প্রেমোদ্দীপক পর্ব ১১

0
812

প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-১১)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মেক আপ রিমোভ করার ফাঁকে গুনগুন করছে তাহিয়া। শাড়ি ছেড়ে থ্রি-পিস পরার পর অদ্ভুত এক প্রশান্তি জায়গা করে নিয়েছে ওঁর মনে। এতটা স্বস্তিবোধ কখনো লাগেনি। মুখ থেকে ভারি মেকাপ তোলার পর যেন স্বস্তির মাত্রা গাঢ় হলো। স্বস্তিবোধ অস্বস্তিতে রূপ নিল গহনা খুলতে গিয়ে। একে একে চুড়ি, কানের দুল, শীতা হার সব খুলে রেখেছে কিন্তু চোকারটা খুলতে পারছে না। মাহমুদা চোকারটা ওঁর গলায় গেঁথে আটকে দিয়েছেন। ফিতে নেই, পিছন দিকে চেইন আকারে। অ্যাঙ্গেলটা নাগাল পাচ্ছে না। বারকয়েক বৃথা চেষ্টার পর হতাশা এসে ভর করল তার মনে। এই চোকার পরে ঘুমানো যাবে না, ফাঁস টাঁস লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

তার এই হতাশাজনক সময়ে রুমের সামনে এসে দাঁড়াল অভীক। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। তারপর ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলের উলটো পিঠ দরজায় ঠেকিয়ে নক দিল। শব্দ হলো, ঠকঠক।
হাত থামিয়ে দরজার দিকে তাকাল তাহিয়া। অভীক এসেছে! লোকটা অনুমতি চাইছে? এতটা ভদ্রতা কেন লোকটার মাঝে! তাহিয়া ধীরে বলল,
‘আসুন।’

দরজার নব ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল অভীক। তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকাল,
‘ ঘুমাও নি কেন?’

‘এই তো যাচ্ছি।’
স্বরটা নিচু রেখেই বলল তাহিয়া। অভীক হেটে গিয়ে কোণায় থাকা নিজের ট্রলির কাছে গেল।
কাপড় বের করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘আমি লম্বা শাওয়ার নিব। বের হতে দেরি হবে। এর মাঝে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমি থাকলে তোমার অস্বস্তিবোধ হবে।’

তাহিয়ার হাতটা তখনো ঘাড়ে, চোকারের উপর। এই চোকারটা না খুললে ঘুমের শান্তিটা ষোলো আনায় পাওয়া যাবে না। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাবে। ওঁর দ্বারা খোলা অসম্ভব। অভীককে বলবে সাহায্য করতে? লোকটা কিছু ভাববে না তো! দ্বিধাবোধের মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে রইল ও। অভীক ওয়াশরুমের দরজায় চলে গেছে ইতিমধ্যে। তাহিয়া আকস্মিক পিছু ডাক দিল,
‘স্যার!’

অভীক অবাক হলো কিছুটা। মেয়েটা তাকে ডাকছে! সে পিছু ফিরে ভ্রু কুঁচকাল, ‘ কোন সমস্যা?’

তাহিয়া সামনে ঘুরে মিনমিনে স্বরে বলল,
‘চোকারটা খুলতে পারছি না।’

অভীক খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকেই রইল। তারপর বলল,
‘ আমার হেল্প চাইছো?’

তাহিয়া মাথা নাড়াল। অভীকের বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল এবার। সে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘আর ইউ শিওর? আমি কাছে গেলে নির্ঘাত কাঁপা-কাঁপি ঘামাঘামিতে জ্ঞান হারিয়ে বসবে।’

তাহিয়া বিরক্তিতে মুখ কুঁচকাল। লোকটা এমন কেন? এত নিশ্চয়তার কী দরকার? সে যখন বলেছে তার সাহায্য দরকার, তখন এসে সাহায্য করবে। তা না করে, সাহায্য করার আগে এত ‘স্বস্তি’র নিশ্চয়তা নিতে হবে কেন! লোকটা কি বুঝতে পারছে না? তার এই ভদ্রতা তাহিয়াকে প্রেম সাগরের তীরে নিয়ে যাচ্ছে? বিরক্তিতে ভরা মাথাটা আবারও ‘হ্যাঁ’সূচক নাড়াল । অভীক চোয়ালে বিস্ময় বজায় রেখে ফিরে এলো। ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল তাহিয়ার পিছনে। আলতো হাতে চোকারের চেইন খোলার চেষ্টা করল। ঘাড়ে হালকা স্পর্শ ও লাগল। অভীকের গায়ে মাখা পারফিউমের ঘ্রাণটা এসে বাড়ি গেল তাহিয়ার নাকে। শ্বাস আটকে এলো। হৃদপিন্ডটা তড়িৎ লাফিয়ে উঠল, বুকে কান পাতলে টের পেতো ভেতরে কত উচ্চৈঃস্বরে স্পন্দন করছে। লজ্জায় আড়ষ্ট হলো ও। নেত্রপল্লব এক করে অসাড় দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে দোয়া পড়ছে,
‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাস জালিমিন! ‘

আড়চোখে তাহিয়াকে পরখ করে ঠোঁট চেপে হাসল অভীক। মেয়েটার স্বভাব সম্পর্কে তার অজানা নয়। লজ্জায় হাঁসফাঁস করবে বলে আগেই নিশ্চয়তা চেয়েছিল। মেয়েটা কী ভেবে সায় জানিয়েছিল কে জানে! ওখন অস্বস্তিতে ডুবে মরছে। চোকার খুলে তড়িৎ সরে এলো। কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল, তাহিয়ার মুখোমুখি।

আটকে রাখা শ্বাসটা এতক্ষণে ছাড়ল তাহিয়া। জীবনে একটা প্রেম করলে ভালো হতো, অন্তত কোন পুরুষের সান্নিধ্যে গেলে এতটা অস্বস্তিবোধ হতো না। জীবনের প্রথম পুরুষ বলেই এতটা জড়তা, এত লজ্জা, এত ভয়।

অভীক তাহিয়ার গলা পরখ করল। রক্তজমাট হয়ে গেছে। গম্ভীরমুখে বলল,
‘এত আঁট চোকার পরার কী কাজ? দেখো গলা কেমন লাল হয়ে গেছে!’

তাহিয়া আয়নায় গলা দেখে বলল,
‘সকাল অবধি সেরে যাবে।’

‘ তোমরা মেয়েরা খুশিমনে বাড়তি ঝামেলা কাধে নাও। এটা বুঝার চেষ্টা করো না যে, সৌন্দর্য থেকে স্বস্তিবোধ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অস্বস্তিতে যে সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে, সেই সৌন্দর্যের দরকার নেই। বেমানান লাগবে বলে চশমা পরোনি, এখন হেডএক হচ্ছে। এখন ব্যাথাটা মানানসই লাগছে? ফাজিল! নেক্সট টাইম এমন গেট আপ নিবে, যা তোমাকে স্বস্তি দেয়। অস্বস্তি নিয়ে এসব ভারি শাড়ি, গহনা পরতে হবে না, চশমা ছাড়তে হবে না। তোমার চশমায় আমি বা আমার পরিবারের কারো কোন আপত্তি নেই। এমন গেট আপ নিবে, যাতে স্বস্তি, সুস্থতা এবং শালীনতা, সব বজায় থাকে।’

অভীকের স্বরে গম্ভীর, রাগমাখা মেশানো। অভীকের রাগমাখানো কথা আজ ভয় নয় স্বস্তি হানা দিল তাহিয়ার মাঝে। ঠিক এই কথাটাই সে মাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে, কয়েক বছর যাবত। অথচ মা বুঝার চেষ্টাই করেন না। আজ আসার আগেও কত আপত্তি জানাল, মা শুনল না। উলটো তার মতের বিরুদ্ধে শাড়ি গহনায় ঢেকে দিল তাকে। দ্বিতীয়বার কখনো অভীকের সাথে বের হওয়ার সময় মা যখন ভারি শাড়ি পরতে বলবে, ঠিক তখন অভীকের এই সংলাপটা হুবহু অনুকরণ করে বলবে। এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হলো তাহিয়া। প্রসন্ন হেসে বলল,
‘আচ্ছা।’

সেই হাসিতে বোধহয় চুরমার হলো অভীক। তড়িৎ রাগ সরিয়ে শান্ত সরে বলল,
‘এখন ঘুমিয়ে পড়ো।’

ওয়াশরুমে চলে গেল অভীক। ওঁর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আকস্মিক তাহিয়ার মনে পড়ল নানান কথা। স্যার আজ এই রুমে থাকবে! বিয়ের দিন দশেক ফেরিয়ে গেলে ও থাকা হয়নি একসাথে। আজ একসাথে তাদের প্রথম রাত। ‘প্রথম রাত’ শব্দটা মাথায় আসতেই চমকাল তাহিয়া। ভড়কাল, লাজুক হলো। প্রথম রাত সম্পর্কে তার বদ্ধমূল ধারণা আছে। সেই ধারণা যদি সত্য হয় তবে ! লজ্জা ডিঙিয়ে বেঁচে ফেরা হবে তার? আশঙ্কা একবারেই ক্ষীণ। অভীকের জন্য সবে মনের অনুভুতিরা জমাট বাধতে শুরু করেছে। এখন যদি অভীক অনুভূতিহীনভাবে কয়েক ধাপ যায়, তবে তাহিয়া মেনে নিতে পারবে না। অনুভূতিগুলো পাকাপোক্ত হোক। জড়তা,ভয় কাটুক তারপর সম্পর্কে পূর্ণতা আসা মানানসই হবে। যদি ও অভীককে যতটুকু চিনেছে এমনটা করবে না সে। তবুও মনে ভয়টা থেকেই যায়।

শূন্য মন শয়তানের কারখানা। ঘটা করে ভাবতে বসলে কত এলোমেলো খেয়াল আসে মনে। তাহিয়া ছাদের কার্নিশে দৃষ্টি রেখে নানান কথা ভেবে যাচ্ছে। ভাবনার বশবর্তী হয়ে দু’গাল লাল হচ্ছে। তার লজ্জাময় ভাবনাচ্যুত হলো ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে। তাহিয়া তড়িৎ চোখ বন্ধ করে ফেলল।

অভীক রুমে এসে কাথা মুড়িয়ে শুয়ে থাকা তাহিয়াকে পরখ করল। চোখের পাতা নড়ছে, মেয়েটা এখনো ঘুমায় নি!

তাহিয়া হালকাভাবে চোখ খুলে এক পলক দেখল অভীককে। শাওয়ার নিয়ে এসেছে, চুল বেয়ে পানি পড়ছে, হাতে ধরা সাদা টাওয়াল। সাদা ট্রাউজার আর নেভি ব্লু পাতলা টি-শার্ট পরেছে গায়ে। কী আকর্ষণীয় লাগছে লোকটাকে! এভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে লোকটার পরিবর্তে তার স্বভাবে দাগ পড়ে যাবে। চোখ বুজল তাহিয়া।

চুল হালকা মুছে বিছানায় বসল অভীক, তাহিয়ার শিয়রে। তাহিয়ার বদ্ধমূল ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে অভীর ওর মাথায় স্পর্শ করল। সেই স্পর্শে কোন ঘোর ছিল, আর না কোন লালসা। যা ছিল তা হলো আলতো যত্মভাব, সচ্চ কোমলতা। স্পর্শটা ঠিক বিয়ের দিনের সেই স্পর্শের মতো। অভীক তাহিয়ার ঝরঝরে লালচে চুলে হাত ডুবিয়ে কোমল স্বরে বলল,

‘ আমি বিলি কেটে দিচ্ছি, এবার ঘুমাও। রাত দুটো বাজে। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। ভালো ঘুম না হলে হেডিক যাবে না।’

থেমে বলল, ‘ অস্বস্তিবোধ থেকে বের হও। আমি বিছানায় শুবো না। তুমি ঘুমিয়ে পড়লেই উঠে যাব। এখন চুপচাপ ঘুমাও তো!’

তাহিয়া মনে মনে বলল, আপনার ভালো হবে না, দেখবেন। সাতারটাও জানি না,অথচ আমাকে সাগরে নামিয়ে দিলেন! এখন মাথায় হাত না বুলালে কী হতো? আপনার এই যত্নে আমার পাথরসম মনটা বরফের মতো গলতে শুরু করেছে, আপনি কি টের পাচ্ছেন ?

তাহিয়া আবার চোখ খুললো। তৎক্ষনাৎ এক জোড়া চোখের মধ্যমণিতে গিয়ে ওঁর দৃষ্টি আটকাল। হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। এই দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ দৃষ্টি আটকে রাখা যায় না। সাগরের তীর থেকে মাঝসাগরে গিয়ে পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকে। তাহিয়া আবার চোখ বন্ধ করল। লাজুক লাল চেহারা ঢাকতে কাঁথা টেনে নিল মুখের উপর। অভীকের দৃষ্টির আড়াল হতেই নিঃশব্দে হেসে দিল। সে হাসিটায় মিশে আছে নব প্রেমের অনুভূতি।

*

গহীন আঁধার মাড়িয়ে বাংলার আকাশে উঁকি দিয়েছে সূর্য। সবুজ শ্যামল প্রকৃতির উপর ঢেলে দিয়েছে সোনালী আলো। প্রথম আলোটা বড্ডো কোমল। সময় বাড়ার সাথে সাথে সেই কোমলতা রূপ নেয় উষ্ণতায়। ঘড়ির কাটায় ৯টা বেজে পাঁচ মিনিট। বিছানার পাশে জানালার পর্দা ভেদ করে এক ফালি উষ্ণ রোদ এসে পড়ল তাহিয়ার চোখে মুখে।
সূর্য্যের প্রখর আলো এসে চোখে পড়তেই ঘুম সম্রাটের আলিঙ্গন ছেড়ে মুক্ত হলো তাহিয়া। রাতে অভীকের আলতো স্পর্শের মাঝে কখন চোখে ঘুম নেমেছে, টের পায়নি। অভীকের কথা মনে হতেই চোখ খুলে তাকাতে চাইল। পরাস্থ হলো। আলোটা চোখে লাগছে, তাকানো যাচ্ছে না। তাহিয়া চোখ বন্ধ করেই বালিশের পাশে হাতড়াল।

অভীক ট্রলিতে কাপড় ভাজ করছিল। নাস্তা করেই বেরুবে সে। তার ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ হলো। কাপড় ভাজ করার ফাঁকে তাহিয়ার দিকে তাকাল। এত বেলা হচ্ছে, মেয়েটার ঘুম ভাঙার নাম নেই। তাহিয়ার নড়চড় দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু হাতড়াতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। নিজের কাজ থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু লাগবে?’

লোকটা রুমে আছে তবে! কখন উঠেছে? কোথায় ঘুমিয়েছে? সারারাত তার শিয়রে বসে কাটিয়েছে? কত প্রশ্ন উঁকি দিল তাহিয়ার মনে। অভীক প্রথমে জানালার সরে যাওয়া পর্দা টানল। রোদ্দুর থেকে তাহিয়াকে আড়াল করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। তাহিয়া নেত্রপল্লব মেলল। অভীক ততক্ষণে তাহিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অভীকের সুন্দর মুখশ্রী দেখেই দিনের শুরু হলো তাহিয়ার। রাতের কথা মনে হতেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। অভীকের দৃষ্টি এদিকে নেই। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে চারদিক কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। খোঁজাখুঁজির সমাপ্তি ঘটল ড্রেসিংটেবিলের কাছে গিয়ে। চশমাটা এখানেই পড়ে আছে। চশমা হাতে নিল। বিছানার দিকে পা বাড়িয়ে নিজের গায়ে জড়ানো গেঞ্জিতে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করার কাজটা সেরে নিল। তাহিয়া স্থির দৃষ্টিতে অভীকের কাজ পরখ করছে। লোকটার সব কাজে যেন তাকে মুগ্ধ করার মন্ত্র লেখা থাকে। অভীক তার দিকে এগিয়ে এসে চশমা পরিয়ে দিল চোখে। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ব্যাথা সেরেছে?’

তাহিয়া মাথা নাড়াল। অভীকের চোয়ালে প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট দেখা গেল। ও বোধহয় তাহিয়ার উত্তরের জন্যই রুমে ছিল। উত্তর পেয়ে দরজার দিকে এগুলো। যেতে যেতে বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে আসো।’

ফ্রেশ হয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে বের হলো তাহিয়া। রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ আসছে। তাহিয়া সেদিকে পা বাড়াল। অবনী পরোটা তেলে ভাজতেছে। তাহিয়া গিয়ে পাশে দাঁড়াল। ওকে দেখে অবনী চঞ্চল গলায় প্রশ্ন করল,
‘ মাথা ব্যাথা কেটেছে?’

‘হ্যাঁ।’ ধীরে বলল তাহিয়া। অবনী ফ্রাইপ্যান থেকে পরোটা তোলার ফাঁকে প্রশ্ন করল,
‘সকালে কী খাস তুই?’
‘পরোটা আর চা।’

অবনী হাফ ছাড়ল। এখন নতুন কিছু বানাতে হবে না। পরোটা ভাজা শেষ। সে এবার দুটো চুলোয় আলাদা আলাদা পাত্রে পানি বসাল। তাহিয়া সেটা পরখ করে বলল,
‘এত পানি দিয়ে কী করবে?’
‘চা বানাব। একটায় দুধ চা, অন্যটায় সবুজ চা।’

তাহিয়া প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে জানতে চাইল, ‘সবুজ চা কার জন্য? সবাই তো দুধ চা খায়।’

অবনী হেসে বলল, ‘ তোর বরের জন্য। ওঁর গ্রীণ টি ছাড়া চলে না। ‘

তাহিয়া অভীকের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে কিছুই জানে না। কাল সকাল অবধি অভীকের ব্যাপারে তার মন কৌতুহলী হয় নি অথচ আজ সকালে তার মনে হাজার কৌতুহল। সে হুট করেই জিজ্ঞেস করল,

‘আপু, স্যারের পছন্দের খাবার কী?’

চুলো থেকে চোখ সরিয়ে তাহিয়ার দিকে তাকাল অবনী। তার চোখে বিস্ময়। এই তো কদিন আগেই তো অভীককে বিয়ে করতে তার কত আপত্তি তাহিয়া! কত বদনাম করছিল! অভীক যেন তার চক্ষুশূল। এখন আগ্রহ দেখাচ্ছে! ভাবটাব হয়ে গেছে না কি! তবে তাহিয়ার চোখে আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে তাহিয়া মানতে শুরু করেছে। অবনী মুচকি হেসে বলল,

‘ অভীকের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে খিচুড়ি। খিচুড়ির সাথে হাঁস ভুনা, সাথে আচার। ‘

তাহিয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনল। যেন মনে মনে লিখে নিচ্ছে। অবনী রগড় করে জিজ্ঞেস করল,

‘অভীকের ব্যাপারে দেখি ব্যাপক কৌতুহল তোর। প্রেমে টেমে পড়ে গেলি না কি!’

তাহিয়া থতমত খেল। স্বীকার করতে চাইল না। নেতিবাচক মাথা নাড়াল। অথচ তার চেহারায় স্পষ্ট লজ্জা দেখতে পেল অবনী। তাহিয়ার ইতিভাব মনোভাব টের পেয়ে মনটা আনন্দে নেচে উঠল ওঁর। মায়ের সাথে সাথে সেও চিন্তিত ছিল, তাহিয়ার অমতে বিয়ে হয়েছে, অভীককে মানতে পারবে কি না। সে বলল,
‘ তোর চেহারা ভিন্ন কথা বলছে। আরে লজ্জার কিছু নেই, বলে দে। ‘

তাহিয়া নিরবতায় গা মাড়াল। অবনী প্রশ্ন বদলাল,
‘ কলেজের বাইরে এখনো অভীককে জাঁদরেল মনে হয়?’

তাহিয়ার উত্তর যেন প্রস্তুতই ছিল। সে তড়িৎ বলল,
‘না। কলেজের বাইরে উনি একবারেই ভিন্নরকম। ‘
‘সেই ভিন্নটা কেমন? ভালো না খারাপ?’
‘ভালো। চমৎকার একটা ব্যক্তিত্ব। ‘ ধীর স্বরে বলল তাহিয়া।

অবনী হৈ হৈ করে উঠল,
‘ আমি বিয়ের আগেই বলেছিলাম। একদিন বাসায় এসে দেখ, প্রেমে টেমে পড়ে যেতে পারিস। দ্যাখ, একদিন একসাথে থেকেই প্রেমে পড়ে গেলি। আমার ভাইটাই এমন।’

তাহিয়া লাজুক হাসল। অবনী টিপ্পনী কাটল,
‘অয়নের আবদার পূরণ হওয়ার আশা দেখা যাচ্ছে। ‘

কথার সারমর্ম বোধগম্য হতেই তাহিয়া কপট রেখে বলল, ‘ দু’লাইন বেশি বলো তুমি।’

তাহিয়ার কথার রেশ টেনে নীলিমা অবধি নিয়ে গেল অবনী। বসার ঘরে নীলিমা আর রেজাউল সাহেব, অভীক বসে আছে। টিভিতে খবর চলছে, সবার মনোযোগ টিভির পর্দায়।

নাস্তার জন্য ডাকতে গিয়ে অবনী বলল,
‘অভী, তোর তো লটারি লেগেছে। ‘

‘কী লটারি!’ টিভি থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করল অভীক।
অবনী হেসে বলল,
‘তুই এখনো টের পাসনি! ওদিকে তোর মন বদলের লটারি দরজায় এসে হানা দিল বলে। দরজা টরজা খুলে রাখ। ‘

অভীক বুঝতে পারল না বোনের কথা। সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। নীলিমা বললেন,
‘কী সব বলছিস? বুঝিয়ে বল?’

‘লটারি প্রমাণ সমেত তোমার বাসার দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে। তখন বুঝতে পারবে আমার কথার অর্থ। সকাল সকাল মনটা ভালো হয়ে গেল লটারির সংবাদে। সবার জীবন চিন্তামুক্ত।’
উৎফুল্ল গলায় বলল অবনী। ডাইনিং টেবিলে বসে অবনীর কথা শুনে আড়ষ্ট হলো তাহিয়া। আপুকে বলা ঠিক হয়নি, এখন স্যার টের পেলে লজ্জার ভাগী হবে।

*
নাস্তার পর্ব শেষে তাহিয়া, শ্বাশুড়ি আর ননাশের সাথে বসার ঘরে গল্পের আসর খুলে বসেছে। রেজাউল আহমেদ, আর তানভীর হাটতে বেরিয়েছে, অভীক রুমে। তাদের গল্পের মাঝে রুম থেকে খানিকটা জোরে আওয়াজ এলো,
‘ তাহিয়া, এদিকে আসো তো!’

গল্পে ব্যাঘাত ঘটল। তিন নারী কথা থামিয়ে নীরব রইল কিছুক্ষণ। তাহিয়া বিব্রতবোধ করল, সবার সামনে এভাবে ডাকার কী দরকার! অবনী হেসে উঠল, নিঃশব্দে। নীলিমা বললেন,
‘যা দেখে আয়।’

অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল তাহিয়া। ধীর পায়ে উঠে রুমের দিকে গেল। তাহিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে অবনী বলল,
‘মা, ছেলে বউ নিয়ে চিন্তা করো না, সে সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করেছে। ‘

নীলিমা অবাক চোখে তাকালেন। অবনী বলল,
‘লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, তিন বছর দূরে থাক তিন মাস যাওয়ার আগে তোমার ছেলে বউ তোমার বাড়ি গিয়ে উঠবে। বরণ ঢালা তৈরি রেখো’

নীলিমার চেহারা আকস্মিক আনন্দে ভরে গেল। ছেলে বিয়ে দিয়েও তার চিন্তার শেষ ছিল না। অভীকের ব্যক্তিত্বের জন্য তার শ্বশুরবাড়ি, বাবার বাড়ি থেকে কম সমন্ধ আসে নি। সব বাদ দিয়ে তিনি তাহিয়াকে বেছে নিয়েছেন। এত বড়ো মুখ করে বান্ধবীর মেয়েকে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। এখন যদি তাহিয়া অভীককে কষ্ট দেয় তবে সবাই তাকেই দোষী সাব্যস্ত করবে। অভীক কিছু না বললে ও নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে যাবেন।
নীলিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
‘এমন হলে তো ভালোই হবে।’

*

তাহিয়া রুমে গিয়ে দেখল অভীক ব্যস্তভঙ্গিতে তৈরি হচ্ছে। রুমে ঢুকতেই অভীক তাকাল ওঁর দিকে। বাঁ হাতের কবজির উপর ডায়াল ঘড়ি পরতে পরতে বলল,

‘আমি এখন বাসায় চলে যাব, মা বাবা যাবে বিকেলে । তুমি এখন আমার সাথে যাবে, না কি বিকেলে মা বাবার সাথে যাবে?’

তাহিয়া খানিক ভেবে বলল, ‘এখন আপু যেতে দিবে? একটু আগেও আমাকে বললেন কোনভাবেই আজ যেতে দিবেন না।’

ওয়ালেট পকেটে রেখে অভীক বলল,
‘তুমি তোমার ইচ্ছের কথা বলো। বাকিটা ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। ‘

তাহিয়া মাথা নিচু করে প্রসন্ন হাসল। লোকটা কী সুন্দর কথা বলে! শুনলেই কেমন যেন অনুভূতি হয়। সে বলল,
‘এখন যাব। তবে কলেজে যাব না আজ, বাসায় যাব।’

এ পর্যায়ে অভীক থামল। তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল,
‘ এখনও তো স্বামী, সংসারের দায়ভার তোমার কাধে আসে নি, তাতেই সব ভুলে বসেছো! দায়িত্ব কাধে এলে তো বোধহয় তোমাকে খুঁজে ও পাওয়া যাবে না।’

নিজের কথার সাথে অভীকের কথার যোগসূত্র খুঁজে পেল না তাহিয়া। কীসের মধ্যে কী বলছে লোকটা? সে ভ্রু কুঁচকাল,
‘মানে!

‘মানে আজ শুক্রবার। তুমি বারের হিসেব অবধি ভুলে বসেছো। ‘ শব্দযোগে হেসে বলল অভীক। তাহিয়া বিব্রতবোধ করল। সোজাসুজি বললেই তো হয়, এর জন্য স্বামী সংসার টানা লাগে!

তাহিয়াকে তৈরি হতে বলে রুম থেকে বেরুলো অভীক। মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
‘ মা, আমি বাসায় যাচ্ছি এখন। আজ তামিমদের সাথে ঘুরাঘুরির পরিকল্পনা আছে। সন্ধ্যার আগে ফিরতে পারব বলে মনে হয় না। বিকেলে বাবার সাথে চলে যেও তুমি।’

নীলিমা বললেন, ‘তাহিয়াকে রেখে যা। বিকেলে তোর বাবা দিয়ে আসবে ওকে ।’

অভীক শান্ত গলায় বলল, ‘ তাহিয়াদের বাসা আমাদের বাসার উল্টোদিকে। বাবাকে একবার আমাদের বাসায় যেতে হবে, তারপর তাহিয়াদের বাসায় যেতে হবে, আবার আমাদের বাসায় যেতে হবে। এসবে দৌড়াদৌড়ির মাঝে চার পাঁচ ঘন্টা লেগে যাবে। বাবার উপর প্রেশার পড়ে যাবে। তার চেয়ে বরং তাহিয়া আমার সাথে চলে যাক। আমি ওকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে যাব। কী বলো?’

অবনী থাকার জন্য বেশ কয়েকবার জোর করল। অভীক রাজি হলো না। নীলিমাও ভেবে দেখল, আসোলেই এতে তার স্বামীর উপর ধকল যাবে। আবার না অসুস্থ টসুস্থ হয়ে যায়। তারচেয়ে বরং অভীক দিয়ে আসুক। দুজনের একসাথে বের হওয়া হয়না, এ উপলক্ষে খানিক ঘুরাঘুরি ও হলো। তিনি সায় জানিয়ে বললেন,
‘তেমনই হোক। তবে যাওয়ার সময়ে ওকে কোথাও ঘুরিয়ে নিয়ে যাস। এতদিন হলো বিয়ের, কোথাও ঘুরতে নিয়ে গেলি না।’

মায়ের সম্মতি পেয়ে অভীক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, এখন বউ এবং মা দুজনের খুশি বজায় রাখা যাবে। তাহিয়া তৈরি হয়ে বের হলো। অবনী আর নীলিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সবে সদর দরজা অবধি দিয়েছে, তখনই সেখানে উপস্থিত হলো অয়ন। শুক্রবারে বেশ বেলা অবধি ঘুমায় সে। সবে ঘুম ভেঙেছে ওঁর। মামা মামীকে চলে যেতে দেখে দৌড়ে এসেছে। ঘুম ঘুম গলায় বলল,

‘ আমার গিফট না দিয়ে তোমরা কোথায় যাচ্ছো? মামা মামী তোমরা এমন করছো কেন! আমাকে একটা বোন এনে না দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছো কেন! ‘

তাহিয়া ঢোক গিলল। এ ছেলে আবার শুরু করেছে! অভীক কথা বাড়ানোর আগেই ঝটপট বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে বোনের উদ্দেশ্য গম্ভীরমুখে বলল,
‘তোর ছেলেকে আদব শিখা। দিন দিন বেয়াদব হচ্ছে।’

অবনী খিলখিল করে হেসে দিল। অভীকরা চলে যাওয়ার পর ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ পরের জন্মদিনে বোন পেয়ে যাবি, বাপ। শান্ত আর নিশ্চিত থাক।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here