#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৩০)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
আকাশটা কালচে মেঘে ঢাকা। সারাবেলা নীলাভ মেঘে ঢাকা ছিল। বিকেল হতেই মেঘের কবলে ডুবল আকাশ। আজকের আকাশে কেমন যে বিষন্ন ভান, ঠিক তাহিয়ার মনের মতোই। বিষন্ন মুখ, বর্ষামুখর চোখ, দৃষ্টি ভরা উদাসীনতা ওর। ভাবনায় বিচরণ মন হরণকারী এক হলদেটে সুদর্শন যুবকের। কানে বাজছে ‘হিয়া’ শব্দটা। আজ চারদিন হলো, শব্দটা শোনা হয়নি। খুনসুটিতে মেতে থাকা হয়নি। সুদর্শন যুবক তার সাথে আড়ি দিয়ে লুকিয়েছে নিজ ঘরে। দেখা নেই, কথা নেই, কল দিলে ধরার নামটাও নেই। কারণটা যে নিজের করা পড়ালেখার অবহেলা তা দিন তিনেক আগেই ধরতে পারছে তাহিয়া। ভেবেছিল অভীক ওকে ভালোবাসে, ও হেয়ালি করলেও কিছু বলবে না। আর যাই হোক অন্তত পড়ালেখার জন্য রাগারাগি করবে না। ওর ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণ করে সেটাই করল। পড়ালেখাকে কেন্দ্র করেই প্রথমবারের মতো সম্পর্কে বিরহ টানল অভীক। রাগটা অভীকের পক্ষ থেকে বলে অভীক নিজের মনকে শক্ত রেখে কথা না বলে থাকতে পারছে, কিন্তু তাহিয়ার পক্ষ থেকে তো রাগের আভা নেই। ও বিনা পূর্বাভাসে আসা বিরহ সহ্য করতে পারছেনা। দগ্ন হচ্ছে বিরহের আগুনে। কেমন অস্বস্তি, অশান্ত, শ্বাসরুদ্ধকর লাগছে। কিছুই ভালো লাগছে না। নিরবতার থাবার ভয়াবহতা টের পাচ্ছে, রাগ প্রকাশ না করেই ওকে বিরহে ঠিকই দগ্ন করছে। তাহিয়ার মনে হচ্ছে, এর থেকে রাগ প্রকাশ করলেই ভালো হতো।
টেবিলে গালে হাত দিয়ে বসে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে তাহিয়া। এই কাজেও অনিহা আসছে। মনটা বিরহে মাতছে। কলম ধরেছে বিরহের,
‘আমার জীবনে বসন্ত হয়ে এসেছিলে তুমি,
বসন্তের প্রাকৃতির মতোই রঙিন রূপে সেজেছিলাম আমি।
যেই ক্ষণে তোমার দেয়া বসন্ত রূপে জীবন মগ্ন,
সেইক্ষণে তুমি এনে দিলে শ্রাবণের প্লাবন লগ্ন।
দৈবাৎ তুমি হারিয়েছিলে আক্রোশের আজ্ঞাবহে
আমায় একাকিত্ব উপহার দিয়ে তুমি মিশেছিলে কুহেলিকায়।
তুমি চেয়েছিলে একাকিত্ব আমায় হাতছানি দিক,
আজ আমি একাকিত্বের সান্নিধ্যে দাঁড়িয়ে তোমার অপেক্ষায় আপেক্ষিক।
শীতাতপ কোমল প্রভাতে শিশিরবিন্দু স্পর্শ করার মাঝে আমি তোমার অপেক্ষা করি,
বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে খোঁপায় গাজরা গুজে তোমার ফেরার পথ চেয়ে থাকি,
বর্ষার বৃষ্টিমুখর গোধূলিতে আমার বৃষ্টিস্নানের সঙ্গী তোমায় খুঁজি,
শরতের ভরদুপুরে শুভ্র কাশফুলের মাঝা তোমায় খুঁজে ফিরি।
তুমি ফিরবে বলে মনের দুয়ার খোলা রাখি,
তুমি আসবে বলে বরণ ঢালা সাজিয়ে রাখি।
তুমি ফিরবে বলে বকুল মালা গাঁততে থাকি,
তোমায় শুনাব বলে তোমার নামে কবিতা লিখি।
তুমি কি ফিরবে আমার দেশে?
আমার অস্তিত্বে আবির ছড়াবে আবার নানা বেশে?
কুহেলিকার চাদর সরিয়ে শুনবে কি আমার কথা?
আমি যে আজও বুনি তোমার নামের প্রেম কাঁথা। ‘
[© আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা। সূত্র- নীলাচল নীলিমা- বই।]
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতার ‘তোমার অপেক্ষায়।’ কবিতাটা তাহিয়ার মনের ক্যানভাসে ভাসছে মলিন অক্ষরে। লোকটা কবে স্বাভাবিক হবে? কী করলে ওর উপর রাগ পড়বে? আচ্ছা, যেই কারণে রাগ করেছে, সেই কারণটা সমাধান করলে হবে? পড়ালেখার কারণেই তো বিচ্ছেদ টানল অভীক। এখন তাহিয়া যদি পড়ায় মনোযোগী হয় তবে অভীক কি স্বাভাবিক হবে? অবশ্যম্ভাবী। তাহলে তাই হোক। পড়ালেখা কারণে আসা ঝড় থেকে শিক্ষা নিয়ে পড়বে, অমনোযোগিতা দূর করে পড়ায় মনোযোগ দিবে। আর জীবনেও পড়ালেখায় অমনোযোগী হবে না। যাই হোক, অভীক যেন ওর থেকে মুখ ফেরাতে না পারে । এই বিরহ সহ্য করার নয়, আবার ডেকে আনার ও নয়। চিরতরে নিঃশেষ করার। কাল ট্যুরে গেলে তার নেয়া পণ এবং তার পদক্ষেপ দেখিয়ে মানাতে হবে অভীককে। যেভাবেই হোক। ওকে পড়তে হবে। অভীকের জন্য, ওর মনের শান্তির জন্য।
চোখ মুছে বিরহ মনেই পড়তে বসল তাহিয়া। মনোযোগ দিয়ে পড়ল অনেক্ষণ। আবেগ মানুষকে খনিকেই পরিবর্তন করে। আবেগের বশে মানুষ অসাধ্য সাধন করে ফেলে। জীবনে এই প্রথমবারের মতো মাঝরাত অবধি পড়ল সে। সকাল সকাল আবার উঠে পড়ল। ট্যুরের জন্য তৈরি হয়ে নিল। ওর ভাবনা ছিল, অভীক এসে নিয়ে যাবে । কিন্তু ওর ধারণা বরাবরের মতোই ভ্রান্ত প্রমাণ হলো। অভীক এলো না। মাহমুদা জানালেন, তুহিন দিয়ে আসবে ওকে।
মনোক্ষুণ্ণ হলো তাহিয়ার। হৃদয়ে বিষন্নতার জোয়ার এলো আবার। মলিন মুখে তুহিনকে নিয়ে বের হলো বাসা থেকে।
ভোর তখন ছ’টা। কুয়াশায় ঘেরা চারপাশ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গেইটের কাছে যেতেই একটা সাদা গাড়ি চোখে পড়ল। গাড়ি বড্ডো পরিচিত তাহিয়ার। গাড়িটায় নজর যেতেই তাহিয়ার মলিন মুখে হাসি ফুটল। নিজে না এলেও গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে! অভীককে কী বলে মানাবে এই পরিকল্পনা পুরো পথ পাড়ি দিল।
কলেজের পার্কিং এরিয়াতেই দাঁড়িয়ে ছিল অভীক। গাড়ি কলেজে গিয়ে থামতেই এগিয়ে এলো। তুহিনের সাথে কুশল বিনিময় করল। তাহিয়ার অগোচরে দুই একবার তাকাল। তাহিয়া টের পেল না। অভীকের দিকে যখন তাকাল তখন অভীকের দৃষ্টি অন্যদিকে। কালো শার্টের উপর কালচে সবুজ ব্লেজার পরেছে। মুখ ভরতি দাঁড়ি। দুই হাত পকেটে। সুন্দর দেখাচ্ছে। ওই সুন্দর মুখশ্রীর দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে রইল তাহিয়া। তারপর চোখ ফিরাল।
অভীকের সাথে কুশল বিনিময় শেষে ‘আসছি’ বলে কোথাও চলে গেল তুহিন। অভীক ফোন করল কাউকে, ওদিকের আপডেট জানতে চাইল। বোধহয় কোন কলিগের সাথে কথা বলছে।
কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় তাহিয়া অভীকের পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
মিনিট খানেক বাদেই ফিরে এলো তুহিন। অভীকের সাথে কথা বলা হলো না তাহিয়ার। তুহিনের হাতে চিপস চকলেট ভরতি দুটো কালো পলিথিন। ওগুলো বোনের হাতে দিয়ে বলল,
‘ লং জার্নিতে তো এসব ছাইপাশ গেলা তোর প্রধান কাজ। এগুলো ছাড়া তোর যাত্রা শুভ হয়না। নে, এগুলো নিয়ে উদ্ধার কর আমায়। ভাগ্যিস আজ টুরিস্টদের জন্য ক্যান্টিন খুলেছে তাড়াতাড়ি। নয়তো এই ছাইপাশের জন্য আমাকে কোথায় কোথায় ঘুরতে হতো! আর তোদের ক্যান্টিনটা এত দূরে কেন! রিক্সা নিলে দশ টাকা নিত ভাড়া। তুই যেমন মাথার সিস্টেম যেমন বাঁকা, তোর কলেজের সিস্টেম ও বাঁকা।’
তাহিয়া পলিথিন দুটো হাতে নিয়ে অবাক চোখে তাকাল ভাইয়ের দিকে। তুহিনের কাছ থেকে আশা করেনি এসব। অবিশ্বাস্য সুরে বলল,
‘তুই আমাকে এসব কিনে দিয়েছিস! হজম হচ্ছে না। সূর্য কোনদিনে উঠল আজ!’
তুহিন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
‘ আমাকে পাগলা কুকুরে কামড়ায় নি যে আমি নিজের ইচ্ছায় তোকে এসব কিনে দিব। নেহাৎ মা বলেছে। নয়তো ভুলেও কিনে দিতাম না। টাকা দিয়ে দিবি বাসায় গিয়ে। ‘
অথচ মাহমুদা তুহিনকে তাহিয়ার সাথে আসতেও বলেন নি। তুহিন নিজ থেকেই বোনকে ছাড়তে এসেছে। তাহিয়ার জীবনের প্রথম ট্যুর। কিভাবে যাবে না যাবে চিন্তার বিষয়। যদি ও অভীক আছে, কিছু অভীকের কাধে কত দায়িত্ব, সব সামলিয়ে দেখতে পারবে কি-না। যদি না পারে! এই চিন্তা থেকেই আসা।
কিছু কিনে দেয়ার কথা কস্মিনকালে ও বলেন নি মাহমুদা। বোনের পছন্দের দিকে খেয়াল রেখেই নিজের সঞ্চিত টাকা নিয়ে এসেছিল সাথে, যাতে বোনকে কিছু কিনে দিতে পারে।
তাহিয়া ভেংচি কাটল, ‘দিব না টাকা, কী করবি?’
‘ট্যুর শেষে বাসায় ফিরবি না? তারপর দ্যাখ, আমি কিভাবে টাকা উসুল করি। ‘ রাগার ভান করল
তাহিয়া ভেংচি কাটল, ‘ আমি ও দেখব, তুই কিভাবে নিস।’
তুহিন দায়সারাভাবে বলল,
‘আমি এখন যাচ্ছি, সাবধানে থাকবি। যাচ্ছিস তো পাহাড় ভ্রমনে। পড়ে গিয়ে পা ভেঙে আসিস না। ল্যাংড়া হলে তোকে ভীষণ ফানি লাগবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমি তোকে কোলে নিয়ে পাঁচ তলা বেয়ে বাসায় যেতে পারব না। ‘ বলে সামনের দিকে পা বাড়াল।
অভীকের কথা বলা শেষ। কিছুটা দূরে গিয়ে কথা বলছিল ও। ফোন পকেটে রেখে তাহিয়াদের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তুহিন গিয়ে সামনে দাঁড়াল। অভীক বলল,
‘কিছু বলবে তুহিন?’
তুহিনের রাগভরা স্বরটা হঠাৎ নরম হয়ে এলো,
‘ভাইয়া, আপু উইন্ডো সিট ছাড়া বসতে পারেনা। আপনি উইন্ডো সিট ম্যানেজ করে দিয়েন। আর পাশে মীরা আপুকে বসতে দিয়েন। আপু বাসে ঘুমায়, গ্লাসে আবার না বাড়ি খায়। মীরা আপু খেয়াল রাখবে। আর আপু কখনো পাহাড় ট্যাকিং করেনি। উঁচু নিচুতে হাটতে গেলে পড়ে যেতে পারে। একটু দেখে রাখবেন। আপু সাঁতার জানে না। বিচে গেলে একা বোর্টে উঠতে দিবেন না। আপনি যাবেন সাথে। আপুর খেয়াল রাখবেন ভাইয়া! আর বিচে ভীড় থাকবে, একটু চোখে চোখে রাখবেন, হারিয়ে না যায় আবার।’
তুহিনের এই সুপ্ত ভালোবাসা প্রকাশটা অভীকের চমৎকার লাগে। ও হেসে বলল,
‘ তোমার মনে রাখা উচিত, তোমার বোন শুধু আমার ছাত্রী নয়। স্ত্রী ও হয়। তার খেয়াল রাখার দায়িত্ব আমার কাধে। চিন্তা করো না, আমি খেয়াল রাখব ওর।’
তুহিন হেসে বলল,
‘ বোনের ভাইদের চিন্তিত হওয়া বাধ্যতামূলক। আপনি শুধুমাত্র আপুর সাথে গেলে চিন্তা হতো না। এখন আপনি শিক্ষক হিসেবে যাচ্ছেন, কত দায়িত্ব আপনার কাধে। সব সামলিয়ে আপুর খেয়াল রাখার সময় হবে কি-না এই চিন্তাটা আপনাআপনি এসে যাচ্ছে। ব্যস্তটার কারণে কাছে না থাকতে পারলে, দূর থেকে চোখে চোখে রাখবেন। আমার একটাই বোন, ওর কিছু হলে সহ্য করতে পারব না। ‘
‘ আচ্ছা। তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও।’ তুহিনের কাধ চাপড়াল অভীক। তুহিন বিদায় নিয়ে চলে গেল।
অভীক ফিরে এলো তাহিয়ার কাছে। কুয়াশার কারণে মাস্ক পরেছে তাহিয়া। মাস্কের উপর চশমা পরেছে। মাস্কের কারণে চশমার গ্লাস বারবার ঝাপসা হচ্ছে। আবার ঠিক হচ্ছে। কাধে ব্যাগ, দু’হাতে তুহিনের দেয়া প্যাকেট। চশমা পরিষ্কার বা মাস্ক খোলার সুযোগ পাচ্ছে না। অভীক পাশে এসে দাঁড়াতেই এক পলক তাকাল। অভীকের মনোভাব যাচাই করতে বলল,
‘চশমার গ্লাসটা ঝাপসা হয়ে গেছে, পরিষ্কার করে দাও।’
অন্যান্য সময় অভীক এই কাজটা নিজ থেকেই করে, আজ বলার পর ও করল না। ফোনটা হাতে নিয়ে দৃষ্টি ফোনেই ডুবাল। নিজেকে গম্ভীর উপস্থাপনের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে ওর মাঝে। এইবার শিক্ষাটা পাকাপোক্ত না হলে এই কাজ আবার করবে। দ্বিতীয়বার পড়ায় হেয়ালী করার সাহস যাতে না পায় তাই এই ব্যবস্থা। অভীক তাহিয়ার দিকে তাকাল না। ফোনের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে তাহিয়ার হাত থেকে প্যাকেট দুটো নিয়ে নিল। ইঙ্গিতটা হলো, এবার নিজে মুছে নাও।
তাহিয়া বিষন্নতার মাত্রা গাঢ় হলো। মলিন মুখে বলল,
‘স্যরি তো! আর কখনো পড়ায় অমনোযোগী হবো না । প্রমিজ। তুমি আমার সাথে স্বাভাবিক বিহেব করো প্লিজ!’
অভীক নির্বিকার। ওর ভাবটা এমন যে, এই মুহুর্তে ফোন দেখার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দুটো নেই। তাহিয়া আবার বলল,
‘আর কখনো পড়ায় অমনোযোগী হবো না। কখনো না। তুমি যেভাবে, যতক্ষণ পড়তে বলবে ততক্ষণ পড়ব। যা বলো তাই করব। তাও একটু স্বাভাবিক হও। তুমি আমার সাথে কথা বলছো না, আমার দিকে তাকাচ্ছো না, কল দিলে তুলছো না। তোমার এই অবহেলা আমার সহ্য হচ্ছে না। মেনে নিতে পারছি না।’
অভীক এবারও নিরুত্তর। তাহিয়া যেন চোখে সরষে ফুল দেখল। মনে যা এলো বলে দিল,
‘আমি ওই চ্যাপ্টারের সব প্রশ্ন শিখে ফেলেছি। বলব?’
তাহিয়া সত্যি সত্যি পড়া বলা শুরু করল। দ্রুত বলে গেল একের পর এক। কয়েকটা ব্রিফ কুয়েশ্চন বলে ফেলল কিছুক্ষণের মধ্য। তিন সপ্তাহের পাঠদানে তাহিয়াকে এত দ্রুত পড়া বলতে শুনে নি অভীক।
অবাক হলো অভীক। চমৎকার কাজ হয়েছে তো! ওর পাঁচ দিনের অভিমান দুর্দান্ত কাজ সফলতা এনেছে। মজা ও লাগল। অভীক ঠোঁট চেপে ধরল। এখন হাসা যাবে না কোনভাবে। কিন্তু হাসিটাকেও চেপে রাখা যাচ্ছে না। অভীকের মনে হলো, ওই একমাত্র ব্যক্তি, যার বউ তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পড়া বলে রাগ ভাঙাচ্ছে। বিষয়টা হাস্যকর। অভীক পকেটে থেকে মাস্ক বের করে পরল মুখ। চেপে রাখা হাসিটা নিঃশব্দে ছাড়ল এতক্ষণে। দেখা যাক এই মেয়ে আর কী করে। তাহিয়া এই হাসি টের পেল না।
ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে কোনমতে ফোনে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল অভীক। তাহিয়ার চোখে পানি ভর করল। মলিন স্বরে বলল,
‘ পড়ার কারণেই তো আমার সাথে রেগে আছো তুমি। দেখো, আমি পড়া মুখস্থ করেছি সব। আর রেগে থেকো না আমার উপর। এবার স্বাভাবিক হও দয়া করে! এই বিরহের ইতি টানো, আমার কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ অভী!’ স্বর কেঁপে উঠল তাহিয়ার।
‘অভী!’ শব্দটা আওড়িয়ে অভীক ভ্রু নাড়াল। মাস্কের আড়ালে প্রাণবন্ত হাসল। মনে মনে বলল, ‘তোমার উপর রেগে থাকার সাধ্য কার! অন্তত আমার নেই। এ তো তোমাকে শায়েস্তা করার চেষ্টা মাত্র। ‘
হাসি থামল। মুখটা স্বাভাবিক করল। না গম্ভীর, না প্রাণবন্ত। প্রথমে তীর্যক চোখ, পরপরই পূর্ণ চোখে চাইল। প্রথমবারের মতো বলল,
‘পড়াশোনার আলোচনা পরে হবে, এখন ট্যুর ইনজয় করো। বাসে উঠো, পরে গেলে উইন্ডো সিট পাবে না।’ অভীকের স্বরটা কোমল।
‘তুমি আমার উপর রেগে নেই, বলো! তারপর যাব।’ কান্নাভেজা স্বরে বলল তাহিয়া। দু’ফোটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। অভীক তাহিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সামনে এলো।
তাহিয়াকে পরখ করে ভ্রু কুঁচকাল।
‘আমি রেগে চোখ রাঙিয়েছি, ধমকে কথা বলেছি, গায়ে হাত তুলেছি,কোনটা? কিছুই তো করিনি। তবে আমার রাগ তোমাকে কাঁদাবে কেন? কান্না থামাও, ফাজিল!’ কপট রাগ দেখিয়ে বলল অভীক। তাহিয়ার চোখের পানি সবে পরখ করেছে ও।
তাহিয়া চোখ মুছে গভীর গলায় বলল,
‘ঝড় থেকে ঝড়ের আগের গুমট পরিবেশটা ভয়ানক বেশি হয়। তুমি রাগটা ঝেড়ে ফেললে তাও মানা যেত। না ঝেড়ে যেভাবে থম ধরে আছো। এটা মানা যাচ্ছে না। তোমার রাগ দুই ধমকে নিঃশেষ করে দাও। তারপর স্বাভাবিক হয়ে যাও। এভাবে থেকো না।’
অভীক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমরা স্বামীরা হলাম, অভাগা। স্ত্রীকে শাসন না করলে স্ত্রী বিপথে যাবে, তখন সবাই বলবে স্বামী শাসন করেনি কেন। আবার শাসন করতে গেলে বলবে স্ত্রীকে নির্যাতন করছে। স্ত্রী নিজেই বেঁকে বসবে। আবার পরে বলবে, আমাকে শাসন করোনি কেন। আমি কিছু বলতাম না। এদিকে রাগটা সেই করতো। দুই কূলেই দোষ। আগেরবার সামান্য এক ধমকে যে তান্ডব চালিয়েছ, তার কথা নাইবা বললাম। তখন ও আমার দোষ হয়েছে। এখন ধমক না দিয়ে চুপ রইলাম তাতেও দোষ। কোনদিকে যাব আমি!’
অভীকের কথায় রাগ পড়ার আভাস পাওয়া গেল। স্বরে গম্ভীরতা নেই। তা তাহিয়াকে স্বস্তি দিল। মলিনতা সরল। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল,
‘ যেদিকে যেতে চাও, যাও। শুধু আমার উপর রাগ করে থেকো না। তাতেই হবে।’
‘আসো। ‘
পার্কিং এরিয়া থেকে ডিপার্টমেন্টের দিকে পা বাড়াল অভীক। ডিপার্টমেন্টের সামনে বাস দাঁড় করানো। পাশাপাশি দুটো বাস দাঁড়ানো। সবাই উঠছে সবে। মীরা আগেই বান্ধবীর জন্য সিট রেখেছে। তাহিয়াকে দেখেই ডেকে বলল। অভীককে কষ্ট করতে হলো না। অভীক বলল,
‘আমি ছেলেদের বাসে আছি। তোমাদের পিছনেই যাবে। কিছু লাগলে বা কোন সমস্যা হলে ফোন দিও। যাও।’
তাহিয়া মাথা নাড়াল। বাসের দিকে পা বাড়াতেই তুহিন এলো কোথা থেকে। ডাকল,
‘আপু!’
তাহিয়া থামল। তুহিনকে দেখে ভ্রু কুঁচকাল,
‘কিরে তুই না তখন চলে গিয়েছিলি! কোথা থেকে এলি?’
তুহিনের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটার বোতল। তাহিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বিরক্তির স্বরে বলল,
‘তোর জন্য যেতে পেরেছি! অর্ধেক পথ যাওয়ার পর মা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোর জন্য পানি কিনে দিয়েছি কি না। ওখানে না কি তার মেয়ে পানি পাবে না। আবার ফিরতে হলো। তোর মতো বোন থাকলে আর কোন ঝামেলার দরকার হয়না। নে ধর।’
তাহিয়া বোতলটা নিল। বলল, ‘এবার বাসায় যা। ‘ সামনের দিকে পা বাড়াল আবার। তাহিয়া সঠিক কারণ ধরতে না পারলেও অভীক ঠিকই ধরে ফেলল। হাসল ও। তাহিয়া যেতেই বলল,
‘ ছোটো মাথায় এত চিন্তা নিও না। ঝেড়ে ফেল। আমি আছি তো তোমার আপুর খেয়াল রাখার জন্য। এবার বাড়ি যাও।’
‘ বাস ছাড়ুক যাব। ‘ তুহিন বাসের দিকে তাকিয়ে বলল। ধীর পায়ে এগুলো বাসের দিকে। বাসে উঠে দেখল তাহিয়া কোথায় বসেছে, ওর পাশে কে বসেছে। নাহ, মীরার পাশেই বসেছে। হাফ ছাড়ল। তাহিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তাহিয়া প্রশ্নবোধক চাহনি দিল।
এক মাস হলো তুহিন টিউশন করছে। ক্লাস ফোরের দুটো ছেলেকে পড়ায়। চারহাজার টাকা দেয়ার কথা। প্রথম মাসের বেতনটা কালই পেয়েছে। পুরো টাকাটা আজ এনেছে সাথে। উত্তরে টাকাটা বোনের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘মা তোকে দিতে বলেছে। কিছু কেনাকাটা করার হলে করতে বলেছে। ‘
তাহিয়া খুশি হলো। টাকাটা ওর দরকার ছিল। কোথাও গেলে খালি হাতে যাওয়া যায় না, কিছু কেনার হলে অভীককে কোথায় খুঁজবে আবার। উৎফুল্ল হয়ে টাকা নিল। তাহিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তুহিন বেরিয়ে গেল। তাহিয়ার হাসিতে ও সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে।
কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। অপেক্ষা করল বাস ছাড়ার। ছাড়ল, দৃষ্টির আড়াল হতেই পা বাড়াল বাসার দিকে।
তাহিয়াদের বাস ছাড়ার পর বাসে উঠল। একটা মাঠে বাস থামল। এখান থেকে পাহাড়ে যাবে, তারপর বিচে যাবে। দুটো বাস থামার পর জাহাঙ্গীর আলম এবং অভীক ছাত্রছাত্রীদের তালিকা চেক করছিল। সবাই নেমেছে কি না। অভীক মেয়েদের বাসের দরজার পাশেই দাঁড়ানো ছিল। ওর হাতে নামের তালিকা। দৃষ্টি ওখানেই। তাহিয়া, মীরা পিছনের দিকে বসেছে। তাই শেষে এলো। মীরা আগে নেমেছে। তাহিয়া সবার শেষে। তাহিয়ার পরনে সালমন কালার সেমি লং শার্ট, শার্টের উপর ব্লু ডেনিস জ্যাকেট,ব্ল্যাক প্যান্ট, গলায় কালো স্কার্ফ প্যাঁচানো, কাধে ব্যাকপ্যাক। চুল ছেড়ে দেয়া। মুখে হালকা প্রসাধনীর আভা। আইনালার দিয়ে চোখ আঁকা, মাশকারা দিয়ে পাপড়ি রাঙানো, কপালে কালো টিপ, চোখে চশমা, ঠোঁটে ম্যাট লিপস্টিক। সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। অভীক লিস্টে তাহিয়ার নামের উপর হাত রেখে দরজার দিকে তাকাল। তাহিয়াকে দেখে ভ্রু বাঁকাল। নামতে বলল ইশারায়। তাহিয়া দরজায় দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চুল ব্রাশ করে, জ্যাকেটের পকেটে হাত রাখল। অভীকের দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে পা ফেলল মাটিতে। অঘটন ঘটে গেল তখন।
বেখেয়ালি থাকায় পা মচকে পড়ে যেতে নিল। মীরা উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
‘আরে সাবধানে। ‘ দ্রুত এগিয়ে এলো। ধরার আগেই দ্বিতীয় কেউ এসো তাহিয়াকে আগলে নিল। সেই দ্বিতীয় কেউটা অভীক।
মীরা সরে গেল। দুলাভাই হোক আর যাই হোক এই স্যারের আশপাশে থাকতেই ভয় লাগে ওর। মনে হয় যেন সিংহের খাচার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোন সময় গর্জন দিয়ে ওর উপর হামলে পড়বে। এই তাহিয়া যে কিভাবে সিংহকে বশে এনেছে আল্লাহ ভালো জানে।
আকস্মিক রগ বেঁকে গেল, তাহিয়া ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠল। অভীক উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
‘ কোথায় ব্যাথা পেয়েছো?’
‘পায়ে।’ কোনমতে বলল তাহিয়া। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না। অভীক আশপাশ চাইল, বসার কিছু নেই। পকেট থেকে টিস্যু বের করে বাসের দরজায় থাকা সিড়িতে বিছিয়ে বলল,
‘দেখি বসো এখানে।’
ধরেই বসাল তাহিয়াকে। তাহিয়ার সামনে হাটু ভেঙে বসল। পা দেখে নিয়ে ম্যাসেজ করল। রক্ত সঞ্চালন বেড়ে রগ সোজা হয়ে যাবে। তারপর ধীরে একটা মোচড় দিল। ব্যাথায় চোখে পানি নামল তাহিয়ার। অভীক কোমল স্বরে বলল,
‘এবার কম লাগছে না? ‘
তাহিয়া ব্যাথাতুর চোখে তাকাল। উত্তর দিল না।
অভীক উঠে দাঁড়াল। তাহিয়ার চশমা গিয়ে পড়েছে সামনে। অভীক মাটি থেকে চশমাটা তুলে নিল। পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুছল । টিস্যু দিয়ে চশমা মুছতে দেখে তাহিয়া বলল,
‘তুমি কি এখনো আমার উপর রেগে আছো?’
অভীক বিরক্ত হলো। নিজে ব্যাথা পেয়েছে, সেই চিন্তা নেই। আছে ও রেগে আছে কিনা সেই চিন্তায়। এখন এই কথা বলার সময়! ফাজিল! অভীক সরাসরি উত্তর দিল না। চশমাটা তাহিয়ার চোখে পরিয়ে দিয়ে তাহিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
‘আমার হাতে হাত রেখে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো হিয়া।’
কথার মাঝে ‘হিয়া’ শব্দের আগমন ঘটেছে মানে রাগের বংশ নিঃশেষ হয়ে গেছে। ব্যাথার মাঝেও চমৎকার এক সুখ এসে হানা দিল তাহিয়ার মনে। তড়িৎ হাত রাখল অভীকের হাতে।
অভীক তাহিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে এক হাত দিয়ে তাহিয়ার বাঁ হাত ধরল, অন্য হাতে ডান বাহু ধরে উঠে দাঁড় করাল। বলল,
‘এবার একটু হাঁটার চেষ্টা করো। পা ঝাড়ো, দেখবে ঠিক হয়ে যাবে।’
মোচড় এতটা গুরুতর ছিল না। হালকাভাবে লেগেছিল। প্রথমে ব্যাথা থাকে, পরে রগ সোজা করে দিলে ঠিক হয়ে যায়। তাহিয়া পা ঝাড়ল, এক দুই পা দিল। অনুভব করল, ব্যাথা কমে আসছে। একসময় অনুভবই হলো না। অভীক আবার জিজ্ঞেস করল,
‘কমেছে?’
‘হ্যাঁ।’
পেছনে ছাত্র শিক্ষক সবার দৃষ্টি ওদের দিকে। অভীক-তাহিয়ার স্বামী স্ত্রীজনক কোন দৃশ্য ইতঃপূর্বে চোখে পড়েনি ওদের। সবাই কত চোখে চোখে রেখেছে ওদের, ক্লাসে চোখে চোখে কথা বলে কি-না, আসা যাওয়ার সময় কী করে দেখার জন্য। বিশেষ কোন দৃশ্য চোখে পড়েনি। দু’জন কেমন গা-ছাড়া ভাবে থাকে। যেন সম্পর্ক নেই তাদের মাঝে। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন ছিল, এরা আদৌ স্বামী স্ত্রী! আর অভীক ‘স্যার’ হিসেবে যেমন গম্ভীর, স্বামী হিসেবেও তেমন? সবার ধারণা, অভীক স্ত্রীকে ভালোবাসবেনা, ধমকের উপর রাখবে। ধারণারা চুরমার হলো এইক্ষণে। অভীকের মুখে মাস্ক নেই। ওর চোখে তীক্ষ্ণ যত্নবোধ, কপালে চিন্তার ভাজ, চোখে উদ্ধিগ্নতা দৃশ্যমান হচ্ছে। যেন ব্যাথাটা তাহিয়া নয় অভীক পেয়েছে। একজন সঙ্গী হিসেবে অভীক কতটা প্রেমোদ্দীপক আর যত্নবান তা আন্দাজ করা গেল। বহু পরিচিত গম্ভীর শিক্ষকের এই কোমল রূপ দেখে যারপরনাই অবাক ছাত্র শিক্ষক সবাই। ভীড়ের মাঝে গুঞ্জন উঠেছে, ওদের বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কি-না।
তাহিয়া এতক্ষণে সবার দিকে লক্ষ করল। সবার চাহনি পরখ করে বিব্রত স্বরে বলল,
‘সবাই কিভাবে তাকিয়ে আছে। ছাড়ো!’
অভীক চারদিকে চোখ বুলিয়ে ভ্রু কুঁচকাল,
‘তুমি আমার স্ত্রী, প্রেমিকা নও। এই ধরাধরিতে ভয় পাওয়া সাজে না। তাছাড়া, আমি তোমার সাথে রোমান্স করতে ধরিনি যে কাউকে দেখেই ছেড়ে দিব। তোমার অসুস্থতায় আমি লোকলজ্জায় তোমাকে একা ছাড়ব! ওসব বাদ, তুমি ঠিক আছো কি না ওটা বলো।’
তাহিয়া প্রসন্ন হেসে নিশ্চিন্ত করল, ও ঠিক আছে। হাটতে পারছে। কোন সমস্যা হচ্ছে না। কৌতুকের স্বরে বলল,
‘সবাই যেভাবে তাকিয়ে আছে যেন সিনেমা চলছে। বিয়ের কথা জানানোর পর ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের সামনে গেলে আমার নিজেকে সেলিব্রিটি মনে হয়। নাইকা নাইকা ভাব আসে। তোমার ও কি নায়ক নায়ক ভাব আসে?’
অভীক হেসে ফেলল। বলল, ‘ আগে আসেনি, এখন আসছে। ‘
তাহিয়া বিজয়ী হাসল। যেন বিশাল কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে। অভীক ওকে ছেড়ে দিল। জাহাঙ্গীর আলম এগিয়ে এলেন। তাহিয়ার শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলেন। তাহিয়া জবাব দিল। তারপর বান্ধবীদের কাছে গেল। মীরা বলল,
‘ ভাই আমরা কি, কলেজ ট্যুরে ঘুরতে এসেছি না কি সিনেমা হলে রোমান্টিক সিনেমা দেখতে এসেছি বুঝতে পারছি না। চারদিকে কাপল সিনের ছড়াছড়ি । ‘
শৈলী ওকে বলল, ‘ব্যাথা পেয়েছিস?’
মীরাই উত্তর দিল, ‘তাহিয়ার মিয়া সারিয়ে নিয়েছে ব্যাথা। আহা! কী কেয়ার! কী ধরাধরি, কী হাসাহাসি! বহুদিন রোমান্টিক দেখিনি, আজ স্বচোক্ষে দেখার পর ফিলিং জোস। বাই দ্যা ওয়ে, স্যারের উপর কিন্তু এখন আমার একদম ক্ষোভ নাই। কেমন একটা টান কাজ করছে।’
তাহিয়া মীরার বাহুতে মৃদু কিল দিয়ে বলল,’ আমার জামাই আর আমাদের প্রেমের দিকে নজর দিবি তো খুন করে গুম করে ফেলব। ‘
মীরা ঠোঁট বাঁকাল, ‘তোমরা খুল্লাম খুল্লা পেয়ার করতে পারো, আমরা নজর দিলেই দোষ!’
‘আমরা মিয়া বিবি, আমাদের প্রেম ভালোবাসার লাইসেন্স আছে। কিন্তু এতে নজর দেয়ার লাইসেন্স নাই তোদের।’ তাহিয়ার ঠোঁট বাঁকাল।
পাহাড়ে উঠছে সবাই। হাতে একটা করে বাঁশ। ছাত্রছাত্রীরা আগে উঠছে, শিক্ষকরা পিছনে। অভীক পিছনে উঠছে, ওর দৃষ্টি কয়েক গজ সামনে হেঁটে যাওয়া চঞ্চল শ্যামবতীর উপর। এই বুঝি পড়ে গেল মেয়েটা! পাহাড়ের চূড়ায় উঠল এমন করেই। উঠে মেয়েটাকে সুস্থসবল দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
চূড়ায় উঠে সবাই প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত হলো। তাহিয়া ব্যাগ থেকে চিপস বের করতে গিয়ে থার্মো ফ্লাস্কটা চোখ পড়ল। চারদিকে চোখ ঘুরাল। অভীক ওর বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছে। সে দিকটা নিরিবিলি, দৃষ্টি ওর পানেই নিবদ্ধ। এক মুহুর্তের জন্য দৃষ্টি সরাচ্ছে না, এই মেয়ে আবার চোখের পলকে কোথায় যায়। তাহিয়াকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কাছাকাছি এসে থামল।
ব্যাগ থেকে ফ্লাস্ক বের করতে করতে চঞ্চল গলায় বলল,
‘এ্যাই, অভী চা খাবে? আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে এনেছি।’ তাহিয়ার দৃষ্টি ফ্লাস্কে। চারদিকে যে সবাই তাকিয়ে আছে সে দিকে খেয়াল নেই ওর। কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছে। সবাই শুনে হাসছে। ওরা নিশ্চিত, অভীক তাহিয়ার লাভ ম্যারেজ। এরেঞ্জ ম্যারেজে এত প্রেম হয় না কি! দুই একজন ইতিমধ্যেই মীরাকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে।
মীরা ও রসিয়ে বলেছে,
‘ স্যারের মা আর তাহিয়ার মা ছোটোকালের বান্ধবী। বাংলা সিনেমার চৌধুরী সাহেবের মতো উনারা ও চেয়েছেন বন্ধুত্বের একটা নাম দিতে। জন্মের আগ থেকে বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন। তাহিয়ার জন্মের পর অভীক স্যারই ওকে প্রথম কোলে নিয়েছে। তাহিয়া চোখ খুলে প্রথম দেখাটাই দেখে ছিল অভীক স্যারকে। লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয়ে গিয়েছিল তখনই। তারপর প্রেম ভালোবাসা, বিয়ে। সাংঘাতিক রকমের প্রেম ছিল ওদের। এই প্রেম অভীক স্যারকে ছোটো ঘর বড়ো ঘর কত ঘরে নিল, একবারে চোখের দেখা। একটা হিয়ামহল বানালে ওদের প্রেম ও হিট খাবে।’
মীরার হেয়ালিপনায় ক্ষেপে গিয়ে শৈলীকে জিজ্ঞেস করল। শৈলী জানাল, এরেঞ্জ ম্যারেজ। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হলো না। এরেঞ্জ ম্যারেজে এত প্রেম থাকে না। নিশ্চিত লাভ ম্যারেজ। কিন্তু লাভ ম্যারেজ হলে আগে টের পেল না কেন! দুজন মানুষ চোখের সামনে ছিল। কখনো তো লাগেনি এদের মাঝে অন্য সম্পর্ক আছে। কত কথা আসল মনে।
ওদের প্রেম- বিয়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো রহস্যজনক মনে হচ্ছে। সমীকরণ মিলছে না।
স্ত্রীর কথার উত্তর অভীক ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘তুমি বাড়ি থেকে চা বানিয়ে এনেছো!’
তাহিয়া ওর কাপে সবুজ চা ঢেলে অভীকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘অনলি ফর ইউ!’
অভীক চায়ে চুমুক দিয়ে ধীর স্বরে বলল,
‘তোমার ‘অভী’ ডাক চারদিকে শোরগোল ফেলে দিয়েছে। আমি কিন্তু ভয়ানকভাবে টের পাচ্ছি। তুমি কি টের পাচ্ছো?’
তাহিয়া বুঝল না। ও আড়চোখ চারদিক তাকাল। সবাই তাকিয়ে এদের দেখছে। ‘অভী’ ডেকেছে এতে এত চমকানোর কী আছে! আশ্চর্য! চোখ ফিরিয়ে বলল,
‘একটু জোরেই বলে ফেলেছি। ইশ!’
অভীক এবার হেসে ফেলল। মেয়েটা আজও বুঝল না, কোন কথার শোরগোল কোথায় হয়। বড্ড অবুঝ হিয়ারানী।
•
ট্যুরের পরদিন তাহিয়াকে পড়াতে গিয়ে চমকপ্রদ দিক সামনে এলো অভীকের। এই মেয়ে ওর বিরহে সত্যিই পুরো চ্যাপ্টার শেষ করে ফেলেছে। কত ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে প্রশ্ন করল। ভুল নেই। ওর রাগটা দারুণ কাজে লাগল। একটু আগে একটা টপিক বুঝিয়েছে, বুঝে নিয়ে শিখে নিয়েছে। এখন আবার লিখছে। হৃদয়গ্রাহী পরিবর্তন। অভীক তো এটাই চেয়েছিল। খুশিতে আত্মহারা ওর মন।
হাতের কলম নাড়িয়ে কিছুক্ষণ ভেবেছে, তারপর উঠে দাঁড়াল। তাহিয়ার রেশমি চুল খোঁপা খুলে পড়েছে পিঠে। সামনের কিছু চুল কপালে এসে বিরক্ত করছে, তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাচ্ছে বারবার। অভীক নিজ উদ্যেগে চুল গুলো টেনে নিয়ে বাধার চেষ্টা করল। ফাঁকে বলল,
‘হিয়ারানীর জন্য চমৎকার একটা অফার আছে।’
খাতায় কলম চালাতে চালাতে তাহিয়া জানতে চাইল, ‘কী অফার? ‘
হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে অভীক তাহিয়ার চুল বেধে দিয়েছে। তাহিয়ার মাথার উপর মাথা রেখে বলল,
‘হিয়ারানী যদি ফার্স্ট ইয়ারের রি-টেইক দেয়া বিষয়গুলোতে বি গ্রেড পায় আর সেকেন্ড ইয়ারে সব সাবজেক্ট মিলিয়ে ফার্স্টক্লাস পায়। তাহলে রেজাল্ট হাতে পাওয়ার পরের সপ্তাহে হিয়ারানীকে তার সংসারে নিয়ে যাওয়া হবে। ‘
অভীকের প্রস্তাব কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তাহিয়ার কলম থেমে গেল। তড়িৎ মাথা ঘুরিয়ে পিছন ঘুরল। অভীক যেন এর অপেক্ষায় ছিল। ওর বিস্ময় মাখা মুখে অধর ছুঁয়ে বসল। বলল,
‘ তোমার লোভনীয় অফার আমি লুফে নিয়েছি। এবার আমার দেয়া অফার তুমিও লুফে নাও ।’
চলবে…