#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [১৮]
লাবিবা ওয়াহিদ
———————-
নিথি রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই সার্ভেন্ট লাগেজটা রুমে রেখে চলে গেলো। নিথি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে লাগেজের দিকে অগ্রসর হয়। লাগেজ খুলে একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। নিথি বের হতে হতে মাগরিবের আযানের ধ্বনিতে চারিপাশ মুখোরিত হলো। রুমে আসতেই নিথি চমকে উঠলো। আয়নার মুখোমুখি রায়িন দাঁড়িয়ে মাথায় টুপি পরছে। নিথির বুকে তীব্র ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। অস্বস্তি, জড়তায় গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তার। এমন অনুভূতির কারণ জানা নেই নিথির। হয়তো রায়িন এবং নিথি এক রুমে সম্পূর্ণ একা অবস্থান করছে, তাই? নিথি কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ঘনঘন পলক ফেললো। সবটাই নিজেকে স্বাভাবিক করার নমুনা। রায়িন আয়নাতে নিথির প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো। পাঞ্জাবিতে আতর ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,
–“ওযু থাকলে নামাজ পড়ে নাও। আমি মসজিদ যাচ্ছি!”
রায়িন এক মুহূর্তও দেরী না করে বেরিয়ে গেলো। নিথি যেন গলায় আটকে থাকা দম ফিরে পেলো। এত অস্বস্তি লাগছে কেন তার? কই, আগেও তো একাকী পাশাপাশি হেঁটেছে, এক রুমে বসে রায়িনের কাছে পড়েছে।
নিথি নামাজ সেরে বাহিরে যেতেই উপলব্ধি করলো করিডোরের আলো নেই। নিথির পা জমে গেলো ভয়ে। সন্ধ্যা হয়েছে তাও লাইট কেন জ্বলছে না? অদ্ভুত তো! নিথি ভয়ার্ত দৃষ্টি চারপাশে বুলালো। কারো সাড়াশব্দ নেই। কেমন স্তব্ধ, গা ছমছমে পরিবেশ৷ বাড়িতে কী কেউ নেই? এমন ভুতুড়ে পরিবেশ হয়ে আছে যে? নিথির অধরজোড়া মৃদ্যু কম্পনরত। তার চেয়েও বড়ো কথা হাতে ফোন নেই, ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতে পারবে না। এছাড়া নিথির ফোন-ই তো ভাঙ্গা৷ সেটা আর চলবে কীভাবে? রুমের লাইট জ্বলছে। নিথির সাহস হচ্ছে না, পিছে ফিরে রুমে দৌড় দিতে।
হঠাৎ পায়ের শব্দ পেলো নিথি৷ যেন সিঁড়ি বেয়ে উঠে তার দিকেই আসছে। নিথি চোখ-মুখ খিঁচে এক চিৎকার দিয়ে পাশে থাকা ফুলের টব দ্বারা অবয়বটাকে আঘাত করার চেষ্টা চালালো। নিথি এরকম ভয়ংকর কিছু করার পূর্বেই এক বলিষ্ঠ হাত তার হাত ধরে আটকালো। চোখে তীব্র আলো পরায় নিথি পিটপিট করে এক চোখ খুললো।
–“পাগল নাকি তুমি? শেষমেষ আমায় খু*ন করতে আসছো এখানে?”
নিথি এবার পুরোপুরি চোখ খুললো। রায়িন ততক্ষণে নিথির চোখের সামনে ধরে রাখা ফোনের ফ্ল্যাশ সরিয়ে নিয়েছে৷ ইলেক্ট্রিসিটি হঠাৎ চলে এলো। তীব্র আলোয় চারপাশ ঝলমল করে ওঠলো। নিথি চরম লজ্জিত। দৃষ্টি নুইয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়। ভয় পেয়ে শেষে কি না রায়িনকে আঘাত করতে গেছিলো? কী লজ্জাজনক অবস্থা।
–“খেতে আসো।”
বলেই রায়িন চলে গেলো। রায়িন নিথির চোখের আড়াল হতেই নিথি নিজ মাথায় এক চা’প’ড় মেরে নিজেকে গালমন্দ করলো।
——————————-
রাত ন’টায় অন্তরা রহমান ফিরলেন মেয়ে রায়াকে নিয়ে। নিথি এসেছে শুনে তার তর সইছে না! বাড়ি ফিরেই রায়া নিথিকে জড়িয়ে ধরলো,
–“ওহ, ভাবী!! তুমি এসেছো? কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আনার কথা কী তোমার একদমই মনে পরেনি?”
নিথি উত্তরে শুধু হাসলো, মুখে কিছু বলার মতো উত্তর তার জানা নেই। নিথি ম্লান দৃষ্টিতে রায়িনের দিকে তাকালো। রায়িন তখন বেশ মনোযোগের সাথে রায়ার রিপোর্ট দেখছে। নিথি চোখ নামিয়ে রায়াকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলে,
–“আগে ফ্রেশ হয়ে নাও৷ তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে খুব গল্প করবো!”
রায়ার নিথির প্রস্তাব পছন্দ হলো। খুশি মনে ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে রায়া নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। ততক্ষণে অন্তরা রহমানও ফিরলেন ফ্রেশ হয়ে। নিথির মাথায় হাত বুলিয়ে নিথিকে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। নিথি এতক্ষণে অন্তরা রহমানের অপর হাত খেয়াল না করলেও এখন দেখলো একটা রিং এর বক্স। নিথি চোখ বড়ো বড়ো সেটায় নজর বুলিয়ে দৃষ্টি নুইয়ে ফেললো। অন্তরা রহমান গলা খাঁকারি দিয়ে শুধালেন,
–“রায়িন, আব্বু। এই রিপোর্ট রাখো, একটা কাজ আছে!”
রায়িন মাথা তুলে অন্তরা রহমানের দিকে তাকালো।
–“বলো!”
–“বিয়ে যেভাবেই হোক, দেনমোহর না পরিশোধ করা অবধি তোমরা একই ঘরে থাকতে পারববে না। তাই আমার প্রশ্ন, তুমি নিথির দেনমোহর পরিশোধ করেছো?”
নিথি চমকে গেলো। সে ভেবেছিলো তার শ্বাশুড়ি আগের বারে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করবে, নানান উপদেশ দিবে। কিন্তু সেরকম কিছুই তো হলো না। নিথি তো এতক্ষণ এসব হজম করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তাহলে?
রায়িন নিশ্চুপ হয়ে কী যেন ভাবে। অতঃপর রিপোর্টে দৃষ্টি দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
–“আমার কাছে আপাতত ক্যাশ নেই!”
–“তাহলে তুমি ঠিক আগামীকালের মধ্যে ওর দেনমোহর পরিশোধ করবে। পরিশোধ না করা অবধি তোমরা এক ঘরে থাকতে পারবে না!”
–“তাহলে তোমার কাছেই এই মেয়েকে রেখে দাও! আমার কী?”
মিনমিন করে বললো রায়িন। অন্তরা রহমান রায়িনের কিছুটা কাছাকাছি বসায় বেশ ভালো করেই শুনতে পেলেন। অন্তরা রহমান চোখ রাঙালে রায়িন নজর ঘুরিয়ে নেয়। নিথি পিটপিট করে তাকিয়ে তাদের কর্মকান্ড দেখছে। যেন সে নিরব দর্শকের তালিকায় রয়েছে।
অন্তরা রহমান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রিং এর ছোট বক্সটি রায়িনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
–“এটা এখন নিথিকে পরিয়ে দিবে। ওর জন্যে আমি গয়না বানাতে দিয়েছি। আশা রাখছি শীঘ্রই পেয়ে যাবো। আমাদেরও তো ওর উপর দায়িত্ব আছে নাকি?”
রায়িন শীতল দৃষ্টিতে নিথিকে দেখে বিনা-বাক্যে বক্সটা হাতে নিয়ে নিলো। খুব আরাম করে রায়িন রিং টা বের করলো। রায়িনের রিং বের করার মুহূর্তে অদ্ভুত ভালো লাগায় নিথির সর্বাঙ্গে থেমে থেমে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো যেন। রায়িন উঠে এসে নিথির বাম হাত নিজের হাতে তুলে অনামিকা আঙুলে সেটা পরিয়ে দিলো।
——————–
গভীর রাত। রায়ার পাশে শুয়ে আছে নিথি। রায়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু নিথি নিদ্রাহীন, তার চোখে ঘুম ধরা দেয়নি এখনো। বেলকনির ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় পলকহীন তাকিয়ে রয় রিং টার দিকে। এখনো রিংটা হাতে চিকচিক করছে। নিথি নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় সেটাতেই। কেন যেন এটার মুগ্ধতা কমছে না। রায়িনের দেয়া প্রথম উপহার। অনুভূতিটা কেমন তা নাহয় অপ্রকাশিত থাক। নিথি এ পর্যন্ত কতবার আলহামদুলিল্লাহ পড়ে ফেলেছে তা অগণিত৷ প্রিয় মানুষটিকে নিজের করে পাওয়া, তার থেকে পাওয়া উপহার সবটাই নিথির কাছে এক অবাস্তব স্বপ্ন লাগছে। কেন এত সুন্দর রায়িন? তার এত সুন্দর তার কঠিনের মাঝে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব? মস্তিষ্ক উত্তর দিতে অক্ষম। বলা যায়, রায়িন মুগ্ধতার আরেক নাম। নিথি মিনমিন স্বরে গাইলো,
–“কোনো এক রূপকথার জগতে,
তুমি তো এসেছো আমার-ই হতে।”
রায়িনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে এলো নিথির, জানা নেই। ঘুম ভাঙলো আলোর তীক্ষ্ণ কিরণের ঝলকানিতে। নিথি পিটপিট করে তাকালো। বেশ ঠান্ডা লাগছে তার। কোনো মতে উঠে বসতেই দেখলো তার গা থেকে ব্ল্যাঙ্কেটটা সরে ডান পাশে গিয়ে জড়ো হয়েছে। সবকিছু বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো নিথির। পাশ থেকে রায়ার দিকে তাকালো। রায়া এখনো ঘুম। নিথি চারপাশে নজর বুলিয়ে কোথাও দেয়াল ঘড়ি বা ছোট ঘড়িও পেলো না। ফোনটাও নেই যে সময় দেখবে। হাই তুলতে তুলতে বিছানা হতে পা নামিয়ে বসলো। হাত টানটান করে আড়মোড়া ভাঙলো। ফ্রেশ হওয়া জরুরি। নিথি উঠে দাঁড়াতেই তার মনে পরে লাগেজ তো রায়িনের ঘরে। সেটাতেই নিথির তাওয়াল এবং জামা-কাপড় আছে। কী করা যায়? নিথি কী যাবে রায়িনের ঘরে? হয়তো রায়িন ঘুমাচ্ছে।
নিথির এক তীব্র আকাঙ্খা হৃদয়ে জেঁকে বসলো। ঘুমন্ত রায়িনকে একপলক দেখার আকাঙ্খা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, সে রায়িনের রুমে যাবে। রায়িনকে দেখাও হলো আবার ফ্রেশও হতে পারলো। নিথি আর দেরী করলো না। এলোমেলো চুল ঠিক করে মাথায় ওড়না টেনে বেরিয়ে পরলো রায়িনের রুমের উদ্দেশ্যে। রুমের কাছাকাছি আসতেই নিথি তার পা জোড়া ধীর গতিতে এগোতে লাগলো। পা টিপে টিপে ভেঁজানো দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। শব্দ ছাড়াই দরজাটা খুলে শুধু মাথা ঢুকালো এবং উঁকি দিয়ে বিছানায় নজর বুলালো। কিন্তু একি? রায়িন তো বিছানায় নেই! এবার নিথি মাথা সরিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়েও রায়িনকে কোথাও পেলো না। বেলকনিতেও নেই। পরমুহূর্তে নিথির খেয়াল যায় পরিপাটি, সাজানো বিছানার দিকে। আচ্ছা, রায়িন কী কোথাও বেরিয়েছে? হতেও পারে।
নিথির নিমিষেই মুখ ভার হয়ে গেলো। কোথায় ভাবলো ঘুমন্ত রায়িনকে দেখবে কিন্তু সাহেব তো রুমেই নেই। উদাসী মনে লাগেজ থেকে তাওয়াল এবং জামা-কাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো। ওয়াশরুমের দরজা লক করে পিছে ফিরতেই নিথি ভূত দেখার মতো চমকে গেলো। রায়িন তার থেকে কিছুটা দূরে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। রায়িনের চুলগুলো ভেঁজা, যা কপালে লেপ্টে আছে। নিশ্চয়ই সবে গোসল করেছে। তার চেয়েও ভয়ানক কান্ড হচ্ছে রায়িন উদোম শরীরে শুধু কোমড়ে একটি সাদা তাওয়াল পেঁচানো৷ রায়িনকে এ রূপে দেখে নিথির চোখ কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কোনো দিক না দেখে যেই চিৎকার দিতে যাবে ওমনি রায়িন ছুটে এসে নিথির মুখ চেপে ধরলো!
–“এই চুপ! নিজের সাথে আমারও ইজ্জতহরণ করবে নাকি? কথায় কথায় এত চিল্লাও কেন?”
নিথির এবার দম বেরিয়ে যাবে যাবে অবস্থা। রায়িনের সদ্য গোসল করা দেহের সঙ্গে সে লেপ্টে আছে! এ যে অবাস্তব, ভ্রম! এত বড়ো বিষ্ময়কর ঘটনা নিথি মানতে পারলো না। মানতে পারলো না তার ছোট্ট মস্তিষ্ক। ধীরে ধীরে বুজে এলো নিথির চোখ জোড়া। ঢলে পরলো রায়িনের বুকে। রায়িন বেসামাল ভাবে নিথিকে আঁকড়ে ধরলো। নিথিকে না ধরলে যেন পরেই যেত। এবার যেন রায়িন বিষ্ময় আকাশচুম্বী। নিথির জ্ঞানহীন মুখটার দিকে তাকিয়ে মিনমিন স্বরে আওড়ায়,
–“কী হলো ব্যাপারটা? এভাবে জ্ঞান হারালো কেন? আশ্চর্য! মানসিক রোগী নাকি এই মেয়ে? ওহ গড!”
—————————
~চলবে, ইনশাল্লাহ!