#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্বঃ ৩১ এবং শেষ।
.
পৃথা ক্যাফেতে বসে অন্যমনস্ক হয়ে আছে। একদিন হয়ে গেলো সায়ান ফোন রিসিভ করছে না। গত কয়েকটা দিন দুজনের প্রত্যেকটা সময় একসাথে কেটেছে। একসাথে অফিসে আসা, বসে প্লানিং করা, কেনাকাটা করা, অফিস সাজানো, আর্কিটেক্ট এর সাথে কাজ করা, সবকিছুতেই দুজনে একসাথে কাজ করেছে। রাতে শহরে হাঁটতে গিয়ে বলা হয়ে গেছে কত কাব্য! কখনো বা হাইওয়ের পাশে বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রেমের কথা বলা। ছেলেমানুষি বায়না করা। রাত জেগে ফোনে মৃদুস্বরে কথা বলা। কখনো রাস্তা পার হওয়ার সময় হাতটা ধরে ফেলা। সমস্ত স্মৃতি বুকের ভেতর মুচড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কি গভীর প্রণয় হয়েছে দুজনাতে। বাইরে থেকে কেউ হয়তো বুঝবে না ব্যাপারটা, কিন্তু পৃথা তো জানে সায়ান তার কত আপন। যে মানুষ টা ধীরেধীরে পৃথার একটা অংশ হয়ে উঠেছে। একটা অংশকে বাদ দিয়ে কি চলা সম্ভব?
পৃথা পেরে উঠছে না। সায়ানকে অজস্রবার ফোন দিয়েছে ও। কিছুতেই রিসিভ করছে না। মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে না, অনলাইনে আসছে না। এতটাও অভিমান কেউ করে! পৃথা বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। বাবাকে ওদের বাসায় পাঠালে যদি ওনারা খারাপ কিছু বলে ফেলেন বাবা খুব দুঃখ পাবেন। পৃথা বাবাকে দুঃখ দিতে পারবে না। এই দুঃসাধ্য ওর নেই। তবে কি সায়ানকে এভাবে হারিয়ে ফেলতে হবে?
দুটো দিন কেটে গেলো ভীষণ বিরহে। সারা রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটছে পৃথার। একটুও দু চোখের পাতা এক করতে পারছে না। সায়ানের কণ্ঠটা শোনার জন্য মনটা বড় ব্যকুল হয়ে আছে। একটা নেশা ধরিয়ে দিয়েছে ছেলেটা। ওর কণ্ঠ না শুনে কিছুতেই ভালো লাগে না। কণ্ঠও তবে নেশার কারণ হতে পারে!
রাতে পৃথার রুমে আলো জ্বলতে দেখে বাবা দরজায় নক করে বললেন, কি রে মা? ঘুমাস নাই?
– না আব্বু। ঘুম আসছে না।
পৃথা লুকিয়ে চোখ মুছলো। বাবার কেন যেন মনে হল পৃথা কাঁদছিলো। লুকাতে গিয়েও বাবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলো না। উনি জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি কোনোকিছু নিয়ে টেনশনে আছিস?
– না আব্বু। নতুন বিজনেসে নামলাম তো, সামান্য দুশ্চিন্তা তো হবেই।
– হুম।
পৃথা বিষয়টা লুকালেও বাবার বারবার মনে হতে লাগলো মেয়েটা মানসিক ভাবে কষ্ট পাচ্ছে। উনি বললেন, আমি কি কালকে বাড়ি চলে যাবো?
পৃথার বুকটা ধক করে উঠলো। বাবা চলে গেলে আর কোনোভাবেই সায়ানের সাথে সবকিছু ঠিক হবে না। সায়ান যেভাবে অভিমান করে বসে আছে তাতে যেভাবেই হোক বাবাকে ওর বাসায় পাঠাতে হবে। কিন্তু ভয় করছে পৃথার। কথাটা বলার ইচ্ছে বা সাহস কোনোটাই নেই। ও বলল, আর দুটো দিন থেকে যাও না আব্বু।
– আচ্ছা ঠিক আছে। তুই রাত জাগিস না। তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।
– আব্বু, আমার পাশে এসে একটু বসবে? কতদিন আমাকে বাচ্চাদের মত আদর করো না। আমি কি খুব বড় হয়ে গেছি আব্বু?
বাবা কাছে আসতেই পৃথা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। নিজেকে কোনোভাবেই সংবরণ করতে পারলো না। কান্না থামাতেও পারলো না। সব চাপা যন্ত্রণারা চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো। বাবা এবার বেশ বুঝতে পারলেন মেয়েটার সত্যি কিছু হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে সেটা কিভাবে জিজ্ঞেস করবেন বুঝতে পারলেন না।
বললেন, আমার সাথে শেয়ার কর মা। তোর কি মন খারাপ কিছু নিয়ে?
– না।
– কেউ কিছু বলেছে?
– আমি কি বাচ্চা যে কেউ কিছু বললে কাঁদবো?
– হা হা। বাচ্চা না হলে কি এভাবে আদর করে দিতে বলতি? আমার ছোট্ট মা, তুই এখনো আমার কাছে বাচ্চা। বাবা মায়ের কাছে সন্তানরা সবসময়ই আদরের, সবসময়ই ছোট্ট সোনামণির মতন।
পৃথা বাবাকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। বাবা মেয়ের পাশে অনেক্ষণ বসে রইলেন। মেয়ের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছু সময়। বিধাতা বড় মায়া দিয়ে গড়েছেন মেয়েটাকে। কত দ্রুত বড় হয়ে গেলো যেন! অথচ সেদিন ই ছোটাছুটি করে এসে বায়না ধরে বলত, আব্বু আমার চকলেট আনোনি? না আনলে কান্না শুরু করে দিতো। কোনো বাবাই হয়তো মেয়ের কান্না সহ্য করতে পারেন না। সেটা তুচ্ছ কারণে হলেও। আজ নিশ্চয় মেয়েটার বড় কোনো কারণে কষ্ট হচ্ছে। বাবা কি করে সইবেন?
নিরবে উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন তিনি। কিন্তু ঘুমাতে পারলেন না। সায়ানের কথা মনে পড়ছে ওনার। উদ্বোধনের দিন সায়ান এসেছিলো। তার আগে পৃথার সাথে ওর কেমন ওঠাবসা ছিল বাবা তা জানেন না। কাজেই বলতে পারছেন না ওদের মাঝে কোনো ঝামেলা হয়েছে কি না। এটা বোঝার কি কোনো উপায় আছে? ভাবতে ভাবতে রাত প্রায় শেষ হতে চললো। তিনি চিন্তিত মুখে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। হঠাৎ একটা দৃশ্যে ওনার চোখ আটকে গেলো। উনি অবাক হয়ে দেখলেন রাস্তায় সায়ান দাঁড়িয়ে পৃথার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। একহাতে কপাল এমনভাবে ঘষছে যে ওকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে গেলো বাবার। এত রাতে সায়ান কেন এসেছে! প্রায় ভোর হতে চললো। পৃথা তো জানেও না বোধহয় সায়ান এসেছে। ও তো ঘুমাচ্ছে। নাকি পৃথা ইচ্ছে করেই সায়ানকে বাইরে দাড় করিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে? রহস্য যাই হোক না কেন ,বাবা এটুকু নিশ্চিত হলেন যে ঝামেলাটা সায়ানের সাথেই হয়েছে।
উনি চাইলে নেমে গিয়ে সায়ানের সাথে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু গেলেন না। ছেলেটা ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাবে। এই বয়সের একটা যুবকের মনে এখন ভীষণ তোলপাড় চলে, খুব পাগলামি থাকে। পাগলামিটা গুরুজনের কাছে ধরা পড়ে গেলে ওরা লজ্জা পায়। বাবা সায়ানকে সেই লজ্জায় ফেলে দিতে চাইলেন না। আগামীকাল একটা কিছু করা যাবে।
.
পরেরদিন নাস্তার টেবিলে বাবা পৃথাকে বললো, সায়ানকে শপে আসতে বল। ওর সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই।
চমকে উঠলো পৃথা। বাবা কি সব বুঝে ফেলেছে! ও বিস্মিত চোখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মাথা নিচু করে ফেললো। মাথা দুলিয়ে বলল, আচ্ছা।
বিকেল পর্যন্ত বাবা অপেক্ষা করলেন কিন্তু সায়ান এলো না। এখন বিষয়টা আরো জটিল মনে হচ্ছে। সায়ানের সাথে আদৌ কথা হয় তো? নাকি পৃথার সাথে ঝগড়ার কারণে কথাই বন্ধ হয়ে গেছে? এটা বোঝার জন্য অবশ্যই পৃথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। উনি পৃথাকেও লজ্জায় ফেলতে চান না।
পৃথার কাছে এসে বললেন, মা রে। রাত বিরাতে ছেলেটাকে রাস্তায় দাড় করিয়ে রাখিস না। তোর খালা খালু অনেক ফ্রি। প্রয়োজন হলে ওকে বাসায় ডেকে এনে দুটো কথা বলে বিদায় করে দিবি। অত রাতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে খারাপ বলবে না?
পৃথা চমকে উঠে তাকালো। বিস্ফোরিত হলো ওর চোখ। মানে কি! বাবা আসার পরেরদিন ই তো সায়ানের সাথে ঝগড়া হলো। তারমানে ও ঝগড়া হবার পরেও রাতে বাসার নিচে এসেছিলো! এত অভিমান করার পরও না এসে থাকতে পারে নি। হয়তো এক পলক দেখার জন্য ছুটে এসেছে। পারছে না মুখে বলতে, পারছে না অভিমান ভাংতে। আবার পারছে না, না দেখে থাকতে। সায়ানের প্রতি ভালোবাসায় ভরে গেলো পৃথার বুক। এত আনন্দ হতে লাগলো যে ইচ্ছে করলো ছুটে ওর কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, আমায় এত ভালোবাসো কেন? অভিমান করার পরও কেউ বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকে নাকি পাগল? তুমি আসলেই একটা পাগল।
বাবা বললেন , সায়ান এলো না যে? ব্যস্ত বোধহয়?
পৃথা ইতস্তত করতে লাগলো। ওর মুখের ভঙ্গি দেখেই বাবা বুঝতে পারলেন সায়ানের সাথে হয়তো কথা হয়নি। উনি মেয়েকে বিব্রত না করে বললেন ,ওর নাম্বারটা আমাকে দে। আমি ওর সময়মত ওর সাথে যোগাযোগ করে নেবো।
পৃথার চোখ দুটো এবার আরো বিস্ফোরিত হলো। বেশিক্ষণ বাবার দিকে চেয়ে থাকতে পারলো না। বাবার হাসিমুখের সামনে ওর তাকিয়ে থাকতে লজ্জা করছিল। তারপরও বলল, আব্বু। সায়ানের সাথে এখন কথা বলার দরকার নেই।
– রাগ করে বলছিস?
– না। আমি জানি দেখা হলে ও কি বলবে। কিন্তু আমি সেটা করতে দিতে পারি না আব্বু। প্লিজ এ ব্যাপারে কিছু জানতে চেও না।
– তুই নাম্বার দিবি?
– না আব্বু। প্লিজ। ও তোমাকে যেটা বলবে আমি সেটা করতে দিবো না। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব কষ্ট পাবো। প্লিজ আব্বু প্লিজ।
– কষ্ট তো এখনও পাচ্ছিস।
পৃথা বাবাকে জাপটে ধরে চুপ করে রইলো। বাবা আর কোনো প্রশ্ন করলেন না।
.
রাতে পৃথা বারবার জানালার পাশে উঁকি দিতে লাগল। অকারণে বেলকুনিতে এসে দাঁড়াল। দেখতে চাইলো সায়ান আজও আসে কি না। এক পলকের দেখা তো হবে। কিন্তু না, অনেক রাত হয়ে গেলো তবুও সায়ান এলো না। আশাহত হয়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়লো পৃথা।
পরেরদিন দুপুরের পরপর সায়ান হঠাৎ ক্যাফেতে এসে হাজির। হাস্যোজ্জ্বল মুখ। ছুটে এসে সবার সামনেই পৃথার হাত ধরে ফেললো। বললো, আমি জানতাম তুমি এটা পারবে। অসংখ্য কৃতজ্ঞতা আমার কলিজা।
পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলল, বুঝলাম না।
– তোমার বাবাকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে তুমি প্রমাণ করে দিয়েছো সত্যিই আমাকেই চাও।
– মানে কি!
ছোটখাটো স্বরে আৎকে উঠলো পৃথা। কাছে এসে বলল, বাবা কখন গেছে?
– আজকে এগারো টার দিকে।
– কি হয়েছে খুলে বলো?
– আমার আব্বু আম্মুকে রীতিমতো পটিয়ে ফেলেছে। আমি সামনে যাইনি। পাশের রুম থেকে ওদের হাসাহাসির শব্দ কানে আসছিলো। দুপুরে একসাথে খেয়েছি আমরা। উনি আমাকে বললেন, যেন সবসময় তোমাকে আগলে রাখি। যেন কখনো কষ্ট না দেই। আমি ওনাকে কথা দিয়েছি কক্ষনো কষ্ট দেবো না। কলিজায় আদরে রাখবো।
পৃথা কি বলবে বুঝতে পারলো না। সবকিছু তাহলে ঠিকঠাক হয়ে গেছে! কিন্তু.. কিন্তু…
সায়ান বলল, তুমি খুশি হও নি? আচ্ছা কবে তোমাকে আংটি পরাতে আসবো বলো? উফফ বিয়েটা আজকেই করে ফেলতে পারতাম যদি। আর তো তর সইছে না।
পৃথা ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলবে বুঝতেই পারছে না।
সায়ান বললো, আমরা কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করবো না প্লিজ। অপেক্ষা অনেক কষ্টের।
– তুমি বাবাকে বলেছিলে তোমাদের বাসায় যেতে?
– কি আজব! আমি কেন বলবো? গত তিনদিন তো আমি বাসা থেকেই বের হইনি। ফোনটাও হাতে নেইনি।
– তারমানে আব্বু নিজে থেকেই এভাবে…
পৃথা এত বেশি আশ্চর্য হয়ে গেছে যে বিশ্বাসই করতে পারলো না। ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। বাবা এত ভালো কেন! সায়ান পৃথার পায়ের কাছে বসে বললো, জানো কাল রাতে তোমাকে না দেখে একেবারে ই ঘুমাতে পারছিলাম না। ইচ্ছে করছিল মরে যাই। না দেখে থাকা দায় হয়ে যাচ্ছিল। তাই ছুটে এসে প্রায় দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে রইলাম বাসার সামনে। একবার বেলকুনিতে এলেও না। অথচ তোমার রুমে লাইট জ্বলছিলো।
পৃথা কিছুই বললো না। বাবা এখান থেকেই সবকিছু বুঝে নিয়েছেন। সত্যিই বাবা এত বেশি বুদ্ধিমান যে কিভাবে যেন সবকিছু বুঝে নিয়ে আবার সামলেও নিলেন। সায়ানকে পেয়ে যাওয়ার পুরো ক্রেডিট টাই ওনার।
সায়ান বলল হাসবে না একবার? সমস্ত অপেক্ষা অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বৃষ্টি নেমেছে।
তবুও পৃথার কপাল থেকে চিন্তার ভাঁজ দূর হলো না।
.
বাসায় ফিরে বাবার ঘরে এসে পৃথা দেখে উনি ঘুমাচ্ছেন। ও কাছে এসে আব্বুর পা ছুঁয়ে দিলো। এত কান্না আসছিল!
বাবা চমকে উঠে বললেন, কি রে মা তুই!
পৃথার চোখ ভিজে উঠলো, আব্বু। তুমি কিভাবে এতকিছু বুঝে গেলে! আমি খুব ভাগ্যবতী যে তোমার মত আব্বু পেয়েছি।
– পাগলী। তবে তুই আসলেই ভাগ্যবতী। সায়ান খুব ভালো ছেলে রে মা। বাইরে থেকে দেখে কাউকে আসলে জাজ করা যায় না। ছেলেরা সবকিছু প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু ওদের ভেতরটা বড় নরম। কি যে ভালোবাসবে ও তোকে!
– আব্বু। তুমি এত ভালো কেন বলোতো?
– কারণ আমি তোর আব্বু। তুই যে আমার সবচেয়ে ভালো মেয়েটা। বাবাকে কষ্ট দিতে চাস না বলে কিছুই জানাস নি।
– হুম। তুমি তবুও সব বুঝে গেছো।
– তোর কান্না আমি সহ্য করতে পারি না মা। ছোটবেলায় চকলেটের জন্য কাঁদলেই ছুটে বাজারে নিয়ে যেতাম। আর এখন কাঁদলে কিভাবে সহ্য করবো বল?
পৃথার সত্যিই এখন কান্না আসছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ও নিরবে অশ্রুপাত করতে লাগলো। অশ্রু সবসময় কষ্টের হয় না। বাবা মেয়ের চোখে আজ যে অশ্রু, তা কেবল আনন্দের, পরম আনন্দ।
সমাপ্তি ঘটলো বৃষ্টির অপেক্ষার। সবাইকে অনেক অপেক্ষা করিয়েছি, অনেকেই ফেসবুকে এসে বারবার নিরবে খুঁজে গেছেন অবশেষে বৃষ্টি এলো কি?
আবার কেউ মন্তব্য করে জবাবের অপেক্ষায় ছিলেন।
সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
পরিশেষে অনুরোধ যতজন পাঠক/পাঠিকা গল্পটি পড়েছেন সবাই ছোট্ট একটি মন্তব্য করে যাবেন। তাহলে অন্তত বুঝতে পারবো আমার গল্পের কতজন পাঠক (শুভাকাঙ্ক্ষী) ছিলেন।
ধন্যবাদ গল্পটি ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য। পৃথিবী সহ আমরা সবাই সুস্থ থাকলে আবার নতুন কোনো গল্পে কথা হবে। গল্পের ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
#নীলাভ্র_নেহাল
#অবশেষে_বৃষ্টি
স্পেশাল পর্ব
#নীলাভ্র_নেহাল
বাসর ঘরে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দিয়ে সায়ান বিছানার দিকে তাকালো। চমৎকার সাজিয়েছে ঘরটা। সব ই করেছে বন্ধুবান্ধব রা। সায়ান ঘরটা আগে দেখেও নি। ওরা বলেছে শূন্য ঘর দেখে লাভ কি? ফুলশয্যার খাটে বউ বসে আছে, এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর হবে না। একবার বাসর ঘরেই সব দেখিস। বলেই সে কি হাসাহাসি সবার। অবশেষে সেই প্রতিক্ষীত মুহুর্তটা এসেছে।
বাবা মা পৃথার উপর ভীষণ সন্তুষ্ট। কারণ পৃথা যে আশ্চর্যজনক কাজটা করেছে তা সাধারণত কেউ করে না। বিয়ের সমস্ত কেনাকাটার দায়িত্ব ও সায়ানের বাবা মায়ের উপর ছেড়ে দিয়েছিল। নিজে শাড়িটাও পছন্দ করে কেনার কথা মুখে বলেনি। শাশুড়ীকে বলেছে, আপনার পছন্দই আমার পছন্দ। শুধু কি তাই, বিয়ের কেনাকাটা দেখে ওর চোখেমুখে আনন্দের ঝলকানি দেখে যেকোনো শাশুড়ীর মন গর্বে ভরে ওঠার কথা। বেশিরভাগ মেয়েরই তো বিয়ের শাড়ি পছন্দ হয় না, মেক আপ পছন্দ হয় না, গয়না তো নয়ই। আবার এখনকার সময়ে সবাই নিজে উপস্থিত থেকে কেনাকাটা করতে পছন্দ করে। সেদিক থেকে পৃথা সম্পূর্ণ আলাদা। মেয়ে হলে তো এরকমই হওয়া উচিৎ। এই একটা ঘটনাই বড়সড় প্রভাব ফেলেছে ওনার মনে।
সায়ানের বাবা মায়ের সাথে বেশ জমে উঠেছে ওনাদের সম্পর্কটা। পুরো ক্রেডিট টাই অবশ্য পৃথার বাবার। প্রথমদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেই উনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলেছিলেন, আমার ভাই। কেমন আছেন? কতদিন পর আবার দেখা।
উনি সায়ানের বাবাকে এমনভাবে আলিঙ্গন করলেন যে সায়ানের বাবা আর রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। এমন একজন দিলখোলা মানুষের সাথে কথা না বলে তো থাকা যায় না। ব্যস, এখান থেকেই শুরু। এখন দুই বেয়াইতে গভীর সম্পর্ক অনেকটা বেস্ট ফ্রেন্ডের মত। যখন বিয়েবাড়িতে সবাই নাচ গানে মেতেছিল, তখন ওনারা একদিকে বসে শুধু আড্ডাই দিচ্ছিলেন।
সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অবশেষে সেই কাঙ্খিত মুহুর্ত এসেছে। বাসর ঘরে পা রাখতে গিয়ে সায়ানের বুক ধুকপুক করছিলো। হৃদপিন্ড ধড়াক করে উঠলো।
যতই বিছানার কাছে এগোচ্ছিল, ততই হার্টবিট বাড়ছিল। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। পৃথা একটু নড়েচড়ে বসলো। লম্বা ঘোমটা টানা ওর মাথায়। চুপটি করে বসে আছে। এখন মনে হচ্ছে সত্যিই এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর হয় না।
এত আপন, এত প্রিয় মানুষটা বেনারসি শাড়ি আর গহনায় নিজেকে সাজিয়ে আবার আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। হাতে পরেছে টকটকে লাল মেহেদি। লাল ঘোমটার আড়ালে ওই প্রিয় মুখখানি দেখার জন্য খুব অস্থিরতা কাজ করছে। কখন দেখবো, কখন মুখটা দুহাতে তুলে ধরে চোখে চোখ রাখবো। এই অপেক্ষা টাও মধুর।
সায়ান বিছানার কাছে এসে দাঁড়ানোমাত্র পৃথার হৃদস্পন্দন আরো বেড়ে গেলো। সায়ান গলা খাকাড়ি দিয়ে বিছানায় বসলো। পৃথা আরেকটু নড়েচড়ে বসল। রীতিমতো কাঁপছে ও। সায়ান ধীরেধীরে প্রথমে ঘোমটাটা তুললো, প্রথমে অল্প একটু, তারপর আরেকটু বেশি। ধীরেধীরে সেই চেনা মুখটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। চক্ষুলজ্জার কারণে ভালো করে দেখাই হয়নি। বউয়ের সাজে কেমন লাগছে সেটা মন ভরে দেখতে হবে তো!
পুরো ঘোমটা সরানোর পর পৃথার হার্টবিট এত বেশি বেড়ে গেলো যে, ও কেঁপে উঠলো। সায়ান কাছে এসে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকালো ওর দিকে। যেন আজীবন এই বিশুদ্ধ মুখটাই হৃদয়ে গাঁথা হয়ে থাকে। আর কখনো যেন অন্য কারো মুখের পানে তাকাতে না হয়। এই একটা বিশুদ্ধ মুখই যথেষ্ট আজীবন ধরে ভালোবাসার জন্য।
সায়ান প্রথমে পৃথার হাত ধরলো। হাতটা তুলে আলতো করে একটা চুম্বন করলো হাতের পিঠে। পৃথা চোখ তুলে তাকালো। ভয়ভয় চাহনি। সায়ান পৃথার চোখে চোখ রেখে বললো, আজকের মত এতটা সুন্দর তোমাকে কখনোই লাগে নি। কারণ কি জানো?
– বউ সেজেছি বলে?
– না।
– তাহলে? আমি সাজগোজ করেছি তাই?
– না।
– তো?
সায়ান পৃথার চিবুকে হাত রেখে বলল, কারণ আজকে তুমি আমার বউ হয়ে গেছো। একান্তই আমার। তাই আজকে তোমাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে। আমার বউ, আমার স্ত্রী, আমার অর্ধাঙ্গিনী আমার জীবন সঙ্গী।
পৃথা সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে সেই সুখটুকু অনুভব করলো। জড়িয়ে ধরলো সায়ানকে। আজকের রাতটা ধীরেধীরে স্বর্গীয় হতে শুরু করেছে।
সায়ান বললো, তুমি আমাকে ফিল করছো তো? পৃথা, কেবল কি আমিই তোমাকে ভালোবেসে এসেছি? তুমি তো কখনো বলোনি আমাকে ভালোবাসো।
পৃথা লাজুক হেসে বললো, ভালোবাসলে কি বলতে হয়? এটা তো অনুভবের বিষয়।
– তুমি আমায় অনুভব করো তো?
– না করলে কি মিছেমিছি আপনার বউ হয়েছি?
– হয়তো হয়েছো। বিয়েটা তো তুমি করতেও চাওনি।
– আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো তো এই চোখে ভালোবাসা দেখতে পাও কি না? এ চোখে ভালোবাসা না দেখলে তো তোমার জীবনটাই মরুভূমি।
– তাই?
– হুম। বোঝোনা কিসের টানে আমি সেই গ্রাম থেকে তোমার জন্য ছুটে আসতে পারি?
সায়ান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। পৃথা বললো, আমি সেদিন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার কেমন কষ্ট হয়েছিল ওই সময়টাতে? কেন জিজ্ঞেস করেছিলাম জানো? কারণ ওই ফিলিংস টা আমি টের পেয়েছি। আমি ফিল করেছি, বুঝেছি। যখন গ্রামে গিয়ে কোনোভাবেই তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না, জানিও না তোমার কি হলো। বিয়ের কথা বলামাত্র হুট করে উধাও হয়ে গিয়েছিলে। ভেবেছিলাম আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাও না। তখন বুঝেছি কি পরিমাণ কষ্ট হয়েছে তোমার। যখন তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম, কিভাবে সহ্য করেছো? সেই একই অনুভূতি আমিও অনুভব করেছি। আর সবচেয়ে বড় সত্যিটা কি জানো? আমি তোমাকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতেও পারছিলাম না। প্রতিটা মুহুর্ত তোমার কন্ঠ শোনার জন্য ব্যকুল হয়ে থাকতাম। কি যে ভয়াবহ যন্ত্রণা হতো আমার। কাউকে বলতে পারতাম না, কাউকে আসলে এই ফিলিংসটা বোঝানো সম্ভব না।
সায়ান পৃথার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি বুঝি গো। আমি তোমাকে বুঝি। তোমাকে ছাড়া অন্য কারো কথা আমি ও ভাবতে পারতাম না। আমরা দুজন দুজনের জন্যই সৃষ্টি হয়েছি।
– সত্যিই, হা হা হা। ব্যাপারটা সিনেম্যাটিক হয়ে গেলো না?
উচ্চ শব্দে হাসতে লাগলো পৃথা। হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলো পুরো ঘর। সায়ান আচমকা পৃথার মুখ ধরে ওর ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটের ভেতর নিয়ে নিলো। হাসি থেমে গেলো পৃথার। সায়ানের নরম ঠোঁটের ভেতর ডুবে গেলো পৃথার ঠোঁট। গভীর আবেশে চুম্বন করতে লাগলো দুজনে। নিচের ঠোঁট টা সায়ান এমনভাবে কামড়াতে লাগলো যে পৃথা পা ছোঁড়াছুড়ি শুরু করে দিলো। সায়ানের পিঠ খামচে ধরলো ও। সায়ান শাড়ির ভেতর দিয়ে পৃথার কোমরে হাত দিয়ে জোরে চাপ দিয়ে ওকে আরো উত্তেজিত করে তুললো। তারপর ছেড়ে দিলো ঠোঁট। সায়ান পৃথাকে বললো, কি পেয়েছো তোমার সিগারেট ফ্লেভার চুমুর স্বাদ? নাকি আরো লাগবে। পৃথা লজ্জা ভুলে গিয়ে বললো এক চুমুতে কি সব ফ্লেভার শেষ হয়।
পৃথা চোখ খুলতে পারছিল না। লজ্জায়, আবেগে চোখ বুজে রইলো ও। সায়ান পৃথাকে আরেকবার ভালো করে দেখে নিয়ে ওর হাতটা তুলে নিলো। একটা একটা করে খুলে দিতে লাগল হাতের চুড়ি। এক হাতের চুড়ি খোলার পর আরেক হাতের চুড়ি খুলে দিলো। পৃথা চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। এরপর একটা একটা করে গলার গয়নাগুলো খোলা শুরু করলো সায়ান।
সবগুলো গয়না খোলা হয়ে গেলে পৃথাকে নিয়ে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়লো। পৃথা চোখ বন্ধ করে আবার খুলে ফেললো চোখ। সায়ান ফিসফিস করে বলল, আই লাভ ইউ পৃথা।
পৃথা সায়ানের গলা ধরে ওকে নিজের উপর টেনে নিতে নিতে শুয়ে পড়লো। তারপর ভালোবাসার অন্য এক রাজ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করলো দুজনে। যেখানে আছে এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি।
সায়ানের নিশ্বাসের শব্দে পৃথা কাঁপতে কাঁপতে বললো, ভালোবাসি। বড্ড বেশি ভালোবাসি তোমাকে সায়ান..
একটা নিস্তব্ধ রাত্রি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। সুখের সমুদ্রে অবগাহন করতে করতে দুজনে অনুভব করছিলো, ভালোবাসায় আছে সুখ। এক অনবদ্য সুখ, যা আর কোথাও নেই। এই সুখ যেন আজীবন এভাবেই ঘিরে রাখে। ?❤️??