#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_১৪
#লেখায়_জারিন
৭১.
রাত ১১ টা প্রায়। পুতুলকে ঘুম পাড়াচ্ছিল নক্ষত্র। হঠাৎ বালিশের তলা থেকে ভ’ভ শব্দে কেঁপে উঠলো তার সেলফোনটা। এক হাতে মেয়েকে বুকে আগলে দ্রুত হাতে ফোন বের করে সাইলেন্ট করলো নক্ষত্র। ফোনের শব্দে কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠেছে মেয়েটা। সে পুনরায় ঠিকঠাকভাবে ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো নক্ষত্র। আবারও শান্তভাবে ঘুমিয়ে যেতেই আস্তে করে তাকে বালিশে শুইয়ে দিল। পুতুলের ছোট্ট হাতের মুঠো থেকে নিজের টি-শার্টের কোণা ছাড়িয়ে নিল আলগোছে। মেয়ের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো সে।
রিং হতে হতে কলটা কেটে গেছে ইতোমধ্যে। বালিশের তলা থেকে ফোন বের করে দেখলো দুটো মিসডকল। ফোনের লক খোলার পর স্ক্রিনে ভেসে উঠলো কলদাতার নাম’পুতুলের আম্মু’। ঘুমন্ত পুতুলকে এক নজর দেখে সে সোজা পা বাড়ালো ব্যালকোনির দিকে। থাইগ্লাসটা চাপিয়ে দিতে দিতে কলব্যাক করলো ওই নাম্বারে।
দু’/ তিন বার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে নম্রস্বরে সালাম শোনা গেল। নক্ষত্র সালামের জবাব দিতেই ওপাশ থেকে ইরিন বললো, ‘কল করেছিলেন যে?
‘কখন করেছিলাম?’ কঠিন গলায় প্রশ্ন করলো নক্ষত্র।
‘৯’টার পরে। কেন বলুন তো?’
‘কতবার কল করেছি?’ রাগ চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে বললো নক্ষত্র।
‘৬ বার। ‘ অপরাধী গলায় বললো ইরিন।
‘রিসিভ হয়নি কেন?’
নক্ষত্রের কন্ঠ আরও বেশি কঠিন হয়ে এলো। একটু রাগও ছলকে পড়লো যেন তার গলার স্বরে। সেটা শুনে কিঞ্চিৎ ভয় খোঁচাখোঁচি শুরু করলো ইরিনের মনে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে যার জন্য নক্ষত্র রেগে আছে। তাছাড়া, খুব জরুরী কিছু না হলে কখনোই এতবার কল দিতো না সে। আর সেই কলও যখন রিসিভ হয়নি একবারও রাগ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। ইরিন অতশত ভাবলো না। ছলাকলাও করলো না। সরাসরি নক্ষত্রের রাগের সম্মুখিন হওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত করে নিল নিজেকে। তবে, সরাসরি সত্যিটাও বললো না।
‘ব্যস্ত ছিলাম। ফোন হাতের কাছে ছিল না। আপনি কল করেছিলেন কেন?’
‘দরকার ছিল। ‘ – কাঠকাঠ গলায় বললো নক্ষত্র।
‘কি দরকার?’ কৌতুহলী স্বরে প্রশ্ন করলো ইরিন।
‘তোমার সাথে ছেলেটা কে ছিল ? ‘
‘কার কথা বলছেন?
‘যার থেকে হাসি মুখে বিদায় নিচ্ছিলে আজ। কে ছিলো?
‘আপনি বাসায় এসেছিলেন?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ইরিন।
‘কেন বাসায় না গেলে কি অন্য কোথাও এই একই দৃশ্য দেখার সুযোগ হতো নাকি?’ চাপা ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বললো নক্ষত্র। ইরিন সেটা বুঝেও পাত্তা দিল না। বরং চিন্তিত স্বরে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো,
‘পুতুল ঠিক আছে? আর বাড়িতে…ঠিক আছে সব ? ভালো আছে তো সবাই?’
নক্ষত্র এসবের কোন জবাব দিল না। ওর রাগ লাগছে ভীষণ। ইরিন তার কথা এড়িয়ে যাচ্ছে বারেবার এটা তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না। এদিকে ইরিন অস্থির গলায় আবার বললো, ‘কি হলো…কথা বলছেন না কেন? হ্যালো…নক্ষত্র, শুনতে পাচ্ছেন আপনি? হ্যালো..?? ‘
‘আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি। এন্সার মি। ‘ নিজের শংকা আর অস্থিরতার বিপরীতে নক্ষত্রের এমন ঠান্ডা কন্ঠস্বর এবারে সত্যি সত্যি চিন্তায় ফেলে দিল ইরিনকে। তাই এবারে সরাসরি নক্ষত্রের প্রশ্নের সোজা উত্তর দিল।
‘আমার পরিচিতি একজন। ‘
‘ওয়াসিফের মত?’ তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো নক্ষত্র।
ইরিন অপমানটা গায়ে মাখলো না। কিন্তু কষ্ট পেল ঠিকই। নক্ষত্র আজও তাকে এই ভুলের জন্য ক্ষমা করেনি। অথচ, ও তো পুরো খেলায় রাণী হয়েও রাজার বিপরীতে ব্যাবহৃত একটা সৈন্য ছিল মাত্র। ওয়াসিফ মন্ত্রী হয়ে রাজার রাজত্ব চিরতরে শেষ করার জন্য ইরিনকে নিয়ে খেলে গেছে। যেটা শুধু ইরিন কেন পরিবারের একটা মানুষও বুঝতে পারেনি।
মাঝখান থেকে এত বছরের নোংরা খেলাটা যখন সামনে এলো বলির পাঠা বনে গেল ইরিন নিজে। যদিও হাড়িকাঠিতে চড়েও শিরচ্ছেদ হতে হয়নি ইরিনকে। কিন্তু, যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল সেটা আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। অথচ তার অপরাধ শুধু এটুকুই ছিল, সে অবুঝ হয়ে নক্ষত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ছেড়ে যেতে চেয়েছিল নক্ষত্রকে। সাথে পিছু ফেলে যেতে চেয়েছিল তাদের সম্মিলিত অংশকেও। আর ভাগ্য এই অন্যায়ের ন্যায়বিচার করতে গিয়েই বোধয় নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়েছিল তাকে, তার পূর্ণ আগমনের পূর্বেই।
আলগোছে আঙুলের আলিঙ্গনে আঁখিপল্লব সিক্ত করা চাপা কষ্টকে আগলে নিল ইরিন। হালকা নাক টেনে স্থির করলো নিজেকে। নক্ষত্রের রাগ ক্ষোভ আর অপমানের বিপরীতে নম্রকন্ঠে বললো, ‘আপনি হঠাৎ বাসায় এসেছিলেন কেন?’
‘আনাম কন্সট্রাকশনের প্রোজেক্ট ফাইল যে তোমাকে হ্যান্ডওভার করা হয়েছে, সেটা আমাকে রিপোর্ট করা হয়নি কেন?’
‘আপনি এটা জিজ্ঞেস করার জন্য এতদূর বাসায় এসেছিলেন?’ বোকা বোকা স্বরে প্রশ্ন করলো ইরিন। তা শুনে নক্ষত্রের মেজাজ চড়ে গেল একেবারে।
‘ওয়াসিফ দেখছি তোমার ব্রেন সিরিয়াসলি এত সুন্দর করে ওয়াস করেছে যে ওই মাথায় গোবরও জায়গা করতে পারেনি বিন্দুমাত্র। ইউ স্টুপিড উইমেন! একবাচ্চার মা হয়ে যাওয়ার পরেও চিন্তা ভাবনা এখনো তোমার সিস্টেমলেস। ‘ ধমকে বললো নক্ষত্র।
ইরিন বুঝলো প্রশ্নটা করা সত্যিই বোকামি হয়ে গেছে। তাই চুপচাপ হজম করে নিল সবটা। খানিক গলা ঝেড়ে বললো,
‘আমি কাল সকালেই আপনাকে প্রোজেক্ট ফাইলসহ রিপোর্ট করতাম। আসলে মামুন স্যার এত শর্ট নোটিশে প্রোজেক্ট হ্যান্ডওভার করে গেছেন, আমি গুছিয়ে উঠতে পারিন। তাই প্রোজেক্ট স্টাডি করে কাল…’
‘আমার ফাইল গতকাল পাওয়ার কথা ছিল। এন্ড আই নিড দ্যাট ফাইল ইমেডিয়েটলি। সেন্ড মি। ‘
‘কিন্তু ওটার কপি তো নেই আমার ল্যাপটপে। শুধু প্রিন্টেড কপির ফাইলটা আছে। কাল অফিস গিয়ে মামুন স্যারের কম্পিউটার থেকে কপি কালেক্ট করার কথা। ‘
‘আমার ফাইলটা এখনই লাগবে। আজ রাতেই লাগবে। এক ঘন্টার মধ্যে ওটা আমাকে মেইল করো যেভাবে হোক। ‘
‘আপনি কি পাগল? এত রাতে আমি ল্যাপটপ নিয়ে বসবো! তাছাড়া, ফাইনাল প্রেজেন্টেশন পরশুদিন। আমি কাল সকালেই রিপোর্ট করবো আপনার কেবিনে। এটুকু সময় অপেক্ষা করা যাচ্ছে না? ‘ কিছুটা চেঁচিয়েই বললো ইরিন। সারাবেলা বাইরে থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এখন ল্যাপটপ নিয়ে বসতে একটুও ইচ্ছা করছেন না ওর। কিন্তু নক্ষত্রের মুখ দিয়ে যখন একবার বেরিয়েছে তখন ওটা তার এখনই চাই।
‘আমি গিয়েছিলাম ফাইলটা আনতে। ৬ বার কল করেছি। তুমি তোমার সো কল্ড পরিচিত ছেলেটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে বিজি ছিলে দ্যাটস হুয়াই…
প্রচন্ড রাগে কথাগুলো বলছিল নক্ষত্র। কিন্তু ইরিন তা সম্পূর্ণ করতে দিল না। ইরিন বোঝে নক্ষত্র ইচ্ছে করে বলে না এসব। কষ্ট থেকে হওয়া রাগ থেকে বলে। তাই চুপচাপ সব অপমান, সব আঘাত সহ্য করে নেয়। কিন্তু মাঝে মাঝে সহ্য করাটা কষ্টকর হয়ে উঠে। প্রতিবাদ করার ক্ষমতা ওর নেই এখন আর।তাই সহ্য করা কষ্টকর হলেই নিরবে সরে আসে। নয় তো নক্ষত্রের আঘাত সয়ে যাওয়া ওর জন্য প্রায়শ্চিত্তর মতো। তাতেই সুখী ইরিন।
‘আমি মেইল করে দিচ্ছি আপনাকে। আর কাল সকালে আপনার কেবিনে ফাইলসহ রিপোর্ট করবো আমি। দ্যাট উইল বি ওকে, রাইট স্যার?’ একদম শান্তুস্বরে বললো ইরিন।
‘পুতুল গিয়েছিল আমার সাথে। তোমাকে দূর থেকেই দেখেছে ছেলেটার সাথে। শী গট আপসেট।আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ছুটির দিনেও আম্মুর কাজ থাকে বাবাই? একটুও সময় হয় না আমার জন্য!’ মেয়ের এমন প্রশ্নের কোনো জবাব আমি দিতে পারিনি। কারণ, সত্য বললে তোমার সম্মানটা থাকবে না ওর কাছে। পুতুলের আম্মু…তুমি পুতুলকে সময় দাও না, অথচ বাইরে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াও এটা সে সহ্য করতে পারেনি।বাসায় তালা থাকায় নীচে অপেক্ষা করছিল। অথচ তুমি তাকে খেয়াল করে দেখোনি পর্যন্ত। আমি তাকে নিয়ে ফিরে এসেছি।অভিমানে সারাপথ কেঁদেছে। বাসায় এসেও কেঁদেছে অনেক। নিজের স্বার্থে মেয়েটাকে তুমি কষ্ট দিচ্ছো, পুতুলের আম্মু। এতটা নীচে না নামলেও পারতে। ‘ প্রচন্ড রাগ ঘৃণা মিশেল ঠান্ডা গলায় বললো নক্ষত্র।
‘আমি নীচে নেমেছি বলেই পুতুলকে আপনার কাছে দিয়ে এসেছি। আমার ছত্রছায়া থেকে দূরে।’ সব শুনে শান্ত গলায় বললো ইরিন।
‘পুতুলের লাইফটা এমন দোটানায় না ফেললেও পারতে তুমি। আমি কখনোই চাইনি আমার মত জীবন ওর হোক। আর যাই হোক,তুমি যেমনই হও না কেন….একজন ভালো মা ছিলে। তারজন্যই এত কিছুর পরেও তোমাকে থেকে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি তো..’
‘আপনি চাইলেই পুতুলের মায়ের নামের জায়গাটা পরিবর্তন করতে পারেন। সেই সুযোগ করে দিয়েই তো এসেছি। ‘
‘আমি কিন্তু ডিভোর্স চাইনি পুতুলের আম্মু। পুতুল নিডস হার মাদার। ‘
‘সেই জন্যই তো জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে তবেই দূরে সরে এসেছি। যাতে আপনি চাইলেই অন্য কাউকে..
‘নিজের জন্য করেছো এমন। আমাকে তো তোমার পছন্দ ছিল না।নিজের অমতে বিয়ে করেছিলে। আবার নিজের একাংশ বিলিয়ে দিয়ে আমার ঘরে, আমার স্ত্রী হয়ে থাকার অভিনয় করেছো। আমার সন্তান জন্ম দিয়েছো। সবটাই নিজের মনের অনিচ্ছায়। কিছুটা আবার লোভে পড়ে।
আর এখন শুধু আমার জন্য আটকে আছো। নইলে কবেই হয় তো এমন আরেকজনের… কথাটা মুখ দিয়ে বের করতে পারলো না নক্ষত্র। যতই রাগ থাকুক, সত্য জেনে বুঝেও কেবলমাত্র রাগ- অভিমানের বশে নিজের ভালোবাসাটুকুকে অপমান করার সাহস ওর হয় না। তাই ওই কথাটুকু অসম্পূর্ণ রেখেই বললো,
‘এন্ড আই সোওয়্যার পুতুলের আম্মু, আমি কখনোই ডিভোর্সটা দিবো না। আমার মেয়ে কষ্ট পাবে আর তুমি অবাধে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরবে এটা আমি কখনোই হতে দিবো না। যতদিন বাঁচবে আমার স্ত্রী আর পুতুলের বৈধ মা হয়েই বাঁচতে হবে তোমাকে। এত সহজে তোমাকে ছাড়ছিনা আমি।’
‘মি. রাফিদ আমার বয়ফ্রেন্ড নয়, নক্ষত্র। উনি জাস্ট…’
‘সেন্ড মি দ্যা প্রোজেক্ট ফাইল, রাইট নাউ।’
কথা শেষ করেই টুক করে কল কেটে দিল নক্ষত্র। ইরিনের মুখে অন্য কোন ছেলের কথা ওর সহ্য হয় না। পুরোনো রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। ফোনটা পকেটে রেখে টি টেবিল থেকে লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল নক্ষত্র। কষ্ট পোড়াতে সে এভাবে নিজেকে পোড়ায়। পুতুলের জন্য আজকাল খুব একটা খাওয়ার সুযোগ হয় না। কিন্তু এখন নিজেকে শান্ত করতে একটা না খেলেই নয়।
সিগারেট মুখে নিয়ে আগুন জ্বালাতে গিয়েও পারলো না নক্ষত্র। পুতুলের পুতুল পুতুল মুখখানি ভেসে উঠে চোখের তারায়। সিগারেট ফেলে ঘরে ফিরে যায় আবার।
বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে পুতুল। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের এই মেয়েটি সত্যিকার অর্থেই এক জীবন্ত পুতুল যেন। রেণুর মতই ডাগর ডাগর চোখ। ঠোঁটগুলো ইরিনের মতই পাতলা।বোঁচা নাকের গোলগাল চেহারা। মাথাভর্তি ঢৈউ খেলানো কোকড়া চুল। সব মিলিয়ে ভীষণ মিষ্টি লাগে দেখতে। অথচ, শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে এমন মেয়েটাকেও মা ছাড়া করে চলে গেছে ইরিন। মেয়ের ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্র মনে মনে আউড়ালো ,
‘পরী…তুমি আমায় ছেড়ে যাবে বলে গেছো। কিন্তু, তোমার পুতুলটাও যে ফেলে গেছো। ফিরে এলেও তো পারো!’
৭২.
ঘড়িতে সময় রাত দেড়টা। আলমারির লকারে কিছু জরুরী ডকুমেন্টস তুলে রাখছিল নক্ষত্র। হঠাৎ চোখে পড়লো মেডিকেল ফাইলটা। নক্ষত্র সযত্নে লকার থেকে বের করে হাতে নিল সেটা। ফাইল খুলে আলোর সামনে মেলে ধরলো ভেতরে থাকা আল্ট্রাসোনোগ্রাফির শিটটা । বেশি কিছু না, মাতৃগর্ভে দলা পাকানো প্রায় ৯ সপ্তাহের একটা মাংসপিন্ডের ছবি। খুব একটা স্পষ্ট নয়, তবে খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় তার অস্তিস্ত্ব।
স্নেহভরা স্পর্শে ছবিগুলোতে হাত বুলালো নক্ষত্র। যেন ছুঁয়ে দিচ্ছে বাস্তব কোন জীবন্ত অবয়ব। মনে পড়ে যায় এই খন্ড সুখের মূহুর্তটা। কি পাগলামিটাই না করেছিল সে ব্যাপারটা জানার পর। মূহুর্তটা মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠলো নক্ষত্র। স্মৃতিরা মনের বন্ধ কপাট খুলে ছুটতে শুরু করলো পেছনে ফেলে আসা পথটায়। চঞ্চল কিশোরীর নুপুর পায়ে ছুটে চলার রুমঝুম শব্দের মত কানে ঝংকার তুলে ইরিনের অস্থির লাজুক কন্ঠস্বর।
_______________
‘এই…আপনি কি পাগল? এমন কেউ করে? দেখি ছাড়ুন। ‘ শাড়ির আঁচল টেনেটুনে পেটের কাছটায় ভালোভাবে ঢেকে নিয়ে বললো ইরিন।
‘এইইইই পরী…এমন করো কেন! জাস্ট একটু ছুঁবো। একটা চুমু দিবো। জাস্ট একটাই প্রমিস। -এই বলে নক্ষত্র ইরিনের পেটের উপর থেকে শাড়ির আঁচল সরানোর জন্য টানাটানি শুরু করলো আবারও।
‘এই না….আমার সুড়সুড়ি লাগে তো। আদর করলে এমনিতেও করা যায়। এর জন্য এভাবে ছুঁতে হবে কেন?’
‘না..যায় না। এভাবে দূরে দূরে লাগে। এটাচমেন্ট তৈরী হয় না। আর তুমি এমন করছো কেন ইরিন? কই আগে তো তোমার সুড়সুড়ি লাগেনি কখনো। রাগ বিরক্তি মিশেল গলায় বললো নক্ষত্র।
‘লা…আ..গতো। আর সবসময়ই লাগে। ‘ লাজুক গলায় বললো ইরিন। তারপর কপট রাগ বিরক্তি দেখিয়ে বললো, ‘কিন্তু আপনি তো…..’বলতে গিয়েও কথার প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
আর আপনার সমস্যা কি? আপনি আদর করবেন করুন। তারজন্য এমন শাড়ি ধরে টানাটানি করতেছেন কেন?’
‘ছিঃ পরী। এসব কি বলো। ভেতর থেকেও শোনা যায় তো। কি না কি ভাববে আমাকে নিয়ে? এভাবে বলে না আর।’ ইরিনকে সতর্ক করে বললো নক্ষত্র। তারপর, ইরিনের দুহাত টেনে নিজের কাঁধের পর রেখে বললো, ‘ধরে দাঁড়াও এভাবে। ‘
ইরিন অনিচ্ছা সত্ত্বে মেনে নিল নক্ষত্রের কথা। শক্ত করে নক্ষত্রের দু কাঁধ চেঁপে ধরে দাঁড়ালো। নক্ষত্রও আর দেরি করলো না। হাঁটু ভেঙে বসেছে সে। ওই অবস্থাতেই ইরিনের কোমড় চেপে ধরে দ্রুত শাঁড়ির আঁচল সরিয়ে গাঁঢ় করে একটা চুমু খেলো ইরিনের পেটে। তাতে হাত রেখে বললো,
‘স্বাগত আমার রাজকন্যা। তোমার আগমন শুভ হোক। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, আমাকে পরিপূর্ণ করার জন্য। থ্যাংক ইউ মাই ডিয়ার লিটিল লাভ’। কথা শেষ করেই আরেকটা চুমু খেলো সে তার অনাগত সন্তানকে।
৭৩.
ইরিন নক্ষত্রকে বাঁধা দেওয়ার সুযোগ পেল না। সে তার জেদ পূরণ করেই ছেড়েছে শেষপর্যন্ত। তাদের অনাগত সন্তানকে না ছুঁয়ে নাকি আদর করা যাবে না। এতে নাকি এটাচমেন্টটাই হয় না। অদ্ভুত সব কথাবার্তা! কিন্তু, ইরিন জানে বাইরে বাইরে সে বাঁধা দিলেও নক্ষত্রের এই খুশি..এই সুখ…এই পাগলামিটাই ইরিনের সব আপত্তিকে অচিরেই উপড়ে ফেলতে সক্ষম।
সে রাতের পর ইরিন যেন এক অন্য ইরিনে পরিণত হয়েছে। নক্ষত্রকে ভালো না বাসলেও একটু একটু করে তাতে ডুবে গেছে সে। নক্ষত্রের ভালো লাগা, খারাপ লাগা, তার পছন্দ অপছন্দ সবটাই যেন ওর কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠলো। স্ত্রী হিসেবে নক্ষত্রের প্রতি যে দায়িত্বগুলো পালন করতো তাতে মিশে গেল যত্ন। দিনকে দিন ইরিন অবিষ্কার করতে থাকলো স্বামী নামক এক প্রেমিক পুরুষকে। নক্ষত্রের যে ভালোবাসাটুকু ইরিন সুকৌশলে এড়িয়ে যেত সেই ভালোবাসাটাই পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে থাকলো দিনকে দিন। নক্ষত্রকে জানার, তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে এখন ওর মন। নক্ষত্রের স্পর্শের স্বাদ বদলে গেছে এখন । অস্বস্তি, সংকোচের জায়গায় তা পরিণত হয়েছে লাজুক এবং তৃপ্তিকর সুখানুভূতিতে।
আর এখন সেই সব স্পর্শের অনুভূতি, সুখগুলোকেই বাস্তবিকরূপে নিজের মাঝে বহন করছে সে। প্রস্তুতি না থাকলেও মা হওয়ার সুখকে দমিয়ে রাখতে পারেনি ইরিন। ইরিনের কেবল শায়লার বলা কথাটাই মনে পড়েছিল যখন এই সন্তানকে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছিল সে। ওয়াসিফের সাথে কথা হয়ে গেছে। মাস তিনেক পরেই দেশ ছাড়ার কথা। যদিও ওয়াসিফকে এখনো বলা হয়নি নতুন প্রাণের কথাটা। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছিল ইরিন।
কিন্তু, ওই যে! মাতৃত্ব একটা একনিষ্ঠ অনুভূতি। একক পরিচয়। এটা উপেক্ষা করা অসম্ভব। তাছাড়া, মাতৃত্ব শুধু সন্তান চিনে। সে সন্তান কার অংশ তার থেকেও বেশি গুরুত্ব পায় মাতৃত্বের স্বাদ..অনুভূতি। ‘
যদিও মাঝে মধ্যেই ওয়াসিফের ফোনকল, ম্যাসেজ ওকে মনে করিয়ে দেয় ও নক্ষত্রের মোহে পড়েছে। এটা কাটিয়ে ওকে চলে যেতে হবে অনেক দূরে। ওয়াসিফ নামক মানুষটার কাছে, যাকে সে চায়। একটা সুন্দর, স্বস্তিদায়ক জীবন ওর জন্য অপেক্ষমান। এই মোহ ক্ষণিকের। ছেড়ে গেলেই ছুটে যাবে। কিন্তু একই মন আবার পক্ষ বদল করে বলে, মোহ নক্ষত্র নয়…ওয়াসিফ নামক মরিচিকাটা।ইরিন যা চায় তা ওয়াসিফ তাকে দিতে সক্ষম বলেই সে ওয়াসিফের প্রতি মোহে পড়েছে। নক্ষত্র তাকে ভালোবাসে। মোহের বিপরীতে ভালোবাসাকে দাঁড় করিয়ে দেখো কার জোর কতখানি! মোহ একসময় ঠিকই ধোঁয়াশা কাটিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, আর দিন শেষে থেকে যাবে ভালোবাসা। ভেঙে যাওয়া তুমিটাকে কেউ যদি সযত্নে আগলে রেখে আবার গড়িয়ে নিতে পারে সেটাও ভালোবাসা। আর নক্ষত্র তোমার জন্য সেই ভালোবাসার স্বরূপ। একে ছেড়ে যাওয়া ভুল। ইরিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। বিভ্রান্ত হয়ে হাঁপিয়ে উঠে। সব ভুলে গিয়ে মত্ত হয় নক্ষত্র বন্দনায়। মনকে প্রবোধ দেয়, ‘ছেড়ে গেলেই ছুটে যাবে সব মোহ। নক্ষত্র একটা মোহ।কেবলই মোহ। ‘
৭৪.
ইরিনও বোঝে, দিন শেষে আজকাল এই মানুষটাকেই ওর সবটাজুড়ে চাই। রাতটুকু তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ না হলে ঘুম হয় না। অথচ একসময় নক্ষত্রের এই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমানোটাই ওর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল একপ্রকার। অস্বস্তি বিরক্তিতে গাঁট হয়ে পড়ে থাকতো বিছানায়। রাতের ঘুমের খামতিটা দিনে ঘুমিয়েও পুষাতো না।
এভাবে অল্প কিছু দিনেই যখন চেহারায় এর ছাপ পড়তে শুরু করে..তা দেখে একদিন নক্ষত্র অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তোমার কি রাতে ঘুম হয় না ইরিন? চোখ মুখ এমন কেন হচ্ছে দিনকে দিন!’
নিয়মিত ঘুম না হওয়ায় মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে ইরিনের। অল্পতেই মেজাজ খারাপ হয় তার। নক্ষত্রের এমন প্রশ্নেও ইরিন বিরক্তি আর রাগ মিশেল গলায় বলেছিল,
‘শাস্তি ভোগ করছি তো। তারই ছাপ এটা।’
‘মানে কি? ‘অবাক হয়ে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।
‘কিছু না। ‘ গোমরা মুখে জবাব দেয় ইরিন।
‘তোমার আমার সাথে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছে ইরিন?’ -সংশয় ভরা কন্ঠে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।
‘হলেই কি? কি করবেন কি আপনি?’ চেঁচিয়ে বললো ইরিন।
‘সমাধান করার চেষ্টা করবো। ‘ শান্ত কন্ঠে জবাব দেয় নক্ষত্র। তার গলার স্বরে ইরিনও শান্ত হয় কিছুটা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
‘তাহলে আমার থেকে দূরে সরে ঘুমাবেন।আর আমাকে দয়া করে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দিবেন প্লিজ।।তাহলেই হবে।’
সেদিন থেকে নক্ষত্র আর ইরিনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়নি। বিছানার মাঝখানটায় কোলবালিশ রেখে এক কোণায় ইরিনের থেকে দূরে শুয়ে থাকতো। তবে এটা খুব বেশিদিন টিকেনি। সপ্তাখানেকের মাথায় একরাতে ইরিন আবারও কোলবালিশের বর্ডার ডিঙিয়ে হাত পা তুলে দেয় নক্ষত্রের শরীরের উপর। নক্ষত্র ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারেনি। বরং ইরিন আগের অভ্যাস মতই বালিশ ছেড়ে জায়গা করে নেয় নক্ষত্রের বুকে।
সকালে নিজেকে নক্ষত্রের বাহুবন্ধনে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় পায়। নক্ষত্রও সুযোগ হাতছাড়া করেনি। ইরিনকে খোঁচা মেরে রসিকতার স্বরে বলেছিল,
‘তুমি হাত পা ছুঁড়ো বলেই তো তোমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশিয়ে নিতাম নিজের সাথে। তবুও তোমার শোয়ার স্টাইল চেঞ্জ হলো না ইরিন। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ যে আসবে তার তো বিছানায় শুয়ে ঘুমানো হারাম হয়ে যাবে। না…না…সে রিস্ক আমি আর নিবো না। আজ রাত থেকে তোমার সোজা হয়ে ঘুমানোর ট্রেনিং আবার শুরু করবো আমরা, কেমন?’
ইরিন পুরো বোকা বনে গেছিল নক্ষত্রের কথায়। সে ভেবে পায় না, নক্ষত্রের মত এমন স্বল্পভাষী, ভদ্র স্বভাবের লোকের মাথায় এমন পাগলাটে আর আহ্লাদি কথা বার্তা কই থেকে আসে! এমন দায়িত্বশীল, সচেতন মানুষটাও মাঝে মাঝে ইরিনের কাছে শিশুসুলভ হয়ে ওঠে। আদর আহ্লাদে একাকার করে ফেলে ইরিনকে।নিজের আবদারগুলোয় বাচ্চাদের মতই জেদ করে। আদায় করে ছাড়ে। যদিও তা কখনোই ইরিনের সাধ্যের বাইরে হয় না। জোরপূর্বকও কোন কিছু করতে হয় না তাকে। তবুও, মাঝে মাঝে নক্ষত্রের এমন বাচ্চামো আচরণের অবাক না হয়ে পারে না ইরিন।
আর সেদিন রাত থেকে আবারও তার জায়গায় হয় নক্ষত্রের বাহুবন্ধনে। হাল ছেড়ে দেয় ইরিন। ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। সেটাও ইরিন টের পায় যে রাতগুলো নক্ষত্র কাছে থাকতো না তার। কাজের সূত্রে যখন প্রায়ই নক্ষত্র শহর ছাড়া হতো ইরিনের ঘুমও ছেড়ে দিত তাকে। বিছানায় এ পিঠ ওপিঠ করেই কেটে যেত বেশির ভাগ রাতটুকু। নক্ষত্রের স্পর্শ পেলে তবেই আরামের ঘুম নেমে আসতো চোখে। ইরিন এই বদভ্যাস নিয়েও বিরক্ত হয়ে উঠেছিল নিজের প্রতিই। তবুও মনকে প্রবোধ দিত, দূরে গেলেই অভ্যাস বদলে যাবে। নয় তো অন্যকারও বাহুবন্ধনেই আপোষ করে নিবে এই অভ্যাসটা।’
৭৫.
শরীরে সিক্ত অনুভূতি হতেই চমকে উঠে ইরিন। নক্ষত্র কাঁদছে। ইরিনের কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুঁজে নিরবে কাঁদছে সে। ইরিনের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো নক্ষত্রকে এভাবে কাঁদতে দেখে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তাকে কাঁদতে দেখছে ইরিন। অস্থির হয়ে উঠলো সে। দ্রুত নক্ষত্রের মাথা চেপে ধরে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। নীচু হয়ে মেঝেতে বসে পড়লো নক্ষত্রের মুখোমুখি হয়ে। নক্ষত্রের দুগালে হাত রেখে অস্থির গলায় প্রশ্ন করলো, ‘এই আপনি কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে আপনার? ‘
নক্ষত্র কিছু বলে না। সিক্ত চোখমুখেই মিষ্টি করে হাসে। ইরিন বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় এই সিক্ত হাসিটুকু দেখে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নক্ষত্র। ইরিনের কানে ভেসে আসে নক্ষত্রের উল্লাসিত সিক্ত কন্ঠ।
‘তোমাকে ধন্যবাদ দিবো না পরী।এটা অনেক কম…বলতে গেলে কিছুই না তোমার জন্য। তুমি আমার পূর্ণতাকে পরিপূর্ণ করেছো ইরিন। আমার রাজকন্যাকে তোমার মাঝে জায়গা দিয়েছো। তোমার এই ঋণ আমি কিভাবে শোধ করি বলো তো? কি চাও তুমি বলো। আমি আমার সব দিয়ে দিবো। তুমি যা চাইবে তাই দিবো। ‘
‘অনেক বেশি খুশি হয়েছেন আপনি?’ মিষ্টি হেসে নক্ষত্রের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ইরিন।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ‘ সন্তুষ্ট ও উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো নক্ষত্র।
ইরিন আলতো হাসলো। বললো, ‘যা চাইবো দিবেন আমাকে?’
‘ইন শাহ আল্লাহ। তুমি যা চাইবে তাই দিবো। তুমি শুধু আমার রাজকন্যাকে যত্নে রেখো তোমার মাঝে। ‘
‘আপনি এত শিওর কি করে যে এটা মেয়ে বাচ্চাই?’
‘আই ক্যান ফিল ইট।’
‘আচ্ছাহ!! বাট হাউ?’
‘জানো পরী,একবার ভীষণ অসুখে পড়েছিলাম আমি। মা আমার খুব যত্ন করেছিল। সারাদিন খাটাখাটনি করে এসেও আমার যত্নে কোন ভুল নেই তার। তখন একবার বলেছিলাম মাকে, ‘মা! তুমি আমার কত যত্ন নাও। আমি তো পারি না তোমার যত্ন নিতে। আমি কবে পারবো?’
মা সেদিন মিষ্টি হেসে বলেছিল, ‘তুমি তো আমার সোনা বাচ্চা। বাবজান লাগো।আমি যখন বুড়ি হয়ে যাবো তখন আমি তোমার মা থেকে মেয়ে হয়ে যাবো। তখন তুমিও আমার যত্ন করো। ‘
আমি সেদিন বুঝিনি মায়ের কথাটার অর্থ। আর তারপর তো কিছু বুঝে উঠার সুযোগই দিল না মা। সে বুড়ি হলো না। আমার মেয়ে হয়ে ওঠাও হলো না তার। কিন্তু,এখন আমার মন বলছে আমার মায়ের বুঝি বুড়ি হওয়ার ইচ্ছে ছিল না।তাই আমার মা সরাসরি আমার মেয়ে হয়েই ফিরছে আমার কাছে। তাই এটা আমার মাই…আমার রাজকন্যা। ইরিনের পেট ছুঁয়ে বললো নক্ষত্র।
‘আর যদি রাজকুমার হয়? ‘
‘রাজকন্যাই আসছে। তুমি দেখে নিও!’ আত্মবিশ্বাসী গলায় বললো নক্ষত্র। ‘
‘বাহ! মানুষ ছেলে চায় আর আপনি মেয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন। যুগ সত্যিই পালটে গেছে অনেক। ‘ আফসোসের স্বরে বললো ইরিন।
‘ছেলে ছেলে করে না। করতো! আর ছেলে চাইতো বলেই আমার আম্মুর তিন রাজকন্য আর তোমার মায়ের চারটা। আর তোমার সামনে এই অস্বীকৃত নক্ষত্র।’ শুরুতে রসিকতা করে বললেও শেষ কথাটায় মলিন হাসলো নক্ষত্র।
পরিস্থিতি গম্ভীর হতে দেখে ইরিন প্রসঙ্গ পাল্টালো। নক্ষত্র জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার রাজকন্যাকে যত্নে রাখার জন্য আমি কি পাচ্ছি বলুন!’
‘কি চাও তুমি? আমার সবটাই তোমাকে দিয়েছি আমি। বাকি থাকার মাঝে কেবল এই চলন্ত নিঃশ্বাসের প্রাণটুকুই। তবে এটুকু তুমি চাইলেও আমি দিবো না। আমি বাঁচতে চাই। একটা পরী আর একটা রাজকন্যাকে আমৃত্যু পাশে নিয়ে বাঁচতে চাই আমি। সে সময়টুকু যত কমই হোক না কেন! এবার বলো তো কি চাই তোমার?’
‘উউউমমম…ঠিক আছে। তবে এখন না। তোলা রইলো। সময় মত চেয়ে নিব। ‘ রহস্যময় কন্ঠে বললো ইরিন।
‘জো আপকি মার্জি মেরী, পারী।’ হেসে দিয়ে বললো নক্ষত্র। হাসলো ইরিনও। ভীষণ সুখের একটা মূহুর্তে আচ্ছন্ন দুজনেই। নক্ষত্র নিজের পরিপূর্ণতার আনন্দে মত্ত আর ইরিন নক্ষত্রের খুশিতে!
হঠাৎ ইরিনকে ছেড়ে দিয়ে ওর মুখখানি আঁজলা নিয়ে নিল নক্ষত্র। কপালে প্রগাঢ়ভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে প্রথমবারের মত ঘোর লাগানো কন্ঠে বললো, ‘ভালোবাসি পরী। ‘
৭৬.
রক্তে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে স্টেচারের সাদা চাদরটা। নক্ষত্র প্রাণপণে ছুটছে স্ট্রেচার নিয়ে। রক্তে মাখামাখি ইরিন। তবুও, নিজের নিস্তেজ হাতে যথাসম্ভব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে নক্ষত্রের হাত। নক্ষত্রের সেদিকে হুশ নেই। সে ছুটছে অপরেশন থিয়েটারে যাওয়ার লম্বা করিডোর ধরে।
শ্বাস নিতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ইরিনের। এই বুঝি প্রাণ পাখি দেহপিঞ্জর ছেড়ে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। কিন্তু, তার তো একটা সুযোগ চাই। নক্ষত্রকে তার রাজকন্যা দেওয়ার একটা সুযোগ সে চায়। আচ্ছা, রাজকন্যার প্রাণ ভোমরা কি এখনো বহন করছে সে? নাকি রক্তে রক্তে ভেসে গেছে?
এসব কথা মনে হতেই নক্ষত্রের ধরে রাখা হাতটা টেনে তাকে থামানোর চেষ্টা করলো। নক্ষত্র সেটা বুঝতে পেরে কেবল এক ঝলক হাতের দিকে আরেকবার ইরিনের দিকে চাইলো। কিন্তু থামলো না। রাগ, ঘৃণা, ভয়ে মাথা কাজ করছে না নক্ষত্রের। ইরিনকে ওর সহ্য হচ্ছে না কিছুতেই। কিন্তু, ইরিনকে হারানোর ভয়টাও তীব্র থেকে তীব্ররূপ ধারণ করছে।
ঘৃণা ও রাগ মিশেল সে দৃষ্টি ইরিনের বুঝতে অসুবিধা হলো না। তীব্র যন্ত্রণার মাঝেও নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য করে হেসে ফেললো ইরিন। মনে মনে প্রার্থনা করলো, রাজকন্যাকে রাজার কাছে দিয়ে যাওয়ার সুযোগ যেন ওর হয় অন্তত। তারপর, পরাণ পাখি ছেড়ে যাক।সে মুক্তি পাক আর না পাক, নক্ষত্র যেন তার রাজকন্যা না হারায়।
রক্তে মাখামাখি শার্ট,প্যান্ট নিয়েই অস্থির মনে করিডোরের চেয়ারে শান্ত হয়ে বসে আছে নক্ষত্র।বিদ্ধস্ত মনে রাগ, ঘৃণা ছাপিয়ে ক্রমশ গ্রাস করছে নতুন করে প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলার আশংকা আর ভয়। এক সাথে দু’দুটো ভালোবাসার প্রাণ নিয়ে টানাপোড়ন চলছে কিছু দূরেই ওটির ভেতরে।
ডাক্তার বলে গেছে বাচ্চার না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। রক্তক্ষরণ হয়েছে অনেক। মায়ের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনাও খুব একটা নেই। তবুও তারা চেষ্টা করবে। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার মর্জি।
টানা পৌনে এক ঘন্টা পর ওটির বাইরের লাল আলো নিভলো। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে চাইলো নক্ষত্র। ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছে। বয়স খুব একটা বেশি নয়। ডাক্তার হয়েছে হবে হয় তো কয়েকবছর মাত্র। সিনিয়র ডক্টরের সাথে ওটিতে ঢুকার সময় সেই ইরিনের সম্ভাব্য অবস্থার কথা বলে গেছিল নক্ষত্রকে।
‘কিছু বলবেন?’ একদম ক্লান্ত নিস্তেজ গলায় বললো নক্ষত্র।
ডাক্তার ছেলেটি বেশ অবাক হলো নক্ষত্রের এমন আচরণে। তাকে দেখে নক্ষত্রের অস্থির হয়ে উঠার কথা। ইরিনকে নিয়ে প্রশ্ন করার কথা। অথচ, কি স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করছে, কিছু বলবে কিনা! ছেলেটি ভাবলো হয় তো আসন্ন পরিস্থিতি আন্তাজ করে শোকাচ্ছন নক্ষত্র। তাই এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। সে নক্ষত্রের কাঁধে মৃধু চাপ দিয়ে বললো, ‘ধৈর্য্য ধরুন প্লিজ। আপনার স্ত্রীর এখন আপনার সাপোর্টটাই বেশি প্রয়োজন। ‘
‘বাচ্চাটা আর নেই, না?’
‘উই আর রিয়েলি স্যরি, মি…’
‘আদৃত রাওনাফ নক্ষত্র।’
‘ইয়াহ, শিওর। আপনি তো নিজের চোখেই দেখেছেন কতখানি ব্লিডিং হয়েছে। আমার ৪ বছরের ডাক্তারি জীবনে এমন এক্সিডেন্টাল মিসক্যারেজের কেস এই প্রথম দেখেছি আমি। যতটা ব্লিডিং হওয়ার পর একটা বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব হয় না তার থেকেও অনেক বেশি ব্লিডিং হয়েছে উনার। ৩ ব্যাগ রক্ত অলরেডি দেওয়া হয়েছে। ৪ নাম্বারটা চলছে। আরও ২/৩ ব্যাগ লাগবে হয় তো। আপনি এরেঞ্জ করুন প্লিজ। ‘
‘বাচ্চাটা মেয়ে ছিল নাকি ছেলে?’
‘মেয়ে! আপনি দেখবেন ওকে?’
ডাক্তারের কথায় অবিশ্বাস্য চোখে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো নক্ষত্র। তা দেখে মলিন হাসলো ডাক্তারটি। একজন নার্সকে ডেকে বললো, বাচ্চাটাকে নিয়ে আসতে।
৭৭.
স্টিলের ট্রেতে নিশ্চিন্তে চোখ বুজে পড়ে আছে ৫ মাসের অপরিপক্ব ছোট্ট একটা শরীর। সদ্য আকার পাওয়া পিচ্চি পিচ্চি হাত পা, মাথা, বন্ধ চোখ! মাথায় চুল হয়নি একটুও। আরেকটু বড় হলেই বোধয় চুল গজানো শুরু করতো। রক্ত পরিষ্কার করা হয়নি। ইরিনের নাড়িকাটা ধন, নক্ষত্রের রাজকন্যা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে সামান্য একটা স্টিলের ট্রেতে। অথচ তার থাকার কথা ছিল মায়ের বুকে, বাবার দু হাতের ভাঁজে গড়া স্নেহময় আনাড়ি কোলে।
নিজের অংশকে এভাবে দেখে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না নক্ষত্র। চোখ বন্ধ করে ফেললো আবারও। ভেতর থেকে প্রবল এক শব্দহীন চিৎকার যেন ঠেলেঠুলে বের করে দিতে চাইছে সব কষ্ট সব যন্ত্রণা। কিন্তু, কোথাও একটা বাঁধা পেয়ে খাঁচায় বন্দী পাখির মত ছটফট করছে কেবল।
নক্ষত্র উঠে দাঁড়ালো। ডাক্তারকে পাশ কাটিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যেতে থাকলো লম্বা করিডোর ছাড়িয়ে। বাইরে আযান শোনা যাচ্ছে। তাকে ডাকা হচ্ছে নিজের প্রভুর সেজদায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। নিজের সব কষ্ট, যন্ত্রণাকে প্রভুর কাছে অবলিলায় উজাড় করে দেওয়ার জন্য এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে। নক্ষত্রও পা বাড়ালো সেদিকে।
আযান শোনা যাচ্ছে। নক্ষত্র হেঁটে চলেছে। কিন্তু মসজিদ খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও। আযানের ধ্বনি অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতেই আরও স্পষ্ট হয়ে এলো আযানের সুমধুর ধ্বনি। চট করেই চোখ খুলে গেল নক্ষত্রের। মিনিট দুই সময় উদ্ভ্রান্তের মত তাকিয়ে রইলো সিলিং এর দিকে। তারপর, সোফার হাতল ধরে আস্তে ধীরে সোজা হয়ে উঠে বসলো।
কিছুদূরে তাকিয়ে দেখলো বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমাচ্ছে পুতুল। সচেতন মস্তিষ্ক জানান দিল, আবারও সে একই স্বপ্ন দেখছিল আজও।
চোখের কোণায় কষ্ট এসে ভীড়ে ধীরে ধীরে। কন্ঠস্বর ভিজে উঠে চাপা আর্তনাদের সুরে। হাতে থাকা আল্ট্রাসোনোগ্রাফির শিটটা বুকে চেপে ধরে নক্ষত্র। চাপা কন্ঠে ঠোঁট নেড়ে বলে, ‘আ’ম স্যরি সোনা। বাবা তোমাকে আগলে রাখতে পারেনি। প্লিজ মাফ করে দিও। ‘
চলবে…