#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_৮
#লেখায়_জারিন
৩৪.
‘আপনি ছাড়া অন্য আর কেউ আমার মতামত জানতেই চায়নি এই বিয়ে নিয়ে, কিছু বলে বা কোন কারণ দেখিয়ে সম্বন্ধ ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগটাই কই ছিল তাহলে আমার?’
মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বেশ শান্ত স্বরে বললো ইরিন। কথা গুলো বলতে বলতেই ভেতরের অসহায়ত্ব, অভিমান কয়েক ফোঁটায় উপচে পড়লো চোখের কার্নিশ টপকে।
নক্ষত্র সেটা দেখাও কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ইরিনের কথায় সে তার প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পায়নি। তাই আবার প্রশ্ন করলো, ‘তাহলে আমাকে জীবনেও বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ?’
নক্ষত্রের এমন প্রশ্নের পর কিছুটা সময় নিল ইরিন। নক্ষত্রও চুপচাপ অপেক্ষা করলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরিন নক্ষত্রের মুখ পানে চাইলো। নক্ষত্রের চোখের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল, ‘ কারণ কোন ধনী ব্যক্তির সাথে আমার বিয়ে হোক এমনটা কখনো চাইনি আমি। আমি যেমন মধ্যবিত্ত তেমনি একটা মধ্যবিত্ত সংসার চেয়েছিলাম। নিজ হাতে সাজানো গোছানো ছোট একটা সংসার। অথচ আপনার বাড়িতে কোন কিছুর অভাব নেই। এক গ্লাস পানি খেতে গেলেও সেটা গ্লাসে ঢেলে দেওয়ার জন্যও কেউ না কেউ হাজির থাকে। রান্নাঘরে রান্নার লোক আছে। হাত পুড়িয়ে রান্না করারও প্রয়োজন হয় না। মুখ ফুটে বলতেই সব কাজ হয়ে যায়। অথচ, এত বিলাস বহুল জীবন কখনোই কাম্য ছিল না আমার। ‘
কথা শেষ করে চোখ নামিয়ে নিল ইরিন। ভেতর ভেতর মস্ত বড় এক ঝড় চলছে তার। মূল সত্যিটা ছাপিয়ে আংশিক ও সম্পূর্ণ অযাচিত কারণটাই ও নক্ষত্রকে বলেছে। সত্য বলার সাহস এই মূহুর্তে একেবারেই নেই ইরিনের। নক্ষত্রের চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলতে গিয়েও ভীষণ রকম যন্ত্রণা হচ্ছিল ওর। যেন জ্বলন্ত লোহা চেপে ধরেছিল কেউ বুকের উপর। তবুও নিজেকে নিজের কাছেই সবচেয়ে নীচে নামিয়ে এনে কারও চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলেছে সে। মূহুর্তের জন্য তার মনে হলো, এখনই যদি মরে যেতে পারতো….আজীবনের এত মিথ্যে বয়ে বেড়ানো থেকে যারপরনাই বেঁচে যেতো সে। কিন্তু, ইরিন জানে এমন মরণও ওর কপালে নেই। চাইলেই সে এভাবে মুক্তি পাবে না। তার সৃষ্টি কর্তার হুকুম ছাড়া মৃত্যুও তার জন্য নিষিদ্ধ।
৩৫.
ঘরজুড়ে পিনপতন নিরবতা। বেশ কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পরেও নক্ষত্র কিছু বললো না। ইরিনের অপেক্ষা করতে করতে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করাটাও যেন সেকেন্ডের চাইতেও দ্রুত বেগে বেড়ে চলেছে তার। এখন সে মনে প্রাণে চাইছে হয় নক্ষত্র ওকে কিছু বলুক নয় তো ও এখান থেকে…নক্ষত্রের চোখের সামনে থেকে আড়ালে কোথাও চলে যাক। কিন্তু, অনেকক্ষণ একইভাবে বসে থাকার পরেও এসবের কিছুই ঘটলো না।
ধৈর্য্যে চির ধরলে এবার আড়চোখে একবার নক্ষত্রকে দেখার চেষ্টা করলো ইরিন। নক্ষত্র যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেভাবেই ইরিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। একধ্যানে চেয়ে দেখছে সে ইরিনকে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু,মুখে কিছু বলছে না।
এভাবেই আরও মিনিট দুই যাওয়ার পর আচমকা এগিয়ে গিয়ে একহাতে ইরিনের হাত ধরলো নক্ষত্র। চমকালো ইরিন। কিন্তু কিছু বললো না। তাকে হাত ধরেই টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করালো নক্ষত্র। ইরিন অবাক হয়ে কেবল নক্ষত্রের কাণ্ডকারখানা দেখছে। এসবের মাঝেই তাকে আরও বেশি অবাক করে দিয়ে নক্ষত্র বললো,
‘তোমাকে একটু গভীরভাবে স্পর্শ করি, ইরিন? জাস্ট একটুখানি?’
নক্ষত্রের কথা শুনে যতটানা অবাক হলো ইরিন তার থেকেও বেশি বিচলিত হলো নক্ষত্রের কন্ঠস্বরে। চমকে তার চোখের দিকে তাকাতেই অনাকাঙ্ক্ষিত এক আশংকায় হৃদস্পন্দন সংকুচিত হয়ে এলো তার। বিষ পিঁপড়ার কাঁমড়ের মত চিনচিনে এক ব্যাথা খাঁমচে ধরলো বুকের ভেতরটায়। হ্যাঁ বা না কিছু বলার কথাও ভুলে গেল ইরিন। ইরিনের ওমন আতংকিত মুখখানা দেখে মুচকি হাসলো নক্ষত্র।যা আরও বেশি ভয় ধরিয়ে দিল ইরিনের মনে।
৩৬.
কোমড়ে শক্তপোক্ত এক পুরুষালি হাতের আলতো স্পর্শ পেতেই শিউরে উঠলো ইরিন। কোমড় চেপে ধরেই তাকে টেনে নেওয়া হলো আরও কাছে। কি ঘটতে চলেছে তা ঠিকঠাক আন্দাজ করার আগেই এক গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো সে নক্ষত্রের প্রশস্থ বুকে। খুব যত্ন করে নিজের অন্য হাতটা দিয়ে তার মাথাটা নিজ বুকে চেপে ধরলো নক্ষত্র। আলতো করে চুমু খুলো ইরিনের ঝরঝরে মোলায়েম চুলের ওপর। সময় যত গড়ালো হাতের বাঁধনও গাঢ় হলো নক্ষত্রের। গভীর থেকে গভীরতম হলো সে আলিঙ্গনে মাত্রা। ঠিক ততোটাই গভীর যতটা গভীরে গেলে হৃদ মাঝারে মিশে যাওয়া যায়।
একদিকে এতদিনের সব সংশয়, সব ভুল ধারণা আর একটু আগের উৎকন্ঠাময় পরিস্থিতির অবসান শেষে এক পশলা বৃষ্টির পরে ফুরফুরে হওয়া প্রকৃতির মত লাগছে নক্ষত্রের। পরম আনন্দে দ্বিধাহীন হয়ে কাছে টেনে নিয়েছে নিজের জন্য কাঙ্খিত নারীটিকে। পরম তৃপ্তিতে সে গ্রহন করছে তাদের প্রথম আলিঙ্গনের স্বাদ।
অন্যদিকে ইরিনের শ্বাস ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে। প্রথমবারের মত কোন পুরুষের বুকে এমন গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়েছে সে। স্পর্শটা যতটা না বৈধ তার থেকেও বেশি আদর যত্নে মাখা । অথচ, এই স্পর্শ এই ব্যক্তি সবটাই তার অনাকাঙ্ক্ষিত। এই স্পর্শ তাকে ভেতর ভেতর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। অসহ্য এক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে বারেবারে। দমবন্ধ লাগছে তার। কিন্তু, সরেও আসতে পারছে না।খুব গভীরভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে নক্ষত্র।
সহ্য করতে না পেরে একসময় নক্ষত্রের বুকে হালকা হাতে ধাক্কা দিয়ে নক্ষত্রকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো ইরিন। কিন্তু, নক্ষত্রের সুপুষ্ট শরীর হেলানো তো আর সহজ বিষয় না। নক্ষত্র দূরে সরা তো দূর, নড়লোও না বিন্দুমাত্র। তাই এবারে মুখেই জোর দিয়ে বললো ইরিন, ‘দেখি ছাড়ুন। দমবন্ধ লাগছে আমার। মরে যাবো তো।’
ইরিনের কথায় আলতো হাসলো নক্ষত্র। স্পর্শের গভীরতা হালকা হলেও পুরোপুরি কাটলো না। বাঁধন হালকা হতেই দ্রুত মাথা উঠিয়ে নিল ইরিন নক্ষত্রের বুকের উপর থেকে। চলে যাওয়ার চেষ্টা করে বুঝলো নক্ষত্র এখনো তার কোমড় ধরে রেখেছে।
এরইমাঝে, আস্তে করে ইরিনের গাল স্পর্শ করলো নক্ষত্র। এবারে অস্বস্তিতে পুরোপুরি জমে গেল ইরিন। নক্ষত্র সেটা ঘুণাক্ষুরেও আন্দাজ অবদি করতে পারলো না। সে মত্ত নিজের প্রাপ্তির উল্লাসে। অজানা সত্যের আড়ালে এক মিথ্যা উল্লাস!
ইরিনের গাল ধরে ধীমি কন্ঠে বললো, ‘তুমি যেভাবে চাও, তেমনই সংসার গড়ে দেবো তোমার। স্বয়ং আমাকে আমি তোমায় দিয়ে দিলাম ইরিন। আমার সবটা দিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো তোমার সব আবদার পূরণ করতে। শুধু বিনিময়ে এটুকুই চাইবো যে….’ এটুক বলে একটু থামলো নক্ষত্র। ইরিন কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
‘বিনিময়ে কি?’
‘বিনিময়ে তুমি কখনো আমাকে মিথ্যা বলবে না। আমার থেকে কোন সত্য লুকাবে না।সেটা যতই তিক্ত হোক না কেন! জানো তো, সত্যির ওপর মিথ্যার আস্তরণ জমলে, পরে সে সত্যি গিলতে কংকরযুক্ত ভাতের দলার মতই লাগে। ভীষণ কষ্ট লাগে ইরিন। আর হ্যাঁ, মায়ের মত আমায় একলা করে দিয়ে কখনো কোথাও যাবে না তুমি। ব্যস এটুকুই। ‘
নক্ষত্রের শুরুর কথাগুলো ইরিনকে প্রবল অপরাধ বোধে গ্রাস করলেও শেষ কথাটা তার বোধগম্য হলো না। মনে মনে ভাবলো, ‘উনার মা তো একদম সুস্থ সবল ভাবে জীবিত। তাহলে উনাকে একলা করে দিয়ে কোথাও যাওয়ার অর্থ কি? ‘
নিজের এসব চিন্তার মাঝেই আরও একবার একটা উষ্ণ স্পর্শে সমগ্র শরীর প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে উঠলো ইরিনের।সে নড়েচড়ে উঠতেই কোমড়ে শিথিল হাতটাও নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে আরেকটু দৃঢ় হলো। ইরিনের কিছু বলার সুযোগ নেই।
তবে, এর পরের সম্ভাব্য স্পর্শগুলোর কথা ভাবতেই সমস্ত মস্তিষ্ক যেন মূহুর্তের জন্য ফাঁকা হয়ে গেল ইরিনের। নক্ষত্রের স্পর্শে সাড়া তো দিলোই না বরং অনাকাঙ্ক্ষিত এ স্পর্শের গভীরতা দমিয়ে বাঁধ সাধার ক্ষমতাটাও যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। অপরাগ হয়ে নিজেকে সঁপে দিল সেই স্পর্শের কাছে। শাঁড়ির আঁচল খাঁমচে ধরে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কেবল। প্রমাণ সরূপ সাক্ষী হলো নিরব অশ্রুধারা।
ঠিক কতটা সময় গড়িয়েছে জানা নেই ইরিনের। স্পর্শের গভীরতাও ওর কল্পনার গন্ডি ছোঁয়নি। কেবল কানে এলো নক্ষত্রের ফিসফিসানো দুষ্টুমিষ্টি স্বরের একটা প্রশ্ন ।
‘ঝাল কমেছে?’
৩৭.
রাত দুটো। নতুন একটা প্রোজেক্ট নিয়ে ভীষণ ব্যস্ততা যাচ্ছে নক্ষত্রের। তিনদিন পর প্রেজেন্টেশন। তাই ফাইনাল প্রিপারেশন এর তোড়জোড়ে চলছে এই রাত জেগে কাজ করা। পা লম্বা করে দিয়ে আধশোয়া হয়ে কোলের উপর ল্যাপটপ রেখে কাজ করছে সে। একটা ফাইল চেক করতে করতেই ধাড়াম করে তার পায়ের উপর নিজের পা তুলে দিল পুতুল। নড়া লেগে ল্যাপটপ পড়ে যাচ্ছিল। কোন মতে ধরে সামলে নিল নক্ষত্র। কোল থেকে সরিয়ে বিছানার এক সাইডে রাখতেই পুতুল হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলো নক্ষত্রের পেট। নিজের ছোট হাতের মুঠোয় যথাসম্ভব চেপে ধরলো বাবার টি শার্টের কোণা। বালিশের এক কোণায় কোন রকমে মাথা ঠেকিয়ে নক্ষত্রের কাছ ঘেঁষে শুলো। ঘুমের মাঝে তার এই এক অভ্যাস। শরীরের উপর হাত পা তুলে দেয়। নক্ষত্র ভেবে পায় না, স্বভাবে বাবার কপিক্যাট হওয়া মেয়েটা ঘুমের বেলায় মায়ের শোয়ার অভ্যাসটাই যে কি করো পেলো! ঠিক মায়ের মতই হাত পা ছুঁড়ে ঘুমায়।
পুতুলকে টেনে সোজা করে দিতে চেয়েও ব্যার্থ হলো নক্ষত্র। বাবার টি শার্ট সে কিছুতেই ছাড়লো না। না পারতে সব কাজ ফেলে মেয়েকে নিয়েই শুয়ে থাকতে হলো তার। পুতুলের সাথে তার খুব একটা থাকা হয় না। বেশিরভাগ সময় শায়লা নয় তো কনকের কাছেই ঘুমায় সে। নক্ষত্র বেশিরভাগ সময় কাজে ব্যস্ত থাকে।দেশের বাইরে যায়। কিন্তু, যতটা সময় পায় সবটায় মেয়ের জন্য তোলা। মেয়েটাও বাবা বলতে পাগল। তবুও, একটা বাচ্চা…বিশেষ করে একটা মেয়ের জন্য মায়ের জায়গাটা সদা অপূরণীয়।
বালিশ ছেড়ে এবার বাবার বুকের উপর আধচড়া হয়ে ঝুলে ঝুলে ঘুমাচ্ছে পুতুল। মেয়ের এমন কান্ড দেখে হেসে ফেললো নক্ষত্র। মেয়েকে এবারে বুকে টেনে নিল সে। ছোট্ট পুতুলও বাবার বুকে স্নেহের উষ্ণতা পেয়ে বিড়াল ছানার মত গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে রইলো।
পুতুলের এই আরামের ঘুম দেখে তৃপ্তির হাসি হাসলো নক্ষত্র। একহাতে ফোন নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকলো সে। লক করা সিক্রেট ফোল্ডারে গিয়ে বের করলো ইরিনের একটা হাস্যকর ছবি। স্মৃতির পাতা উল্টে আরও একবার কল্পনায় ফিরে গেল সেই মূহুর্তটায়।
৩৮.
বিয়ের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়েছে ওদের। সব স্বাভাবিক ও সুন্দর মত চলছিল ওদের বিবাহিত জীবনের। ইরিন যতটা পারে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। ফিরানির দিন যেটা ঘটেছে তারপর ইরিন অনেক ভেবে চিন্তে
ঠিক করেছে নক্ষত্র যখন নিজের অধিকার ছাড়বে না, সেও আর নিজেকে গুটিয়ে রাখবে না। মন থেকে মানতে না পারলেও নক্ষত্রের সাথেই আর পাঁচটা স্বাভাবিক স্ত্রীর মত সংসার করবে। এক জীবনে তো আর সবাই সবটা পায় না। কম্প্রোমাইজ করে চলতে হয়। সেও কম্প্রোমাইজ করে চলবে।
তাছাড়া, রাতে থাকার কথা থাকলেও কোন একটা অদ্ভুত কারণে নক্ষত্র সেদিন বিকালেই ইরিনকে নিয়ে ফিরে এসেছিল নিজ বাড়িতে। সাথে রিতুকেও নিয়ে এসেছে। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় নক্ষত্র বলেছে, ‘মায়ের সাথে এ ব্যাপারে আমার কথা হয়ে গেছে। রিতুর সব দায়িত্ব আমার এখন থেকে। এই পরিবেশে থেকে ও কখনোই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পাবে না। তাই এখন থেকে ও আমাদের সাথেই থাকবে। আমার বাকি দুই ছোট বোনের সাথে রিতুও আমার আরেকটা বোন হয়েই থাকবে। মাকেও বলেছিলাম আমাদের সাথে থাকতে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। আশা করি এই নিয়ে আর কোন প্রশ্ন তুমি করবে না। ‘
ইরিন আর কোন প্রশ্ন করেনি সেদিন। নিজের অজান্তেই একরাশ কৃতজ্ঞা জন্মায় ওর মনে নক্ষত্রের জন্য। কারণ,ইরিন ভালো করেই জানে বাবা হারা এই ছোট্ট মেয়েটার কোন ভালো ভবিষ্যৎ এ বাড়িতে অন্তত সম্ভব না। তাছাড়া আদরের বোনটা তার সাথেই থাকবে,এর থেকে শান্তির কি হতে পারে। তাই সেও নক্ষত্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই বাকি জীবনটা কম্প্রোমাইজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিন্তু, এত সব স্বাভাবিক ব্যাপারের মাঝেও বিপত্তি বাঁধলো নক্ষত্রের ঘুম নিয়ে। বৌভাতের রাতের পর থেকে প্রায় ৭ দিন নক্ষত্র রাতে বিছানায় ঘুমায়নি । ইরিনের উড়াধুরা শোয়ার স্টাইলে না পারতে সে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে নেমেছে। দুদিন সোফায় এডজাস্ট করার ট্রাই করে ঘাঁড় ব্যাথাও হয়ে গেছে ওর। তাই শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন মাঝ রাতে ইরিনের সাথে ঘুমাতে গিয়ে বিছানা ছাড়তে হয়েছে ওকে। প্রথম কয়েকদিন ডাকাডাকি করে ইরিনকে উঠিয়ে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিলেও কয়েক মিনিট গড়াতেই তা বিগড়ে গিয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত সে মেঝেতেই বিছানা করে থাকছে। কিন্তু এত কালের অভ্যাস বদলে মেঝেতে ঘুমানোর ফলস্বরূপ শরীর ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে ওর রোজ রোজ।
তবে ইরিন এসবের কিছুই জানে না। কারণ ইরিনের ঘুম থেকে উঠার আগেই নক্ষত্র মসজিদে পৌঁছে যায় রোজ সকালে। দিনে অফিস করতে হয় বলে ঘুমানোর সুযোগ পায় না নক্ষত্র। ঘুমের ব্যাঘাতে সে নিজেও অসুস্থবোধ করতে শুরু করেছে।
একদিনের ঘটনা।
বিয়ের তখন ১১ দিন গড়িয়েছে।সেদিন সিলেট থেকে ফিরেছে নক্ষত্র। তিনদিন আগে কিছু মিটিং এ্যাটেন করতে গেছিল সে। একটা বড় ডিল ফাইনাল করে এসেছে। দু-তিন দিনের টানা জার্নি, মিটিং স্ট্রেস আর কদিনের অনিয়ত ঘুম সব মিলিয়ে অসম্ভব ক্লান্ত ছিল সে। রাতে ডিনার করে বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে যায় সে।
ইরিনও সব কাজ শেষ করে এসে রোজকার মত দূরত্ব রেখেই এক কোণায় শুয়ে পড়ে। নক্ষত্র ওর সাথে স্বাভাবিক স্বামীসুলভ আচরণ করলেও সে এখনো সহজ হতে পারেনি। কম্প্রোমাইজ করার চেষ্টা করে চললেও মন থেকে মানতে পারেনি নক্ষত্রকে। এছাড়া শশুড় বাড়ির সবার সাথেই খুব সহজেই মিশে গেছে ইরিন। নক্ষত্রের ব্যাপারটা বাদ দিলে সব মিলিয়ে ভালোই আছে ইরিন।
সেদিন একটু দ্রুতোই ঘুম ভেঙেছে ইরিনের। নড়তে গিয়েও নড়তে পারলো না। কোন কিছু তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বলে মনে হলো তার। মস্তিষ্ক আভাস দিলো এটা নক্ষত্রের কাজ। তবে কি নক্ষত্র এখন তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো শুরু করেছে? মনে শংকা নিয়েই পিটপিট করে চোখ খুললো ইরিন। প্রথমে জানলার দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল হয়নি এখনো। বাইরে তখন কেবল রাতের আঁধার ঝাপসা হতে শুরু করেছে অল্প বিস্তর।
নাড়াচাড়া করতে না পেরে বিরক্ত হলো ইরিন। এভাবে কেউ তাকে জাপটে ধরে রাখলে সেটা ভালো লাগে না ইরিনের। ঘুম হয় না। নক্ষত্রকে দূরে সরানো দরকার। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই যেন আকাশ থেকে পড়লো ইরিন। বোকা বোকা চোখ করে তাকিয়ে রইলো কিছু দূরে বালিশ জড়িয়ে আরামে ঘুমিয়ে থাকা নক্ষত্রর দিকে। নক্ষত্র ওকে জড়িয়ে ধরে নেই বুঝতে পেরেই তড়িৎগতিতে চোখ ঘুরিয়ে নিজকে দেখার চেষ্টা করলো ইরিন। অতঃপর….
‘আম্মাআআআআ….’ বিকট এক চিৎকারে ঘুম ছুটে গেল নক্ষত্রের। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসতেই সম্পূর্ণ বোকা বনে গেল সে। ইরিন বাইম মাছের মত মুচড়ামুচড়ি করছে। নক্ষত্রকে উঠে বসতে দেখে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, ‘এ্যা…এএইইই…ভু..ভু…উ..উ..ভূত। ভূত!! ‘
ইরিনের এমন কম্পনরত কন্ঠ শুনে উদ্বিগ্ন হলো নক্ষত্র। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ইরিনকে শান্ত করতে বললো, ‘এইই…ইরিন, কি হলো..এমন চেঁচাচ্ছো কেন?’
‘ভু…উউ..উৎ এসেছিল ঘরে। আমাকে বেঁ..এএ..ধে রেখে গেছে। দেখুন। প্লিইইইজ…প্লিজ খুলুন আমাকে। ওও…আম্মা…আআআ…। ভয়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা হলো ইরিনের।
ইরিনের কথা শুনে নক্ষত্রের আর বুঝতে বাকি রইলো না, নিজেকে এভাবে কম্বলে মোঁড়ানো দেখে ভয় পেয়েছে। চিন্তা কেটে গেল তার। ঘুম আবারও খোঁচাখুঁচি শুরু করেছে চোখ বোজার তাড়ায়। অলস ভংগিতে একটা হাই তুললো নক্ষত্র।
ও দিকে ইরিন চেঁচাচ্ছে। ‘এই…খুলুন না প্লিজ। আমার দম বন্ধ লাগছে। প্লিজ খুলুন। ‘
‘ডোন্ট প্যানিক ইরিন। কোন ভূত ফুত আসেনি। আমিই করেছি এটা। রাতে বড্ড হাত পা ছুড়ছিলে। এন্ড আই নিডেড টু স্লিপ সাউন্ড। জড়িয়ে ধরলেও মুচড়ামুচড়ি করছিলে অনেক। নীচে শুয়েও শরীর ব্যাথা হয়ে গেছে আমার। দ্যাটস হুয়াই আই…। এ্যানি ওয়ে…ওয়েট, খুলে দিচ্ছি। ‘
ইরিন পুরো বিষ্ময়ে হতবিহ্বল। কি সব বলছে নক্ষত্র। আর সে কিনা কি না কি ভেবে…ভয়ে মরতে বসেছিল।
নক্ষত্র আর দেরি করলো না। বিছানা থেকে নেমে কম্বলের উপর বাঁধা বেল্ট দুটো খুলে দিল। তারপর উপর থেকে কম্বলের এক পরত সরিয়ে দিতেই বাকি কম্বলটুকু সরিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে নেমেই রাগে ফেটে পড়লো নক্ষত্রের উপর।
‘এই….কি করেছেন আপনি এটা?এভাবে কেউ কাউকে বেল্ট দিয়ে বাঁধে?
‘শুধু বেল্ট দিয়ে বাঁধলে তুমি ব্যাথা পেতে।শরীরে দাগ বসে যেত। তাই সেইফিটির জন্য কম্বল ইউজ করতে হয়েছে। ‘ একদম স্বাভাবিক গলায় বললো নক্ষত্র। যেন এমনটা করা কোন স্বাভাবিক কাজ।
‘তাই বলে আপনি আমাকে এভাবে বাঁধবেন?’
‘এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। বিয়ের পর থেকে তুমি আমার আরামের ঘুম হারাম করে দিয়েছো। ‘ বলতে বলতে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল নক্ষত্র।
‘মানে কি!’
‘তুমি যে রাতে হাত পা ছুড়ো এ কথা বিয়ের আগে বলোনি কেন আমায়?’
এ কথায় এক নিমিষেই লজ্জায় মিইয়ে গেল ইরিন। কিন্তু দমলো না সে। আগের তেজ দেখিয়েই বললো, ‘কে বলেছে আপনাকে আমি হাত পা ছুড়ি? আমি তো রোজ ঠিকঠাকভাবেই শুই।’
“তাহলে কি তুমি জ্বীন ভূত ক্যারি করো নিজের সাথে?’
এমন প্রশ্নে পুরো হকচকিয়ে গেল ইরিন। দ্বিগুণ তেজে চেঁচিয়ে বললো, ‘কি সব যা তা বলছেন। জ্বীন ভূত ক্যারি করি মানে? এত শিক্ষিত হয়ে এমন ননসেন্স কথাবার্তা বলেন কি করে আপনি?’
‘ননসেন্স কেন হবে! তুমিই তো বললে হাত পা ছুঁড়ো না। তাই ভাবলাম রাতে তোমার উপর জ্বীন ভূত কিছু ভর করে কিনা যে তোমাকে আর আমাকে এক বিছানায় দেখতে পারে না বলে আমাকে লাথি গুতা মেরে বিছানা ছাড়া করে। আর যেহেতু আমি ইসলামে বিশ্বাসী তাই জ্বীন ভূতের ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার কোন পথ নেই। ‘
‘তারপরেও, আপনি ভুলভাল বকছেন। আমি ঠিকঠাকভাবেই শুই। ‘
‘অহ আচ্ছা, তাহলে এটা কে বলো তো ইরিন।’ – গ্যালারি থেকে একটা ছবি বের করে ইরিনকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো নক্ষত্র।
ছবি দেখে ইরিনের চক্ষু চড়কগাছ। পুরো এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে সে পুরো বিছানা জুড়ে। এবার পুরোপুরি মিইয়ে গেল সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো নিজ অবস্থানেই।
‘যাই হোক, এখন বলো…বিয়ের আগে এ কথা বলোনি কেন? বিয়ের ক্ষেত্রে বিয়ের আগেই সব ক্লিয়ার করে বলে কয়ে নিতে হয়, এটা কি জানো না তুমি?’
‘জানি।’ আস্তে করে বললো ইরিন।
‘তাহলে? তুমি কি জানো এ ক’দিন আমার ঘুমাতে কি পরিমাণ কষ্ট হয়েছে? এত বছর পর আবার মেঝেতে শুয়ে পিঠ শরীর সব ব্যাথা হয়ে গেছে। তুমি যেভাবে মরার মত ঘুমাও ডাকাতদল তোমার বাড়িতে এসে লেট নাইট পার্টি করে সব লুটে পুটে নিয়ে গেলেও টের পাবে না বোধয়। আবার, একটু যে রাত জেগে বডি ম্যাসাজ করে দিয়ে স্বামী সেবা করবে সেই উপায়ও তো নেই। ‘ – বেশ গম্ভীর স্বরে বললো নক্ষত্র।
নক্ষত্রের বলার ধরণে ভীষণ লজ্জা পেল ইরিন। এতক্ষণের সব রাগ…সব তেজের জায়গায় এসে ভীড় করলো একরাশ লজ্জা। মিনমিনে গলায় বললো, ‘ স্যরি….আসলে ছোটবেলা থেকেই হাত পা ছুড়ি বলে আপারা তাদের সাথে এক বিছানায় শুতে দিতো না। ঘরের মেঝেতে শুতাম।ওখানে শুতে শুতে অভ্যাসটা আরও জেঁকে বসেছে। তাই আর কি…। আমি রোজ কিনারায় শুই এই জন্যই। তারপরেও যে কিভাবে এমন হয়! আমি সত্যিই দুঃখিত।আজ থেকে আমি মেঝেতেই শুবো। আপনার আর ঘুমে সমস্যা হবে না। আর আপনি যদি আগেই বলতেন তাহলে তো আর আপনাকে কষ্ট করতে হতো না। ‘
কয়েক মূহুর্তের ব্যাবধানেই ইরিনের এমন বাঘিনী থেকে ভিজে বিড়াল হওয়া দেখে ভীষণ হাসি পেলো নক্ষত্রের। কিন্তু সে হাসলো না। বরং গলার গাম্ভীর্য বাড়িয়ে বললো,
‘মেঝেতে শোয়ার দরকার নেই। তোমার ব্যবস্থা আমিই করবো। এখন এসো ঘুমাবে। ‘
‘হ্যাঁ…হ্যাঁ..আপনি শুয়ে পড়ুন। ঘুমান ।
‘হু…ঘুমাবো। আজ থেকে নতুনভাবে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। ‘ আড়মোড়া দিতে দিতে বললো নক্ষত্র।
‘মানে?’
ইরিনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাকে হাত ধরে একটানে বিছানায় এনে বসালো নক্ষত্র। ইরিনের মুখে দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখে তখনো অসম্পূর্ণ ঘুমের রেশ। তাই, ইরিনকে দু কাঁধে চেপে ধরে শুইয়ে কম্বল টেনে দিল আবার। ইরিন কেবল অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখছে নক্ষত্রে কর্মকান্ড।
নিজের জায়গায় এসে শুয়ে পড়লো নক্ষত্র। কম্বলের ভেতর ঢুকে ইরিনের কাছাকাছি গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। নিজের পায়ের ভাজে ইরিনের পা আটকে বললো, ‘এবার দয়া করে মুচড়ামুচড়ি করো না। ঘুমাও।আর লক্ষী বউয়ের মত আমাকেও শান্তিতে ঘুমাতে দাও। গুড মর্নিং বউ। ‘ বলেই ইরিনকে জড়িয়েই চোখ বুজলো সে।
ইরিন পুরো স্তব্ধ নক্ষত্রের এমন কাজে। কেউ এভাবে ধরে রাখলে ওর ঘুম হয় না। কিছুতেই না। উপরন্ত নক্ষত্রের নিশ্বাসের উষ্ণতা ওর সমগ্র শরীর মনে ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। সহ্য করতে না পেরে নক্ষত্রকে বললো, ‘আমি ঘুমাবো না। ছাড়ুন আমাকে। নামতে দিন। ‘
‘তোমার ঘুম কমপ্লিট হয়নি ইরিন। ঘুমাও আরেকটু।’
‘বললাম তো ঘুমাবো না আর। এভাবে কেউ ছুঁলে ঘুম হয় না আমার। একা ঘুমিয়ে অভ্যাস। ‘
এখন আর একা নেই। ভবিষ্যতে প্রোমোশন হলে বিছানার ভাগ বাড়বে। তাই আগে ভাগেই অভ্যাস করা ভালো। ঘুমাও এখন। এন্ড টুডে ইটস আ ট্রিট ফর ট্যাট ফর ইউ’ । বলেই ফিচলে হেসে ইরিনের গলায় মুখ ডুবালো নক্ষত্র। নক্ষত্রের কথার ইংগিতটা বুঝতে অসুবিধা হলো না ইরিনের। কিন্তু, শেষ কথা অর্থ তার দ্বারা উদ্ধার হলো না। অগত্যা ইরিনকে অস্বস্তিতে গাট হয়েই বিছানায় পড়ে থাকতে হলো নক্ষত্রের বাহু বন্ধনে।
চলবে…