মন পিঞ্জর পর্ব ৩৭+৩৮

0
993

#মন_পিঞ্জর
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_৩৭

আয়ানকে ঘিরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে,একজন রোগীর পরিবার পুলিশকে আনিয়েছেন।
পেটের ব্যাথায় ছটফট করতে থাকা এক বৃদ্ধ লোককে ভুল ইনজেকশন প্রয়োগ করায় প্যারালাইজ্ড হয়ে গেছেন তিনি,আর তার দায় ভার আয়ানেরই ঘাড়ে কারন ইনজেকশনটা সেই সাজেস্ট করেছে নার্সকে,তবে আয়ান তা মানতে নারায।

আঁখি তুমি অন্ততো বিশ্বাস করো আমি অন্য ওষুধ সাজেস্ট করেছিলাম নার্সকে, কিন্তু নার্স ওটা বদলে ভুলটা দিয়েছে হয়তো আর এখন বলছে ওটা না কি আমি বলেছি ওকে দিতে,আমি এর কিছুই জানি না।

না ইন্সপেক্টর সাহেব আমি সত্য বলছি, ইনজেকশনটা স্যারই আমাকে দিতে বললেন।

মিথ্যুক মেয়ে তোমাকে তো আমি।

নার্স চোখ নিচু করে চোর গলায় কথাটা বললে রাগে আয়ান তেঁড়ে যেতে চায় ওর পানে,কিন্তু পুলিশ ওকে আটকে নেন।

দেখেন মি.আয়ান যা তেজ দেখানোর কোর্টে দেখাবেন,চলেন এবার।

আঁখি আদৃত অনেক করেও পুলিশকে বুঝাতে সক্ষম হলো না,পুলিশ আয়ানকে নিয়ে যেতে ব্যস্ত,এদিকে ততক্ষণে হাসপাতালে ভির জমে গেছে,মানুষ ক্ষিপ্ত স্বর তুলেছে আয়ানের বিরুদ্ধে, লোকগুলো আয়ানের উদ্দেশ্যে ইট পাটকেল ছুঁড়ছে, এমনকি জুতোও, পুলিশ ওকে কোনোরকম বাঁচিয়ে নিয়ে যাচ্ছে,আঁখি ওকে বাঁচাতে ছুটে যেতে চাইলে আদৃত শক্ত হাতে আটকে নেয় ওকে।

কি করছেন ড.আদৃত?পুলিশ আয়ানকে নিয়ে যাচ্ছে,লোকগুলো ওকে ইট পাটকেল,এমনকি জুতোও ছুঁড়ছে।

তবে এতে আপনার কি মিস আঁখি?আপনি এগিয়ে গিয়ে তো আর তা আটকাতে পারবেন না,বরং নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন,তাই আপনার না যাওয়াটাই ভালো।

কিন্তু আয়ান নির্দোষ, আমি জানি ও স্বার্থপর হতে পারে কিন্তু নিজের কাজে খামখেয়ালীপনা ও কখনো দেখাতে পারে না।

হুম মিস আঁখি,আমিও জানি এখানে ড.আয়ানের কোনো দোষ নেই,আমি দেখছি,পুলিশও এ বিষয়ে তদন্ত করবে,আমি একজন লয়্যারের সাথে কথা বলছি দেখি কি করা যায়,আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই যে আয়ান নির্দোষ, তাই ওকে বাঁচাতে হতে উপযুক্ত প্রমাণ লাগবে। আমাদের যাই করতে হবে সব ঠান্ডা মাথায় করতে হবে।

এখন মাথা ঠান্ডা রাখার সময় না,ও অনেক কষ্ট করে ডাক্তারি কমপ্লিট করেছে,আমরা এভাবে হাতে হাত রেখে বসে থাকলে ওর ডাক্তারি লাইসেন্স চলে যেতে বেশি সময় লাগবে না,মা-বাবার সপ্ন ছিলো ওকে ডাক্তার বানানোর,আর আমি তাদের সপ্ন মাটিতে মিশতে দেবো না,প্রামাণ তো আমার এক্ষুনি চাই।

ক্ষিপ্ত কন্ঠে কথাগুলো বলে সেই নার্সের দিকে এগিয়ে গেলো আঁখি,হাত ধরে টেনে ওকে নিয়ে একটা ওষুধ ভর্তি কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো,আদৃত ভাবলেশহীন হয়ে গেলো আঁখির এহেন কান্ডে,হাত পা ঠুকিয়ে দরজা ঢেলে যাচ্ছে।মুখ দিয়ে আঁখি নামক ধ্বনি বের করছে খনিক ক্ষিপ্ত গলায়।এদিকে ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসছে আঁখির তেজি গলার প্রহার।

নার্সকে দুগাল বরাবর বসিয়ে দিয়েছে আঁখি কয়েকটা,নার্স নিজেকে বাঁচাতে ছুটাছুটি করলেও পারছে না,এবার আঁখি নার্সের চুল মুঠো করে ধরে বললো।

বল কে বলেছে এসব করতে?বল?

আমায় কেউ বলে নি,স্যার ওই ইনজেকশনটাই দিয়েছিলেন,কথাটা শুনতেই আবারও নার্সের এক গাল বরাবর আরেকটা বসিয়ে দেয় আঁখি।

তবে তাই,আচ্ছা তবে চল সেই ইনজেকশন দিয়েই না হয় তোকেও প্যারালাইজ্ড করি,অন্যের জীবন আর কেরিয়ার নষ্ট করে তোর শান্তিতে বেঁচে থাকাটাও শোভা দিবে না,আঁখি নিজের গায়ের ওড়না দিয়ে নার্সের দুই হাত বেঁধে দেয় টেবিলের সাথে তারপর উঠে গিয়ে ড্রয়ার খুলে ওষুধ বের করে যে ওষুধ ওই রোগীকে দেওয়া হয়েছিলো,তা ইনজেকশনে নিয়ে আঁখি এবার এগিয়ে আসে নার্সের দিকে,চোখে ভয়াবয়তা,একপ্রকার পাগলের ন্যায় অঙ্গভঙ্গিতে এগুচ্ছে আঁখি, নার্স এতে অনেক ভয় পেয়ে যায়,আঁখি এমনটা নার্সকে ভয় পাওয়ানোর জন্যই করে।আঁখি নার্সের গালে ইনজেকশনটা দিয়ে স্লাইড করে ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি টাঁঙিয়ে বললো এবার।

বলবি না তো সত্যটা,তবে সারাজীবনের জন্য অচল হয়েই থাক।

আঁখি ইনজেকশনটা পুশ করার সুবিদার্থে নার্সের পানে এগিয়ে আনলেই নার্স চিৎকার করে বলে উঠে।

আমি বলছি,আমার এতো বড় সর্বনাশ করবেন না,আমি বলছি।আঁখি নিজের হাত আটকে নেয়,তারপর নার্সকে সোজা করে উঠিয়ে বসায়।ওকে পানি পান করতে দেয়, নার্স একটু স্বাভাবিক হলে আঁখি ওকে সত্যটা বলতে বলে।এদিকে ফোনের রেকর্ডার অন করে দেয়।

বল।

নার্স কাঁপা গলায় সত্যটা বলতে লাগে।

আসলে আজকে মাহি নামের কেউ একজন এসেছিলেন,এসে আমাকে আড়ালে ডাকলেন,তারপর আমার হাতে অনেকগুলো টাকা দিলেন দিয়ে বললেন উনার একটা কাজ করে দিতে।আজকে যে কয়েকজন রোগী আছেন আয়ান স্যারের কাছে ওদের যেকোনো একজনকে ভুল ওষুধ দিয়ে ওদের সাথে বড় কিছু করে দিতে যার ফলস্বরূপ দোষ আয়ান স্যারের ঘাড়ে আসবে।

কাজটার কথা শুনে আমি তা করতে মানা করে দেই,তারপর উনি আমায় হুমকি দেন আমি উনার হয়ে কাজটা না করলে উনি আমার চাকরি খেয়ে যাবেন, এই চাকরিটা আমার জন্য অনেক জরুরি, আমার মা আর ছোটো তিন বোনের খরচ আমি একাই বহন করি এমতাবস্থায় চাকরিটা গেলে যে আমার কিছুই করার ছিলো না?তাছাড়া কাজটার পরিনামে উনি আমাকে বিপুল পরিমান টাকাও দিচ্ছিলেন,তাই আমি লোভে পড়ে যাই।

আর তাই বলে একজন সুস্থ মানুষকে সারা জীবনের জন্য অচল করে দিবে,অন্য জনের কেরিয়ার নষ্ট করে দিবে,,তুমি ভালো করেই জানো মাহি চাইলেই তোমাকে এখানকার জব থেকে বের করতে পারবে না কারন এখানে বাইরের কেউ নিজের জোর খাটাতে পারে না,ড.আমির চৌধুরী আর ড.নোমান, ড.আদৃত কখনো এসব হতে দিবেন না,তুমি তো শুধু টাকার লোভেই এমন করেছো,আর এখন অসহায়ত্বের দোহাই দিচ্ছো,তোমার মতো স্বার্থপর লোকগুলো তো নিজের অসহায়ত্ব দেখিয়ে অন্যের কাছ থেকে সব কিছু আদায় করে নিতে চায় শুধু, তুমি কি ভেবেছিলো আমি তোমাকে সত্যিই ইনজেকশন পুশ করবো?আগ্যে তা না,আঁখির চিন্তাভাবনা কখনোই এতোটা নিচ হতে পারে না,তবে তোমার মতো লোক যে নিজের স্বার্থে অন্যের এতো বড় ক্ষতি করে দিতে পারে সে নিজের প্রাণের উপর বিপদ আসলে কখনোই অন্যকে বাঁচাতে চাইবে না,আর তোমার মতো লোকের মুখ থেকে কথা বের করার কৌশল আমি ভালোই জানি, তোমার ভাগের টা আমি পরে দেখছি আগে আয়ানকে বাঁচাতে হবে,আর ওই মাহিকেও তো দেখতে হবে,তবে যাওয়ার আগে কনফার্ম হই,দেখো এই মেয়েটাই ছিলো তাই না।ফোনে মাহির ছবি দেখিয়ে বললো আঁখি।

হ্যাঁ এই মেয়েটাই ছিলো।

দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো আঁখি, আদৃত আন্দাজ করতে ব্যার্থ হলো ভিতরে কি হয়েছে এতোক্ষণ, আঁখি তারপর সব খুলে বলে আদৃতকে, নার্সের রেকর্ড করা কথাগুলোও শুনায় আদৃত হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে এবার আঁখির পানে।

কি হয়েছে কি দেখছেন?

আপনাকে।আমার তো মনে হয় আপনাকে হার মানিয়ে যাওয়ার মতো কোনো কিছু এখনও পৃথিবীতে আসে নি।

আর আসবেও না,কারন আমার রব আমার সাথে আছেন সবসময়,এবার চলেন,আয়ানকে জেল থেকে আনতে হবে,এই প্রমাণ যথেষ্ট ওকে ছাড়াতে।

হ্যাঁ এই প্রমাণের জোরে হয়তো আজকে আয়ানকে ছাড়ানো যাবে তবে কারো সাক্ষ্যের জোরে ওর উপর থেকে এই কেস উঠানো যাবে না,উপযুক্ত প্রমাণ লাগবে মাহির বিরুদ্ধে।

ও পরে দেখা যাবে আগে আয়ানকে ছাড়িয়ে আনি।

হুম।
____________

আঁখি আদৃত একজন উকিল আর সাথে আয়ানের জামিননামা নিয়ে আয়ানের জামিন করাতে আসে,জামিন করিয়ে নেয়ও,তবে আঁখি আয়ানের সাথে একা কিছু কথা বলতে চায়,আয়ানও যেনো তাই চাইছিলো,কিন্তু আদৃতের কথাটা একদম হজম হলো না,গা জ্বলে উঠলো ওর,কিন্তু আঁখির কথা ফেলতেও পারলো না,আয়ান আঁখি পুলিশ স্টেশন এর বাইরে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর আদৃত ওদের থেকে খনিক দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে,তবে চোখ ওদের উপরই ওটল,বার বার মুঠো শক্ত করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে,ওদের দুজনকে একসাথে যে মেনে নিতে ব্যার্থ হচ্ছে আদৃতের সে উতলা মন।

আঁখি আয়ানকে জিজ্ঞেস করলো,যে মাহির সাথে ওর কি এমন সমস্যা হয়েছে যে মাহি ওর সাথে এমন কিছু করলো,অতঃপর আয়ান সমস্ত সত্য আঁখিকে খুলে বললো,কথাগুলো শুনে তো আঁখি অবাকত্বের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে।

হোয়াট মাহি বাবা মায়ের সম্পত্তি নিয়ে গেছে আর তুমি কিছুই করতে পারো নি?তোমার সাথে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে,তা তো হওয়ারই ছিলো আমি ভালো করে জানতাম তাই হবে,মাহিকে যে ভালোই চেনা আছে আমার,তবে ও মা-বাবার সম্পত্তি নিতে পারবে না।

আয়ান অনুনয়ের স্বরে বললো এবার।
হুম সব আমার পাপের শাস্তি,আমি তোমার সাথে যা করেছি তা তো পেতে হতোই আমার।

হয়েছে এখন ইমোশনাল হওয়ার টাইম না,যে করেই হোক মাহির বিরুদ্ধে আমাদের প্রমাণ আনতেই হবে।

কিন্তু আমরা কি করে কিছু করবো,আমার উপর এতো বড় কেস, যেটা মাথা থেকে না নামা পর্যন্ত অন্য কেসেও আমাকে দোষী মানা হবে,মাহি ক্লিয়ারলি বলবে যে আমি সম্পত্তি ওর নামে দিয়ে এখন মানা করছি,হয়তো সেটা গ্রাজ্য হতো না যদি এ কেসটা আমার উপর থাকতো না,কারন ম্যাজেস্ট্রেট এর সামনে আমি ওকে সাইন করে সম্পত্তি দেই নি,কিন্তু এই কেস আমার উপর থাকার ফলে ওর জিতার সম্ভাবনাই বেশি।ও বুক ফুলিয়ে বলবে আমি এমনিতেই অপরাধী।

হুম,তাই ওকে হারাতে আমাদের ওর বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রামাণ চাই,তুমি চিন্তা করো না আয়ান,আমি দেখছি কি করা যায়।

কি করবে তুমি?

যাই করি না কেনো সম্পত্তি আমি মাহির হাতে যেতে দেবো না,কথাটা শুনেই আয়ান আঁখিকে ঝাপটে ধরলো অতিরিক্ত খুশিতে আর বলতে লাগলো।

তুমি থাকতে আমার কোনো টেনশন নেই আঁখি।তুমিতো আছো আমার জন্য।

আঁখি আয়ানকে ছাড়াবে এর আগেই আদৃত তেঁড়ে এসে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে আয়ানকে ওর কাছ থেকে ছাড়িয়ে দেয়।তারপর কটমট কন্ঠে বলে উঠে।

দেখেন ড.আয়ান মিস আঁখি এখন আর আপনার স্ত্রী নয় তাই ওর থেকে দূরে থাকাটাই আপনার জন্য ভালো হবে,চলেন মিস আঁখি।

আদৃত আয়ানকে দেখিয়েই আঁখির হাত ধরে ওকে ওখান থেকে নিয়ে আসে,আয়ান অসহায় হয়ে তাকায় আদৃতের ধরে থাকা আঁখির হাতের দিকে, এদিকে আঁখি অজানা এক অনুভুতি নিয়ে তাকিয়ে আছে আদৃতের পানে,আদৃত আঁখির উপর নিজের অধিকারত্ব খাটিয়ে নিতে চাইছে বিষয়টা যে মোটেও মন্দ লাগছে না আঁখির কাছে,বরং আদৃতের এমন কান্ডের ফলস্বরূপ আঁখির ঠোঁটের কোনো যেনো অল্প প্রাপ্তির কিঞ্চিৎ হাসি ফুঁটে উঠে।

বাড়িতে এসে গেছে ওরা,আদৃত আঁখিকে কড়া ভাবে নিষেধ করেছে যে এখন আর আয়ানের বিষয় নিয়ে চিন্তা না করতে,বাকিটা আদৃত দেখে নিবে ওকে রেস্ট করার কথা বলে লয়্যার কে ফোন করে আসতে বলে আয়ানের সাথে দেখা করতে গেছে।

আদৃত চলে যাওয়ায় আঁখি মনে শান্তি পায়,কারন আদৃত থাকলে আঁখিকে কখনোই তা করতে দিতো না যা এখন আঁখি করতে চাইছে,আঁখি এবার অনেক কিছুই ভেবে নিয়ে আয়েশার কাছে গেলো,ওকে সবকিছু খুলে বললো।

আমি জানতাম ভাইয়া ওর কর্মের সাজা একদিন পাবেই।

হুম,কিন্তু এখন তা ভাবার বিষয় না,আমাদের বাবার রেখে যাওয়া আমানত রক্ষা করতে হবে,না হলে ওই মাহি আমাদের বাড়ি ভেঁঙে না জানি কতো বড় বাংলা উঠাবে,কাল সকালে কোর্টে সম্পত্তি নিয়ে ফায়সালা হবে আর তার আগেই আমাদের মাহির বিরুদ্ধে প্রামাণ আনতে হবে আমাদের।

হ্যাঁ তবে কিভাবে আনবো?

একদম সহজ,তুই তো জানিস ওই মাহি যতোটা চালাক ততোটাই মুখ পাতলা মেয়ে।একটু টুনকো দিলে পেট থেকে সব কথা বর বর করে বলে দেয়,তোর মনে নেই স্কুল টাইমে কিভাবে আমরা ওর পেটে পুরা কুবুদ্ধি জানতে পারতাম যা ও আমাদের বিরুদ্ধে এটে রাখতো,আজ সেটাই কাজে লাগাতে হবে।

আঁখি আয়েশা মাহির উদ্দেশ্য বের হলো।

______________

হল ভর্তি লোকের সামনে ডায়মন্ড রিং হাতে হাটু গেঁড়ে বসেছে তাজবীর,সামনেই সায়েদা দাঁড়িয়ে, একটু আগেই তাজবীর নিজের মনের অব্যক্ত ভাব সায়েদাকে প্রকাশ করেছে সবাইকে সাক্ষী রেখে।এবার সায়েদা ইউল ইউ মেরি মি বলে ওর উত্তরের অপেক্ষায় মুখে একরাশ হাসি টাঙিয়ে সায়েদার দিকে দৃষ্টি অটল রেখে তাকিয়ে আছে,তবে সায়েদা কিছু বলছে না,সবাই জোরে জোরে বলছে।

সায়েদা সে ইয়েস,সায়েদা।সে ইয়েস।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সায়েদা অট্টাহাসিতে ফেঁটে পড়লো,হাসতেই থাকলো,কেউ বুঝতে পারলো না ওর হাসির মানে,তাজবীরের অবাকত্ব টা একটু বেশিই হলো,সায়েদা এবার হাসতে হাসতে বললো।

আমাকে কি যেনো বলতে তুমি তাজবীর,ও হ্যাঁ মনে পরেছে,বোকা টিউবলাইট,তবে তুমি কি?আরে এতোদিন ধরে তোমার সাথে কথা বলে তোমাকে নিজের প্রেমে ফেললাম,তোমার সাথে প্রেমের অভিনয় করলাম,তোমাকে দিয়েই তোমার আর আমার সব ফ্রেন্ডকে একত্রে করালাম আর সবার সামনেই প্রমাণ করে দিলাম যে টিউবলাইট আর বোকা গাঁদা আমি না বরং তুমি,হা হা হা হা,অনেক মজা লাগে না তোমার অন্যকে নিজে মজা করতে এখন কেমন লাগলো যখন নিজের সাথে হলো এমনটা?এখন অবশ্য হয়তো এসব ভালো লাগছে না,এতো বড় বিজনেসম্যান হয়েও আমার ছল বুঝতে পারলে না,বোকা হলেই এমন,কেমন লাগলো এবার সবার সামনে অপমানিত হয়ে? হা হা হা।

সায়েদার কথাগুলো শুনে তাজবীরের চোখ বেয়ে টপটপ করে জল বইতে শুরু হয়,বসা থেকে উঠে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে,কথাগুলো সব যেনো ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

সেখানের সবাই হতবাক সায়েদার এমন কান্ডে, কেউ আশা করে নি সায়েদা এমনটা করবে,তাজবীর এবার কান্নায় ধরে আসা কন্ঠে বললো।

ভালোই করেছো,আজ হয়তো তুমি অনেক খুশি হয়েছে নিজের প্রতিশোধটা যে নিতে পেরে গেছো তুমি।সত্যিই তুমি বোকা একদম নও,বোকা তো আমার এই মন যে তোমার চাতুরী ধরতে পারে নি,আমি তোমার সাথে যা যা করেছি তার জন্য ক্ষমা চাইছি পারলে ক্ষমা করে দিয়ো কারন আবারও তার শোধ দেওয়ার মতো অবস্থা আমার নেই।

চোখ মুছতে ব্যস্ত হয়ে তাজবীর স্থান ত্যাগ করলো, তাজবীরের এক ফ্রেন্ড অনেকটা ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে বললো এবার সায়েদাকে।

আজ নিজেকে নিয়ে অনেক প্রাউড ফিল হচ্ছে তাই না,হবারই কথা,তাজবীর সুদর্শন সাকসেসফুল বিজনেসম্যান যার আগ পিছন মেয়েরা ঘুরে বেড়ায় তবে কখনো কাউকে পাত্তা দেয় নি। তাকে যে প্রেমের জালে ফেলে যথারীতি নাচিয়ে দিয়েছো তুমি,যে ছেলে কাজ ছাড়া কিছুই বুঝতো না সে ছেলে কাজ ধান্দা ফেলে তোমার পিছন পড়ে গিয়েছিলো,জানো তোমাকে সময় দিতে গিয়ে এ মাসে বিজনেসে ও কতো বড় লস খেয়েছে ও তবে তা গায়ে মাখে নি এটা ভেবে যে পরিবর্তে তোমাকে পেয়েছিলো,ও কখনোই কোনো মেয়ের সাথে তেমন ফ্লার্ট বা ফাজলামো করে না,তোমার সাথে করেছিলো কারন প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছিলো তোমাকে, যখনি কথা হতো আমার সাথে শুধু তোমাকে নিয়েই কথা বলতো,আজ আমার কি মনে হয় জানো যে তুমি সত্যিই টিউবলাইট তা না হলে হাতের মুঠোয় হিরে পেয়ে তা ছুঁড়ে ফেলতে না।

ছেলেটা কথাগুলো বলে চলে যায়,সায়েদার প্রায় সব ফ্রেন্ডও ওকে কথা শুনিয়ে যায় এ নিয়ে,সায়েদারও মন পিঞ্জরের কোনে কেনো যেনো একটা খারাপ লাগা কাজ করতে শুরু করেছে।

সায়েদা প্রায় দিন রাত সারাক্ষণই তাজবীরের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত থাকতো,একদিন চ্যাট করারত অবস্থায় তাজবীর সায়েদাকে প্রপোজ করে,সায়েদাও মানা করে না,তবে ও চায় তাজবীর যেনো সায়েদা আর তাজবীরের সকল ফ্রেন্ডসদের সামনে ওকে প্রপোজ করে,তাজবীরও এতে দ্বিমত করলো না,আর তারপর এসব ব্যবস্থা তাজবীরই করলো শুধু সায়েদার জন্য।

চলবে……….

#মন_পিঞ্জর
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_৩৮

আয়েশা মাহি ফোন হাতে প্রবেশ করেছে মাহির বাড়িতে,ওগুলাতে ভিডিও আর রেকর্ডার অন,এমনভাবে ওরা হাতে ফোনগুলো ধরেছে যাতে মাহি বুঝতে পারে না ওর বিরুদ্ধে আয়েশা আঁখি কি ফন্দি করে এসেছে।
মাহি আয়েশা আর আঁখিকে ওর বাড়িতে দেখে অনেকটা আশ্চর্য হয়,মাহি একাই এখন আয়ানদের বাড়িতে রাজত্ব করছে ওর সম্পত্তি দাবিতে,বেশ চিন্তাভাবনা করে নিয়েছে বাড়িটা হাতেই এলেই ভাঙিয়ে বড় বাংলো বানাবে,কিন্তু হঠাৎ সেখানে আঁখি আয়েশাকে দেখে ভ্রুযোগল কুঁচকালো মাহি,সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওদের দিকে প্রশ্ন ছু্ঁড়লো।

তোরা এখানে?

ওর উত্তরে আঁখি বললো।

হ্যাঁ আমরা,কি পেয়েছিস তুই তোর সাহস হলো কি করে আয়ানের সাথে ছল চাতুরি করে আমাদের বাবার সম্পত্তি নিজের নামে করে নেওয়ার।

বেশ করেছি,তোদের সমস্যা কি এতে?

তুই কি মনে করেছিস তুই সবকিছু পেয়ে যাবি, আয়ান জেল থেকে ছুটে গেছে আর কালকে কোর্টে আসছেও,তুই সম্পত্তি পাবি না,ওই তুই যে নার্সকে ভাড়া করেছিলিস ও সবকিছুই মুখ ফুঁটে টর টর করে বলেছে তো বিরুদ্ধে ।

কি ওই ছোটলোকটার এতো বড় সাহস আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়,ছাড়বো না আমি ওকে,তবে ওর সাক্ষ্য তে তেমন কিছু হবেও না,আয়ান তো অপরাধী হিসেবে এখনও চিহ্নিত, তোমাদের কাছে এখনও এর কোনো উপযুক্ত প্রমাণ নেই যে ওই নার্সকে আমিই টাকা দিয়ে কাজটা করিয়েছি,তাছাড়া আয়ানও যে আমাকে স্বজ্ঞানে সম্পত্তি দেয় নি তারও কোনো প্রমাণ নেই কোর্টে হাজির করার মতো,হা হা হা হা,দেখ সবকিছু আমিই করলাম কিন্তু তোরা কেউই আমার কিছুই করতে পারবি না।

তোর কি মনে হয় তুই বেঁচে যাবি?

অবশ্যই বেঁচে যাবো,এতো কিছু আমি করেও এখন জয়টাও আমারই হবে,হা হা হা হা,আমি সব পাবো,আসলে যানিস তোরা কিছু পেতে হলে আমার মতে মাস্টারমাইন্ড হতে হয়,যা তোরা কেউই নয়।হা হা হা হা

দেখে নিবো মাহি তোকে।

কথাটা বলে আঁখি আয়েশা দুজন স্বাভাবিক ভাবে চলে যেতে নেয়,মাহির সন্দেহ হয় অনেকটা, এই দুজন মাহির কাছে এসে এতো কিছু শোনার পরও স্বাভাবিক ভাবে চলে যাওয়ার মেয়ে না,অন্যদিন হলে মাহিকে এতো কাছে পেয়ে মাহির এতো বাজে কথা শুনার পরও ওর উপর হাত না তুলে যেতো না, দুজন চলে যেতে নিলে সন্দেহের বশে মাহি কর্কশ গলায় গার্ডদের ডাকে।

গার্ড এদের আটকাও,এরা যেনো বাড়ির বাইরে না যেতে পারে,দুজনকে ধরে মেরে আধমরা করে বেঁধে নিয়ে এসো আমার সামনে।

মাহির কথায় আয়েশা আঁখি হতভম্ব হয়ে ওর পানে তাকায়,মাহি তেজি গলায় বলে উঠে।

তোরা কি ভেবেছিস?আরে তোদের সাথে ছোটো থেকে বড় হয়েছি তোদের রক্তে রক্তে চেনা আমার,জানি না ঠিকভাবে তবে এটা জানি নিশ্চয়ই আজকে দুজন আমার বিরুদ্ধে বড় কোনো মতলব করে এখানে এসেছিস আর মতলব পুরো হতেই এখন ভালো মানুষের বেশে চলে যাচ্ছিস,দাঁড়া যাওয়াচ্ছি তোদের, হয়তো আমার হাতেই তোদের মৃত্যু লেখা,গার্ডের বাচ্চারা ধরো ওদের।

গার্ড চারজন চারদিক থেকে এগিয়ে এলো আঁখি আয়েশাকে ধরতে,পাশেই রাখা ছিলো মাহির কিছু মদের খালি বোতল হয়তো ফেলে দেওয়ার জন্য বক্সে করে এখানে এনে রাখা হয়েছিলো,আঁখি ওখান থেকে দুইটা বোতল উঠিয়ে সামনের দুজন গার্ডদের মাথার পর পর ভেঁঙে দিলো,তারপর আরও একটি বোতল হাতে নিয়ে আয়শাকে সাথে করে ছুঁটতে লাগলো,তিনজন গার্ড ওদের পিছনে এমনকি মাহিও।

আয়েশা ঝটফট ওই রেকর্ড আর ভিডিওটা যাকে যাকে আর যেখানে যেখানে পারিস সেন্ড কর আমাদের বাড়ির লোক বন্ধু বান্ধব কেউ যেনো বাদ না পড়ে।

………..

হয়েগেছে সেন্ড করা এখন পালা।

পালাতে পালাতে দুজন বেশ হয়রান হয়ে পড়ে,আঁখির মাথা খনিক ঘুরতে শুরু হয়েছে তবে তা অনুমান করতে দিচ্ছে না আয়েশাকে,গার্ডদের চোখের আড়াল হয়ে একটা ঝুপের পিছন লুকিয়ে পড়েছে দুজন।

আঁখি লোকগুলো তো আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, এখান থেকে বেরুবো কি করে,আমার মনে হয় বাড়িতে ফোন করে কাউকে আনা দরকার।

তুই ড.আদৃতকে ফোন কর আমি পুলিশকে ফোন করে এখানে আনি।

আঁখি ফোন করে পুলিশকে সবকিছু বলে জায়গার ঠিকানা অনুযায়ী আসতে বলে,এদিকে আয়েশা কথাটা আদৃতকে বললে আদৃত অস্থির হয়ে পড়ে,তখন ও আয়ানের সাথে ছিলো উকিলকে নিয়ে কিছু কথা বলতে,তখনি ফোন আসে, আদৃত আর দেড়ি না করে তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে পড়ে,নোমানকে আর তাজবীরকেও ফোন করে ওখানে আসতে বলে,আয়ান আদৃতের কাছ থেকে বিষয়টা জানতে পেরে নিজেও অস্থির হয়ে আদৃতের সাথে আসে।

আঁখি আয়েশা হঠাৎ লক্ষ্য করে লোকগুলো সেখানে নেই,তাই সুযোগ বুঝে বেড়ুতে নিলেই হুট করেই মাহি প্রকট হয় সামনে,পিছনে ওর দুটি গার্ড,আয়েশা মাহি ওপর দিকে ছুঁটতে নিলে ওদিক থেকেও ওদের আরও একজন গার্ড এগিয়ে এলো, আঁখি আবারও দুদিক না ভেবে হাতে থাকা কাচের ওই বোতল সামনে থাকা গার্ডের মাথায় ফাঁটিয়ে পালাতে লাগলো আয়শাকে নিয়ে,তখনি আঁখি গুলির শব্দ শুনতে পেলো,পাক ফিরে তাকিয়ে দেখে আয়েশা পায়ে ধরে রাস্তায় পরে কাতরাচ্ছে,আঁখি এসেই ওকে উঠিয়ে বসালো,নিজের বুকের সাথে এটে ধরলো ওকে ওর যন্ত্রণায় ব্যাথীত হয়ে,ওকে তোলার চেষ্টা করতে লাগলো এবার।মাহি গার্ডের কাছ থেকে বন্ধুক নিয়ে গুলি করেছে আয়েশার পায়ে।

আঁখি আয়শাকে তুলতে নিয়েছে এদিকে আয়েশা বলছে।

আঁখি তুই পালা।

প্রাণ থাকতে তোকে ছেঁড়ে পালাবো না।
মাহি এবার হাসতে হাসতে ওদের দিকে এগিয়ে এলো।

অনেক তেজ না তোদের, হা হা হা,আমার সাথে চালাকি,পালিয়ে বাঁচবে কোথায়?তা আয়েশা তোর পায়ে কেনো গুলি করেছি জানিস? তোকে পারলে তো একদম মাথায় গুলি করতে পারতাম,তবে তা করবো না,তোদের তো তিল তিল করে মারবো,গার্ড আয়েশাকে নিয়ে গিয়ে ওকে ধর্ষণ করে কোনো জঙ্গলে ফেলে দিও আর এই আঁখিকে তো আমি দেখছি,গার্ডগুলো আয়েশার দিকে এগিয়ে আসলে আয়েশার ঢাল হয় আঁখি।তেজি গলায় বলে উঠে।

যতোক্ষণ প্রাণ আছে আয়েশার কিছুই হতে দেবো না।

বলিষ্ঠ দুজন গার্ড, আঁখি যথেষ্ট টক্কর দেওয়ার চেষ্টা করছে নিজের জানা কৌশল দিয়ে কিন্তু পারছে না,তবুও হার মানছে না,আয়েশার গায়ে এখন অব্দি ছুঁতেও দেয় নি ওদের।হঠাৎই আয়েশা আঁখি বলে চিৎকার করলে আঁখি পিছনে তাকাবে তখনি শক্ত কিছুর বারি পড়ে ওর মাথায়,মাহি অনেক বড়সড় একটা লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে আঁখিকে,এক মুহুর্তের জন্য আঁখির যেনো পুরো পৃথিবী ঘুরতে শুরু হয়,চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করে,কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মাহি আঁখির মাথায় আরেকটা প্রহার করে, আঁখি রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে,আয়েশা আঁখি বলে বলে চিৎকার করে কাঁদছে আঁখি চোখ মেলে ওকে দেখার চেষ্টা করছে শুধু,চোখের ঝাপসা আবরণের ফাঁক দিয়ে আয়েশাকে দেখতে পাচ্ছে,দুই হাত ধরে দুই গার্ড ওকে টেনে হেচরে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে,আঁখি অনেক চেষ্টা করছে উঠে যেতে কিন্তু পারছে না,হাত বাড়িয়ে শুধু কাঁপা ঠোঁটে নাম নিচ্ছে আয়শার,গার্ডগুলো ওকে নিয়ে যেতে ব্যস্ত আয়েশা শুধু আঁখি নামেই চিৎকার করছে,নিজেকে ছাড়ানোর অসীম চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যার্থ হচ্ছে বার বার।

আঁখি কাকুতি ভরা কন্ঠে অনেক কষ্ট করে আওয়াজ ফুঁটিয়ে মাহিকে বলছে।

ছেঁড়ে দে আয়েশাকে,তুই আমাকে মারতে চাস মেরে ফেল,আয়েশাকে ছেঁড়ে দে শুধু।

য়ু হু,তা তো আর হবার নয়,না আমি আয়েশাকে ছাড়বো না তোকে,আয়েশার কাম তামাম আমার লোক করে দেবে,আর তোর টা না হয় আমি করি।

কথাটা বলে মাহি রিভালভারটা আঁখির দিকে তাক করে,আঁখিও চোখ বন্ধ করে নেয়,ওর মা, বাবা, ভাই, আয়েশা, আয়ান, মিরা মা সবার সাথে কটানো কিছু মধুর স্মৃতি ওর মস্তিষ্কে ধরা দেয় অল্পতে,শেষবার যেনো আদৃতের গম্ভীর মুখখানি ওর চোখের সামনে ভেসে উঠে।তবে বাস্তবেও যে শেষবারের মতো ওকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে আঁখির।হয়তো তা সম্ভব নয় এমনই এক অনুভুতি আঁখির ভিতর কাজ করলো।
কাঁপতে থাকা ঠোঁটে কিছু কথা ফোঁটালো এবার আঁখি, আয়েশা পারলে আমায় ক্ষমা করিস,আল্লাহ ওকে রক্ষা করুন, কবুল করুন আমায় রাব্বুল আলামীন,লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।

মাহি আঁখির উপর গুলি চালিয়ে দিতে যাবে তখনি একটা গুলি লাগে মাহির হাতে,মাহি ছিটকে পরে রাস্তায়,সামনে তাকিয়ে দেখে পুলিশ,এমনকি আদৃত আয়ান নোমান তাজবীর সবাইও।

পুলিশ এসেই মাহিকে এরেস্ট করে,এদিকে আয়েশা অবরতব চিৎকার করছে গার্ডরা বেশিদূর এখনও নিয়ে যেতে পারে নি ওকে,তাজবীর নোমান সেদিকে ছুটলো সাথে কিছু পুলিশও,আদৃত আর আয়ান ছুটে আসলো আঁখির কাছে,আদৃতের অস্থিরতাই বেশি,টান দিয়ে আঁখিকে উঠিয়ে নিজের বুকের সাথে ল্যাপ্টে ধরলো,আঁখিকে গালে হাত দিয়ে ওকে জ্ঞানে রাখার চেষ্টা করছে,আঁখির মাথা ফেটে বেড়িয়ে আসছে অনেক রক্ত,যা আদৃতের ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুন।

মিস আঁখি,জ্ঞান হারাবেন না,কথা বলেন আমার সাথে,আপনার কিছুই হবে না,বলেছিলাম না আমার কথা শুনতে,কখনো শুনবেন না তো আমার কথা,দেখলেন আজ কি হয়ে গেলো ,কেনো আপনি এমন বলেন তো?কি করবো আমি আপনাকে নিয়ে,আপনার কিছু হয়ে গেলে কি হবে আমার,ভেবেছেন একবার?

আদৃত নিজের মধ্যে নেই,আঁখির অবস্থা দেখে খনিক পাগলের ন্যায় আচরন করছে,আয়ানও নিজেতে অটল থাকতে পারছে না,আদৃত আয়ান দুজনেরই চোখ বেয়ে বেড়িয়ে আসছে অজস্র জল তা শুধু আঁখিকেই নিয়ে,ভয় পাচ্ছে দুজনই যদি আঁখিকে হারিয়ে যায়,তবে আঁখির যেনো এই সময়টাতেও বেশ চিন্তা হচ্ছে আদৃতকে নিয়ে,কোনোরকম চোখ খুলে ধিদ্বার করতে চাইছে ওর কান্নারত চেহারায়,হাত তুলে মুছে দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে আদৃতের চোখের জল,তবে তা পারছে না,শুধু ধিমি কন্ঠে একটা কথাই ফুটাতে সক্ষম হলো।

আপনি এতো কৃপন কেনো বলেন তো?কৃপণতা ছাড়েন আর ঠোঁট বাকিয়ে হেসে নিন।

কথাটা আদৃতের বুকে গিয়ে তীরের ন্যায় আঘাত করলে,পুরো শরীরে শিহরনের সৃষ্টি করলো।আঁখি তৎক্ষনাৎ জ্ঞান হারালো,আদৃত ওকে চিৎকার করে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।

আঁখিিিি,না আমি আপনার কিছুই হতে দিবো না মিস আঁখি,আমি হাসবো অনেক হাসবো তবে আপনাকে সাথে নিয়ে,আপনার সাথে হাসবো বুঝেছেন,আপনার সাথে নতুন করে বাঁচবো শুধু আপনার সাথে।

আয়ান কান্না করতে করতে বললো।

ড.আদৃত আমাদের দেড়ি করা উচিৎ নয় আঁখিকে হাসপাতালে নিতে হবে,কথাটা বলে আয়ান আঁখিকে ধরতে নিলে আদৃত ঝাপটি দিয়ে আয়ানের হাত সরিয়ে দেয়।

ছুবেন না উনাকে আপনার কোনো অধিকার নেই উনার উপর,আজ আঁখির এই অবস্থা শুধু আপনার জন্য,তবে ওকে আমি কিছু হতে দেবো না,ওর আপনাকে কোনো দরকার নেই,কিন্তু ওকে আমার বড্ড প্রয়োজন।

আদৃত কোলে তুলে নিলো আঁখিকে,আয়ান ড্রাইব করছে আর আদৃত আঁখিকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বসে আছে,হাত দিয়ে ধরে আছে আঁখির মাথা ফেঁটে রক্ত বের হওয়া অংশতে,যাতে রক্ত বেশি না বের হয়।আয়ান হাওয়ার বেগে গাড়ি ছেঁড়েছে।

আয়শাকেও গার্ডেরা কিছু করতে পারে না,নোমান তাজবীর এতোক্ষণে ওখানে পৌঁছে যায় সাথে পুলিশও,তবে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরনে আয়েশা জ্ঞান হারায়,পুলিশ মাহি আর গার্ডগুলোকে নিয়ে যায়,আর তাজবীর নোমান আয়েশাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য বের হয়।
___________________

হাসপাতালে সবাই চলে এসেছে এতোক্ষণে, আদৃত সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে আঁখির ব্রেন টিউমারের কথা,
অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হয়েছে আঁখিকে,ওর চিকিৎসা আদৃত করেছে আর ওর সার্জারীও ওকে করতে হবে, আঁখির ব্রেন টিউমার উপর থেকে দুটি আঘাত পর পর মাথায় করা হয়েছে এমতাবস্থায় এমন সার্জারী কেউ করতে চাইছেন না,শহরের বেস্ট সার্জনদের একজন আদৃত,ও ছাড়া এতো ক্রিটিকাল অপারেশন কেউ করতে সমর্থ্য হবে না,এদিকে আদৃত এই প্রথম বার কোনো সার্জারী করতে ভয় পাচ্ছে,আঁখির দিকে তাকিয়ে যথারিতি ওর হাত পা কাঁপছে,কখনো কোনো সার্জারীতে অসফল হয় নি আদৃত,কিন্তু এই প্রথম সার্জারীর নামে ভয় করছে আদৃতের মনে,ওটিতে ঢুকে আঁখির দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

স্যার আমাদের খুব জলদি অপারেশন টা শুরু করতে হবে,কথাটা আরেকজন ডাক্তার বললো।

আদৃতের যেনো ঘোর কাটলো তাতে,ধিমি পায়ে এগিয়ে গেলো আঁখির পানে,ওর মাথায় নিজের কাঁপতে থাকা হাত বুলালো,অশ্রুশিক্ত কন্ঠে বললো।

চিন্তা করবেন না মিস আঁখি,আপনিই আমার সাহস,আমি যখন আপনার বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ৩০-৪০ এর উপর আনতে পেরেছি তবে আপনাকে বাঁচাতেও সক্ষম হবো,কারন ওই উপরওয়ালা শুধু আপনার সাথে না আমার সাথেও আছেন।

আদৃত নিজেকে শক্ত করে সার্জারী করতে শুরু করলো।

আয়েশার গুলি বের করা হয়ে গেছে,ওকে রক্ত দিয়ে রেস্টে রাখা হয়েছে,এদিকে বাইরে বসে সবাই কাঁদছেন,আয়ান এক কোনে বসে অনেকটা শব্দ করেই কাঁদছে,ঠিক সময়ে যদি আঁখির মর্ম বুঝতে পারতো তাহলে আজ হয়তো এমনটা হতো না,বার বার তাকাচ্ছে ওটির দিকে,নিজের ভালোবাসার মানুষটা আজ মৃত্যুর মুখে অথচ কিছু করতে পারছে না আয়ান, খুব অসহায় মনে হচ্ছে ,পারছে মাফ করতে নিজেকে,আঁখিকে যে সর্বক্ষণ কষ্টে দিয়ে এসেছিলো আয়ান,আজ সবকিছু মনে স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে,চোখের সামনে ভাসছে আঁখির সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্তগুলো,মনে মনে শুধু একটা কথাই বলছে,আল্লাহ বাঁচিয়ে দাও ওকে,পারলে ওর পরিবর্তে আমার প্রাণটা নিয়ে নাও,তবুও ওকে বাঁচিয়ে দাও,অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি ওকে,এর প্রশ্চিত্য যে প্রাণ দিয়েও করা যাবে না।

একটা কর্নারের বেঞ্চে বসে তাজবীর কাঁদছে, বোনটা যে ওর প্রাণ প্রিয়,ওর কিছু হয়ে গেলেও তাজবীরের জীবনটাও যে শুণ্য হয়ে যাবে।

বাড়িতে যাবার পর সায়েদা দেখলো তাজবীর ওকে সবকিছুতে ব্লক করে দিয়েছে,এতে অনেক খারাপ লাগা কাজ করতে লাগলো ওর মনে,সাথে অনেক অপরাধ বোধও আছে,আসলে ও তখন বুঝতে পারে নি যে ও কতো বড় অপরাধ করে ফেলছে হয়তো এবার এর জন্য অনেক পস্তাতে হবে ওকে,এমনি এক ব্যাথার্থ অনুভুতি কাজ করছিলো সায়েদার ভিতর তখন জানতে পারলো আঁখির হাল তারপর কাঁদতে কাঁদতে সবার সাথে চলে আসলো,এখনও চোখের জল ফেলছিলো সায়েদা হঠাৎ নজর গেলো তাজবীরের উপর,তাজবীরকে কান্না করতে দেখে সায়েদার খারাপ লাগার পরিমান আরও বেড়ে গেলো,তাই উঠে আসলো ওর পাশে,তাজবীরের ঘাড়ে সহানুভূতির হাত রাখলে তাজবীর পাক ফিরিয়ে তাকালো সায়েদার পানে,ওকে দেখতেই কেমন ঘৃণা কাজ করতে লাগলো তাজবীরের মনে যা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে সায়েদাও আন্দাজ করতে সমর্থ্য হলো,তাজবীর আর ওখানে বসলো না,চট করে উঠে চলে গেলো সেখান থেকে সায়েদাকে একপ্রকার অবহেলা করে,যা সায়েদার মনে ব্যাথার ঝড় সৃষ্টি করলো,চোখের সীমানা পেড়িয়ে অজস্র জল নেমে এলো।

সবাই কান্নায় মগ্ন তখনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেখানে প্রবেশ করলেন আঁখির বাবা,সাথে ওর মা,দাদু আর দিদুভাই,উনাদের চোখে মুখে কান্নার ঝলক স্পষ্ট,ফায়সাল খানের অবস্থা অনেকটা নাজেহাল বুঝাই যাচ্ছে,অস্থির শরীরের অঙ্গভঙ্গি, তেজি গলায় সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।

আমার মেয়ে কোথায়?কি হয়েছে আমার মেয়ের?

তাজবীর ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ওর বাবাকে,তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।তাজবীরই সব বলেছে ওর বাবাকে।

বাবা আমাদের ছুটকি, আমাদের ছুটকি আজ ওই ওটি রুমে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে বাবা,ও আমাদের থেকে সব লুকিয়ে গেছে, একাই লড়ে গেছে বাবা আমাদের ছুটকি,সেদিনই তো কাপড়ে মুড়ে নার্স ওকে আমাদের কোলে তুলে দিয়েছিলেন,কোলে নিয়ে কতো আদরই না করতাম তা বলে কখনো শেষ করতে পারবো না,পিঠে চড়িয়ে ঘোড়া হয়ে পুরো বাড়ি ঘুরতাম,এখনও মনে আছে ছোট ছোট পোকা দেখেও ভয় পেতো,আরশোলা দেখলে তো বিছানা থেকেই নামতো না,কতো বিরক্ত করতো আমায়,যখন অতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে কান মুড়ো দিতাম তখন নাক চেটিয়ে বলতো,ভাইয়া তোকে বুড়ো বউ বিয়ে করাবো,সারাদিন কতো হৈ-হুল্লোড় করতো আমার বোনটা আর আজ ওই অটি রুমে রক্তমাখা অবস্থায় শান্ত হয়ে পড়ে আছে,সামান্য অন্ধকার দেখে ভয় পাওয়া আমাদের ছুটকি মৃত্যু যন্ত্রণার সাথে একাই লড়াই করেছে এতোদিন,কাউকেই কিছু জানতে দেয় নি,কি করে পারলো বাবা ও এসব করতে?কোথা থেকে পারলো এতো সাহস ঝোটাতে?কেনো বললো না আমাদের কিছু কেনো বাবা,কখন এতো বড় হয়ে গেলো আমাদের ছুটকি।

তাজবীরের কথায় সকলের কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেলো,ফায়সাল খান ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কন্ঠে গম্ভীরতা ফুঁটিয়ে বললেন এবার।

আমার মেয়েকে লড়াই করতে শিখিয়েছি আমি,আমার মেয়ে কোনো লড়াইকে কখনো হার মানবে না,আমার আঁখি দূর্বল না,ওই মৃত্যুর সাথে লড়াই করার ক্ষমতা আল্লাহ ওকে দান করবেনই ঈনশাআল্লাহ, তবে ওর সাথে এমন করা লোকগুলোকেও আমি ছাড়বো না।

ফায়সাল খান এবার ছেলেকে ছাড়িয়ে আয়ানের দিকে তেড়ে গিয়ে ওকে মারতে শুরু করলেন,সবাই এসে ফায়সাল খানকে আটকালেন,আয়ান কিছুই বলছে না,শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে,আজকে যে নিজের করা সকল ভুল অক্ষরে অক্ষরে অনুমান করতে সক্ষম আয়ান,তাই হয়তো এর সাজা হিসেবে সবকিছুই মাথা পেতে নেওয়ার সাহসটা ওর মধ্যে চলে এসেছে।ফায়সাল খান গর্জে উঠে বলছেন।

ছাড়বো না আমি তোকে আয়ান,তোর জন্যই আজ আমার মেয়ের এই অবস্থা, তোর জন্য আমি আমার কলিজার টুকরার মুখ তিন বছর দেখি নি,ওকে বলেছিলাম রাস্তার কুড়ো মাথায় তুলিস না শোনে নি আমার কথা যার পরিনামস্বরুপ আজ ওই অটিতে পড়ে আছে ওই ভাবে,আমার মেয়ের কিছু হয়ে গেলে ছাড়বোনা আমি তোকে,জীবন্ত মাটিতে পুঁতে দিবো, ছাড়বোনা তোকে,আর ওই মাহিকেও ছাঁড় দিবো না,ওকেও সব অক্ষরে অক্ষরে শোধ করতে হবে,একদম ছাড়বো না কাউকে।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here