কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা পর্ব ১৬+১৭

0
495

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [১৬+১৭]
লাবিবা ওয়াহিদ

——————————-
সকাল আনুমানিক পৌণে সাতটা। ধরণীতে ধীরে ধীরে আঁধারিয়া কাটিয়ে নতুন আলোর আগমন ঘটছে নির্বিঘ্নে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেও আবছা আলোর রেশ থাকলেও এখন ঝকঝকে সকালে পরিণত হয়েছে৷ পক্ষী’রা মনানন্দে কিচিরমিচির করতে করতে এদিক সেদিক ছুটছে। ব্যস্ত শহরে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে। কলিংবেলের শব্দে শারমিন আক্তার রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। চোখ-মুখ তার অসম্ভব লাল। মেয়ের চিন্তায় তার চোখে দীর্ঘ রজনীতে ঘুম ধরা দেয়নি। তার চেয়েও বড়ো কথা, সে মেয়েটার সাথে অন্যায় করেছে, চরম অন্যায়। স্বামীর অনুস্থিতিতে যেই পরিবারকে আপন ভেবেছিলো সেই পরিবার-ই তার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করলো আর তার চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না৷ সে একজন ব্যর্থ মা। এ নিয়ে গতরাতে অসুস্থও হয়ে পরেছিলো। পাশের বাড়ির ভাবী তার সেবা না করলে এখন হয়তো অবস্থা অবনতির দিকে যেত। আদনও এখনো ছোট। সে একা হাতে সব সামলাতে ব্যর্থ ছিলো। আফিয়ার বিয়েটা সুষ্ঠুভাবে হলেও রায়িন এবং নিথির কথা পুরো মহল্লায় বাতাসের বেগে ছড়িয়ে গেছে। হয়তো আজ একেকজন করে এসে সার্কাসের মতো ঠাট্টা করবে, খোঁচা মেরে কথা বলতে আসবে। এছাড়া এই সমাজ কী পারে? দেখা গেলো বেলা গড়াতেই তাদের আনাগোনা শুরু হবে।

শারমিন আক্তার ভেবে নিলো এখন থেকে হয়তো তাদের আনাগোনার সূচনা। তাই নিজেকে শক্ত করে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হয়। খট শব্দে দরজা খুলে সামনের আগন্তুকটিকে দেখতেই তিনি চমকে উঠলেন। দরজার সামনে যে নিথি দাঁড়িয়ে। ভাবলেশহীন নিথি শারমিন আক্তারকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। শারমিন আক্তার কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই নিথি নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলে ওঠে,
–“আমি ঘুমাবো৷ কেউ ডাকবে না। আদনকেও বলে দিবা যেন আমাকে জ্বালাতে না আসে! গুড নাইট!”

বলেই রুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। নিথির এমন স্বাভাবিক আচরণে শারমিন আক্তার একটু নয় বরং অনেকটা চমকে গেলেন। মেয়ে ফিরে আসলো কেন শ্বশুরবাড়ি থেকে? প্রশ্নটা যেন বাজেভাবে গেঁথে রইলো।

বেলা এগারোটা। আজ শারমিন আক্তার ছুটি নিয়েছেন গার্মেন্টস থেকে। আদন স্কুলে গিয়েছে। আদন এখনো জানে না তার আপু ফিরেছে। গতকাল থেকে আদনেরও খুব মন খারাপ। তার আপুকে একবারও দেখেনি সে। ঘটনাস্থলেও আদন ছিলো না। শারমিন আক্তার রান্না-বান্না করার সময়ই কলিংবেল বেজে ওঠে। শারমিন আক্তার ত্রস্ত পায়ে চলে গেলো সদর দরজার উদ্দেশ্যে। দরজা খুলতেই দেখলো চার তলার ইউনিট তিন এর ভাবী এসেছে। চেহারায় রসিক ভাব প্রকাশ পেয়েছে নির্বিঘ্নে। শারমিন আক্তার বুঝেছেন তার উদ্দেশ্য। তাও ফ্যাকাসে মুখটায় কৃত্রিম হাসির রেখা টেনে বলে,
–“আরে ভাবী, আসুন!”

মহিলা আসলো। আরাম করে সোফায় বসলো।
–“তা ভাবী শুনলাম আপনার মেয়ে ন’ষ্টামি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে? বিয়েও নাকি দিয়ে দিয়েছেন! ঘটনা কী সত্য?”

শারমিন আক্তার প্রতিউত্তর কী দিবেন বুঝলেন না। হাসির রেশটাও তার বিলুপ্ত হয়েছে। মহিলা পুণরায় তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
–“এক মেয়ে আপনার মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলো। এখন কী মেয়েকে কোনোদিন ঘরে তুলবেন নাকি সারাজীবন জামাইর বাড়িতেই ফেলে রাখবেন? আমার মতে না উঠানোই ভালো। এমন মেয়ে আমার হলে প্রথমেই জিন্দা পুঁ’তে দিতাম।”
–“ঘরে তো অলরেডি উঠিয়ে রেখেছে আন্টি। আপনার শুধু শুধু জ্ঞান দেয়ার কী দরকার শুনি?”

মহিলা চমকে মাথা উঁচু করে সামনে তাকালো। নিথি তখন হাই তুলতে তুলতে রুম থেকে বের হচ্ছে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠার ফলে তার চোখ ফুলে আছে। মহিলা যেন ভূত দেখার ন্যায় চমকে ওঠে। আমতা আমতা করে বলে,
–“আপনার মেয়ে আপনার বাড়িতে নাকি ভাবী?”
–“কেন দেখতে পারছেন না? জলজ্যান্ত আমি-ই তো আপনার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। তা আন্টি কী বলছিলেন কেন? আমি ন’ষ্টামি করতে গিয়ে ফেঁসেছি? তা আপনি বুঝি খুব খুশি?”

মহিলা থতমত খেয়ে গেলো। নিজেকে সামলে শারমিন আক্তারের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বললো,
–“আপনার মেয়ে তো ভারি বে’য়া’দব! অন্যায় করেও মুখে মুখে তর্ক করছে? নির্ঘাত এর বে/য়া/দবি দেখেই বিয়ের পরেরদিন বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিছে!”
–“সেটা আমরা বুঝে নিবো ভাবী। আপনি আসতে পারেন। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আপনি আমার মেয়েকে হেনস্তা করবেন সেই অধিকার আমি আপনাকে দেইনি!”

মহিলা অপমানবোধ করলেন। তাই কিছু না বলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলেন। নিথিও বিনা-বাক্যে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে অনেকেই ভেতরে তাকিয়েছে যা প্রচন্ড অস্বস্তিদায়ক। তার চাহনি ছিলো এমন যেন এই ফ্ল্যাটে সার্কাস চলছে। নিথি দরজা আটকে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“নাস্তা দাও। খুদা পেয়েছে! আমি ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে আসছি!”

বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো। টেবিলের উপর ভাঙ্গা ফোনটা দেখে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আসার সময় রাস্তায় পরে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। নিথির আফসোস হচ্ছে এই ভেবে রায়িনকে সে দেখতে পারবে না। বেশ কিছু ছবি যে ছিলো ফোনটিতে। মুহূর্তে-ই চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো তার। নিজেকে সামলে নিথি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। তাকে শক্ত হতে হবে। লড়তে হবে এই কঠিন সমাজের সাথে। তবে রায়িনকে ডিভোর্স দিলেও তাকে নিরবে ভালোবেসে যাবে সারাজীবন। কে বলেছে ভালোবাসা শুধু পাওয়াতেই থাকতে হবে? ভালোবাসার মাধুর্যতা যে ভালোবাসার মানুষটাকে সুখী থাকতে দেখা। এর চেয়ে সুখের আর কী হতে পারে? গতকাল দুপুর পর্যন্তও নিথি ভেবেছিলো ভালোবাসলেই তাকে পেতে হবে, তার সাথে জীবন কাটাতে হবে। পরবর্তীতে রায়িনকে যখন পেলো, পুরো রাত রায়িনের অবহেলা সহ্য করলো তখনই উপলব্ধি করলো ভালোবাসা পেতে নয় বরং ভালোবাসার মানুষটাকে সুখে দেখাটাতেই প্রশান্তি। অপ্রত্যাশিত বিয়েটা নিথি কিছুটা মেনে নিতে পারলেও রায়িন একদমই মানতে পারেনি, যা নিথি বেশ ভালো করেই বুঝেছে। তাইতো ফিরে এলো নিজ নীড়ে।

——————————
মেয়ের মুখে সমস্ত সত্য ঘটনা জানতেই শারমিন আক্তারের চোখ ভিঁজে গাল গড়িয়ে জল পরতে লাগলো। নিথি তখন শক্ত মনে নাস্তা করছে। শারমিন আক্তারের আফসোস হচ্ছে, চরম আফসোস৷ যদি একটাবার সাহস করে মাইনুল হোসেনকে বলতে পারতো, একবার জানতে চাইতো নিথির সাথে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনাটি। তাহলে এই দিন দেখতে হতো না! সবকিছুর জন্যে শারমিন আক্তার এখন নিজেকেই দায়ী করছে। খাওয়া শেষে নিথি মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“তৈরি হয়ে নাও মা!”
–“হঠাৎ? কিন্তু কেন?”
–“থানায় যাবো!”

শারমিন আক্তার যেন আকাশ থেকে পরলেন। নিথি তখনো ভাবলেশহীন। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে,
–“এত বড়ো অন্যায় হলো আমার সাথে। আসল অন্যায়কারীকে আমি ছেড়ে দিবো? এত সহজ? তুমি চলো তো! আমি পারব না ওই জা/ নো/ য়ারকে নির্দোষ হয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখতে!”

শারমিন আক্তার বুঝলেন। তার মনে যেই ক্রোধ এবং ঘৃণা চেপেছে তা এখন বের করার পালা। নিথি বোরকা হিজাব পরে রেডি হয়ে নিলো। আগে বোরকা হিজাব না পরলেও এখন তার মন বলে সে বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে ওভাবে চলাফেরা করা মানায় না। এছাড়া বিয়েটা ভিত্তিহীন হলেও তার অশান্ত মন তা মানতে নারাজ। তাই মনের সাথে যুদ্ধে হার মেনে নিথি বোরকা, হিজাবেই নিজেকে আবৃত করলো। দুই মা-মেয়ে বের হলো নিকটবর্তী থানার উদ্দেশ্যে। অফিসারকে নিথি সবটা খুলে বললো এবং বুঝালো। এছাড়া নিথি একজন মহিলা কর্মচারীকে আলাদা করে তার কাঁধের আঁচড়টাও দেখালো। মহিলা কর্মচারী থেকে অফিসার শিওর হয়ে বেরিয়ে পরলো অপরাধীর উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে অফিসারের অজানা কারণে মুখটা চিকচিক করছিলো, কিন্তু কেন তা নিথির ঠাওর হলো না।

থানা থেকে বেরিয়ে নিথি গেলো তার চাচাদের বাড়িতে। বর্তমানে নিথি মাইনুল হোসেনের মুখোমুখি বসে আছে। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে নিথি বলতে লাগলো,
–“পর কোনদিন আপন হয় না, তাই না জেঠু? আপনি এবং সাজিদ ভাই আসলেই গতকাল তা প্রমাণ করে দিলেন। বাবা সমান আপনাকে এবং সাজিদ ভাইকে বড়ো ভাইয়ের মতো নিজের ভরসা ভাবতাম। সেই আপনারাই নিজ স্বার্থে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন। শুধু আমার কেন? আমার রায়িন স্যারের জীবনও। একবারও জানতে চাইলেন না আসল ঘটনা কী? আমার জায়গায় আফিয়া আপু বা মোহনা থাকলে কী করতেন? একই ভাবে ট্রিট করতে পারতেন? দুইটা জীবনের চেয়ে আপনাদের মান-সম্মান, ইজ্জত বড়ো হয়ে গেলো? আমার এই অবস্থার জন্যে দায়ী কে জানেন? আপনার মেয়ে জামাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। সে এসেছিলো আমার সাথে অস’ ভ্যতামি করতে। যদি রায়িন স্যার ঠিক সময়ে দরজা না ভাঙ্গতো তাহলে আমার সতিত্ব নষ্ট হতো, কালো এক কলঙ্ক লাগতো। আমায় বাঁচিয়ে রায়িন স্যার কী পেলো? একগাদা অপমান এবং লাঞ্ছনা! এমনকি আমার সাথে জোর করে বিয়েও দিয়ে দিলেন। স্যারে’রা কী সবসময়ই খারাপ হয় জেঠু? একজন শিক্ষক যুবক হলেই তার চরিত্রে দোষ? অথচ এই যুবক’রাই আমাদের ভাই-বোনদের পড়িয়ে উচ্চ শিক্ষিত করেছে। তাদের জ্ঞান আছে যেটা আমাদের সমাজের নেই। ওই মহিলা গুলোর কোনদিন জ্ঞান-বুদ্ধি ছিলো? সমাজ না বুঝে সবসমই তিল কে তাল বানাতে জানে। সেটা তাদের ভয়ংকর রকম বাজে স্বভাব। তাদের কথা শুনে আপনি কেন এরকম অবুঝের মতো কাজ করে বসলেন? আমি আর কী বলবো। আপনি সবসময় আমাকে এবং আমার মাকে পর ভেবেছেন, তাইতো বাইরের মানুষের কথা আগে বিশ্বাস করেছেন, আমাদের নয়।”

বলেই নিথি উঠে দাঁড়ায়। গলা ধরে আসছে তার। শারমিন আক্তার এক জায়গায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ চোখের জল ফেলছে। নিথির বড়ো জেঠীও তাই। মাইনুল হোসেন তখন চুপ করে বসে আছে। বাড়িভর্তি মেহমান। নিথির কথাগুলো কমবেশি সকলেই শুনেছে। মোহনা অদূরে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘটনা কী না সে জানতে চেয়েছে আর না জানতে চায়। নিথির সাথে রায়িনের বিয়ে হয়েছে। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে?

নিথি তার ভিঁজে আসা চোখের কোণ হালকা করে মুছে আবারও বলে,
–“আপনাদের দেয়া ভালোবাসাও যেমন কোনোদিন ভুলবো না তেমনই আপনাদের দেয়া জখম আমি কোনোদিন ভুলবো না। আজকের পর থেকে এই চরিত্র*হীনা মেয়ের পরিবারের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ না রাখার অনুরোধ। ইভেন আমরা মরে গেলেও কেউ খবর নিবেন না। চলো মা।”

বলেই নিথি শারমিন আক্তারের সাথে গুঞ্জনে ভরা বিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে পরলো। মাইনুল হোসেন সেখানেই থমকে বসে রয়। নিথির বলা কথাগুলো তাকে চরমরকম আঘাত করেছে।

পুরো দুইদিন কেটে গেলো। জামানকে জেলে ভরলেও কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ছেড়ে দেয়ার কারণ হিসেবে দেখায়,
–“উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া তারা কাউকে জেলে রাখতে পারবে না!”
কিন্তু আসল কারণ হচ্ছে অফিসারকে মোটা অঙ্কের টাকা খাওয়ানো হয়েছে। টাকার কথা শুনেই নিথির বুঝতে বাকি নেই অফিসারের রহস্যময় হাসির কারণ। নিথি যেন কিছুটা ভেঙ্গে পরলো। সে কী কোনদিন সঠিক বিচার পাবে না? টাকা ছাড়া এই জীবনের কী কোনো মূল্য নেই? এছাড়া জামান তাকে হুমকি দিয়েছে। সেদিন যা করেনি তা সে একদিন না একদিন করবেই। এ কথা শারমিন আক্তারেরও কানে এসেছে। এতে শারমিন আক্তার ভিষণরকম ভয় পায়। মেয়ের খা’রা’প সে কিছুতেই হতে দিবে না। কোন মা জেনেশুনে তার মেয়ের দুর্দিন দেখতে চাইবে? তাইতো শারমিন আক্তার সিদ্ধান্ত নেন এই ফ্ল্যাট সে ছেড়ে দিবেন। অন্য কোথাও থাকবেন আর এই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে দিবেন। এটা ছিলো শারমিন আক্তারের বাবার দেয়া শেষ সম্বল। তাই সে চাইলেও এটাকে বিক্রি করতে পারবেন না।

নিথি ভার্সিটি যাবার সময় শারমিন আক্তার বলে ওঠেন,
–“আগামীকাল-ই নতুন বাড়িতে উঠবো আমরা। আমার এক কলিগ এই বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে। তাই আমি আর দেরী করতে চাই না!”

নিথি বিরক্ত হলো, চরম বিরক্ত। ভয়টা তার মাঝে কাজ করলেও সে কখনোই চায় না এই ফ্ল্যাট ছাড়তে। কিন্তু মায়ের ধমকে নিথি আর কিছু বলতে পারলো না। বেরিয়ে পরলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। ভার্সিটি যাওয়ার সময় অনেক কটুবাক্য হজম করতে হয়েছে তাকে। এমনকি পাড়ার টেন-ইন্টারের ছেলেরাও তাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছে। যা ভিষণ বেদনাদায়ক।

ভার্সিটি থেকে ফিরে বৈঠকঘরে রায়িনকে দেখে নিথির মাথাতে যেন আকাশ ভেঙ্গে পরলো। রায়িন তার বাড়িতে কী করছে? নিথি শুকনো ঢোঁক গিলে। পরমুহূর্তে তার মনে পরে ডিভোর্সের কথা। শিট! জামানের কেস নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কোর্টে যেতে সে ভুলেই গেছিলো। নিশ্চয়ই ডিভোর্স নিয়ে কথা বলতে এসেছে? নিথি ত্রস্ত পায়ে সোফার দিকে এগিয়ে গেলো। রায়িন তখন হাতে রিমোট নিয়ে টিভিতে নিউজ দেখছে। শারমিন আক্তারকেও আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। আদনও স্কুলে। নিথি আমতা আমতা করে বললো,
–“আমি আজই ডিভোর্স পেপারের জন্যে কোর্টে যাবো। তাই আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যেতে পারেন!”

নিথির আটকে যাওয়া কন্ঠ শ্রবণ হতেই রায়িন তড়িৎ নিথির দিকে তাকালো। চোখে রায়িনের চিকন ফ্রেমের চশমা। রায়িনের চাহনি নিষ্প্রভ। নিথিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে নিথির প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললো,
–“দু’দিন ধরে ফোন ধরছিলে না কেন?”

নিথি যেন আসমান থেকে টপ করে জমিনে পরলো। মাথাটাও কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো তার! অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“এ্যাঁ?”

——————————-

[১৭]

————————————-
–“দু’দিন ধরে ফোন ধরছিলে না কেন?”

নিথি যেন আসমান থেকে টপ করে জমিনে পরলো। মাথাটাও কেমন ঝিমঝিম করছে নিথির! এমতাবস্থায় অস্ফুট স্বরে আওড়ায়,
–“এ্যাঁ?”

রায়িন চোখের চশমাটি খুলে বাম হাতের মুঠিতে বদ্ধ করলো। অতঃপর পুণরায় নিথির পানে তাকিয়ে বেশ শীতল স্বরে বলে,
–“আমি তো ভেবেছিলাম সিনেমাটিক মেয়েদের মতো স্বামীকে ফেলে অন্য শহরে অথবা দেশের অপর প্রান্তে গিয়ে বসতি গড়বে এবং নিজেকে গড়ে ফিরবে। এজন্য বলা যায় একপ্রকার দিশেহারা হয়ে গেছিলাম যে কোন প্রান্ত থেকে তোমায় খোঁজা শুরু করবো! দু’দিন ধরে তোমায় ফোনেও পাচ্ছি না। ভাবলাম তোমার মায়ের সাথে কন্টাক্ট করবো, সরাসরি। পরে এখানে এসে শুনি তুমি এখানেই আছো। অদ্ভুত না? চিন্তায় দুনিয়া উদ্ধার করর ফেললাম আর তুমি এখানে! রা*বি*শ!”

শেষোক্ত বাক্যে রায়িনের মুখশ্রীতে রাগ প্রকাশ পেলো৷ নিথি কেমন অভিব্যক্তি দেখাবে বা দেখানো উচিত বুঝলো না। যেন হাসলেও তার পাপ হবে তেমন কাঁদলেও তার পাপ হবে। একপ্রকার বাক্যহারা হয়ে গোল গোল চোখে রায়িনের দিকে তাকিয়ে রইলো। রায়িন নিথির সামনে চুটকি বাজালো। নিথি চমকে উঠলো। কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“কেন এসেছেন? ডিভোর্স তো পাঠিয়ে দিবো বলেছি!”
–“এই মেয়ে, তোমার থেকে ডিভোর্স কে চেয়েছে? দ্রুত রেডি হয়ে চলো আমার সাথে! শুধু শুধু কম পীড়া দেওনি তুমি!”

নিথি টাস্কি খেয়ে রায়িনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে পীড়া দিয়েছে মানে কী? নিথি তো রায়িনকে মুক্তি দিয়েই আসলো। এখানে পীড়ার তো কিছুই দেখছে না।
–“এক সেকেন্ড! পীড়া দিয়েছি মানে কী? আপনাকে তো আমি জ্বালাইনি!”

এবার রায়িন চোখ রাঙিয়ে নিথির দিকে তাকালো। নিথি রায়িনের চোখে তাকাতেই আঁতকে উঠলো। কী সেই ভয়ংকর চাহনি, যেন সেই চাহনি দ্বারা তাকে ভষ্ম করে দিবে, ছাড়খাড় করে দিবে, খেয়ে ফেলবে ইত্যাদি। নিথির বুলি সেখানেই থেমে গেলো। অবশেষ কথা গলা দিয়ে বের হলো না। উল্টো বের যেন না হয় তার জন্য মুখে কুলূপ এঁটেছে! এর মাঝে শারমিন আক্তার আসলো। হাতে তার কফি। নিথির দিকে তিনি না তাকিয়ে টি-টেবিলে কফির ট্রে-টা রেখে বলে,
–“এ কী জামাই? এই দুপুরবেলা শুধু কফি খাবে? লাঞ্চটা আমাদের এখান থেকেই সেরে যেতে!”

রায়িন নিথির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শারমিন আক্তারের দিকে তাকায়৷ ফিচেল হাসি দিয়ে বলে,
–“মা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। পইপই করে বলে দিয়েছে, যতক্ষণ না তার বাড়ির বউকে নিয়ে ফিরবো ততক্ষণে ও বাড়িতে ভাতের পাতিল চুলোয় উঠবে না!”

শারমিন আক্তার শব্দ করে হেসে দিলেন। রায়িন হাসলো তবে নিঃশব্দে। নিথি নিরব দর্শকের মতো সব দেখছে। তার ভেতরটা বড্ড খুঁচখুঁচ করছে। সে মোটেও রায়িনের এই অস্বাভাবিক আচরণ মানতে পারছে না। রায়িনের উদ্দেশ্য কী? কেন এমনটা করছে?

শারমিন আক্তার হাসি থামিয়ে মেয়ের দিকে তাকালো। তার চাহনিতে স্পষ্ট মুগ্ধতা। হোক না বিয়েটা একটা দুর্ঘটনা। তাও তো রায়িনের পরিবার নিথিকে কত সুন্দর করে মেনে নিলো, বুঝলো। সত্যি-ই তারা মহান।

নিথি এবার সাহস সঞ্চার করে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–“মা, ওনাকে বলে দাও চলে যেতে। আমি কেন যাবো তার সাথে?”
–“এই চুপ! জামাই যা বলছে তাই করবি। যা গিয়ে চুপচাপ রেডি হয়ে নে। তোর বুঝি খুহ ভালো লাগছে চারিপাশের মানুষের কথাবার্তা হজম করতে?”

নিথির মুখ ভার হয়ে এলো মায়ের কড়া কথাতে। নিথি কিছুক্ষণ চুপ করে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। নিথিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শারমিন আক্তার ভ্রু কুচকে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
–“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা!”
–“আমি সবেই বাইরে থেকে ফিরেছি মা। আলাদা করে রেডি হওয়ার কী আছে? ওনার তাড়া থাকলে এভাবেই নিয়ে চলুক আমাকে!”

রায়িন কিছু বললো না ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিতে দিতে কোণা চোখে নিথিকে দেখছে। মুখোশ খোলা মুখশ্রীতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। নাক আর গালও কেমন লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই গরমে। রায়িন দৃষ্টি ঘুরিয়ে কফিটা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই আদন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে। যখন শুনলো বোন চলে যাচ্ছে আদনকে তখন কেউ-ই থামাতে পারছে না। এক নাগাড়ে ছোট প্রাণটা কেঁদে যাচ্ছে।
–“না। আমার আপু কোথাও যাবে না। আমি আমার আপুকে কোথাও যেতে দিবো না আম্মু। তুমি প্লিজ স্যারকে বলো না!”

————————–
নিথি একমনে বাইরে তাকিয়ে আছে। রায়িন এক হাতে স্টেয়ারিং ঘুরাচ্ছে তো কোণা চোখে নিথিকে দেখছে৷ নিথির চোখ ফুলে আছে এখনো। প্রিয় ভাইটার জন্যে সে নিজেও কেঁদেছে। গতবারের অপূর্ণ বিদায় যেন আজ পূর্ণ হলো। মায়ের এবং ছোট ভাইয়ের গলা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছে। গাড়িতে অবস্থান করছে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। প্রগাঢ় নিস্তব্ধতাকে প্রত্যাখ্যান করে নিথি বলে ওঠে,
–“কেন নিয়ে যাচ্ছেন আপনার বাড়িতে? সাময়িক দয়া দেখাতে? আমি তো জানি আপনি বিয়েতে একদমই রাজি ছিলেন না, আমাকে আপনার মেনে নেয়াও সম্ভব না। তাহলে কেন ফিরে আসলেন? আমি তো ডিভোর্স দিবই বলেছিলাম, তাহলে আপনার সমস্যাটা কোথায়?”

রায়িনের তরফ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। নিথি ক্ষণিক সময় রায়িনের গম্ভীর মুখশ্রীতে তাকিয়ে রয় উত্তরের অপেক্ষায়। রায়িনের নিশ্চুপ আচরণে নিথি হতাশ হয়ে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। রায়িনের পক্ষ থেকে উত্তর আসলো আরও দশ মিনিট নিরবতার পর। রায়িন বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
–“জানো। আমার দাদী সবসময় বলতো, বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন। এটা সম্পূর্ণ-ই উপরওয়ালার ইচ্ছে। ভাগ্যে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে যে লিখা থাকবে তাকেই মেনে নিতে হবে। চাইলেও বিয়ে নামক দায়িত্ব হতে কেউ পিছু হঁটতে পারে না। আমি দাদীর কথাগুলো মন থেকে কদর করতাম। তাইতো কখনো পারিনি কাউকে পছন্দ করতেন কিংবা ভালোবাসতে। কিন্তু তুমি বর্তমানে আমার বিবাহিতা স্ত্রী। আমার অন্যতম দায়িত্ব। সেটা আমি না ভুলেছি আর না ভুলতে পারবো। যেই পরিস্থিতিতে আমাদের বিয়ে হয়েছে তাতে হয়তো তোমায় মানতে পারিনি। তাই বলে মানিয়ে নিতে পারবো না এমন তো নয়। বিয়ে হয়ে আবার ছাড়াছাড়ি, এই বিষয়টা আমার জন্যে বড্ড বিরক্তিকর।”

নিথি মুগ্ধ হয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে রয় রায়িনের দিকে। এতদিন ভাবতো গম্ভীর মানুষটা শুধু রাগ দেখাতে জানে। কিন্তু আজ বড়ো কিছুর ভাগিদার হলো সে। রায়িন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানব। এমন এক মানব যে নিথির কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। লোকটা শক্ত ব্যক্তিত্বের হলেও তার ভাবনা সুন্দর, খুব সুন্দর। নিথির খুব ইচ্ছে হলো রায়িনের দাদীর পা ধরে সালাম করতে। কিন্তু রায়িনের দাদী আছে জীবিত? নিথি প্রশ্ন করলো,
–“আপনার দাদী…”
–“নেই। আমি কলেজে ওঠার পরপরই তিনি মারা যান!”

নিথি রায়িনের দিকে তাকিয়েই রইলো। নিথি এবার মনে মনে ঠিক করেছে মোনাজাতে তার দাদীর জন্যে এত এত দোয়া করবে। নিথি যে রায়িনের দাদীর কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন বলেই তো রায়িন এতটা ভদ্র। নইলে বর্তমান যুগে বিয়েটা কমবেশি সবার কাছেই হাতের মোয়া। রোজ শোনা যায় হাজারও ডিভোর্সের গল্প। বর্তমানে ডিভোর্সের কোনো কারণ লাগে না। আধুনিক যুগ, কতকিছুই না হয় এই যুগে।

নিথি পুরোটা রাস্তা ঘুমিয়ে কাটালো। রায়িনকে দেখতে দেখতে কখন যে চোখ লেগে আসে বুঝতে পারেনি। ঘুম ভাঙ্গলে নিথি নিজেকে গাড়িতেই আবিষ্কার করলো। গাড়ি চলছে না, স্থির। নিথি আশেপাশে তাকালো। প্রায় সন্ধ্যা নেমে গেছে। ড্রাইভিং সিটে রায়িন নেই। কোথায় গেলো রায়িন? বাইরে দেখতে দেখলো রায়িনদের মতো একটা বাড়ি। এর মানে কী নিথি রায়িনদের বাড়িতে চলে এসেছে? নিথি সিটবেল্ট খুলে জানালার কাঁচ নামালো। ঠিক তখনই রায়িন টি-শার্ট এবং টাউজার পরে বাড়ি থেকে বের হলো। হ্যাঁ গাড়ির দিকেই আসছে সে। নিথিকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে রায়িন বললো,
–“ঘুম ভাঙ্গলো? আমি তো ভাবলাম গাড়িতেই রাত পার করে দিবে!”

নিথি চোখ বড় বড় করে রায়িনের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো,
–“আমায় ডাকেননি কেন?”
–“ডাকিনি তোমায়? বাড়িতে ফিরেছি বিকেলে। আধঘন্টার মতো বসে ছিলাম গাড়িতে তোমার ঘুম ভাঙ্গার আশায়। তাও তোমার হুঁশ নেই। তাই ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে চলে গেছি। ফ্রেশ হয়ে আবার ফিরেছি৷ মা আর রায়া নেই যে তারা তোমায় ধরে ভেতরে নিয়ে যাবে!”

নিথির মুখ ঘুচে এলো। ঘুমোচ্ছিলো বলে তাকে ফেলে বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবে? এটা কেমন নীতি? এছাড়া এই গভীর ঘুমেরও কারণ আছে। গত দুই রাত চিন্তায় চিন্তায় ঘুম হয়েছিলো নাকি? রায়িনকে দেখেই তো তার সব কষ্ট বিলুপ্ত হয়ে চোখ জোড়ায় ঘুম ধরা দিয়েছিলো।
–“এইযে ম্যাডাম? বের হবেন না?”

নিথি থতমত খেয়ে গেলো। রায়িন ডোর খুলে দিলে নিথি ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে এলো। বাড়ির দিকে যেতে যেতে বললো,
–“আন্টি এবং রায়া কোথায়?”
–“রায়াকে সাইকোলজিস্ট এর কাছে নিয়ে গেছে!”

নিথি আর প্রশ্ন করলো না। রায়িনের সাথে ভেতরে ঢুকতেই রায়িন বললো,
–“তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো। আমি লিভিংরুমে আছি।”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here