#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ২৭
#নীলাভ্র_নেহাল
.
সায়ান পৃথার অপেক্ষায় না খেয়ে বসে আছে। শরীর মোটামুটি সুস্থ। আজকে মনটাও ভীষণ ফুরফুরে ।সায়ান ঠিক করে রেখেছে আজ পৃথা আসলেই মায়ের সাথে বসিয়ে দুজনের মধ্যে যেভাবেই হোক একটা সন্ধি করিয়ে দেবে। একই রুমে দুজনেই অনেক্ষণ বসে থাকে তবুও কেউ কারো সাথে কথা বলে না। পৃথা মাঝেমাঝে দু একটা কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কোনো লাভ হয় নি। মা কোনো উত্তর ই দেন নি। উনি পৃথাকে বেশ অপছন্দ করেন সেটা ওনার আচরণেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারপরও সায়ান চেষ্টা করে দেখতে যায়। পৃথার সামনেই ও মাকে বলবে, ‘মা তুমি ওর সাথে কথা বলো না কেন? ও কে কি তোমার খুব বেশি খারাপ লাগে মা? এমন একটা মেয়েকে কি করে আদর না করে থাকতে পারো তুমি? তুমি না মা? মা কি কখনো মেয়েকে দূরে রাখতে পারে?’
কিন্তু ভাবনা সেটা ভাবনার জায়গাতেই রয়ে গেলো। বেলা বয়ে যাচ্ছে এখনো পৃথার আসার নামগন্ধ নেই। একবার ফোন করে ওর খোঁজ নেবে সেই সুযোগ ও নেই। প্রথমত মোবাইল ফোন নেই, দ্বিতীয়ত পৃথার নাম্বারও নেই। বসে বসে শুধুই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। সায়ান বেডে বসে আছে। মাটিতে পা ফেলতে পারবে না এখন। নয়তো জানালার পাশে গিয়ে একবার উঁকি দিতো। অনেক সময় পার হয়েছে, পৃথার তো এত দেরি করার কথা নয়। এবার তো মন খারাপ হতে শুরু করেছে। অপেক্ষা না করলে একটা কথা ছিলো। যখন কারো জন্য খুব করে অপেক্ষা করা হয় আর তাকে পাওয়া না যায়, তাহলে সত্যিই কষ্ট হয়। মনকে তো আর সবসময় নিয়ন্ত্রণ করে রাখা যায় না।
সায়ান অস্থির হতে শুরু করেছে। মা সায়ানকে দেখে বুঝতে পারলেন ছেলে কেন এমন করছে। ওনার মন এতে এতটুকুও গললো না। আর যাই হোক ওই মেয়ের বিষয়ে এক বিন্দু ভাবার ইচ্ছেও ওনার নেই। সায়ানকে কিভাবে বোঝাবেন সেটা নিয়েই চিন্তিত উনি।
সায়ান বলল, মা আমরা কবে বাড়ি যাবো? আমি তো সুস্থ হয়ে গেছি। তাহলে আর হসপিটালে পড়ে থাকা কেন?
– তুই বেশি বুঝিস নাকি? ডাক্তার বলেছে আরো দুদিন থাকতে হবে।
– মা, ওরা তো বলবেই। একটু জেদ করলেই বাসায় যেতে দেবে।
– কেন জেদ করবো?
– আমার এখানে একদমই ভালো লাগছে না। এর আগে কখনো হাসপাতালে আসিনি আমি। খুব বোর লাগছে।
– লাগুক। ডাক্তার যা বলবে তাই করবো আমরা। তুই কেন বুঝছিস না তোর ভয়াবহ বিপদ হতে পারতো। সবসময় ছেলেমানুষি ভালো না সায়ান।
– আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। তারপরও আমাকে তুমি বাচ্চা বলতে পারো না। এখানে কোনো ছেলেমানুষী আমি করছি না। আমি ভেবেচিন্তে পৃথার সাথে সারাজীবন থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরা এটাকে মানতে চাও না কেন?
– ও একটা মেয়ে হলো? এর চেয়ে ভালো মেয়ে দিয়ে তোকে বিয়ে দেবো।
– আমার পৃথাকেই চাই। আমার জন্য ওর চেয়ে ভালো কেউ হবে না। তুমি না জেনে ওকে নিয়ে কথা বোলো না তো মা।
– একটা অচেনা মেয়ের সাথে দু দিনের পরিচয়ে মা পর হয়ে গেলো?
মায়ের কণ্ঠটা কাঁদোকাঁদো শোনালো। সায়ান পড়লো মহাবিপদে। এবার শুরু হলো মাকে সান্ত্বনা দেয়া। যা প্লান করে রেখেছিল সব ভেস্তে গেলো। পৃথাও এলো না। এদিকে মা কাঁদছেন। সায়ান বসে বসে মাকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বোঝাতে লাগলো। পৃথার বিষয়টা আপাতত এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না।
বিকেল পেরিয়ে গেলো। এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে অর্পা দাঁড়িয়ে বলল, আসবো?
সায়ানের মা উঠে গিয়ে অর্পাকে ভেতরে নিয়ে এলেন। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস মা?
– জ্বি আন্টি ভালো আছি। সায়ান এখন কেমন আছে? আমি আজকেই শুনলাম ও এক্সিডেন্ট করেছে। শোনার পর আর থাকতে পারিনি। ছুটে এলাম। যদিও সায়ান এখন আমাকে সহ্য করতে পারে না।
গত চার বছরে অর্পা অনেক ভাবেই সায়ানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সায়ান অর্পাকে পাত্তা দেয় নি। শেষমেষ বাধ্য হয়ে অর্পা বন্ধু হয়ে থাকার আবদার জানিয়েছিল। সায়ান বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু কখনো নিজে থেকে খোঁজ খবরও নেয়নি। অর্পা ই মাঝেমাঝে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতো কেমন আছিস? সায়ান দায়সারা কথাবার্তা বলে রেখে দিতো। তবে মায়ের সাথে অর্পার সম্পর্কটা আম আর আমের আঁটির মতন। মাকে ওকে মেয়ের মত দেখেন। নিজেই অর্পার বাসায় বেড়াতে গিয়ে ওর মায়ের সাথে গল্প গুজব করে আসেন। আবার অর্পাকেও জোর করে বাসায় নিয়ে আসেন। তিনি জানেনও না সায়ানের সাথে দীর্ঘ এতগুলো দিন অর্পার সম্পর্ক ভালো নেই।
মা বললেন, এভাবে বলছিস কেন? বোস মা। সায়ান আগের চেয়ে ভালো আছে। কাল পরশুর মধ্যেই বাড়ি চলে যাবো আমরা।
অর্পা সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, শরীর কেমন লাগছে এখন?
সায়ান শুকনো মুখে উত্তর দিলো, ভালো।
– কিভাবে হলো এমন?
সায়ান কোনো উত্তর দিলো না। অর্পা উত্তরের আশায় না থেকে হাতের প্যাকেট টা রেখে বলল, আমি কিছু ফ্রুটস এনেছি। ওকে খাইয়ে দিয়েন আন্টি। আপনার শরীর কেমন এখন?
– আমার আর শরীর। দিন রাত হাসপাতালে। এক ফোঁটা ঘুম নেই চোখে। সাইমু (সায়ানের বোন) আজ আসার কথা। ও এলে আমি বাসায় যাবো।
সায়ান বললো, আমি তো বলছি এভাবে কষ্ট করে হাসপাতালে থাকার দরকার নেই। আমি মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছি। বাসায় চলো। শুনছো না আমার কথা।
অর্পা বললো, আন্টি যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি?
– বল মা।
– আপনি অনেক ক্লান্ত। আপনি বরং বাসায় চলে যান। আমি এখানে থাকি। সায়ানের দিকে খেয়াল রাখবো। আর ওষুধও ঠিকমতো খাওয়াবো।
সায়ান বললো, না না। তোকে কষ্ট করে থাকতে হবে না।
– প্লিজ সায়ান। তোকে আমি যে কষ্ট দিয়েছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত। আমাকে তোর সেবা করার সুযোগটুকু দিয়ে অনুশোচনা করতে দে প্লিজ।
– লাগবে না। তোর ওপর আমার কোনো রাগ নেই।
– সায়ান, আমার উপর এখনো রেগে আছিস আমি জানি। আন্টির শরীরটা খারাপ। ওনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। উনি বাসায় চলে যাক। আমি থাকি এখানে। প্রমিস তোকে ডিস্টার্ব করবো না।
মা বললেন, এভাবে কেন বলছিস? বন্ধুদের মাঝে ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি হয়েই থাকে। তাই বলে এত ছোট হতে হবে না। আমি জানিনা কি হয়েছে কিন্তু এত কষ্ট পাস না। আমি তোকে এখানে রেখে যাচ্ছি। ওর দিকে খেয়াল রাখিস।
সায়ান বারবার আপত্তি জানিয়ে বলল, না মা। ওকে থাকতে হবে না।
– আমি একটু বাসায় যাই তুই কি সেটা চাস না?
– চাই। কিন্তু অর্পাকে থাকতে হবে না।
– ও থাকুক। একজনকে তো থাকতেই হবে তোর পাশে।
– লাগবে না মা।
মা কোনো কথা শুনলেন না। উনি প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অর্পা সায়ানের কাছে এসে দাঁড়াল। নরম গলায় বলল, অনেকদিন তো হয়ে গেছে। এখনো রাগ পুষে রেখেছিস?
– নাহ। তোর বয়ফ্রেন্ড এর কি খবর?
– কোন বয়ফ্রেন্ড?
– বারে কতগুলো বয়ফ্রেন্ড পালিস?
– সেটা বলিনি। আমার তো কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিলই না।
– ছিলো না? চশমা ওয়ালা একটা ছেলের সাথে খুব ঘোরাফেরা, ছবি আপলোড দিতে দেখলাম।
– ও.. ও তো আমার ফ্রেন্ড।
– আমার মত ফ্রেন্ড? যাকে কাছে পেলে চুমু খেতে ইচ্ছে করে? বাসায় গিয়ে বিছানায় শুয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে?
– সায়ান প্লিজ। এভাবে বলিস না।
– তো কিভাবে বলবো? তোর কারণে আমার সম্পর্কটাই শেষ হয়ে গেছে। ও আমাকে এতটাই ভুল বুঝেছিল যে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। আমার বাবা মাকেও ফিরিয়ে দিয়েছে। সব তোর জন্য।
– সায়ান, আমি সরি। আমি যা করেছি কেবল তোকে পাওয়ার জন্যই করেছিলাম। শুধুমাত্র পাগলের মত তোকে চাইতাম বলে।
– চাওয়ার একটা ওয়ে থাকতে হয়। কোনো নোংরা চাল চেলে কাউকে চাইতে হয় না।
অর্পা অপমানে মুখ কালো করে চুপ হয়ে গেলো। ইচ্ছে করছে এখান থেকে বেরিয়ে চলে যেতে। কিন্তু আন্টিকে বাসায় পাঠিয়ে এভাবে চলে গেলে উনি কি মনে করবেন? তাই আর কথা না বাড়িয়ে অর্পা চুপচাপ চেয়ারে বসে রইলো।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলো। অর্পা কোনো কথা বলছে না। সায়ানের শরীর খারাপ হতে শুরু করেছে। মনটাও অস্থির। বুক ব্যথা করছে ভীষণ। কিন্তু নিরবে সহ্য করছে। কিছু বললেই অর্পা কাছে এসে ধরার চেষ্টা করবে। সায়ান এটা চায় না। অর্পার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ওকে মুখ বুজে ব্যথা হজম করতে হচ্ছে। কিন্তু মনটা বড় অস্থির। ক্রমশ অস্থিরতা বাড়ছে। পৃথা আজকে কেন এলো না? ও কি কোনো সমস্যায় পড়েছে? কি জানি কি হলো ওর আবার। দুশ্চিন্তাও হচ্ছে পৃথার জন্য।
কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিল সায়ান। ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দর্শন পেলো পৃথার। দেখলো পৃথার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। পৃথা সিল্কি চুল ওর মুখের উপর এসে পড়েছে। সায়ান একহাতে সেই চুল সরিয়ে দিতে যাবে এমন সময় ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে দেখে সাইমু আপু এসেছে।
সায়ান উঠে বসার চেষ্টা করলো। আপু বলল, সরি রে। আসতে দেরি হয়ে গেলো। মা বললো এখানে অর্পা আছে তাই আমিও ভাবলাম দেরি করে যাই।
– আপু, তোর ফোনটা একটু দিবি?
– কেন দেবো না?
আপুর ফোনটা এগিয়ে দিলো সায়ানের দিকে। সায়ান ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো। পৃথার আইডি নাম লিখে সার্চ করে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে দেখলো ওর অনেক গুলো মেসেজ রিকুয়েষ্ট অপশনে জমা পড়ে আছে। আপু সিন করে নি। পৃথা জানতে চেয়েছিল সায়ানের কি হয়েছে। ও সুস্থ আছে কিনা। ওর মেসেজ দেখে সায়ানের কলিজাটা ঠান্ডা হয়ে গেলো।
ও রিপ্লাইয়ে লিখলো, আমি সায়ান বলছি। আপুর কাছে ওর ফোন নিয়ে তোমার আইডিতে ঢুকলাম। তুমি আজ আসো নি কেন গো? জানো না তোমাকে না দেখলে আমার ভালো লাগে না? আমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছি। এর দায় কি তুমি নেবে? আমাকে কষ্ট দিয়ে কি পাও তুমি বলো? আমি রাতে ঘুমাতেও পারবো না। কেন আসো নি? কেন?
মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে সায়ান বেরিয়ে এলো ফেসবুক থেকে। আপুকে বলল, তুই তো আজ রাতে থাকবি তাই না? তোর ফোনটা আমার কাছে থাক। নাকি সমস্যা আছে?
– না না সমস্যা হবে কেন? রাখ তোর কাছে।
সায়ান বারবার ফেসবুকে ঢুকে মেসেজ চেক করতে লাগল। হঠাৎ রিপ্লাই এলো পৃথার- সরি সায়ান। আমার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। বলতেও পারছি না, যেতেও পারছি না আর থাকতেও পারছি না। আমি কি করবো বলে দিন আপনি।
– কেন? কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো?
পৃথা প্রথমে বলতে চায় নি। পরে আর থাকতে না পেরে লিখল, আপনার মা আমাকে নিষেধ করেছেন। যেন আর কখনো না যাই আপনার কাছে।
– ওহ শিট। শোনো এখন মা নেই। বাসায় গেছে। তুমি কাল খুব সকালে চলে এসো প্লিজ।
– আমি এখনই আসছি।
– না না। এখন রাত অনেক। পাগলামি কোরো না প্লিজ।
পৃথা অফলাইনে চলে গেছে। রাত সারে এগারো টা। এত রাতে ও ছুটে আসবে। কি পাগলামি ব্যাপার স্যাপার। কিন্তু এখন ওকে বারণ করলেও ও মেসেজ দেখবে না। এত রাতে একা বের হবে, দেশের যা অবস্থা! আবার কোনো বিপদ না হয়ে যায়। সায়ানের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যেতে লাগলো।
ভালোবাসা তো এমনই। আপনজনকে সবসময় বুকের ভেতর আগলে রাখতে ইচ্ছে করে। তার বিপদের কথা ভাবলেই শরীর শিউরে ওঠে। পৃথা অফলাইনে জেনেও সায়ান বারবার মেসেজ পাঠাতে লাগলো, তুমি কোথায়? প্লিজ আজকে আসার দরকার নাই। আমাকে টেনশন দিও না, এমন পাগলামি কোরো না। একা বের হয়ো না। এরকম অসংখ্য মেসেজ। কিন্তু কোনো মেসেজ ই সিন হলো না।
চলবে..
#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ২৮
#নীলাভ্র_নেহাল
.
পৃথা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। রীতিমতো হাঁফাচ্ছে ও। সায়ান চমকে তাকালো ওর দিকে। এক পলক দেখেই যেন বুকে বৃষ্টির পশলা নেমে এলো। উত্তপ্ত রোদের পর বৃষ্টি যেমন প্রকৃতিকে ঠান্ডা করে দেয়, তেমনি সায়ানের মনটাও শীতল হয়ে গেলো এক পলক পৃথাকে দেখে।
পৃথা একবার সায়ানের বোনের দিকে তাকালো, আরেকবার তাকালো অর্পার দিকে। এত রাতে অর্পাকে এখানে দেখতে পেয়ে ও ভীষণ অবাক হয়েছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ধীরেধীরে সায়ানের কাছে এগিয়ে গেলো। সায়ান শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করছিল। পৃথা ছুটে গিয়ে সায়ানকে ধরে ফেললো।
সায়ান পৃথার চোখের দিকে চেয়ে বলল, জানিস না তোকে না দেখলে আমার কি ভীষণ অস্থির লাগে? তবুও কেন আসিস নি?
– আমার কিছু করার ছিলো না।
– আমি কোনো বাধা মানি না। মানবো না। তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে, আমার পাশে থাকতে হবে ব্যস।
সায়ান বাচ্চাদের মত করছে দেখে অবাক হয়ে সাইমু তাকিয়ে আছে। সেই সাথে অর্পারও চোখ ছানাবড়া। অর্পা জানে সেই ঘটনার পর থেকে ওদের আর যোগাযোগ ই হয় নি। এ আবার কোথ থেকে উড়ে চলে এলো? কি গভীর প্রেম! তাহলে কি ওদের প্রেমটা সবসময় ই ছিলো? মনে প্রশ্ন নিয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলো অর্পা।
সায়ান পৃথাকে পাশে বসিয়ে বললো, আজকে সারা রাত তুমি আমার পাশে বসে আমাকে গল্প শোনাবে। পারবে না?
পৃথা সংকোচ বোধ করছে। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে বললো, হুম শোনাবো।
সায়ান বালিশে হেলান দিয়ে বেডের উপর বসে রইলো। পৃথাকে বসিয়েছে ওর পাশে। পৃথাকে দেখে অর্পার আর ভালো লাগছে না। ও যখন এসেই গেছে, তখন ওদের রঙ্গ দেখার জন্য আর এখানে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। অর্পা বাসার ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসতে বললো। সায়ান ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। জোর করে অর্পাকে এখানে আটকে রাখার ইচ্ছে ওর একেবারেই নেই। তাছাড়া সাইমু আপু যখন আছে তখন অর্পার দরকারও আর হবে না। সায়ান তো বিকেল থেকে এই সুযোগ টাই চাইছিলো।
অর্পা চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেলো, লাইফটাকে হেলায় নষ্ট করিস না। লাইফকে এমন কিছু উপহার দিস লাইফ তোকে যেমনটা দিয়েছে। আবেগের স্রোতে গা ভাসানোর মত সময় বা বয়স কোনোটাই এখন আমাদের নেই।
অর্পার কথাটা কানে বাজছিল পৃথার। কথাটা অর্থবহ। কিন্তু সায়ানকে বলা উচিত হয়নি বলে মনে হচ্ছে। পরোক্ষভাবে পৃথাকেই ইঙ্গিত করছিল কথাগুলো। পৃথা ছোট হবেই বা কেন? নিজেকে অগোছালো করে উপস্থাপন করাটাই তাহলে ভুল হয়ে গেছে। সায়ানের জন্য পাগলের মত ছুটে আসতে গিয়ে নিজের গেট আপ নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না ওর। তাতেই অর্পা এভাবে বলার সুযোগ পেয়ে গেছে। অদ্ভুত মেয়ে! নিজেকেই সবসময় সবার উপরে ভাবে। তবে ভেবে তো লাভ নেই। সায়ান তো কেবল আমারই- মনেমনে এই কথা ভাবছিল পৃথা।
সায়ান ওর বোনকে বলল, আপু। পৃথা থাকলে কি তোর কোনো সমস্যা হবে?
– না না। আমার সমস্যা হবে না। তবে বেড তো একটাই। তোর পাশে একজন শুতে পারবে। আরেকজনকে বসে বসে রাত কাটাতে হবে।
পৃথা বলল, সমস্যা নেই আপু। আমি সারা রাত ওকে গল্প শোনাবো।
– ও কি ঘুমাবে না? সারা রাত তোমার গল্পই শুনবে?
পৃথা চুপ হয়ে গেলো। সায়ান বলল, আপু তুই চিন্তা করিস না। আমরা জেগে থাকবো। কতদিন মন খুলে কারো সাথে কথা বলা হয় না। আজকে মনটা হালকা হয়ে যাবে।
সায়ানের কথা শোনার পরও আপু স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলো না। কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়লো। পৃথা গল্প শুরু করে দিয়েছে। সায়ানের মাথার কাছে বসে একমনে গল্প বলছে ও। কত রকমের কথা! ওর ছোটবেলার গল্প, বড়বেলার গল্প, এই কয়েকটা বছর কিভাবে কেটেছে তার গল্প। সায়ানের বোন ঘুমিয়ে পড়েছে। সায়ান পৃথার আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে আরেকহাতে পৃথাকে ধরে রেখেছে। একসময় বলল, তুমি পা দুটো বিছানায় তুলে আমার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। যতটুকু ঘুম হয় ততটুকুই লাভ।
– আমার ঘুম লাগবে না। আপনি ঘুমান। আমি বরং জেগে থাকি।
– তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি গত কয়েকটা দিন তুমি ঘুমাতে পারোনি। আজকে প্লিজ আমার বুকে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও।
– কি করে বুঝলেন আমি ঘুমাইনি?
– তোমার পরির মত চেহারাটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শুষ্ক মুখ, চোখ দেবে গেছে।
– এতকিছু মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন?
– ভালোবাসি যে তাই।
– সত্যি ভালোবাসেন?
– হুম। বোঝোনা?
– জানিনা। কিচ্ছু জানিনা।
– আরে আসো তো।
সায়ান পৃথাকে জোর করে বিছানায় তুলে নিজের কাঁধের উপর ওর মাথাটা রাখালো। কোনোমত পা দুটো তুলে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল পৃথা। সায়ান ধরে রইলো যাতে ও পরে না যায়।
সায়ানের কাঁধে মাথা রাখলে ও মাথাটা টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরল। পৃথার আচমকা মনে হল এর মত আশ্রয় আর কোথাও নেই। এতটা শান্তিপূর্ণ, এতটা কোমল। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই চোখ ভিজে আসতে শুরু করলো ওর। নিজের অজান্তেই সায়ানকে এতবেশি ভালোবেসে ফেলেছে, এটাও হয়ত কান্নার একটা কারণ।
সায়ান পৃথার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথা বুঝতেই পারেনি।
ঘুম ভাংল যখন তখন ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। সায়ান বালিশে হেলান দিয়ে অর্ধশোয়া অবস্থায় ঘুমাচ্ছে। আর পৃথা ওর বুকে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছিল। কি লজ্জার বিষয়। অসুস্থ মানুষটার সেবা করার কথা ওর, অথচ সে কিনা বুকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। লজ্জায় কি করবে বুঝতে পারলো না পৃথা।
সায়ান ঘুমে মগ্ন। পৃথা আস্তে করে উঠে এসে সায়ানের গায়ে হাত বুলাতে লাগল। চমকে উঠে ঘুম ভেঙে গেলো সায়ানের। ও বলল, কি করছো পাগলী?
সায়ানের কথা শুনে ঘুম ভেঙে গেলো সাইমু আপুরও। সে উঠে দেখলো পৃথা সায়ানের পায়ে, হাতে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পৃথা লজ্জা লজ্জা মুখে মাথা নত করে রইল। আপু বুঝতে পারলো মেয়েটা আসলেই সায়ানকে ভালোবাসে। কিছু না বলে সে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। সায়ান বললো, তুমি ঘুমাচ্ছো না কেন?
– আর লজ্জা দেবেন না তো। বেঘোরে ঘুমিয়েছি।
– ঘুম কেমন হয়েছে?
পৃথার কাছে মনে হল জগতের সবচেয়ে সেরা প্রশ্নটা ও এখন শুনছে। কারণ আজকের মত এত ভালো ঘুম ওর কখনোই হয়নি। কখনো এত আরাম করে ঘুমায়নি, ঘুমিয়ে এতটা তৃপ্তিও পায় নি। ভালোবাসার উষ্ণতায় ওর হৃদয় ছেয়ে গেলো।
সায়ান হাত বাড়িয়ে দিলো। পৃথা ওর আপুর দিকে তাকিয়ে হাত এগিয়ে সায়ানের হাত ধরলো। সায়ান বললো, জানো আমি দিনের বেলা খুব অসুস্থ ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে সুস্থ হয়ে গেছি।
– তাই?
– হুম। তুমি এসেছো বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। থ্যাংক ইউ ডিয়ার। আচ্ছা তুমি রাতে খেয়েছিলে তো?
– না মানে খাইনি।
– সেকি! আমার একবার মনেও হল না। ছিই, কি বোকা আমি। আপু ভাত এনেছিল, আমি সব খেতে পারিনি। অর্ধেক ভাত আছে। প্লিজ খাবার নিয়ে আসো। আমার সামনে খেতে বসো।
– এই রাত্রিবেলায়?
– হ্যাঁ। সমস্যা কোথায়? আমারও ক্ষুধা লেগেছে। তুমিও খাও আর আমাকেও খাওয়াও।
পৃথা হাসিমুখে গিয়ে বাটি থেকে খাবার নিয়ে এলো। সায়ানকে তুলে খাওয়ানোর সময় আপু একবার মাথা তুলে তাকালো। কিছুক্ষণ চোখ মেলে এই দৃশ্য দেখার পর এত ভালো লাগা কাজ করলো যে অভিভূত হয়ে গেলো। নিজের ই অসুস্থ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এমন প্রেম দেখে। যদি বর এসে এভাবে সেবা করতো! তুলে খাইয়ে দিতো!
পৃথা বলল, আপু আপনাকে খাইয়ে দিই একটু?
সাইমু আপু চমকে উঠলো। বলল, না না। আমি খাবো না।
– আরে খান একটু।
– খিদে লেগেছে বটে। আচ্ছা দাও।
আপু হেসে ফেললো। পৃথা কাছে এসে আপুর মুখেও কয়েকবার খাবার তুলে দিলো। মনটা ভীষণ নরম হয়ে গেলো আপুর। পৃথাকেই মনে হতে লাগলো জগতের সবচেয়ে ভালো মেয়ে। কি মিশুক, কি আদুরে! সায়ান একটা সঠিক মেয়েকেই বেছে নিয়েছে।
সায়ান বললো, পৃথা আমি কিন্তু আর খাবো না। যা খেয়েছি সব বমি করে ফেলে দেবো।
– সেকি? কেন?
– তুমি একটুও মাংস খাচ্ছো না। সব আমাকে খাইয়ে দিচ্ছো।
পৃথা লাজুক হাসলো। সাইমু আপু বলল, তুই যে ওরে ছাড়া বাঁচবি না সে আমি বুঝে গেছি।
– হ্যাঁ রে আপু। খালি আব্বু আম্মুই বুঝতেছে না।
– দেখি তোর জন্য কিছু করতে পারি কি না।
সায়ানের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখা গেলো। আপুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো ওর।
.
সকালবেলা মা খাবার নিয়ে হাজির। উনি হয়তো দুশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতেই পারেননি এই ভেবে যে, আবার এই সুযোগে সকালে পৃথা চলে আসে। উনি তাই খুব সকালেই চলে এলেন। কিন্তু যখন দেখলেন পৃথা সায়ানের হাত ধরে বসে আছে তখনই মাথায় রক্ত উঠে গেলো ওনার। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। পৃথার কাছে এসে রেগে বললেন, তোমার বাপ মা তোমাকে ভদ্রতা শেখায়নি? পড়াশোনা করে কি অর্জন করেছো? বেহায়ার মত আবার এসেছো? লজ্জা নেই এতটুকুও?
সায়ান চেঁচিয়ে উঠল, মা। থামো।
কিন্তু পৃথা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। গাল বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো ওর। সায়ান ওঠার চেষ্টা করে পারলো না। ব্যথা পেয়ে বলল, আহ!
মায়ের আগে পৃথাই ছুটে গিয়ে সায়ানকে ধরে ফেললো। তাতেও মেজাজ গরম হলো ওনার। পৃথা সায়ানকে বলল, আপনি বলুন আমি কি করবো? চলে যেতে বললে চলে যাবো। আপনার মা চাইছেন আপনি আপনার জীবন থেকে সরে যাই। আপনিও কি তাই চান? চাইলে আমি আর কক্ষনো আপনার সাথে যোগাযোগ করবো না।
– তুমি জানোনা আমি কি চাই? তুমি আসার পর আমি কতটা সুস্থ হয়ে গেছি খেয়াল করেছো তুমি? আমার জীবনে তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন পৃথা।
– আমি কি করবো এখন বলুন?
সায়ান মাকে বললো, মা। পৃথার সাথে দুদিন মিশে দেখো। ও অনেক ভালো মেয়ে, মা। তোমার খেয়াল রাখবে দেখে নিও।
মা কিছু বললেন না।
পৃথা বললো, আপনার জায়গায় থাকলে আমিও হয়তো রেগে থাকতাম। এটাই স্বাভাবিক। তবে সেদিন আপনাদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না। আসলে তার আগে আমি নিজেকে এমন করে প্রস্তুত করছিলাম যে সবকিছুর আগে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলবো। তাছাড়া সায়ানকে আমি ভুল বুঝেছিলাম। কাজগুলো করেছিলো অর্পা আপু। আমি তার কথাকেই বিশ্বাস করে সায়ানকে ঘৃনা করতে শুরু করি। আপনি ভেবে দেখুন, যাকে অপছন্দ করি তাকে কিভাবে স্বামী হিসেবে মেনে নেবো? আর নিজেকে গড়ে তোলার শপথ করার পর আমি কি করে মাঝপথে থেমে যাবো? আমার জায়গায় থাকলে আপনি কি করতেন? যদি জানতেন ছেলেটা অন্য মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত, তাকে কি বিয়ে করতে চাইতেন? আশাকরি কথাগুলো ভেবে দেখবেন। তারপর আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন, আমি তাই করবো। আজ আসি।
সবাই চুপচাপ। পৃথা ব্যাগ কাঁধে নিতেই সায়ান বলল, পৃথা..
– আপনি প্লিজ আর কিছু বলবেন না। আপনার মাকে বিষয়টা বুঝতে দিন। উনিই বলবেন আমার দোষটা কোথায় ছিল? নিজের যত্ন নেবেন।
পৃথা বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে। চোখে জল। চোখ মুছতে মুছতে কেবলই মনে হতে লাগল, হয়তো এখানেই শেষ নয়ত এখানেই শুরু জানিনা কি হবে! তবে যাই ঘটুক, আমাকে নিজের লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়ালে হবে না। আবারও একটা শিক্ষা পেলাম। মাত্র পড়াশোনা শেষ করেছি। এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াইনি। আমি হাল ছেড়ে দেবো না। সায়ান আমার ভাগ্যে থাকুক বা না থাকুক, সেই সময়ে শুরু করা যুদ্ধটা আমি মাঝপথে থামিয়ে দেবো না। আমি পারবো, অবশ্যই পারবো।
চলবে..