#শেষ_থেকে_শুরু
কলমে :লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:২ + ৩
গভীর রাতে ফরহাদ লতাকে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসেছে। গতকাল রাতটা ছিল অবিশপ্ত তবে জীবনের মোড় দারুণভাবে ঘুঁরে গেছে। কথায় বলে ভাগ্যবানের বউ মরে যদিও হৈমন্তী মরেছে কি ফরহাদের জানা নেই। মেয়েটা ছিল বড্ড বেশি শান্ত। সব সময় চুপচাপ গুটিয়ে থাকতো। কোথাও হয়তো প্রথম স্বামীর মৃত্যুর জন্য নিজেকে দোষী ভাবতো। তাছাড়া সমাজের কিছু স্বার্থপর মানুষ আছে তাঁরা কারণে অকারণে মেয়েদের উপরে দোষারোপ করে। তাঁরা মুখিয়ে থাকে কিভাবে সরল মেয়েদের উপরে নির্যাতন করা যায়। দুর্বলের উপরে যুলুম করা ওদের নেশা। হৈমন্তীর প্রথম স্বামী যখন মারা গেলো লোকেরা বলা শুরু করলো ও অপয়া তাই বিয়ের দিন স্বামী মারা গেছে। হৈমন্তীর বাপ ভাইয়ের টাকা পয়সা ছিল তবুও লোকজনের মুখ বন্ধ করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। ছেলেদের বউ মারা গেলে আরামসে বলা হয় ভাগ্যবানের বউ মরে অথচ মেয়েদের বেলায় ভিন্ন। হৈমন্তীর ছোট মনে মানুষের এই কটাক্ষগুলো মেনে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করা কঠিন ছিল। তবুও বড় ভাইয়ের সহায়তায় বিয়ে করে নতুন সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল। তাছাড়া ওর মা মিনারা বেগম রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে ছিলেন। হৈমন্তীর জন্য উনার ভালোবাসা ছাপিয়ে সমাজের মানুষের কথাবার্তা বেশি প্রভাবিত করেছে। উনি চাইতেন মেয়ে সংসার করুক আর লোকজনের মুখ বন্ধ হোক। কিন্তু হৈমন্তীতো তো জানতেই পারেনি ফরহাদ আর ওর পরিবার ওকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফরহাদ আগে থেকেই জানতো এই মেয়েটাকে ভেঙে টুকরো করা খুব কঠিন কাজ হবে না। তাই মায়ের পরামর্শে গেম শুরু করে আর সফল হয়। ফরহাদ লতাকে পেয়ে ভীষণ খুশী হৈমন্তীর জন্য ওর মনের কোথাও কোনো জায়গা নেই। সবখানে শুধু লতা। মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য কতকিছু করতে হয়েছে। অপেক্ষার ফল সত্যি সুমিষ্ট। কথাটা ভেবে ফরহাদ লতার কপলে চুমু দিয়ে ওকে দুহতে জড়িয়ে নিয়ে স্বস্তিতে ট্রেনের জানালায় চোখ রাখলো। লতা চুপচাপ বসে আছে। নিরবতা ভেঙে ফরহাদ বলল,
> তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি লতা। তোমার জন্য আমি নিজের জীবন দিতেও পিছপা হবো না।
লতা ফরহাদের মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। শুনো না আমাদের বাড়ির জন্য আসবাবপত্র কিনতে হবে এতগুলো টাকা কোথায় পাবে ভেবেছো?
ফরহাদের বেশ মনক্ষুন্ন হলো লতার কথা শুনে। মেয়েটা কখন কি বলতে হয় জানে না। তবুও নিজের সামলে নিয়ে বলল,
> আম্মা সব রেডি করে ফেলেছে তোমাকে ভাবতে হবে না। সরকারি বাসভবনে থাকবো আসবাবপত্র আম্মা লোকজন দিয়ে কিনে ফেলেছে। আব্বার ব্যবসা এখন মোটামুটি ভালো চলছে।
লতা ফরহাদের হাত নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,
> ওই মেয়েটার খবর জানো? হঠাৎ এসে ঝামেলা করবে নাতো?
> করবে না। ওর নাম নিয়ে আমাদের সুখের মূহুর্ত নষ্ট করো না তো।
ফরহাদ বিরক্ত হয়ে লতাকে ছেড়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। লতা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাঁকিয়ে ব্যাগ থেকে আয়না বের করে গাঢ় রঙের লাল লিপস্টিক দিয়ে নিজের উষ্ঠ জোড়া রাঙিয়ে নিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ভোরের আলো ফুঁটবে। শুনেছে ফরহাদের অফিস থেকে লোকজন আসবে এদের রিসিভ করতে। ওদের সামনে নিজেকে আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করতে হবে নয়তো ফকিন্নি ভাববে। ছি এসব হবে না। সবাইকে বুঝতে হবে মাধবী লতা কতটা সুন্দর। ফোনের শব্দে লতার ভাবনার অবসান ঘটলো। লতা দ্রুত ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো ওপাশে ওর শাশুড়ি আম্মা অধীর আগ্রহে ছেলের খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। লতা মিষ্টি হেসে বলল,
> হ্যাঁ আম্মা বলুন।
> তোমরা ঠিক আছো? ফরহাদ কি করছে?
> আপনার ছেলে ঘুমিয়ে আছে চিন্তা করবেন না। আম্মা একটা কথা ছিল যদি অভয় দেন তবে বলতে পারি।
> বলো
> কিছু টাকা লাগবে। আসলে নতুন শহর বুঝতেই পারছেন ফরহাদ বেতন পেলে অসুবিধা হবে না।
> ফরহাদ কি তোমাকে টাকার কথা বলেছে?
ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে আওয়া হলো। লতা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বলল,
> আম্মা ও বলবে কেনো। আমি দেখেছি ওর কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে এতে হবে না। আপনি যদি আর কিছু দিতেন।
> আচ্ছা দেখছি।
শায়লা বানু ফোন কেটে দিলেন। লতার মুখে হাসিটা আরও দীর্ঘ হলো।মফস্বলের মেয়ে লতা। কতদিনের স্বপ্ন শহরে বসবাস করবে। সেই স্বপ্নটা আজ হাতের নাগালে। জীবন কিভাবে উপভোগ করতে হয় ওর জানা আছে। ফরহাদ সুদর্শন পুরুষ,বাবার অর্থসম্পদ তেমন না থেকলেও মেধাবী ছিল। ফিউচারে ভালো কিছু করবে এটা ওর ভালো করে জানা ছিল। তাছাড়া ছেলেটা ওর প্রেমে অন্ধ কথাটা ভেবে লতা ফোনটা ব্যাগে রেখে ফরহাদকে ডেকে দিলো কারণ ট্রেম থেমে গিয়েছে নামতে হবে।
______________
চাঁদরের এক প্রান্ত শক্ত করে ধরে ছোট বন্ধ করে আছে হৈমন্তী। মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে তবুও চাঁদর আকড়ে ধরে আছে ছাড়ছে না। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার এসে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। ওর মুখের দিকে দুজোড়া অশ্রুসিক্ত চোখ এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। মেয়েটার ঠোঁটে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। গতকাল রাতে চলন্ত গাড়ির সামনে থেকে ওকে উদ্ধার করেছে রোহান শেখ। ব্যবসার কাজে এসেছিল ফেরার সময় হঠাৎ মেয়েটা ওর গাড়ির সামনে চলে আসে। বিশেষ ক্ষতি হয়নি তবে হাতে পায়ে একটু ক্ষত হয়েছে।রোহান ভাবছে মেয়েটার চোখের সঙ্গে হয়তো সমুদের সংযোগ আছে। চুপচাপ চোখ বন্ধ আছে অথচ অনবরত পানি ঝরছে। গতকাল থেকে চুপচাপ পড়ে আছে কথাবার্তা বলেনি। মেয়েটা ওর পূর্বপরিচিত। বোনের ছোট ননদ। রোহানের সঙ্গে ওর অনেক বছর আগে দেখা হয়েছিল তখন মেয়েটা ছোট ছিল। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকাই মেয়েটার খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। দুসপ্তাহ আগে দেশে ফিরেছে। মেয়েটাকে পাওয়া মাত্র বোনকে ফোন করেছিল। বোন শোনা মাত্র এখানে ছুটে এসেছে। হৈমন্তী সকলের প্রিয় অথচ তার কপালে সুখ নেই। রোহানের ধ্যান ভাঙলো বোনের কথা শুনে।
> ভাবছি ওকে আর গ্রামে রাখবো না। লোকজন নানারকম কথাবার্তা বলবে মেয়েটা এমনিতেই চুপচাপ। ওর শশুর বাড়িতে খোঁজ নিয়েছিস?
> আপা নিয়েছিলাম। ফরহাদ বিয়ে করেছে। হয়তো এসব নিয়েই ঝামেলা। হৈমন্তী তো কিছুই বলছে না। না বললে কিভাবে কি করবো?
> তোর দুলাভাইকে বলেছিলাম মেয়েটার বিয়ে নিয়ে এতো মাথামাতি না করতে। ওই লোকটার জন্যে এই অবস্থা। ফরহাদকে দেখলেই কেমন চোর চোর মনে হয়। তোর দুলাভাই তো মহা খুশী ওই চোরের সঙ্গে বোনের বিয়ে দিয়ে।
চয়নিকার কন্ঠ স্বামীর প্রতি আক্ষেপ ঝড়ে পড়ছে। রোহান জানে এখানে দুলাভাই থাকলে এক ঘর ঝগড়া হয়ে যেতো। বোনকে শান্ত করতে বলল,
> এইটুকু একটা মেয়ের দুবার বিয়ে কিভাবে সম্ভব আপা? দুলাভাই নাহয় ভূল করেছে কিন্তু তুই তো ছিলি মানা করতে পারতি? একদম ঠিক হয়নি।
> মফস্বলে মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে হয় রোহান। সমাজে মেয়ের বয়স নিয়ে নানারকম কুট কাচারী হয়। তাছাড়া তোর দুলাভাইয়ের মা আছে না ভদ্রমহিলা তো মেয়ের বিয়ের জন্য নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল তাই বাধ্য হয়ে এসব করা। যাইহোক ছাড় মেয়েটা সুস্থ হলে ওই বাটপারের সঙ্গে আর রাখবো না।
> এটাই ভালো। দুলাভাইকে বলেছিস আপা?
> বলেছি। এবার আমি কারো কথায় শুনছি না। মেয়েটকে নিয়ে দরকার হয় বাপের বাড়িতে থাকব। আসুক আগে কি অবস্থা করি।
রোহান বোনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। বোনকে ও ভীষন ভালোবাসে। মায়ের পরে এই একটা মানুষ আছে তাকে ও অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে পারে। বোনটা সব দিক থেকেই সুখী কিন্তু তবুও একটা শূন্যতা রয়ে গেছে। পনেরো বছরের বিবাহিত জীবন অথচ সন্তানের মুখ দেখেনি। যদিও এটা নিয়ে কখনও দুলাভাই আফসোস করে না। গ্রামে গেলে অশান্তি হবে তাই চয়নিকাকে নিয়ে শহরে থাকে। গ্রামের বাড়িতে আগে হৈমন্তী বাবা মায়ের সঙ্গে ছিল। তিন ভাইয়ের দুই বোন। হৈমন্তী সকলের ছোট। বড় বোনটার গ্রামে বিয়ে হয়েছে জামাই পুলিশে চাকরি করে । ভাইয়েরা ভিবিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাই তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন শহরে বসতি গড়েছে। হৈমন্তীর মেঝো ভাই আর্মি অফিসার সে বউ বাচ্চা নিয়ে চট্টগ্রাম থাকে। বছরে একবার তিনি গ্রামে পা রাখেন। ছোট ভাই অবিবাহিত, আমেরিকা আছে। বড়ভাই ব্যবসা করে। হৈমন্তীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে বিয়ে হয়েছিল।
বারো ঘন্টা বেঘোরে ঘুমানোর পরে হৈমন্তী জেগে উঠলো। শরীর কাঁপছে কেমন শূণ্য শূণ্য লাগছে।চোখ খুঁলে অচেনা পরিবেশে নিজেকে দেখে খুব ঘাবড়ে গেছে। একটু একটু করে সবটা মনে পড়তেই চিৎকার করে কেঁদে ফেলল। হঠাৎ ওর চিৎকার শুনে পাশ থেকে কেউ একজন ওকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলাই বলল,
> কি হয়েছে, এই তো আমি আছি ভয় পেয়েনো।
হৈমন্তী পরিচিত মানুষের কন্ঠ শুনে তাঁকিয়ে বড় ভাবিকে পেয়ে নিজেকে সামলাতে পারলো না। আরও শব্দ করে কেঁদে ফেলল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। চয়নিকা ওর চোখমুখ মুছিয়ে শান্ত কন্ঠ বলল,
> কি হয়েছে বলবে? না বললে বুঝবো কিভাবে? তোমার ভাইয়া বাইরে আছেন, চিন্তা করছে। ডাকবো তাকে?
হৈমন্তীর ভাবিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভয়ে ভয়ে বলল,
> ভাবি বিশ্বাস করো আমি খারাপ কিছু করিনি। এই বাচ্চা ফরহাদের কিন্তু ও কেনো মানতে চাইছে না জানিনা। সবাই আমাকে দোষারোপ করছে। আমি বাঁচতে চায়না। একটু বিষ দিবে আমাকে,
> আজেবাজে কথা বন্ধ করে কি হয়েছে সবটা বলো আমি সামলে নিবো। বিশ্বাস করোতো আমাকে?
হৈমন্তী মাথা নাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে দুদিনে সব ঘটনা ভাবির কাছে বলে ফেলল। চয়নিকা এবার বুঁঝতে পারলো হৈমন্তীর সঙ্গে কি কি হয়েছে। মগের মুল্লুক নাকি।ফরহাদ বললেই তো আর হবে না। দেশের আইনকানুন আছে। তাছাড়া বাচ্চা কার এটা জানা এখনকার যুগে এতোটা কঠিন কাজ না। টেস্ট করলেই সব বেরিয়ে আসবে। লুচ্চা ব্যাডা বউ রেখে পরকীয়া করে এখন স্ত্রী সন্তানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছে। ওরে তো ফাঁসি হওয়া উচিৎ। চয়নিকা আজকের মধ্যেই রোহানকে দিয়ে পুলিশ পাঠাবে ফরহাদের বাড়িতে। কিন্তু হৈমন্তীর শেষ আকুতি। ফরহাদ বা ওর পরিবারের সামনে ও আর যেতে চাইনা। যদি ওকে আবারও ফরহাদের বাড়িতে পাঠানো হয় বা ওর ভাইয়েরা যায় সেখানে তবে ও সুইসাইড করবে বলে জানিয়ে দিলো। চয়নিকা পড়লো ভারি বিপদে। হৈমন্তীর ভাইয়েরা যদি জানে বোনের এই অবস্থা তাহলে তো সবগুলোর মাথায় খুন চেপে যাবে। কিভাবে সামলাবে? একটা বুদ্ধি তো করতে হবে?
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। আমি লেখালেখিতে যথেষ্ট কাচা। ভুল করলে ভদ্রভাবে কমেন্টে জানিয়ে দিবেন ইনশাআল্লাহ শুধরে নিতে চেষ্টা করবো। আজেবাজে কমেন্ট করলে মন খারাপ হয়, লিখতে মন বসে না। গতকাল আল্লাহ শব্দের বানান ভুল ছিল এটা পোস্ট করার পরে দেখেছি। তাছাড়া লেখার সময় সঠিক লিখেছিলাম জানিনা কিভাবে হলো। তবুও দুঃখিত।
#শেষ_থেকে_শুরু
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:৩
হৈমন্তী কাঁদতে কাঁদতে অচেতন হয়ে গেলো। চয়নিকা মেয়েটার মাথায় হাত রেখে বসে আছে। মনে হচ্ছে এই মূহুর্ত্তে ফরহাদকে সামনে পেলে পিটিয়ে ওর পিঠের চামড়া তুলে দিয়ে গায়ের জ্বালা মিটাতেন। রাগে শরীর জ্বলছে। সহজ সরল মেয়েটাকে বিয়ে করে তাঁর জীবনটা নরক বানিয়ে ছেড়েছে। এই মা ছেলেকে আগে থেকেই ওর সন্দেহ হয়েছিল কিন্তু শাশুড়ির জন্য বলতে পারেনি। মনে হচ্ছে নিজের স্বামি আর শাশুড়িকে আচ্ছা করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে। নয়তো গায়ের জ্বালা মিটছে না। কি দরকার ছিল এতগুলো টাকা যৌতুক দিয়ে বোনের বিয়ে দেওয়ার। এতগুলো ভাই বোন থাকতে এইটুকু একটা মেয়ের দ্বায়ীত্ব নিতে পারেনা। কথাটা ভেবে চয়নিকা আলতো হাতে হৈমন্তীর মুখটা মুছে দিলেন।হৈমন্তীকে নিজের সন্তানের ন্যায় স্নেহ করে আসছেন। যখন উনি মির্জা বাড়িতে বউ হয়ে জান তখন হৈমন্তীর বয়স ছিল চার বছর। চোখের সামনে হতে দেখেছেন। শাশুড়ির সঙ্গে চয়নিকার তেমন মতের মিলমিশ হয়না তবে দেবর ননদদের সঙ্গে উনার বেশ ভালো সম্পর্ক। বড় ভাবি বলতে তাঁরা পাগল। আদরের অধরের এমন পরিণতি উনি মানতে পারছেন না। হঠাৎ বাইরে থেকে কারো পায়ের শব্দে চয়নিকা চোখের পানি মুছে তাঁকালো। ওর স্বামী রাজীব দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখেমুখে আতঙ্ক খেলা করছে। ও কিছুক্ষণ আগে এসেছে। হৈমন্তীর কি হয়েছে শোনার জন্য উতলা হচ্ছে। উনি ভেতরে এসে হৈমন্তীর পাশে বসে মেয়েটার মুখে হাত দিয়ে বললেন,
> মেয়েটা ঠিক আছে? রোহানতো কিছুই বলছে না তুমি তো বলবে ওর কি হয়েছে ? গতমাসে গিয়েছিলাম তখন তো ঠিক ছিল। আচ্ছা ফরহাদ কোথায়?
রাজিব ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে । চয়নিকা নিজেকে শান্ত রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> ওর যা হয়েছে তাঁতে তুমি আর তোমার মা দুজনেই সমান দোষী। তাই নতুন করে আর কোনো ঝামেলা করবে না আমি যা বলবো তাই শুনবে ঠিক আছে?
> হেয়ালি করো না। আমি আমার বোনের ক্ষতি কিভাবে করতে পারি? তুমি জানো ও আমার কতটা আদরের।
রাজীব উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। চয়নিকা চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল,
> ফরহাদ আবার বিয়ে করেছে। তোমার বোনকে অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
রাজীব হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে পড়লো। ভাবসাব ও এখুনি ফরহাদের বাচ্চাকে খুন করবে। বোনের সুখের জন্য এতোকিছু করেছে বেইমানটা সব ভুল গেলো।। চয়নিকা অবস্থা বেগতিক দেখে স্বামীর হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল,
> চেচামেচি করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আমার কথাগুলো শুনে যা ভালো মনে হয় করো। হৈমন্তী সেখানে ফেরত যেতে চাচ্ছে না। ওকে জোরজবরদস্তি করলে সুইসাইড করবে বলছে। মেয়েটার উপরে কম ধকল যায়নি। যদি আবারও এমন করা হয় তাহলে কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে। ওকে বাঁচতে দাও।
রাজীব এবার শান্ত হলো। মেয়েটাকে সুখী করতে গিয়ে এভাবে চির দুঃখী করে ফেলবে ভাবেনি। সব সময় টাকা পয়সা দিয়ে সুখ কেনা যায়না। ভালো মানুষের কাছে থাকলে সুখ আপনা আপনি ধরা যায়। কথাটা বুঝতে বেশ দেরী হলো। কিন্তু এই মূহুর্তে কি করবেন মাথায় আসছে না। দুভাইকে বিস্তারিত জানাতে হবে। মায়ের শরীর তেমন ভালো নেই হৈমন্তীর কথা শুনলে ঝামেলা শুরু করবে। চয়নিকার কথা শুনে রাজীবের ধ্যান ভাঙলো,
> বলছিলাম মেয়েটা আমাদের সঙ্গে থাক, গ্রামে পাঠানোর দরকার নেই। পড়াশোনা শুরু করুক।আর বাচ্চার দায়িত্ব নিতে তুমি পারবে না?বোন আর বোনের ছোট্ট বাচ্চাটা কি তোমার কাছে খুব ভারী হয়ে যাবে?
> কি বলছো তুমি? আমার ছোট বোনের দায়িত্ব নিতে আমি পারবো না ভাবলে কিভাবে। তবে ফরহাদকে তুমি ছেড়ে দিতে বলোনা। ওর চাকরির বারোটা আমি বাজিয়ে ছাড়বো। বোনের কথা ভেবে আমি ঝামেলা করছি না তবে দেখে নিও ঠিক সময়ে প্রতিশোধ নিয়ে নিবো কেউ বুঝতেও পারবে না। কেঁদে কুল পাবেনা, ফকিরের বাচ্চাটা। আমার বোনের চোখের পানির মূল্য সুদে আসলে তুলে নিবো, হারাম খোরের বাচ্চা
রাজীব আরও কয়েকটা গালি দিয়ে থামলো। চয়নিকা জানে এই ভদ্রলোক রাগলে মুখ দিয়ে নানারকম অকথা কূকথা বেরিয়ে যায়।তাই ও চুপচাপ হজম করলো। এখন ঝামেলা করা বোকামি হবে।রাজীব মমতার সহিত বোনের কপালে চুমু দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। চয়নিকা শান্তিতে চোখের পাতা বন্ধ করলো। আপাতত ঝড় থামানো গেছে। বাকী দুভাইকে এভাবেই বোঝাতে হবে। মেয়েটার উপরে আর কোনো জুলুম হতে দেওেয়া চলবে না।
___________________________
সকাল ছয়টা, পূর্ব আকাশে সূর্য উঠেছে সঙ্গে মানুষের কোলাহল বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও বাইরের পরিবেশ খুব একটা খারাপ না। স্টেশনে লোকজন তেমন নেই। গতকাল ভোররাতে ভারি বর্ষণ হয়েছে তাই ঠান্ডা হাওয়াতে প্রাণ জুড়িয়ে যাবার জোগাড়। ফরহাদ লাগেজ হাতে তুলিকে সঙ্গে নিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে পড়লো। ওদের নিজের জেলা শহরের বাইরে তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি। ধারণা কম তবে আধুনিকতার যুগে কেউ রাস্তা হারিয়ে বনবাসে যায়না এটাই ভরসা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ফরহাদ সামনে এগিয়ে গেলো। সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। দেখে বেশ ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে তবে চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি। হয়তো ঘুমের বেঘাঁত ঘটিয়ে কোনো অগন্তুককে রিসিভ করতে আসার বিড়ম্বনা সইতে পারছে না। ঘনঘন এদিকে ওদিকে তাঁকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলছে। ফরহাদ ভদ্রলোকদের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নিজের পরিচয় দিতেই লোকগুলোর মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো। পেছনে লতা সাইড ব্যাগ জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওষ্ঠে লাজুকতার হাসি। ফরহাদ ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে গাড়িতে চেপে বসলো। দুজন ওদের সঙ্গে যাচ্ছে আর বাকীলোকগুলো ফিরে গেলো। লতার মন মস্তিষ্ক অন্য কথা বলছে। ফরহাদ সরকারি চাকরীজীবি হয়তো ঘুঁসের টাকার পরিমাণও বেশি হবে।সেই টাকা দিয়ে কি কি প্রসাধনী ক্রয় করবে তার লিস্ট মনের মধ্যে তৈরী হয়ে গেছে। ও সেসব নিয়েই ভাবছে। অন্যদিকে ফরহাদের মনে লাড্ডু ফুটছে। এতো বছরের ভালোবাসার পূর্ণতা পেয়েছে জীবন না জানি কতো সুখের হবে। সরকারি চাকরি সঙ্গে সুন্দরী অল্প বয়সী বউ আর কি চাই জীবনে? লোকজন ওকে দেখবে আর জ্বলবে। মানুষকে জ্বালাতে মন্দ লাগে না। সবাই ওকে দেখে আফসোস করবে ভেবেই পৈশাচিক আনন্দ হৃদয়ের কোনে দোলা দিচ্ছে। গ্রামে ছুটি কাটাতে গিয়ে হৈচৈ ফেলে দিবে। হৈমন্তীর গ্রামের পাশের গ্রামে ওদের বাড়ি। হৈমন্তীর বাপ ভাইয়ের বেশ নামডাক আছে সেই সঙ্গে অর্থসম্পদ। ফরহাদের বাবার অবস্থা আগে মোটামুটি ভালো ছিল কিন্তু মাঝখানে খারাপ হয়ে খেছে। আবারও ভালো হবে সেই আশায় ফরহাদের চোখদ্বয় চকচক করছে। হৈমন্তীর জন্য ওর মনে কোনো আফসোস নেই। হৈমন্তী ওর উপরে উঠার সিঁড়ি মাত্র। ওসব ভেবে সুন্দর জীবনটা বিষাদে ভরানোর কোনো মানে নেই।
আধা ঘন্টার মধ্যেই ফরহাদ নিজের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলো। নতুন শহর সঙ্গে নতুন বাসস্থান লতার বেশ নজর কেঁড়েছে। লতা বাকপটুতাই প্রথম থেকেই পরিপক্ব। আশেপাশে প্রতিবেশির সঙ্গে ভাব জমানো সেতো শুধু সময়ের অপেক্ষা। নতুন বাড়িটা ওদের পছন্দ হয়েছে। ফরহাদের মা ওর একাউন্টে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে তার নোটিফিকেশন এসেছে।। ফরহাদ অবাক হয়ে মায়ের নাম্বারে ফোন করলো। দুবার ফোন বাজার পরে রিসিভ হলো। ভদ্রমহিলা আল্লাদি কন্ঠে বললেন,
> পছন্দ হয়েছে বাড়িটা?
> অপছন্দের কি আছে আম্মা? তুমি আমার জন্য কিছু কিনেছো আর আমার পছন্দ হবে না এমন কখনও কি হয়েছে? আম্মা তুমি আবারও টাকা পাঠিয়েছো? বলেছিলাম তো টাকা লাগবে না যা আছে আমাদের হয়ে যাবে।
> লতাকে বলো কিছু কেনাকাটা করতে। মানুষের সঙ্গে চলতে হলে তো ভালো পোশাকের দরকার হবে। কিছু শপিং করো। যাইহোক রেস্ট করো আমি রাখছি।
> আচ্ছা আম্মা।
ফরহাদ ফোন রেখে বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। চোখে রাজ্যের ঘুম সঙ্গে ক্লান্তি ওকে গ্রাস করে ফেলল। ভদ্রলোকেরা ওদের সকাল আর দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বিকাল থেকে বাজার করে রান্না করে খেতে হবে। একটা কাজের মহিলার খোঁজ করতে হবে কথাটা ভেবে লতা জিনিসপত্র আলমারিতে সাজাতে মনোযোগ দিলো।
_________________________________
অন্যদিকে হৈমন্তীর বড় ভাই রাজীব ডাইনিং রুমের সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। নিজের ভূলের জন্য বোনটার কপাল পুড়েছে। মেয়েটার জন্য প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে। এই অবস্থায় কি করা উচিৎ বুঝতে পারছে না। রোহান দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> এতো টেনশনের কি আছে বলবেন?
> মেয়েটার জন্য ভালো কিছু করতে চাইলে খারাপ হয়ে যায়। কি করবো বুঝতে পারছি না।
> কিছু করতে হবে না। মেয়েটা একটু সুস্থ হলে নতুন করে পড়াশোনা করবে। তারপর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করতে চাইলে করবে না চাইলে না।
> আবারও বিয়ে? আমাদের বংশে ডিভোর্সী মেয়ে নেই। এমনকি কোনো ছেলেও নেই। এর মধ্যেই দুবার হয়ে গেছে মা জানলে কি হবে জানো?
> দূর এখনকার যুগে ওসব কোনো ব্যাপার না। আপা ঠিক বলে আপনি প্রাচীন যুগের মানুষ। পড়াশোনা শিখে লাভের লাভ কি হয়েছে বলবেন? দৃষ্টিভঙ্গি বদলে মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন ভালো হবে। তাছাড়া আপা মনে হয় না আপনাকে আর ভাবতে দিবেন। হৈমন্তীকে নিয়ে সে আমাদের বাড়িতে থাকবে। আমরা আগামীকাল ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি। আপনি চাইলে যেতে পারেন। যদিও আপনার বাড়ি সেখানেই তবে পাশাপাশি তো না।
> তোমার বোনের মাথায় আগুন জ্বলছে। এবার তাঁর কথার বাইরে কথা বলার মুখ নেই। ওর ইচ্ছে যা করুক সাপোর্ট করবো।
> সেই আপনার জন্য ভালো হবে।
রোহান তৃপ্তির হাসি হাসলো। দুলাভাই বোনকে ভয় পাচ্ছে তবে মুখে স্বীকার করছে না। তাছাড়া দুলাভাই নিজের বুদ্ধিতে ফকির হওয়ার টেকনিকটা খুব বেশি ফলো করে আর ফলাফল শূন্য হয়। তবুও আজ নিরুপায় হয়ে মানছে।
দুদিন পরে হৈমন্তী ভাই ভাবির সঙ্গে ঢাকায় এসেছে। মোটামুটি সুস্থ তবে মাঝেমধ্যে বমি করে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে তবে আশঙ্কার কিছু নেই। হৈমন্তী নিজেকে আরও বেশি গুটিয়ে নিয়েছে। ভাবি ছাড়া কারো সঙ্গে কথা বলে না। চয়নিকা ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে দশ দিনের মাথায় ভালো একটা মহিলা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন। মেয়েটা সব সময় চুপচাপ থাকে কারো সঙ্গে কথা বলেনা। ওর মনে হয় লোকজনের সামনে গেলে সবাই ওকে আবারও আজেবাজে কথা বলতে শুরু করবে।ফরহাদের বিশ্বাসঘাতকতা মানতে পারছে না। মানুষ কিভাবে পারে এতো সুন্দর অভিনয় করতে ওর বোধগম্য হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে বকে। তবে বাচ্চার জন্য হলেও ওকে সুস্থ থাকতে হবে ।
এভাবে প্রায় আট মাস পার হলো। হৈমন্তীর পরিবর্তন হয়নি তবে চেহারার বেশ উন্নতি ঘটেছে। পেটটা বেশ বড়সড় হয়েছে। কলেজ, পড়াশোনাতে উদাসীন, মাসে একদিন কলেজে গেছে কি সন্দেহ। জোরজবরদস্তি করলে কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা করে ফেলে।চয়নিকা আর রাজীব বোনকে ভালো রাখতে যথাযথ চেষ্টা চালিয়ে গেলো কিন্তু ঘটলো চরম বিপত্তি। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত পেশারে মেয়েটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পর পর সব ভূলে যায় কাউকে চিনতে পারে না। এই ভালো তো এই খারাপ। ডাক্তার বলল বাচ্চা ডেলিভারির পরে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু হলো না আরও খারাপ অবস্থা। নয় মাসের মাথায় বাধ্য হয়ে সিজার করতে হলো। বাচ্চা ওর থেকে দূরে রাখা হয়েছে। ওর কাছে দিলে ভয় পাই। হৈমন্তীর অবস্থা দিনদিন অবনতি দখে ওর ছোট ভাই প্রস্তাব দিলো হৈমন্তীকে ওর কাছে পাঠিয়ে দেওেয়ার জন্য। মেয়েটার ভালো চিকিৎসার দরকার। তাছাড়া নতুন পরিবেশ ওকে নতুন করে বাঁচতে সাহায্য করবে। শেষপর্যন্ত হৈমন্তীকে ওর ছোট ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। প্রশ্ন, বিদেশ বিভূঁয়ে হৈমন্তী কি পারবে নিজেকে নতুন করে, নতুন রূপে গড়ে নিতে? পারবে কি জীবনের শেষ অধ্যায় থেকে নতুন করে শুরু করতে? অন্যদিকে ফরহাদ কি পারবে লতার সঙ্গে মিলে পৃথিবীটাকে সুখের স্বর্গে পরিণত করতে? হৈমন্তীর অভিশাপ লাগবে না? মানুষের কৃতকর্মের শাস্তি মৃত্যুর আগে থেকেই তো শুরু হয়ে যায়।। ভাগ্য বিধাতা কাউকে ছাড় দেয়নি আর দিবেও না। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।