#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ১৫
#নীলাভ্র_নেহাল
.
পৃথা শান্ত হয়ে ঘরে বসে আছে। বাবা অনেক্ষণ ধরে কথা শোনালেন পৃথাকে। বিয়ের মতামত না থাকলে আগেই সেটা বলে দিলে হতো। তাহলে এভাবে গ্রাম থেকে শহরে এসে তাদেরকে হয়রানি হতে হতো না। তারচেয়েও বড় কথা সায়ানের বাবা মা অনেক মন খারাপ করে চলে গেছেন। এভাবে অপমান করাটা একদমই পৃথার উচিৎ হয়নি।
পৃথা সব শুনে একটা কথাই বলল, ‘আব্বু, আমি সায়ানের যোগ্য নই। সায়ান আমার চেয়েও দেখতে ভালো, টাকাওয়ালা, ভালো ফ্যামিলির চেয়ে। আজ বিয়ে হলে দুদিন পর সে নিজেও আমার যোগ্যতা নিয়ে কথা তুলতে পারে। আমি এ সুযোগ কাউকে দিতে চাই না। আগে নিজেকে ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, যাতে কেউ আমাকে নিয়ে টু শব্দ ও উচ্চারণ করে আমাকে কথা শোনাতে না পারে।’
পৃথার কথা শুনে বাবা আর কিছু বললেন না। বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। মা বললেন, তুই যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস নিশ্চয়ই বুঝে শুনেই নিয়েছিস। যেটা বলছিস, সেটা করে দেখাবি এটাই আশা করি। নয়তো এত বড় মুখ করে বলা কথাগুলো সব মূল্যহীন হয়ে যাবে।
– আমার উপর ভরসা রাখো মা।
– সায়ানকে এভাবে ফিরিয়ে দিয়ে তোর খারাপ লাগছে না পৃথা?
– একটুও না আম্মু। গতকাল ভালো লেগেছিল ও বিয়ে পর্যন্ত চেষ্টা করেছে বলে। কিন্তু সারা রাত ভেবে নিজের মনকে শক্ত করে নিয়েছি আমি।
– তুই যা ভালো মনে করিস।
মাও বেরিয়ে গেলেন। পৃথা বিছানায় শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। এরপর বই খুলে পড়তে বসল। আজ একটা বড় ঝামেলা মিটে গেছে। আশাকরি এরপর আর কোনো ঝামেলা হবে না। এখন শুধুই নিজেকে সময় দেয়া আর নিজের জন্য ভাবা।
রাত ঠিক সারে এগারো টায় একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসলো। পৃথা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রিসিভ করে বলল, হ্যালো। কে বলছেন?
– এই অপমান করে তুমি ঠিক করোনাই পৃথা। একদিন সাফার করতে হবে এটার জন্য।
– সায়ান, এত রাতে কেন কল দিয়েছেন?
– তুমি নিজেকে কি ভাবো? আমাকে কি ভাবো? ছাগলের বাচ্চার মতন আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে আর আমি ঘুরবো?
– আপনার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? নেশা করেছেন? ছিহ, সামান্য একটা ব্যাপারে কেউ এসব খায়?
– জাস্ট শাট আপ মিস পৃথা। আমি ড্রিংক্স করেছি মনের জ্বালা কমাতে। আমার বাবা মাকে কতকিছু করে রাজি করিয়েছিলাম তোমার ধারণা আছে?
সায়ান বলতে শুরু করলো কিভাবে ওর বাবাকে ম্যানেজ করতে হয়েছে। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে গ্রাজুয়েশন শেষ করে ওনার ব্যবসায়ে হাত দেবেন। সমস্ত কাজ সায়ানকে বুঝিয়ে দিয়ে বাবা অবসর নিয়ে দেশে বিদেশে ঘুরে বেরাতেন। এজন্য ছেলেকে প্রস্তুত করছেন এখন থেকেই। সায়ানের বাবা যেভাবে ছেলের হাতে ব্যবসা তুলে দিচ্ছেন ওনার বাবা কিন্তু সেভাবে ওনার হাতে তুলে দেয়নি। সায়ানের দাদার পরিবার খুবই অসচ্ছল ছিল। নিজের প্রচেষ্টায় সায়ানের বাবা এতদূর এসেছেন। পুরো পরিবারকে সাহায্য করেছেন। তিনি চান তার প্রতিষ্ঠানকে তার ছেলে আরো অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিয়ের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ বা ছেলেকে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছেটাও ওনার ভেতরে ছিল না। বিয়ে হয়ে গেলে ছেলেরা একটা দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে গিয়ে জীবনের লক্ষ্য থেকে সরে যেতে পারে। এই ভয়টাই পেতেন উনি। ছেলেকে বলে দিয়েছিলেন যেন কারো সাথে সম্পর্কে জড়ালেও শারীরিক কিছু না করে, যার অজুহাতে কেউ ধরে বেঁধে বিয়ে দেবে। এরকম কোনো ঘটনাকে প্রশ্রয় দেবেন না উনি। সায়ানও ছোট থেকে বাবার কথা শুনেই বড় হয়েছে। বাবা স্বপ্ন দেখেন সায়ান একদিন ব্যাবসাকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিয়ে যাবে। সেই ছেলে অনার্স শেষ করার আগেই যদি বাবাকে এসে নিজের মুখে বলে, ‘আব্বু আমি বিয়ে করতে চাই’ তখন বাবার মানসিক অবস্থা কেমন হবে? বাবা অনেক ভেঙে পড়েছিলেন। ছেলের উপর থেকে ভরসা হারাচ্ছিলেন তিনি। সায়ান একটু একটু করে বাবাকে বুঝিয়েছে যে পৃথাকে ছাড়া ওর একেবারেই চলবে না। বরং পৃথাকে কাছে পেলে আরো সামনে এগিয়ে যেতে পারবে। দুজনেই পড়াশোনা শেষ করবে, এরপর দুজনেই ব্যবসায় মন দেবে। কত রকমের প্রতিশ্রুতি বাবাকে দিয়েও রাজি করানো যায় নি।
শেষে সিনেম্যাটিক পন্থা ধারণ করতে হয়েছে। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকা, খাবার খেতে অনীহা, গোসল না করা, চুল দাড়ি কাটতে অবহেলা এসব করার পর অবশেষে বাবা সম্মত হয়েছেন ছেলের বিয়ে দিতে। তবে বড় ধরণের অনুষ্ঠান এখন করতে পারবেন না। সায়ান তাতেও রাজি হয়েছিল। এরপর আপত্তি সাধলেন মা। এত সুন্দর রাজপুত্রের মত ছেলের সাথে একটা গ্রামের মেয়ের বিয়ে তিনি দেবেন না। সায়ান মাকে বুঝিয়েছে পৃথা গ্রামের মেয়ে হলেও সবার থেকে আলাদা। ওর মানসিকতা সুন্দর, আচার আচরণ সুন্দর। শহরের মেয়ের থেকে শত গুণে সমৃদ্ধ। মাকে রাজি করাতেও বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সায়ানকে।
পৃথার বাবাও শুরুতে রাজি হতে চান নি। প্রতিদিন ফোনে কথা বলে তাকে ইমপ্রেসড করেছে সায়ান। সমস্ত পরিশ্রম বৃথা হয়ে গেলো এটা যেমন সত্যি, তেমনি বাবা মা ভীষণ অপমানিত বোধ করছেন এটা তারচেয়েও বেশি সত্যি। সায়ান বাবা মায়ের কাছ খুব ছোট হয়ে গেছে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার মত মুখ ওর আর নেই।
সবকিছু পৃথাকে বলে দিলো সায়ান। পৃথা চুপচাপ শুনে গেলো। কোনো আওয়াজ করলো না। ওর খারাপ লাগছে সায়ানের জন্য। সায়ান বলল, নিজের জেদ নিজের ইগো এসবের জন্য আমাকে সবার কাছে হাসির পাত্র বানিয়ে দিলে তুমি। আমি বিয়ে করতে গিয়েছিলাম। আমার বাবা মা চেয়েছিল আজকেই পারলে কাবিন করিয়ে রাখতে। ওনারা ছেলের কষ্ট আর সইতে পারেননি। বাবা মায়ের অপমান বাদ দিলাম পৃথা, একটা ছেলে কতটা পাগল হলে এতকিছু করতে পারে ভাবতে পারো?
পৃথা নিশ্চুপ।
সায়ান বললো, আমি তোমাকে পাগলের মত ভালোবাসি পৃথা। পাগলের মত। তোমার ছবি দেখে দেখে আমার রাত কাটে, তোমার আগের পাঠানো মেসেজ পড়ে আমার দিন কাটে। আমি সারাক্ষণ তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকি। এমন কোনো সেকেন্ড হয়তো নেই যখন তোমার কথা ভাবি না। ঘুমের মাঝেও আমার মস্তিষ্ক তোমাকে নিয়েই ভাবতে থাকে। তোমার জন্য, কেবল তোমাকে ভালোবেসে আমি সবকিছু ত্যাগ করতে রাজি ছিলাম। তুমি এটা কি করলে? কি করলে এটা?
পৃথা বলল, আমাকে এত ভালোবাসেন আগে কেন বলেন নি?
– বলার সুযোগ দিয়েছিলে? তোমার নাম্বার চেঞ্জ করে ফেলেছো, ফেসবুক আইড়ি ডিএকটিভ করে রেখেছো, তোমার খালার বাসার বারান্দায় আসো না, বেলকুনিতে আসো না, ভার্সিটিতে গেলে আমার থেকে লুকিয়ে থাকো। আমি কিভাবে বোঝাবো তোমাকে কত ভালোবাসি? বলো আমাকে?
পৃথা নিশ্চুপ। ওর কাছে এর কোনো উত্তর নেই।
সায়ান বললো, আমি চেয়েছিলাম বাসর রাতে তোমাকে বুঝিয়ে বলবো সত্যিই কতটা ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। তোমার অবহেলা ধীরেধীরে আমার ভালোবাসাকে আরো খাঁটি করে তুলেছিল। নিশ্চিত ছিলাম আমার ফ্যামিলি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে তুমি না করতে পারবে না। তুমি এটা কি করলা? কিভাবে পারলা পৃথা?
পৃথা আর সহ্য করতে পারছে না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে ফেললো ও। কিছুক্ষণ পর কল কেটে গিয় আবার কল এলো। অনেক্ষণ রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো #পৃথা। সায়ান বলল, তোমার বাবার থেকে নাম্বারটা নিলাম শুধুমাত্র শেষ কথাগুলো তোমাকে বলার জন্য। আর কোনোদিনো এই সায়ান তোমাকে বিরক্ত করবে না। মরে গেলেও না।
সায়ান কল কেটে দিলো। প্রকৃতির পরিবেশ স্তব্ধ, শান্ত অথচ বুকের ভেতর শো শো শব্দে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শরীর শিউরে উঠছ পৃথার। এমন করে কেউ কখনো ভালোবাসেনি। এমন করে কেউ কাছে আসতে চায় নি, কেউ কাছে টানে নি। কি অদ্ভুত নিয়ম পৃথিবীর। না জেনে, ভুল বুঝে সায়ানকে কষ্ট দিয়ে ফেলাটা ঠিক হয় নি। আনমনা হয়ে পড়লো পৃথা। বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম আওয়াজ হচ্ছে। ভালোবাসা পেয়েও পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলে দিলে ,নিজের ভুলটা বুঝতে পারলে এমন লাগে। বড়ই যন্ত্রণাময় মুহুর্ত। একদিকে নিজের জেদ ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে নয়তো সবার কাছে নিজেকে ছোট হতে হবে, একদিকে সায়ানের অপমানের জন্য খারাপ লাগছে। তবে কি মনটা এখনো সায়ানের জন্য মায়া করে? এখনও কি ওকে ভালোবাসে?
রুম থেকে বেরিয়ে সোজা ছাদের উপর চলে যায় পৃথা। তারপর শব্দ করে কাঁদতে থাকে। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে ওর কান্না। পৃথা নিজেও জানেনা ও কেন কাঁদছে?
১২
বাবা মা বাড়িতে চলে গেলেন। পৃথার কিছু ভালো লাগে না। খুব মন খারাপ লাগে, সবকিছু এলোমেলো লাগে। পড়ায় মন বসে না, গান শুনতে ভালো লাগে না, খেতে ইচ্ছে করে না।
সারাদিন নিজের ঘরটাতে চুপটি মেরে বসে থাকে ও। কি যে হয়েছে নিজেও বোঝে না। খালা এসে খেতে ডাকে, ওঠার কথা মনে থাকে না। বেলা বয়ে যায়, গোসল করা হয় না। এভাবেই এলোমেলো ভাবে কেটে গেলো কতগুলো দিন।
এক বান্ধবী ফোন করে জানালো ক্লাস টেস্ট হবে। ভার্সিটিতে গিয়ে নোটগুলো সংগ্রহ করতে। পৃথা ভার্সিটিতে যায়, কখনো কখনো চোখ দুটো সায়ানকে খোঁজে। পায় না, আপন মনেই চোখ নামিয়ে নেয় পৃথা।
কয়েকদিন লেগে গেল পৃথার স্বাভাবিক হতে। ভার্সিটিতে নিয়মিত যাওয়া শুরু করলো। ক্লাস, পড়াশোনা নিয়ে মেতে উঠলো। আবারও যাওয়া শুরু করলো জিমে। সকালে উঠে ফ্রেশ হয়েই ভার্সিটি তে যাওয়া, ফিরে এসে গোসল দিয়ে খাওয়া, পত্রিকা পড়া, একটা ফ্রেশ ঘুম, জিম, বই পড়া এসব নিয়েই সময় কাটছে পৃথার। অনেকদিন বাবা ফোন করে না, মায়ের সাথে কথা হয় নিয়মিত। মাকেই জিজ্ঞেস করে বাবা কেমন আছে? কিন্তু বাবার সাথে কথা বলার সাহস পায় না পৃথা। বাবাটাও বড্ড অভিমান করে বসে আছে। নিজে থেকে ফোন দেয় না।
একজন নতুন বান্ধবী হয়েছে পৃথার। নাম অবন্তি। মেয়েটা খুব চঞ্চল, সারাক্ষণ বকবক করে। প্রচুর হাসে, অনর্গল কথা বলতে থাকে কোনো স্পেস ছাড়া। ক্লাস টাইম ছাড়া অবন্তির সাথে আড্ডা দিয়েই সময় কাটে পৃথার। অবন্তির সাথে মিশতে মিশতে ওর মতই হতে শুরু করেছে পৃথা। আজকাল পৃথাও বেশি কথা বলে। ছুটোছুটি করে, যেকোনো প্রোগ্রামে অংশ নিতে এগিয়ে যায়। কয়েকটা মেয়ে আবার পৃথার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। ওদের দুজনের এত দূরন্তপনা মেয়েদের ভালো লাগে না। পৃথার তাতে কিছুই আসে যায় না। সময়টাই তো তার, যে সবকিছুকে এড়িয়ে গিয়ে সামনে চলতে পারে।
নিয়মিত আউট বই পড়া শুরু করেছে পৃথা। ক্লাসে স্যার কোনো প্রশ্ন করলেই উঠে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়। কেউ কেউ আড়ালে পৃথাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। এভাবেই সময়গুলো অতিবাহিত হচ্ছে।
মাঝেমাঝে মনে হয় একবার সায়ানকে ফোন করে সরি বলতে। কিন্তু সেই রাতেই সায়ানের নাম্বারটা ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়েছে পৃথা। কোনো এসএমএস ও রাখে নি। ফেসবুক আইডিটা আনব্লক করে নক দিলে হবে না, এতে করে যন্ত্রণা বাড়বে। আবার মাঝেমাঝে মনেহয় থাকুক না সে নিজের মত। সবকিছু শেষ হয়ে গেছেই যখন, তখন আর নতুন করে কনভারসেশন শুরু করার দরকার কি? থাকুক না সবকিছু এভাবে। কিন্তু সত্যিই কি সব শেষ হয়ে গেছে? শেষ হয়েও তো তার রেশ রয়ে গেছে। যে বাজনা এখনো বাজে বুকের ভেতর।
চলবে..
#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ১৬
#নীলাভ্র_নেহাল
.
একদিন অবন্তি এসে জানালো ওর বড় বোনের বিয়ে। পৃথাকে এক সপ্তাহ আগেই ওর বাড়িতে যেতে হবে আর বৌ ভাত পর্যন্ত থাকতে হবে। যদিও বিয়ের অনুষ্ঠান হবে কমিউনিটি সেন্টারে। তবে গায়ে হলুদ হবে বাসাতেই। সব আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাই মিলে আনন্দ উল্লাস করার একটা মোক্ষম সুযোগ হচ্ছে বিয়ে বাড়ি। এই সুযোগ টাকে কেউই হাতছাড়া করতে চায় না। তাই বিয়ের প্রোগ্রাম কমিউনিটি সেন্টারে হলেও কাছের আত্মীয়রা সবাই বাসায় আসবেন। এক সপ্তাহ ধরে হৈ চৈ আর বিয়ে বাড়ির আমেজ ধরে রাখতে না পারলে কিসের আর বিয়ে বাড়ি?
পৃথা আমতা আমতা করে বলে দিলো, না রে আমার যাওয়া হবে না। আব্বু কোথাও যাওয়া পছন্দ করে না।
– আমাকে এসব শুনাতে আসবি না। আব্বু যদি এটা অপছন্দই করতো তাহলে তোকে শহরে রাখত না ।ওকে?
– কিন্তু আমার যাওয়া হবে না রে। প্লিজ আমাকে জোর করিস না।
– আমি করবো না জোর। তুই তোর বিবেক দিয়ে বলবি। যদি তোর বোনের বিয়েতে আমাকে ডাকতি আর আমি না যেতাম, কেমন লাগত?
– বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার ব্যাপারটা বোঝ। আমাকে কেউই যাওয়ার পারমিশন দেবে না।
– সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই আমাকে আন্টির নাম্বার দে। আমি ওনাকে বুঝিয়ে বলবো।
– হয়তো বিয়েতে যেতে বলবে কিন্তু এক সপ্তাহ থাকার অনুমতি দেবে না।
– দেবে। সেটা তুই আমার উপর ছেড়ে দে।।
পৃথা মায়ের নাম্বার দেয়ার সাহস পাচ্ছিল না। কারণ এর আগে একবার মিথ্যা কথা বলে মাকে আবার সত্যিটা বলে দিয়েছে ও। এবার এমন কিছু বললে মা নিশ্চয়ই অন্যকিছু ভাব্বে। পৃথা কিছুতেই নাম্বার দিতে চাইলো না। অবন্তি রীতিমতো পৃথার ফোনটা কেড়ে নিয়ে আন্টির সাথে কথা বললো৷ আর দ্রুত রাজিও করে ফেললো ওনাকে। মা একবার পৃথাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে যাবি?
পৃথা বলল, না আম্মু। ও জোর করে নিয়ে যেতে চায়।
– কবে বিয়ে?
– বিয়ে আরো দশদিন বাকি। ও আমাকে এক সপ্তাহ আগেই নিয়ে যেতে চায়।
– আচ্ছা যাস। ওকে বল যে যাবি। তবে পাঁচদিন আগে।
– আম্মু! পাঁচদিন আগে যাবো। কি বলো এসব?
আশ্চর্য হয়ে গেলো পৃথা। এখনো এর প্রতি মায়ের এত বিশ্বাস!
মা বললেন, হুম। তবে একটা কথা বলে রাখি, আমার মান সম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো কিছু কখনো করবি না মা।
– তুমি আমার উপর ভরসা রাখতে পারো আম্মু। আব্বুকে বললে আব্বু কি পারমিশন দেবে?
– ওটা আমার উপর ছেড়ে দে। এখন ভালোভাবে মনদিয়ে ক্লাস কর।
মা ফোন রেখে দিলেন। অবন্তি খুশিতে জড়িয়ে ধরলো পৃথাকে। ক্লাসের ফাঁকে পৃথা একবার ফিসফিস করে বলল, জানিস আমার খুব এক্সাইটেড লাগছে। কত্তদিন কোনো বিয়ে বাড়িতে যাই না।
– আমারও এক্সাইটেড লাগছে। খুব মজা করবো আমরা।
– সবাই কি এত আগে চলে আসবে?
– না। শুধু কাজিনরা। আর ফুফুরা। আমার কিন্তু অনেক কাজিন। হেব্বি ফুর্তি হবে রে।
– ছেলে না মেয়ে?
– ওমা! ছেলের কথা জানতে চাইছিস কেন রে?
দুষ্টুমি হাসি হাসলো অবন্তি। পৃথা বলল, এমনি। আমার ছেলেরা থাকলে বিরক্ত লাগে।
– বলিস কি রে? তুই তো শালা নিরামিষ। ছেলেরা থাকলে মজা আরো বেড়ে যায়।
– যাহ! ফাজিল মেয়ে।
– শিওর। তবে আমার মেয়ে কাজিন বেশি। ছেলে আছে দু চারটা। একেকটা হেভি হ্যান্ডসাম মাইরি। তুই ঘ্যাটাঘ্যাট ক্রাশ খাবি।
দুই বান্ধবী হেসে উঠলো ফিক করে। পরক্ষণেই মনে পড়লো ওরা এখন ক্লাসে আছে। হাসি চেপে গেলো ওরা। ভাগ্যিস স্যার দেখেন নি। দেখলে কি কেলেঙ্কারি টাই না হতো!
১৩
যথারীতি বিয়ের পাঁচদিন আগে অবন্তিদের বাসায় চলে এলো পৃথা। খুব বেশি লোকজন আসে নি। তবে কিশোরী ও যুবতী বয়সের পাঁচ/ছটা মেয়ে কে দেখা গেলো। ওদের মধ্যে দুজন এগিয়ে এসে পরিচিত হতে চাইলো পৃথার সাথে। পৃথার মনে হলো, সময়টা তাহলে ভালোই কাটবে।
সময়টা আনন্দেই কেটে যেতে লাগল। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চললো। আড্ডা শেষ হবার আগেই পৃথা ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বাসায় এসেছে। ছুটে নামতে গিয়ে হঠাৎ কি হয়ে গেলো বুঝতে সময় লাগলো ওর। অনেক্ষণ পর বুঝতে পারলো কারো সাথে ভীষণ জোরেসোরেই ধাক্কা খেয়েছে আর তাল সামলাতে না পেরে দেয়ালের উপর এসে পড়েছে। যার সাথে ধাক্কা লেগেছে সে পৃথার বাহুতে হাত রেখে বলল, সরি সরি। ব্যথা পেয়েছেন?
পৃথা বলল, হ্যাঁ। খুব ব্যথা পেয়েছি। হাতটা ছিলে গেছে ।
– দেখুন আপনি দিগ্বিদিক হয়ে ছুটছিলেন। আমি কিন্তু দেখেই চলছি। আপনি এসে ধাক্কা লাগিয়ে দিয়েছেন।
– সরি। এটা একটা একসিডেন্ট।
– দেখি কোথায় লেগেছে?
– এইখানে…
পৃথা মুখ তুলে তাকালো। বেশ ড্যাশিং একটা ছেলে। গালে খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়ি। চোখ দুটো ছোট ছোট, ভ্রু দুটো বেশ ঘন। ও হন্তদন্ত হয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো। ছেলেটা পিছন থেকে বললো, আপনি কি বেশি ব্যথা পেয়েছেন?
– ইটস ওকে। আর আপনাকে অনিচ্ছায় ধাক্কা দেয়ার জন্য আমি দুঃখিত।
পৃথা দ্রুত চলে আসলো সেখান থেকে। ফ্রেশ হয়ে রুমেই শুয়ে রইলো। খানিক বাদে অবন্তি এসে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বলল, কি রে? শুয়ে আছিস কেন?
– এমনি। বেশি হৈ চৈ করলে আমার মাথা ধরে যায়।
– হুশ৷ এটা কোনো কথা? এত পুতুপুতু হলে চলে নাকি? মেয়েদেরকে হতে হয় স্ট্রং। আমার মত হ বুঝলি।
– আসলেই ভাই তুই একটা জিনিস।
– তোকেও ঘষামাজা করে একটা জিনিস বানাই দিবো।
হেসে উঠলো দু বান্ধবী। পৃথা বলল, একটু আগে এক ছেলের সাথে ধাক্কা খেয়েছি।
– মারহাবা। প্রথম দিনেই ধাক্কা! হা হা হা।
– ধুর হাসবি না। ব্যথা পেয়েছি খুব।
– ইস রে। এরকম ব্যথা দিয়েই শুরু হয়। আমার কোন ভাইয়ের সাথে ধাক্কা খেলি বলতো?
– চিনি নাকি আমি? শোন আগেই বলে রাখি একটা কথা। ধাক্কাতেই যেন শেষ হয়ে যায় ব্যাপার টা। এটা নিয়ে ফাজলামো করলেও আমি এলাও করবো না।
– এত্ত সিরিয়াস ক্যান তুই?
– আমার এসব ভালো লাগে না।
পৃথা উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালো। অবন্তি হেসে পৃথাকে পিছন দিক থেকে ধরে বললো, কখনো কাউকে ভালোবেসেছিস?
– না।
– না বাসলে বুঝবি কি করে ভালোবাসায় কি মধু?
– তাই নাকি? আমার একদমই এসব ভালো লাগে না।
– আমার খুব ভালো লাগে। নির্ঝর কে নিয়ে আজ অনেক গল্প করবো।
দু বান্ধবী শুয়ে গল্প শুরু করে দিলো। নির্ঝর অবন্তির প্রেমিকের নাম। দুজনের কিভাবে পরিচয়, পরিচয় থেকে প্রেমের সূচনা, প্রেম গভীর হওয়া সবকিছুই শোনালো ওকে। দু মাস পরপর ওরা একসাথে ট্যুরে যায়। সে সময়টা জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটে, এমন মন্তব্য করলো অবন্তি।
পৃথা বলল, কোথায় ট্যুরে যাস?
– সাজেক, কক্সবাজার, বান্দরবান। চার/ পাঁচদিন থাকি।
– বাসায় কিভাবে ম্যানেজ করিস?
– বাসায় ট্যুরের কথা বলেই যাই। গ্রুপ ট্যুরে যাই। কিন্তু কেউ জানেনা গ্রুপে গিয়েও আমরা কাপল ট্যুর দেই। হি হি।
অবন্তি খিলখিল করে হাসতে লাগলো যেন খুব মজার ব্যাপার ঘটেছে। পৃথা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, মনের মত একজন সঙ্গী পেলে নিশ্চয়ই অনেক মজা হয়!
– আর বলিস না। প্রতিদিন ওয়েট করি আর প্লান করি আবার কবে যাবো। জানিস ওকে কাছে পেলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না। সারা রাত আমরা জড়াজড়ি করে উফফফ!
পৃথা অবাক হয়ে বলল, জড়াজড়ি মানে! তোরা একসাথে থাকিস?
– তো?
– সিরিয়াসলি!
অবাক হয়ে হা করে রইলো পৃথা। অবন্তি ওর হা বন্ধ করে দিয়ে বলল, মুখে মশা ঢুকে যাবে ইয়ার। ট্যুরে তো সবাই যায়। ট্যুরে গেলে দেখবি খালি কাপল আর কাপল।
– একসাথে থাকা যায়? কিভাবে থাকিস?
– পাগলী। কিভাবে আবার থাকবো? লাইক হানিমুন।
– রোমান্স করিস?
– কেন নয়?
– ওরে বাবা রে!
আৎকে উঠল পৃথা। অবন্তি পৃথাকে জড়িয়ে ধরে পৃথার বুকে মুখ লুকিয়ে বলল, যা দারুণ লাগে রে ওর বুকে ঘুমাতে!
– যাহ আর বলিস না। আমারও খুব যেতে ইচ্ছে করবে।
– তোর তো আর বয়ফ্রেন্ড নেই৷ একা গেলে এনজয় করতে পারবি না।
– বয়ফ্রেন্ড আর হবেও না আমার রে। বিয়ের পর বরকে নিয়ে যাবো।
– মিস করবি দোস্ত মিস করবি।
অবন্তি গল্প শোনালো কিভাবে ওরা জার্নি করে, কিভাবে আনন্দ করে, পাহাড় দেখে, সমুদ্র দেখে। গল্প শুনে উৎসুক হয়ে পৃথা বলল, আমাকে একবার নিয়ে যাবি ট্যুরে? আমার খুব যাওয়ার ইচ্ছে।
– ওকে। বাট আমার সাথে থাকার জেদ ধরবি না আবার।
– না না। কাবাবে হাড্ডি হবো কেন? আমি একা এক রুমে থাকবো।
– আচ্ছা। আপুর বিয়েটা শেষ হোক, এরপর যাবো কেমন?
অনেক রাত অব্দি দু বান্ধবী গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালবেলা হৈ চৈ আর শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো পৃথার। ও মুখ তুলে দেখে জানালা দিয়ে আলো ঢুকে পড়েছে। অবন্তি এখনো ঘুমে বিভোর। বাইরে খুব হৈ চৈ হচ্ছে। ও উঠে ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হলো।
ড্রয়িং রুমে এসে দেখে মেঝেতে বসে অনেকে একসাথে নাস্তা করছে। ওরও বসে যেতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু অবন্তি তো এখনো ঘুমে। গতকাল রাতে পরিচিত হওয়া একটা মেয়ে ওকে টান দিয়ে পাশে বসিয়ে নিলো। নাস্তা করতে করতে নানান লোকে নানান গল্পগুজব আর হাসি তামাশা করছিলো।
পৃথা আচমকা দৃষ্টি ঘোরাতেই গত রাতের ছেলেটার সাথে চোখাচোখি হলো। ছেলেটা মুচকি হাসছে। পৃথা আবারও চোখ নামিয়ে নিলো।
খাওয়া শেষে ঘরে ঢোকার সময় দেখলো ছেলেটা অবন্তির সাথে কথা বলছে। পৃথা ঘরে ঢুকলে অবন্তি পরিচয় করিয়ে দিলো। ওর নাম আবির। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে কিছুদিন আগে চাকরিতে জয়েন করেছে। পৃথা সৌজন্যসূচক হাসি দিলো।
আবির জিজ্ঞেস করল, আপনার ব্যথা কমেছে?
– এখন নেই।
– আমি তো আপনার ব্যথার চিন্তার ঘুমের মাঝেও দুশ্চিন্তা করছিলাম। কি অন্যায় হয়ে গেছিল মাইরি।হা হা হা।
– না না। দোশ তো আমারই।
অবন্তি বলল, গতকাল ধাক্কাটা ওর সাথেই খাওয়া হয়েছিল? হা হা।
– তোর বান্ধবীর গায়ে জোর আছে বলতে হবে। শুকনা হলেও তেজ আছে।
হেসে উঠলো অবন্তি। আবির বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। পৃথা জিজ্ঞেস করল, এটা কে রে?
– আবির ভাইয়া। বড় খালার ছেলে।
– ওহ আচ্ছা।
– এরপর ওর বিয়ের সানাই বাজাবো।
– কথাটা কি আমাকে বললি?
অবন্তি ফিক করে হেসে বলল, নাহ তোকে কেন বলবো? ওর বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে বলেছিল খালা। তাই আরকি।
আজকে কিছু মেহমান আসলো বাসায়। এখন একটা বেশ বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি ভাব চলে এসেছে। কেউ হাসছে, কেউ খেলছে, কেউ রান্নাঘরে, কেউবা আড্ডায় বসে গেছে। বেশ জমেছে বটে।
রাত্রিবেলা মেয়েরা যখন অবন্তির রুমে আড্ডা দিচ্ছিল তখন আবির সেখানে এসে বসল। কয়েকবার চোখাচোখি হলো পৃথার সাথে। যতবার ই চোখাচোখি হয়, আবির মুচকি হাসে। পৃথাও হাসির বিনিময়ে হাসি ফেরত দেয়।
আজকের আড্ডায় গান চললো। সবাই চলে গেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো পৃথা। কিছুক্ষণ পর মৃদু স্বরে শুনতে পেলো অবন্তির গলা। ও কাকে যেন বলছে, প্লিজ এখন না। কেউ দেখে ফেললে আপুর আগে আমারই বিয়ে হয়ে যাবে। প্লিজ প্লিজ।
পৃথা কৌতুহলী এসে দেখে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে অবন্তি ফোনে কথা বলছে। ওকে কথা বলতে দেখে নিজে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সবকিছু হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। একটু আগেও হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকা বাড়িটা শান্ত হয়ে গেছে। কেমন যেন একা একা লাগছে পৃথার। মনে হচ্ছে আজ একটা প্রেমিক থাকলে সেও কত কথা বলত!
চলবে..