সমস্যা নেই আমি বাসায় ই থাকব !
কোথাও বের হলে গাড়ি নিয়ে যেও !
ঠিক আছে পাপা !
ন‌ওশাদ ও ছেলের সঙ্গে উপরে উঠে এলো ! ওদের পিছনে পিছনে আসছে হেরা।
নিজের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে নিশাল বলল, গুড নাইট পাপা !
গুড নাইট বাচ্চা !
পিছন ফিরে হেরার দিকে তাকিয়ে হাসলো শুধু নিশাল!
হেরা নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ! ন‌ওশাদ নিজের রুমে ঢুকে যেতেই সেও তার রুমে ঢুকে গেল !
রুমে ঢুকে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো । বুকের যেখানটায় ন‌ওশাদ চুমু খেয়েছে সেটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে ! ইসস কি অদ্ভুত মুহুর্ত ছিল !
খুট করে দরজায় আওয়াজ হতেই ঘাবড়ে গেল হেরা ! তাকিয়ে দেখে ন‌ওশাদ দাঁড়িয়ে আছে ! একটু থতমত খেয়ে গেল সে !
কি ব্যাপার ভূত দেখলে নাকি ?
আপনি আসবেন বুঝতে পারিনি !
আয়নার সামনে কি করছিলে ?
কিছু না !
সুন্দরী রা অবশ্য সারাক্ষণ আয়না দেখে !
হেরা হাসলো‌!
ন‌ওশাদ হেরার বিছানায় বসলো ! আজকে ভালো ঠান্ডা পড়েছে !
হুম !
হেরা থ্যাঙ্কস !
কেন ?
নিশালের জন্য এত ভালো রান্না করলে !
ও আচ্ছা ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন , আমার খুব ভালো লেগেছে ও মজা নিয়ে খাচ্ছিল দেখে !
সে জন্যই থ্যাঙ্কস।
ন‌ওশাদ কিছু একটা বলতে চাইছিলো কিন্তু বলল না ! শুধু বলল,বেশি রাত জেগে থেকো না! ঠান্ডা পড়েছে অসুস্থ হয়ে যাবে।
জ্বি।
ন‌ওশাদ উঠে চলে যাচ্ছে।
হেরার খুব ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করতে কিছু বলতে এসেছিলো কিনা! কিন্তু সাহস হলো না।
ন‌ওশাদ নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। হেরা তার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো ঢুকার সময় পেছন ফিরে একবার একটু হাসি দিল যা সব সময়ই দেন উনি।
হেরার খুব জানতে ইচ্ছে করছে কি বলতে এসেছিল মানুষ টা।

( চলবে )

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

২০তম পর্ব

২য় খন্ড

সকাল থেকে আনারের মা আজ ছুটোছুটি করছে ! বিকেলে তার স্যারের বোন দুলাভাই আসবে সে জন্য রাতে অন্য সব ভাই রা তাদের ব‌উদের নিয়ে হাজির হবে ! মেহমানদের খাওয়া থেকে শুরু করে আপ্যায়ন সব করতে হবে তাকেই ! বহুবছর থেকে এসব কাজ করে সে অভ্যস্ত । কিন্তু তবুও ইদানিং সে হাঁপিয়ে উঠে ।
আনারের মা তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন ?
আম্মা অস্থির হচ্ছি কি সাধে , সমস্যা তো ফুফু না সমস্যা হলো স্যারের ভাইয়ের ব‌উ রা ! আসবো আর আমার কামের ভুল ধরবো !
তুমি চিন্তা করো না তো !
আম্মা তাড়াতাড়ি সংসার টা আপনার হাতে নেন তাহলে দেখবেন কারো কোন মাতব্বরি শুনতে হ‌ইব না !
হেরা হাসলো , আনারের মা আমার তো এখনো নিজেকে এই সংসারের মনেই হয় না !
হ‌ইব আম্মা একটা কথা ক‌ই কিছু মনে নিয়েন না যেদিন এই ঘর বদলায়ে আপনার ঘর ঐটা হ‌ইব দেখবেন আপনারো মনে হ‌‌ইব সংসার আপনার, দ্বায়িত্ব আপনার, মানুষ গুলোও আপনার !
কি জানি ?
আম্মা আজকে সুন্দর ক‌ইরা সাজগোজ ক‌ইরা থাকেন তো আপনারে ফুফুআম্মা প্রথম দেখব ! স্যার খুব মানে সন্মান দেয় বড় ব‌ইনরে আবার ফুফুআম্মাও স্যাররে সব ভাইদের চেয়ে বেশি আদর করে। খুব আদর করব আপনারেও আগের আম্মারে অনেক আদর করতো !
আমার ভয় লাগছে !
ভয়ের কিছু নাই !
নিশাল কোথায় ?
ভাইয়ার মাস্টার আসছে পড়ে ! সেই দুপুরের খাওয়ার পর আসছে সন্ধ্যা পর্যন্ত পড়ব স্যারের কাছে !
এলিন আনারের মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালো ! কে আসবে বৌমনি ?
স্যারের বড় ব‌ইন আর দুলাভাই !
সেজন্যই বাসায় আজ এত আয়োজন চলছে !
হুম! তুমি কখন এলে ভার্সিটি থেকে?
অনেকক্ষণ !
আফা আম্মারে সুন্দর ক‌ইরা আপনাদের মত সাজায় দেন তো !
আরে না না । আমি শুধু শাড়ি পরব । মুরুব্বি মানুষ শাড়ি পড়লে খুশি হবে কি বলো এলিন!
তুমি ব্যাপার টা আমার উপর ছেড়ে দাও তো আমি তোমাকে রেডি করে দিচ্ছি ! চলো কোন শাড়ি পড়বে দেখি !
তাড়াতাড়ি করেন আফা গাড়ি কিন্তু এয়ার পোর্ট গেছে যে কোন সময় আইসা পড়ব সবাই !

সন্ধ্যায় ন‌ওশাদ নিজে এয়ার পোর্টে গিয়ে বোন আর দুলাভাই কে রিসিভ করলো ! ন‌ওশাদের বোন তাকে ছোট থেকেই খুব আদর করে।‌ন‌ওশাদ মায়ের চেয়ে বেশি বুবুর ন্যাওটা ছিল ছোটবেলায়। এয়ার পোর্টে ভাইকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলেন জান্নাত আজমী ! অনেকদিন পর ভাইদের দেখলে আজ‌ও তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
ন‌ওশাদের গাড়ি বাসায় পৌঁছানোর আগেই ছোট দুই ভাইয়ের ব‌উ নাদিয়া আর মিলা বাচ্চাদের নিয়ে হাজির হলো ! দুই ভাইয়ের ব‌উ এসে আনারের মা কে ধরলো ।
তোমার নতুন আম্মা কোথায় ?
আম্মা নিজের ঘরে বসেন আপনারা আসব এখনি !
এই আনারের মা তোমার আম্মা নাকি গেস্ট রুমে থাকে স্যারের সঙ্গে থাকে না ?
ছোট আম্মা আমি কেমনে ক‌ই স্যার কখন ডাকে নিজের ঘরে আর কখন আসে আম্মার ঘরে ? আমি তো স্যার আর আম্মার ঘরের দিকে সারাদিন চায়া থাকি না !
এক রুমে থাকে না সেটা বলো !
তাদের ব্যাপার সেপার তারা জানে বসেন আম্মা আসতেছে রেডি হয় !
নিশাল ওর নতুন মা কে দেখে কি বলল সেটা বলো ?
ভাইয়া তো খুব খুশি দুপুরেও দুইজন একসাথে ভাত খাইছে ! আম্মা ভাইয়ার জন্য রান্না করে !
সত্যি বলছো এটা তো বিরাট ঘটনা! আমি ভাবছিলাম নিশাল রিয়েক্ট করবে !
মেঝ ভাবি আমারো তাই মনে হচ্ছিল !
মিলা দেখি বুবু এত কম বয়সী বিয়ে করেছে বলে ভাইয়াকে কি বলে ?
ভাবি বুবু কিছুই বলবে না দেখো বুবু অন্য দুই ভাইয়ের থেকে ভাইয়ার প্রতি বেশি দূর্বল ! দেখলে না গীতি ভাবি মারা গেল যখন বুবু কি কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে গেল।
গীতি ভাবীর প্রতি বুবু সব সময় ই বেশি দরদ দেখিয়েছে বিয়ের পর থেকে তো তাই দেখতাম বুঝলে !
চলো উপরে যাই !
না মিলা এখন সিঁড়ি ভাঙতে ইচ্ছে করছে না। তোমার মেঝ ভাইয়া এখনো কেন আসছে না বুঝলাম না ?
ভাইয়া কি এয়ার পোর্টে গেছে?
না বড় ভাইয়া গেছে ! বুবু কি ভাববে এত বছর পর আসছে আর ছোটভাই রিসিভ করতে আসে নাই !
ওদের কথার মাঝখানে হেরা চলে এলো।
ভাবি, বড় ভাবি আসলো ! দেখেছো এখন দেখে মনেই হয় না গ্রামের মেয়ে ! হাঁটা চলা ড্রেস সব কিছুতেই এলিগ্যান্ট ব্যাপার চলে আসছে !
দেখতে হবে না কার ব‌উ , ন‌ওশাদ আজমীর গায়ের বাতাস লাগলেও এলিগ্যান্ট ব্যাপার চলে আসার কথা। তারমধ্যে সব কিছু হাতে ধরে শিখাচ্ছে মনে হয় সুমনা ভাবি ! উনি তো মারাত্মক স্মার্ট !
ভাইয়ার সঙ্গে যখন দাঁড়ায় না এই মেয়ে একেবারে সেরকম লাগে ।
ঠিক বলেছো !
ভাইয়া তো অল‌ওয়েজ স্মার্ট , ফিগার মেইনটেইন করে । প্রতিদিন গলফ খেলে , জীমে যায়, সুইমিং করে । আর বাকি দুই ভাই যদি নিজেদের নিয়ে ভাবতো একটু ! বিশেষ করে আরমান !
তোমার দেবর মনে হয় কত সচেতন , ঘোড়ার ডিম !
হেরা কাছে আসতেই চুপ হয়ে গেল দুজন!
কেমন আছো ভাবি ?
ভালো !
ওমা কি সুন্দর লাগছে তোমাকে !
ভাবি তো বিউটিফুল এজ অল‌ওয়েজ !
কখন আসলেন আমাকে মাত্র বলল আনারের মা !
এই ভাবি আপনি করে বলো না আমাদের, সম্পর্কে তুমি বড় বয়স যাই হোক !
ঠিক আছে বলব !
তোমরা কক্সবাজার থেকে ঘুরে এলে শুনলাম !
আপনার ভাইয়ার কাজ ছিল সঙ্গে আব্বা, রেজোয়ান ভাই আর সুমনা ভাবি ও গিয়েছিল।
আব্বা যাচ্ছে শুনে তো অবাক হয়েছি আমরা !
এত মানুষ নিয়ে হানিমুন , ভাইয়া কক্সবাজারে হানিমুনে যাবে কল্পনাও করিনি । ভাইয়া যাবেন গ্রীস, অস্ট্রিয়ার মত জায়গায় কথাটা বলে নাদিয়া হেসে উঠলো!
উনি হোটেলের কাজ দেখতে গিয়েছিলেন সঙ্গে আমাদের নিয়েছেন !
মিলা উঠে এসে হেরার পাশে বসলো । ভাবি গলার কানের এই এমারেল্ড এর সেট কি ভাইয়া দিয়েছে ?
জ্বি !
ভাইয়ার পছন্দ‌ই অসাধারণ !
তোমার কোন সন্দেহ আছে মিলা, ভাবিকে দেখে বুঝতে পারছো না ! ভাইয়ার পছন্দের হাইট কোথায়।
হেরা ওদের গল্পের সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু অস্বস্তি বোধ করছে !
দুজনেই চুপ করে গেল কারণ ন‌ওশাদের গাড়ি গুলো এসে বাসায় ঢুকেছে ! দুই বুদ্ধিমতি জা উঠে গেল তাদের ননাস কে রিসিভ করতে !
হেরার খুব লজ্জা লাগছে ! ননাস কে আগে দেখেনি আর কালকে সন্ধ্যার পর থেকে ন‌ওশাদের সামনে যেতে তার কেমন যেন লাগছে ! উনি তাকালেই গা শিউরে উঠছে !
গাড়ি থেকে নেমেই ন‌ওশাদের বোন ছোট ভাইয়ের ব‌উদের জড়িয়ে ধরলো !
হেরা বাকি দুজনের থেকে যথেষ্ট পিছনে দাঁড়িয়ে আছে !
নতুন ব‌উ কোথায় তাকে আগে দেখি !
বুবু আগে ঘরে আসেন ভাবি আছে ।
হেরা মাথায় ঘোমটা দিয়ে এগিয়ে গেল ননাসের সামনে ! ছলছল চোখে জান্নাত আজমী হেরা কে জড়িয়ে ধরলো , হেরা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো !
জান্নাত আজমী ন‌ওশাদ কে উদ্দেশ্য করে বলল,বাবু তুই তো দেখি পরী নিয়ে চলে এসেছিস ভাই !
ন‌ওশাদ নিজেও আজ হেরাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। বটল গ্রীন একটা বেনারসী কাতান টাইপের শাড়ি পড়েছে হেরা ! চুল টেনে খোঁপা করেছে । বেলী ফুল দিয়ে সেই খোঁপা ঢেকেছে ! কানে গলায়, হাতে এমারেল্ড আর জারকানের গয়না পড়েছে ! কপালে একটা সবুজ টিপ ।‌ এত সুন্দর লাগছে ! মাথায় ঘোমটা দেয়াতে একে বারে নতুন ব‌উ ! গাড়ি থেকে নেমেই ওকে দেখে বুকে ধাক্কার মত লাগলো ওর । কালকে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ওর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে হেরা। নিজের কাছে অপরাধী লাগছে নিজেকে ন‌ওশাদের। রাতে ভেবেছিল সরি বলবে , গিয়েছিল রুমে সরি বলার জন্যেও কিন্তু বলতে পারেনি । আজকে বলবে ! কিন্তু আজকে ওকে কাছেই পাওয়া যাবে না মনে হচ্ছে।
কি রে বাবু ওখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস , এদিকে আয় ?
ন‌ওশাদ বুবুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো !
ব‌উ এর পাশে দাড়া আমি দেখি তোদের দুজনকে !
বুবু আগে বসো রেস্ট নাও এত লম্বা জার্নি করে আসলে।
যা বলছি আমার কথা শোন আমি রেস্ট করব তোকে চিন্তা করতে হবে না !
ন‌ওশাদ হেরার পাশে এসে দাঁড়ালো !
ন‌ওশাদের দুলাভাই মজা করে বলল, শালাবাবু তোমার ব‌উ ভাগ্য মারাত্মক! দারুন মানিয়েছে!
হেরা আমার ভাইয়ের খেয়াল রেখো ও জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে !
বুবু হয়েছে এখন আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিও না প্লিজ ।
জান্নাত আজমী হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা গয়নার বক্স বের করলেন ! হেরার হাতে দিয়ে বললেন , তোমার জন্য ! নতুন ব‌উ খালি হাতে দেখব নাকি !
ন‌ওশাদ হেরার দিকে তাকিয়ে আছে ! হেরা লজ্জা পাচ্ছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে !
লজ্জার কিছু নেই সব ভাইদের ব‌উ দের আমি দিয়েছি এটা তোমার ! কি নাদিয়া, মিলা ?
জ্বি বুবু । তবে বড় ভাইয়ার প্রতি আপনি বেশি দূর্বল ! তাই বেশি আদর পায় ভাবিরা ! হাসতে হাসতে নাদিয়া বলল!
বাবুর মত অন‌্য দুই ভাই আমাকে এতটা ভালোবাসে বুঝি ? কোথায় বাকি দুজন এত দিন পর আসলাম ওদের দেখা নেই !আর বাবু এত ব্যস্ত মানুষ ঠিকই সব ফেলে এয়ার পোর্টে ছুটে গেছে।
সরি বুবু ওরা আসছে পথে আছে !
বুবু ফারহান তো বাসায়ই কম থাকে !
সে আমি জানি টাকার পিছনে দৌড়াচ্ছে !
বুবু চলো আব্বার কাছে যাই !
বাচ্চারা কোথায় ?
সব উপরে নিশালের রুমে ! আসছে !
দোতলায় উঠতেই সব বাচ্চারা ঘিরে ধরলো তাদের ফুপি কে। হৈচৈ এর মধ্যে ন‌ওশাদ হেরার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ! তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে কে সাজিয়ে দিলো ?
হেরা মাথা নিচু করে বলল, এলিন!
চোখে আটকে আছো একেবারে। কথাটা বলেই ন‌ওশাদ তার আব্বার রুমে ঢুকে গেল !
নিশাল কে দেখে তার ফুপি জড়িয়ে ধরলো। আমার শেহজাদ বাবাটা কেমন আছে ?
ভালো , তুমি আমাকে শেহজাদ ই ডাকবে সব সময় ?
হুম তোমার নাম শেহজাদ আজমী আমি রেখেছিলাম !
কলেজে সবাই ডাকে কিন্তু ফ্যামিলি র লোকজন নিশাল ডাকলেই ভালো লাগে তো !
ওটা তোমার পাপা রেখেছে আমি শেহজাদ ই ডাকব !
আচ্ছা ডেকো ! অনেক দিন পর তোমার সঙ্গে দেখা।
তুমি ইউএসএ তে চলে আসো আমার কাছে !
পাপা দিবে না জীবনেও, ক্যাডেট কলেজে ই আছি তাই বলে বাসায় চলে আসতে । দেশের বাহিরে গেলে থাকতে পারবে না পাপা।
নিশালের ছোট চাচী মিলা নিশালকে সবার সামনেই বলে উঠলো, নতুন মা কে কেমন লাগলো নিশাল ?
চুপ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে সবাই ! নিশাল যথেষ্ট অপ্রস্তুত হয়ে গেল, সবচেয়ে বেশি অপ্রস্তুত হয়ে গেল হেরা !
জ্বি ভালো চাচী !
ছোট ভাইয়ের ব‌উ এর দিকে তাকিয়ে জান্নাত আজমী বলে উঠলেন , তোমার দেখি মিলা বুদ্ধি আগের মতই আছে । বাচ্চা ছেলেটা কে অপ্রস্তুত করে দিলে খেয়াল আছে !
সরি বুবু !
তোমরা সবাই লিভিং রুমে গিয়ে বসো আমি আব্বার সঙ্গে দেখা করে আসি !
সবাই লিভিং রুমে চলে গেল ! হেরা নিশালের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো !
সরি আমার জন্য তোমার আন‌ইজি অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।
আপনি সরি বলছেন কেন ছিঃ ! আমার চাচীরা একটু এমন‌ই মজা করে !
কিছু খাবে তুমি , দুপুর থেকে পড়ছো !
জ্বি আনারের মা কে দিয়ে কিছু একটা রুমে পাঠিয়ে দিলেই হবে !
আচ্ছা পাঠাচ্ছি !
থেঙ্কস আন্টি !
হেরা তাকিয়ে আছে নিশালের দিকে ।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল , কিন্তু যখন জান্নাত আজমী হেরা কে গেস্ট রুমে আবিষ্কার করলেন তখন‌ই মেজাজ খারাপ করে ফেললেন।
কিছুই বললেন না চুপ করে র‌ইলেন সবার সামনে ! ছোট ভাই আর তাদের ব‌উদের সামনে ন‌ওশাদ কে তিনি ছোট করতে চাইছেন না !
সবাই রাতে ডিনার করে বিদায় নেয়ার পর তিনি ন‌ওশাদ কে ধরলেন !
বাবু আমি কোন ঘরে থাকব ?
তোমার জন্য তিন তলায় রুম রেডি করে রেখেছি বুবু কেন অসুবিধা হচ্ছে ?
দোতলায় কি সমস্যা , এখানেও তো গেস্ট রুম আছে সবসময় আসলে তো আমি ওখানেই থাকি !
বুবু তুমি আর দুলাভাই আমার রুমে থাকো‌‌, আমি আনারের মা কে বলে দিচ্ছি সব নিচে নামিয়ে আনবে এক্ষুনি!
আর তুই কোথায় থাকবি ?
আমার বাসা এক জায়গায় থাকলেই হলো !
জায়গাটা কোনটা শুনি ?
বুবু তুমি থাকাথাকি নিয়ে প্যাঁচানো শুরু করলে কেন , কি হয়েছে ?
কি হয়েছে মানে তোর বিয়ে করা ব‌উ তোর রুমে না থেকে গেস্ট রুমে থাকছে কেন বাবু ?
বুবু আসলে হয়েছে কি , তুমি শান্ত হয়ে বসো বুঝিয়ে বলছি !
আগে বল বিয়েটা সত্যি করেছিস তো ?
ওমা কি বলে বিয়ে না করে একটা মেয়েকে ব‌উ পরিচয় দিব সবার কাছে ? আশ্চর্য!
আশ্চর্য তো আমি হচ্ছি , আমার ভাই বাবু তো এমন অবিবেচক না ! একটা মেয়ে কে বিয়ে করে তাকে তার প্রাপ্য সন্মান না দিয়ে তাকে আশ্রিতার মত বাসায় ফেলে রেখে অসন্মান করার কি মানে ?
নাকি মেয়েটা তোর স্ট্যাটাস এর সাথে যাচ্ছে না ওর সংস্পর্শে আসতে দ্বিধা হচ্ছে ?
বুবু এসব কি বলছো ?
ঠিক কথাই বলছি । তোর বাসা কাজের লোকজনের ভরা তোর ব‌উ কে তাদের সামনে অপমান করছিস না ? বাহিরের মানুষের কথা বাদ দে ওরা তোর বেড রুমে উঁকি দিয়ে দেখছে না কিন্তু এই বাড়ির অন্য লোকদের সামনে তো অপমান করছিস বাবু !
বাবু মেয়েটা গরীব হলেও মানুষ তো , ওর ও মান সন্মান বলে কিছু আছে ! সন্মান দিতে বিয়ে করে এখানে এনে কিন্তু আরেক অপমানের ভেতরে ফেলেছিস। একটা মেয়ের বিয়ের পর সবচেয়ে বড় অধিকার তার স্বামীর উপর ! তুই সেটাই তো তাকে দিচ্ছিস না !
বুবু আমি একটু সময় চেয়ে নিয়েছি ওর কাছ থেকে !
কিসের সময় ? দশ জন ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে তোকে নিয়ে হাসাহাসি করছে ! আজ এই মুহূর্তে তুই ওকে তোর ঘরে নিয়ে আসবি ! সেখানে তোদের মধ্যে দূরত্ব থাকলো কি ঘনিষ্ঠতা হলো কেউ দেখতে আসবে না বাবু ! আল্লাহ কে ভয় কর অন্তত !
বুবু নিশাল যাক !
কেন এবার গেলে তোর ছেলে আবার আসবে যখন তখন কি আবার ব‌উকে ঘর থেকে বের করে দিবি ?
না তা কেন ?
বুবু আর কয়টা দিন সময় দাও !
তাহলে তুই তোর মত থাক তোর বাসায়, আমি কালকে আমার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকা শুরু করি !
এখন আমি কিভাবে হেরা কে আসতে বলব তাও আজকেই ?
তোকে কিছু বলতে হবে না আমি ওকে নিয়ে আসছি তোর ঘরে !
জান্নাত আজমী ন‌ওশাদের রুম থেকে বের হয়ে গেলেন । ন‌ওশাদ খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।

বুবু কি করবে বুঝতে পারছে না সে ! সবচেয়ে বড় কথা নিশাল কে কিভাবে ফেইস করবে কালকে ! ইস বুবু কয়টা দিন পরে আসলে কি হতো !
দরজায় পারুল এসে দাঁড়িয়েছে !
কিছু বলবে ?
স্যার ফুফুআম্মা বলল বিছানায় সুন্দর দেখে একটা চাদর বিছিয়ে দিতে !
কেন এই চাদর কি দোষ করেছে ভালোই তো আছে ! ন‌ওশাদের মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
আমি জানি না বলল , নতুন দেখে চাদর বিছাতে!
জানো না নতুন কড়কড়া চাদরে আমি ঘুমাতে পারি না , আনারের মা কোথায় ?
উপরের গেস্ট রুমে ফুফুআম্মার জিনিস দোতলায় আনে !
এখন কি করতাম স্যার ? পারুল ভয়ে ভয়ে বলল!
কি আর করবে বিছিয়ে দাও !
পারুল বিছানার চাদর পাল্টে দিচ্ছে !
ন‌ওশাদ মনে মনে ভাবছে বুবু আর কি কি নাটকীয়তা করে আজ আল্লাহ জানে ! রেজোয়ানের মত খাট ফুল দিয়ে ভরবে না তো ! ও আল্লাহ প্লিজ সেইভ মি !
একটু পর জান্নাত আজমী তড়িঘড়ি করে এসে ন‌ওশাদের রুমে ঢুকলো !
কি রে এখনো শার্ট প্যান্ট পড়ে বসে আছিস কেন ?
চেন্জ করতে যাচ্ছি বুবু !
শোন একটা সুন্দর দেখে পাঞ্জাবি পড় !
বুবু এত রাতে পাঞ্জাবি পড়ব কেন ? তোমার কি সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গেছো ! হেরা দেড় মাস এই বাড়িতে আছে ও আমাকে প্রতিদিন দেখছে বুবু ওর জন্য এখন আমাকে এই রাত বিরাতে পাঞ্জাবি পড়তে হবে না !
আচ্ছা থাক পড়িস না , মেজাজ ঠান্ডা কর !
তোকে একটা জিনিস দিতে এসেছি সেটা দেখ !
কি জিনিস ?
জান্নাত আজমী একটা ছোট কাঠের বক্স থেকে পাঁচ লহরের মোটা সোনার চেইন বের করলেন । মটর দানার মতো দানা চেইনের ভেতরে !
এটা কি জিনিস বুবু ?
এটা আমাকে দাদী দিয়েছিল ছোট বেলায় ! আম্মার খুব ইচ্ছে ছিল দাদীর এই চেইন আমার মেয়েও পড়বে ! আমার তো কোন মেয়েই হলো না ! তোদের একটা ভাইয়ের ও মেয়ে নেই ! আমার ছেলেদের ও মেয়ে নেই ! এখন এই চেইন নিয়ে কি কবরে যাব ?
এটা আজ রাতে তুই হেরাকে দিবি ।
কেন বুবু তোমার জিনিস তুমি তোমার ছেলের ব‌উদের দাও !
চুপ কর, ওদের যা দেয়ার দিয়েছি !
হেরা কে ই কেন দিতে হবে এটা , আরো তো ভাইয়ের বউ আছে তাদের দাও !
কারণ আমার মন বলছে হেরাই এই বংশে নেক্সট একটা মেয়ের জন্ম দিবে ! আমি ততদিন থাকি না থাকি তাই ভাবলাম দিয়ে দেই ! আর কারো বাচ্চা হ‌ওয়ার সম্ভাবনা আছে বল?
ন‌ওশাদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলল, কি যে বলো না তুমি বুবু হাস্যকর ! এই বয়সে তালেগোলে একটা বিয়ে করেছি এতেই লোকজন কি বলছে কে জানে ! তারপর আবার বাচ্চা ! নিশাল এবার এসএসসি দিবে কত বড় ছেলে আমার । আর তুমি কত কি চিন্তা করছো ! তোমাকে নিয়ে না পারি না !
তোর বাবা হ‌ওয়ার ইচ্ছে নাও থাকতে পারে কিন্তু হেরার তো মা হ‌ওয়ার খায়েস হবে তখন ?
বুবু আমি এত কিছু এখন চিন্তা করতে পারছি না !
আচ্ছা ঠিক আছে রাতে একটা গিফট দিতে হয় , এটা দিয়ে দিস হেরাকে প্লিজ !
না বুবু তোমার ইচ্ছে হলে যত খুশি দিতে চাও দাও কিন্তু আজ রাতে হেরাকে আমি কিছুই দিব না ! প্রয়োজনে কালকে সকালে গয়নায় মুড়িয়ে দিব কিন্তু আজ রাতে এ ঘরে ওকে আমি কোন উপহার দিব না !
কেন ?
একুশ বছর আগে গীতিকেও প্রথম রাতে কিছুই দিতে পারিনি বুবু !
জান্নাত আজমী উঠে দাঁড়ালেন এখানে রেখে গেলাম তোর যা ইচ্ছা করিস ! একটা কথা কি একুশ বছর আগে গীতি কে যা দিয়েছিলি এই মেয়েটাকে তুই সেটা কিন্তু আজ দিবি না আমি জানি ! জিনিস টা হলো , তোর ভালোবাসা!
জান্নাত আজমী উঠে চলে গেলেন !
ন‌ওশাদ বুবুর শেষ কথা টুকু শুনে একটু হোঁচট খেলো !
সত্যিই তো আজ রাতে হেরাকে সে কিছুই দিতে পারবে না ! কিছুই না !

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here