শাপলা ও সেতুর গল্প পর্ব ৯

0
301

#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-৯]

একজন মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও লিখির ফিসফিস করে কথা বলায় রাসিফ অপমানিত বোধ করলো। ওর মুখ দেখে মুনিয়া সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলো। হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ।”

বিনিময়ে রাসিফ কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না। লিখি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বললো,
“আমাদের যেতে হবে।”

লিখি দুই পা এগোতেই শাড়ির কুচিতে পা বেধে আবারো পড়ে যেতে নিলো। রাসিফ বাহু টেনে ধরে পিছিয়ে আনলো ওকে। লিখি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে দম ছাড়লো। আর এক পা এগোলেই বাজারের আবর্জনা ঠাসা ড্রেনে গিয়ে পড়তো। রাসিফ মেয়েদের মতো ঠোঁট বাকিয়ে বললো,
“ভাবে তো মাটিতে পা পড়ে না। আর যখন পড়ে একেবারে ড্রেনে। বাঙালি নারী শাড়ি পড়ে হাটতে পারে না। লজ্জার ব্যাপার। তবে আপনার জন্য নয়, শাড়ির জন্য।”

নিজের বেহাল অবস্থায় লিখি লজ্জা পেলো ভীষণ। রাসিফকে কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। বিপদ যেমন রাসিফের সঙ্গে দেখা হলেই আসে তেমন সাহায্যও তো সে করেছে। সে হিসেবে একবার ছাড় দেওয়া যায়। লিখি ঝাড়া দিয়ে রাসিফের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। শাড়ির কোচকানো আঁচল ঠিক করতে করতে বললো,
“এবার আসতে পারেন। আমরা কাছাকাছি থাকলেই কিছু না কিছু ঘটবে।”

রাসিফ আহত দৃষ্টিতে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“দেখেছেন? একেই বলে অকৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলো না।”

মুনিয়া না চাইতেও এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে হেসে ফেললো। বললো,
“আপনারা দুজনই ছেলেমানুষী করছেন। কার দোষ ধরবো বলুন?”

লিখি বললো,
“তো এখন আপনাকে ধন্যবাদ দিতে হবে? বিপদ তো আপনি আসাতেই বাধলো।”

” কিসব লেইম কথা বলছিস, লিখি? কেউ কারো বিপদ ডেকে আনে নাকি?”

“অবশ্যই আনে। ওনাকে আমার কাছেপিঠে দেখলেই বিপদ উড়ে উড়ে চলে আসে নিজের ক্ষমতা দেখাতে। তুমি বুঝবে না আপু।”

রাসিফ বললো,
“ধন্যবাদের দরকার নেই। আমার সরি এক্সেপ্ট করে আমাকে মুক্ত করুন।”

“তাহলে আপনি সরির জন্য আমার পেছন পেছন ঘুরছেন?”

রাসিফ তাচ্ছিল্য করলো, “এহ! নিজেকে এতটা উপড়ে তুলবেন না। নাহলে পরের বার বাজারে নয়, ডোবায় গিয়ে পড়বেন। দেখা হওয়াটা সম্পূর্ণই কাকতালীয়। অবশ্য আপনি আমার পেছনে ঘুরলে আলাদা কথা।”

রাগে লিখির নাকের পাটা ফুলে উঠলো। দাম্ভিক ভঙ্গিতে ঘামে ভিজে ঘাড়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে বললো,
“আয়নায় মুখটা দেখেছেন? কি ভাবেন নিজেকে?

“নায়ক ভাবি।”

“এমন ব্যবহারের পরও আপনার সরি এক্সেপ্ট করবো ভাবছেন? আপনার সরিতে চড়া সুদ বসালাম। আপনার এমন ব্যবহারে সরি এক্সেপ্ট না করার ইচ্ছা প্রতিবার দ্বিগুণ হারে বাড়ছে।”

“সুদখোর মেয়ে। একেই বলে ব্যবসায়ীর রক্ত।”

পরিবেশ চাপা গুমোট হলেও আকাশের অবস্থা খারাপ। আজকাল আবহাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যে কোনো সময় ধুসর মেঘখন্ড ভেঙে ঝমঝনিয়ে বৃষ্টি নামবে। মুনিয়া বিরক্ত হলো ভীষণ। ধমক দিয়ে বললো,
“চুপ করবি তোরা? পথের মাঝে অহেতুক বিষয় নিয়ে ত্যানা প্যাঁচানোর মানে হয়? কতটা দেরি হলো সে খেয়াল আছে?”

লিখি আর কিছু না বলে মুনিয়ার হাত টেনে ধরে সেখান থেকে চলে এলো। রাসিফের সঙ্গে ঝগড়া করার সময় সে পায়ের ব্যাথাটা ভুলে গেছিলো। এখন আঙুলটা টনটন করে আঘা’তের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। চারতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় রেস্টুরেন্ট। সিড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে রেস্টুরেন্টের সুসজ্জিত কাঁচের দরজা ঠেলতে যাওয়ার সময় মুনিয়া লিখির হাত টেনে ধরে চুলগুলো ঠিক করে দিলো। যদিও রাস্তায় পড়ে শাড়িতে হালকা ময়লা লেগেছে, দূর থেকে তেমন বোঝা যায় না। মুনিয়া চিন্তিত গলায় বললো,
“তোর কি নার্ভাস লাগছে? পানি খাবি একটু?”

“আমার মনে হচ্ছে তোমার পানি খাওয়া দরকার। তুমিই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছো।”

মুনিয়া উদাস গলায় বললো,
“আসলে এতবার পাত্রপক্ষের মুখোমুখি হয়েছি তবুও নার্ভাসনেস কাটাতে পারিনি। দর্শনধারী মানুষদের থেকে অনেক রকম অভিজ্ঞতা পেয়েছি কিনা। তাই এখন অন্যের বেলাতেও নার্ভাস হয়ে যাই। বাদ দে এসব। শোন দেরি হওয়ার কারণ তো দেখাতে হবে তাই না। নাহলে তো ভাববে আমাদের সময়জ্ঞান নেই। পাত্রী রাস্তায় পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছে সেটা তো আর বলা যায় না।”
মুনিয়া ঠোঁট টিপে হাসলো। লিখি মুখ ভাড় করে বললো,
“তুমি কি আমায় লজ্জা দিতে চাইছো?”

“না, লজ্জা থেকে বাঁচাতে চাইছি। দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে বলবি আমরা জ্যামে পড়েছিলাম।”

“তোমার কি মনে হয় লোকটার সম্পর্কে খোঁজ না নিয়েই আমি চলে এসেছি? অতো কারণ দেখিয়ে ভালো সাজার মানে নেই। এমনিতেও বিয়েটা আমি করবো না।”

“তার মানে?”

“মানে লোকটার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি আমি। ভালো কিছু শুনলাম না। কাজিন নিয়ে প্রেমের ঝামেলাও আছে।”

মুনিয়ার নার্ভাসনেস কেটে গোল মুখশ্রীতে রাগ এসে ধরা দিলো। বললো,
“আগে বলিসনি কেনো?”

“মায়ের হাসিমুখটা কালো করতে ইচ্ছে করছিলো না। দেখলেই তো সম্বন্ধটা এনে মা কত খুশি ছিলো।”

“তাহলে এখন? পাত্র যদি তোকে পছন্দ করে গ্রিন সিগনাল পাঠায়, আর তুই যদি মানা করিস তাহলে মামি তো বেজায় রেগে যাবে।”

ওদের কথার মাঝে রাসিফকে দেখা মিললো। বাইরে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মিছিল দেখা যাচ্ছে। রাসিফের পরিহিত শার্টে বৃষ্টির ছাট। কৃত্রিম আলোয় চুলের ওপর শায়িত শিশিরের মতো জলবিন্দু চিকচিক করছে। রাসিফ রেস্টুরেন্টের দরজার সামনে এসে বললো,
“আবারো দেখা! আমি কিন্তু আপনার পিছনে আসিনি।”

লিখি বিরক্ত হলো না। মুচকি হেসে বললো,
“আপনার সরি এক্সেপ্ট করার সময় এসেছে।”

রাসিফ অবাক হয়ে তাকালো। মেয়েটার হঠাৎ এত পরিবর্তনের মানে বুঝলো না। বললো,
“মানে?”

“চলুন আমার সাথে।”

লিখির পেছনে ভেতরে ঢুকলো রাসিফ ও মুনিয়া। এসির শীতলতা ও উজ্জ্বল আলোয় লিখি হঠাৎ বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো। আগে ছবি দেখেছিলো বলে পাত্রকে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না লিখির। গিয়ে বললো,
“আপনাকে অপেক্ষা করতে হলো মি. সাদিক। তারজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”

মি. সাদিকের অভিব্যক্তি স্পষ্ট বোঝা গেলো না। তার আগেই লিখি রাসিফকে হাত ধরে পেছন থেকে টেনে এনে পাশে দাড় করালো। হাতে হাত রেখে বলে উঠলো,
“মিট মাই বয়ফ্রেন্ড রাসিফ রাওয়াদ। ওর সঙ্গে আপনার দেখা করাবো বলেই এত দেরি হলো আসতে।”

রাসিফ যেন জমে বরফ হয়ে গেলো। মুনিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো লিখির দিকে। মেয়েটার মনে এই ছিলো! মি. সাদিক কিছুই বললো না। তবে মুখ দেখে বোঝা গেলো লোকটা ভীষণ রেগে গেছে। কিছুক্ষণ নীরবে রাসিফকে পর্যবেক্ষণ করে মি. সাদিক বেরিয়ে গেলো। লিখি বললো,
“দেখলে কি বেয়াদব লোক! মানছি বয়ফ্রেন্ডকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। তাই বলে সামান্য সৌজন্য না দেখিয়ে বেরিয়ে গেলেন!”

মুনিয়া বিস্মিত গলায় বললো,
“এটা তুই কি করলি? লোকটা যদি মামিকে বলে দেয়? মামি জানলে তোর খবর আছে।”

লিখি রাসিফের হাত ছেড়ে আয়েশে চেয়ারে বসে বললো,
“আরে ধুর! বললেও বা, আমি অস্বীকার করে ফেলবো। ছেলেটা কে সেটা তো আর কেউ জানবে না।”

বরফ মানব রাসিফের কাঠিন্যে তরলে রূপ নিলো। সে ধপ করে চেয়ারে বসে ঢকঢক করে এক বোতল ঠান্ডা মিনারেল ওয়াটার শেষ করে ফেললো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে যে কোনো সময় কেঁদে ফেলবে। লিখির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার এত বড় সর্বনাশটা কেনো করলেন আপনি?”

“আপনি ভয় পাচ্ছেন কেনো? আজকের এই ঘটনায় আপনার ভূমিকা এখানেই শুরু আর এখানেই শেষ।”

“আমার হাত ধরে এত বড় মিথ্যাটা বলা কি খুব দরকার ছিলো? আর কারো হাত পেলেন না ধরার জন্য?”

“এমনভাবে বলছেন যেন আপনার হাতের ইভটিজিং করেছি! এই হাত সমাজে আর মুখ দেখাতে পারবে না! শো-রুমে তো বাবার সামনেই আমার হাত ধরে টানাটানি করেছেন। সে তুলনায় আমি কিছুই করিনি। বরং আপনার উপকার করলাম। সম্বন্ধ ভাঙলেই আপনার সরি এক্সেপ্টেড।”

“আপনার এই উপকারে শুধু আপনার সম্বন্ধই নয়, আমার আত্মীয়তাও ভাঙতে চলেছে।”

“মানে?”

রাসিফ দাত কিড়মিড় করে বললো,
“আপনিও একটা আহাম্মক বুঝলেন। এসেছিলাম কাজিনের পাত্রী দেখায় সামিল হয়ে ওকে সঙ্গ দিতে। আর আপনি আমার কাজিনের সামনে আমাকেই বয়ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন।”

লিখি স্তব্ধ। এবারও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে মুনিয়া শব্দ করে হেসে ফেললো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here