“লুকোচুরি”
পর্ব- ১৬
(নূর নাফিসা)
.
.
পোস্ট করার পরপরই ইভান কল করলো, রিজোয়ানা হাসি নিয়ন্ত্রণে এনে রিসিভ করে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এতোই খুশি যে, সোস্যাল সাইটে স্লোগানের সূচনা করে ফেললেন!”
“শাট আপ! এমনি ফান পোস্ট দিয়েছি।”
“হ্যাঁ, আমিও তো ফানই করছি। বিয়েটা আজই হয়ে গেলে ব্যাপারটা বোধহয় সিরিয়াসে দাঁড়াতো তাই না?”
“আমি তোমাকে গলা টিপে হত্যা করবো। তার আগে ফেসবুক থেকে ব্লক করবো। তোমার যন্ত্রণায় আমি কোনো পোস্ট কমেন্ট কিচ্ছু করে শান্তি পাই না!”
ইভান শব্দযোগে হাসলো। রিজোয়ানা বললো,
“আবার হাসো!”
“ওকে, আমি একটা স্লোগান দেই। বউয়ের কাছে হাসতে মানা।”
“তারপর?”
“আরও দিবো?”
“কথা কেমন অর্ধেকে আটকে গেলো।”
“ও, আচ্ছা। তাহলে আবার বলি। বউয়ের কাছে হাসতে মানা, কারণ থাকুক গোপনে জানা।”
রিজোয়ানা খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
“বাচ্চাদের ছড়া শোনাচ্ছো!”
“বউ তো বাচ্চাই। শ্বশুরবাড়ি নিয়ে এতো উত্তেজনা, আগে জানলে কিডন্যাপ করে হলেও কবেই নিয়ে চলে আসতাম।”
“ইশ! বেশি কথা। শুনো, সবাই এলো শিহান এলো না কেন?”
এমনি শিহানের কণ্ঠে বেজে উঠলো,
“নিরীহ পেয়ে বাড়িটা পাহাড়া দেওয়ার জন্য একা রেখে গেছে আমাকে। এর একটা কঠিন বিচার চাই আমি।”
রিজোয়ানা বিস্মিত হয়ে বললো,
“তুমি শিহানের সামনে বসে কল করেছো!”
“ভাবি, তোমাদের বিয়ের প্রোগ্রামের প্ল্যানিং করছিলাম। এতো এতো ব্যবস্থা করতে হবে তো।”
“চুপ! প্ল্যানিং করবে করো, তো ফোনের দিকে কান কেন? পাজি ছেলে! তোমার ভাই আরও বড় পাজি। ফোন দেওয়ার তার সময়গময় নেই! রাখলাম আমি ফোন। করো তোমরা প্ল্যানিং।”
“আরে, শুনো তো প্ল্যানিংয়ের ব্যাপারটা।”
“প্রয়োজন নেই। গুড নাইট।”
রিজোয়ানা কল কেটে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে ঘুম ভাঙতেই থ মেরে বসে আছে। কি অদ্ভুত রকমের এক স্বপ্ন দেখে বসলো! মনে হতেই বারবার চোখ পিটপিট করতে লাগলো! আযব মস্তিষ্ক আযব আযব সব চিন্তা করে বসে। নয়তো এমন স্বপ্ন চোখ দেখলো কিভাবে! রিজোয়ানা চোখেমুখে পানি ছিটকে ফ্রেশ হলো। কিন্তু স্বপ্নের ব্যাপারটা তার চোখ থেকে সরছেই না। রিলেক্সে যেতে নামাজ পড়ার পরপরই সকাল সকাল চা খেতে লাগলো। ওদিকে ইভানের গলার স্বর শুনতে পেয়ে সে বুঝতে পারলো ইভান ঘুম থেকে উঠে গেছে তাহলে। দেখা পেতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। একটু পরই ইভান অয়ন নিয়নের বারান্দায় এলো, ততক্ষণে চা কাপের শেষ পর্যায়। ইভান এসে বললো,
“খুঁজছিলে নাকি?”
“না, এমনি দাঁড়িয়েছিলাম। ঘুম হয়েছে?”
“না হওয়ার কারণ?”
“না, ওইযে প্ল্যানিং করছিলে…”
“ধুর, কিসের প্ল্যানিং! ঘুমানোর নাম করে আমার রুমে এসেছে ঘুমের বারোটা বাজাতে। ঘাড় ধরে বের করে দিয়ে দরজা আটকে আরামসে ঘুমিয়েছি।”
“ওহ্।”
রিজোয়ানার চিন্তিত মুখখানা দেখে বললো,
“কি ভাবছো?”
“হুম? না কিছুনা। কি একটা স্বপ্ন দেখলাম বলোতো। স্বপ্ন না বাস্তব ছিলো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না এতোক্ষণ যাবত। এখন বুঝলাম।”
“কি বুঝলে?”
“বিয়ে হয়নি।”
“মানে!”
“মানে তোমার আর আমার বিয়ে হয়নি।”
“অতি খুশিতে তো তুমি পাবনা চলে যাচ্ছো! কি আবোলতাবোল বলছো? বিয়ের এতো বছর পর আজ বলছো বিয়ে হয়নি!”
“না, মানে স্বপ্নে দেখলাম মাঝরাতে আবার এসেছো কাজি নিয়ে। সন্ধ্যায় এনগেজমেন্টের সারপ্রাইজে তোমার মন ভরেনি, সারপ্রাইজ গাঢ় করতে মাঝরাতে এসে আবার বিয়ে করার মর্জি ধরেছো। এরপর বিয়েও হলো। ভাবলাম সত্যি আবার তুমি এসেছিলে নাকি! এখন নিশ্চিত হলাম, সেটা স্বপ্ন ছিলো।”
“তারপর কি হলো? তোমাকে রেখেই চলে এলাম? এখন এসে আবার নিয়ে যাই। ত্রিপল সারপ্রাইজ, কি বলো?”
রিজোয়ানা চোখ পাকিয়ে তাকালে ইভান হেসে বললো,
“চা খাবো।”
রিজোয়ানা কাপ উল্টে বললো,
“নেই।”
“সকাল সকাল ছ্যাকা দিলে! কোথায় ভাবলাম তোমার হাতের চায়ে লম্বা এক চুমুক দিয়ে বসবো!”
“দু সপ্তাহ পর দিয়ো।”
বলেই লজ্জাময়ী হাসলো রিজোয়ানা। বিপরীতে ইভানের মুখেও দেখা গেলো মুচকি হাসি। রিজোয়ানা বললো,
“মামির হঠাৎ ডিসিশন চেঞ্জ হয়ে গেলো কিভাবে? ফোর্স করেছো?”
“নাহ! ওই সেই যে একটু রাগারাগি করেছিলাম, এরপর তো তোমাকে নিয়ে আর কোনো কথায়ই হয়নি ঘরে। পরশু হঠাৎ জব করতে নিষেধ করে দিলো। ভালো কথা, জবের কি হলো?”
“কি আবার হবে। রবিবার যোগাযোগ করতে বলেছে, নিষেধ করে দিবো।”
“ওকে, মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা কিন্তু নিয়ে নিয়ো মায়ের কাছ থেকে।”
“আবার!”
ইভান শরীর কাপিয়ে হেসে বললো,
“দু সপ্তাহ পর থেকে রোজ সকালে এক কাপ কফি দিয়ো মনে করে। গাঢ় রঙ চা হলেও চলবে।”
“আচ্ছা? তখনকারটা তখন দেখা যাবে।”
পরবর্তী শুক্রবার তারা বর কনে নিজেরাই শপিংয়ে গেলো। সব কেনাকাটা তারা করবে না, নিজেদের পোশাকগুলো নিজেরা কিনতে এসেছে। বাকিসব ইভান ও শিহান আরও দুদিন আগেই কিনে ফেলেছে। ব্রাইডাল শাড়ি পছন্দ করতে ও কিছু সময় ঘুরাফেরা করতে রিজোয়ানাকে সাথে নিয়ে আসা। নয়তো ইভান নিজেই এটুকু কেনাকাটা করতে পারতো।
ঘুরাফেরার মজা বাড়িয়ে তুলতে শিহানকে সাথে নিয়ে যায় সবসময়। আজও আছে সে। গল্প করতে করতে, বাদাম খেতে খেতে তিনজন প্রবেশ করলো শপিংমলে। প্রথমে শাড়ি কিনবে, পরে ইভানের পোশাক দেখবে। ব্রাইডাল শাড়ির দোকানে এসে শাড়ি দেখছে তারা। ইভান এক হাত পকেটে রেখে অন্যহাতে রিজোয়ানার হাত ধরে যখন ঘাড় ঘুরিয়ে শাড়ি দেখছিলো, শিহান সিটি বাজিয়ে দুজনের মনযোগ আকর্ষণ করলো। তারা শিহানের দিকে তাকিয়ে দেখলো শিহান দোকানের সাইডে দাঁড় করানো শাড়ি পরিহিতা পুতুলের হাত ধরে আছে পরম যত্নে। চোখে আবার ইশারা করলো তারা যেমন একে অন্যের হাত ধরে আছে, তেমনই নিজের একাকিত্ব দূর করতে সে-ও পুতুলের হাত ধরে নিয়েছে। রিজোয়ানা তা দেখে ফিক করে হেসে উঠলো। দোকানদারও তাকিয়ে আছে তার দিকে। শিহান দোকানদারের উদ্দেশ্যে বললো,
“আপনাদের এই কিউট ডলটা কিছুক্ষণের জন্য দিবেন? না মানে, ওদের মতো একটু হাত ধরে হাটতাম আরকি।”
দোকানদার হাসছে। ইভান বললো,
“তুই এদিকে আসবি!”
শিহান হাত ছেড়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“তোমরা এভাবে হাটো, আর তোমাদের সাথে হাটলে নিজেকে কেমন অসহায় অসহায় লাগে! আমারও তো কিছু মন চায় নাকি! ফিলিং, বড় একা একা লাগে আমার…”
“চুপচাপ এখানে এসে দাঁড়া, আর শাড়ি পছন্দ কর। এক্সট্রা কোনো কথা নেই।”
“শাড়ি পছন্দ করবো? আমার বউয়ের জন্য?”
“আগে আমার বউয়েরটা সম্পন্ন হোক, পরেরবার তোর বউয়ের জন্য আসবো।”
“সেলফিশ ভাই তুমি। হুহ্! ভাই, দেখান তো। কিছু ভালো শাড়ি দেখান।”
তাদের দুইভাইয়ের কথাবার্তা শুনে এদিকে হাসতে হাসতে হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে রিজোয়ানা। দোকানদারও নিজের কাজ করতে করতে হাসছে। যে দোকানে প্রবেশ করেছে সেই দোকান থেকেই দরদাম করে শাড়ি কিনে নিয়েছে। এরপর ইভানের পোশাকের জন্য গেলেও শিহানের দুষ্টুমির শেষ নেই। ইভানের মাপ নিতে চাইলে শিহান গিয়ে দৌড়ে দাঁড়াচ্ছে সামনে। অযথাই নিজের জন্য পোশাকের কথা জিজ্ঞেস করে লোকদের হয়রান বানাচ্ছে। রিজোয়ানা তো হাসির উপর হেসেই যাচ্ছে। ইভান না পারছে হাসতে, আর না পারছে ধমকাতে! শুধু কঠিন দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে। দৃষ্টি কঠিন হলেও ভয়ংকর না। শিহানকে থামানোর জন্যই এই দৃষ্টি নিক্ষেপ হচ্ছে। আবার রিজোয়ানার দিকেও তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে। তার তাকানোর ভঙ্গিমাই যেন বলে দিচ্ছে, “তুমি হাসছো, সেই আস্কারায়ই বারবার দুষ্টুমি করে যাচ্ছে।”
তখন আবার হাসি চাপা দিয়ে দিচ্ছে সে। কেনাকাটা শেষে আবার সেই শাড়ির দোকানের সামনে দিয়ে আসার সময় ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
“গুড বায়, জানু…”
পাশে থেকে এবার ইভান হাত তুলেছিলো তার মাথায় একটা মারার জন্য। শিহান হাসতে হাসতে সরে গেলো। এবার ইভানের মুখেও হাসি দেখা গেছে। রিজোয়ানা আবার তার হাত ধরে হাটতে লাগলো। রেস্টুরেন্টে ডিনার সেড়ে অবশেষে বাড়ি ফিরে এলো। সময়টা বেশি লাগলেও শিহান ছেলেটা বোরিংনেস ফিল করতেই দেয়নি। সারাক্ষণ হাসির কান্ডে মাতিয়ে রেখেছে।