#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ১৩
#নীলাভ্র_নেহাল
.
অনেক গুলো দিন কেটে গেলো । পৃথার নাম্বার বন্ধ। সায়ান অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারে নি। ফোনে, ফেসবুকে, ভার্সিটিতে কোথাও পৃথাকে দেখা গেলো না। পৃথা সারাদিন বাসায় বসে পড়াশোনা করে, গল্পের বই পড়ে, মুভি দেখে আর গাড়ি নিয়ে সোজা জিমে যায়। বাসার বেলকুনিতেও এসে দাঁড়ায় না ও। কারণ ওর মন বলে সায়ান এসেছে। সায়ান মাঝেমাঝেই বেলকুনির সামনে দাঁড়ায়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকে। এটা অজানা নয় পৃথার। কিন্তু সায়ানের সাথে চোখাচোখি হলে, ওর মুখ দেখলে নিজেকে সামলানোটা পৃথার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছে করেই বাইরে আসে না ও। জানালা দিয়েও কখনো উঁকি দেয় না। গাড়িতে করে জিমে যাওয়ার সময়ও কখনো জানালা দিয়ে তাকায় না। নিজের জন্যই এই সংগ্রাম বেছে নিয়েছে পৃথা।
কয়েকদিন ভার্সিটি তে না যাওয়াতে ভালোই হয়েছে পৃথার জন্য। মেয়েরা ওত পেতে ছিল পৃথাকে শাস্তি দেয়ার জন্য। কিছু একটা করে পৃথাকে শায়েস্তা করেই ছাড়তো। কিন্তু দীর্ঘদিন পৃথাকে না দেখায় ওদের মাঝ থেকে বদলা নেয়ার জিদ টা চলে গেলো ধীরেধীরে।
হঠাৎ একদিন ভার্সিটিতে সায়ান ও পৃথার মুখোমুখি দেখা। আচমকা এমন দর্শনের জন্য প্রস্তুত ছিলো না পৃথা। সায়ান পৃথাকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারে নি। এ কেমন অদ্ভুত পরিবর্তন! শুধু চোখ দুটোই বদলায়নি। নয়তো চেনাই যাচ্ছিল না পৃথাকে। চুলগুলো আগে কার্ল ছিল, এখন স্ট্রেইট। ভ্রু দুটো তলোয়ারের মত, মুখে যত্নের ছাপ৷ আগে এত যত্ন করতো না নিশ্চয়ই। হালকা মেকাপও করেছে। শরীরের গড়নে অদ্ভুত পরিবর্তন। আগের থেকেই আকর্ষণীয়, স্লিম দেখাচ্ছে। গাল দুটোও স্লিম হয়েছে বেশ। সায়ান কয়েকবার পলক ফেললো।
পৃথা সায়ানকে না দেখার ভান করে এড়িয়ে চলে যাচ্ছিল। সায়ান বললো, দাঁড়াও।
থমকে দাঁড়াল পৃথা। সায়ান কাছে এসে বললো, কোথায় ছিলে এতদিন?
– কেন?
– তোমাকে অনেক খুঁজেছি। যাকে বলে পাগলের মত খোঁজা। একটা বড় হীরের টুকরো কেও কেউ এভাবে খুঁজবে না।
– তাই? আপনাকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিয়েছি, ফোন নাম্বার চেঞ্জ করেছি, ভার্সিটিতে আসিনি। এমনকি ঘরের জানালাতেও ভুল করে উঁকি দেইনি। বুঝতে পারছেন না আমি যোগাযোগ রাখতে চাই নি?
– সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু একটা সত্য কি জানো তো? কেউ যখন কাউকে খুব করে এভোয়েড করে, সে খুব আনন্দ পায়। এটাকে বলে পৈশাচিক আনন্দ। কিন্তু অপর পাশের মানুষটা, যাকে এভোয়েড করা হয়, কেবল সেই বুঝে অবহেলিত হওয়ার কি যন্ত্রণা।
– শুনুন, এসব আমাকে বলবেন না। আমি আপনাকে এভোয়েড করতে চাইনি। ভুল করে জড়িয়েছিলাম। এটার জন্য ক্ষমা চেয়েছি। আমি এখন আমার মত থাকতে চাই।
– আমিও চাই। কিন্তু তোমার জড়িয়ে যাওয়াটা ভুল করে হলেও আমার জড়ানোটা ভালোবাসা থেকে ছিল। তাই আমি চাইলেও ভুলতে পারি না।
– শেষ কথা কি আপনার?
সায়ান বললো, তোমার ভুল ভাঙিয়ে দিতে চাই।
– এটাই শেষ কথা?
– হ্যাঁ।
– বলুন?
– তুমি যা জানতে সেটা ভুল। আমি অর্পার সাথে কথা বলেছি। এবং সত্যিটা জেনেছি।
– কোন সত্যিটা?
সায়ান সবকিছু খুলে বললো পৃথাকে। অর্পা অনেক আগে থেকেই সায়ানকে ভালোবাসে। সায়ানের জন্য অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায় নি ও। অর্পা ভেবেছিল সায়ানও ওকে ভালোবাসে আর একইভাবে চায়। কিন্তু সায়ান কখনো অর্পাকে পছন্দই করে নি। অর্পাকে শুধুমাত্র কাছের একজন বন্ধু ভেবে এসেছে। পৃথাকে প্রথম দেখেই প্রেমে পড়ে যায় সায়ান। ঠিক প্রেমে পড়েনি কিন্তু মনের মাঝে অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করে। ভুলতে চায় পৃথাকে, মন থেকে সরাতে চেয়েছে অনেকবার। কারণ সায়ান যেমন মেয়েকে চায় পৃথা সেরকম নয়। তাছাড়া পৃথা গ্রামে থাকে, সায়ান ছোটবেলা থেকেই শহরে মানুষ। দুজনের মাঝে সম্পর্কটা বোঝাবুঝির পর্যায়ে আসবে না। বা একসাথে চলাফেরা করতেও সমস্যা হবে। কিন্তু মনকে আটকাতে পারে নি। মন ঠিকই ছুটে গেছে পৃথার কাছে। পৃথার সাথে কথা বলার পর সায়ান বুঝতে পারে ও গ্রামের মেয়ে হলেও একেবারে আলাদা। আর মনের কথা বলে আরাম পাওয়া যায়, বুঝাবুঝি ভালো দুজনাতে। সায়ান পৃথাকে নিয়ে সিরিয়াস হতে শুরু করে। তাই সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এমনই এক দিনে অর্পা হঠাৎ এসে হাজির হয় এক বৃষ্টির বিকেলে। সায়ান বরাবরের মতই ঘুমাচ্ছিল, তাও খালি গায়ে। অর্পা এসে নিজে থেকেই সায়ানকে কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করে। রুম ছিল অন্ধকার। তার উপর রোমান্টিক ওয়েদার। অর্পাকে জোর করে ঠেলে দিতে পারছিল না সায়ান। নিজের মাঝেও উত্তেজনা কাজ করছিল। কিন্তু যখন বুঝতে পারে এসব ঠিক না, একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের সাথে এভাবে মেলামেশা করতে পারবে না ও। ঠিক তখনই অর্পাকে সরিয়ে দেয়। অর্পা কষ্ট পায়। কারণ ও ভেবেছিল সায়ানও ওকে ওর মতই কাছে চায়। কিন্তু সায়ান অর্পাকে কাছে চায় না বুঝতে পেরে মন খারাপ করে ফেলে। সরি বলে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সায়ান বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বলে, ইটস ওকে। কিন্তু অর্পার শান্তি হচ্ছিল না। ও সায়ানের পাশে শুয়ে পড়ে আর রিকুয়েষ্ট করে৷ একটু জড়িয়ে ধরতে পারবে কিনা? সায়ান ইতস্তত করে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। কিন্তু অর্পা ওকে জড়িয়ে ধরে। কিছু ছবি তুলে নেয় ফোনে।
অর্পা যেদিন জানতে পারে সায়ান পৃথাকে ভালোবাসে, দুজনের একটা সম্পর্ক ও গড়ে উঠেছে, সেদিন থেকেই পরিকল্পনা আঁটতে থাকে কিভাবে সবকিছু ভেস্তে দেয়া যায়। অর্পার পরিচিত এক মেয়েকে ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়ে ওর সাথে বুদ্ধি করে রাজি করায় যাতে ও পৃথার কাছে এসে অর্পার শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো বলে দেয়। এরপর কয়েকটা ফেক আইডি খুলে সায়ানের বন্ধুদের নামে, তারপর একটা সিক্রেট কনভারসেশন গ্রুপ খুলে সবাই মিলে আড্ডা দেয়ার মত ভূয়া কনভারসেশন তৈরি করে। এই জিনিস গুলো দিয়েই পৃথাকে ভুল বুঝিয়েছে ওরা।
সব শুনে পৃথা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো৷ সায়ান বললো, অর্পার আচরণে আমার সন্দেহ হয়েছিল। ওর ফোন নিয়ে কৌশলে মেসেজগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে এই ফেইক কনভারসেশন গুলো পাই আমি। এরপর ফেসবুকে সার্চ দিয়ে দেখি সবার নামেই একাউন্ট খোলা। এমনকি আমার নামেও। আমি অর্পার থেকেই সব কথা বের করে আনি। যদি তোমাকে অপমান করে থাকে তাহলে আমি সবার হয়ে ক্ষমা চাইছি পৃথা। এই সত্যিটাই তোমাকে বলার ছিলো। আমার আর কিছু বলার নেই। সব জেনেও যদি দূরে সরে যাও, আমার আপত্তি নেই। আটকাতে তো পারবো না। তুমি যে কেমন জিনিস তা এই কয়দিনে বুঝে গেছি। শুধু দূর থেকেই চাইবো, ভালো থাকো৷
সায়ান চলে গেলো। পৃথা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। স্তব্ধ হয়ে। অনেক্ষণ চোখের পলকও ফেলতে পারলো না। এরকম কিছু হতেও পারে সেটা ওর মনেও এসেছিল। কিন্তু মন থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছে ও।
অনেক দৃঢ় মনোভাব নিয়ে এতদিন চলছিল। আজকে হঠাৎ সায়ানকে দেখার পর, ওর কথাগুলো শোনার পর থেকে কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। অবচেতন মন কি তাহলে ওকে নিয়ে আবার ভাবতে শুরু করেছে?
পৃথা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে। আবেগে গা ভাসানোর সময় এখন নয়। এখন নিজেকে ক্যারিয়ারের জন্য গড়ে তোলার সময়। মনটা বারবার চাইলেও ভুল করেও আগের আইডিতে ঢুকলো না পৃথা। ফোন নাম্বার বদলে ফেলেছে অনেক আগেই। সায়ান কোনোভাবেই ফোন দিতে পারবে না। আজকে মনটা চাইছে সায়ান কল করুক। কল রিসিভ না করলেও ভালো লাগতো পৃথার। কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয়।
পৃথা বই খুলে পড়তে বসে। পড়াশোনায় একদমই মন বসছে না। তবুও লেগে থাকে। কম্পিউটার খুলে গেমস খেলে, বই নিয়ে পাতা ওল্টায়। আজ কিছু ভালো লাগছে না।
এক কাপ চা হাতে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু রাস্তাটা ফাঁকা। পৃথা জানে সায়ান আর এখানে কখনো আসবে না। ওর যা বলার ছিল সব বলা শেষ। এখন সবকিছু পৃথার হাতে। কিন্তু মাকে কথা দিয়ে এসেছে পৃথা। নিজেকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। সেই কথার গুরুত্ব রাখতে হবে তো।
বেলকুনিতে বসে ফাঁকা রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে পৃথা। মন ভালো হয়না, মন শান্তও হয় না। অবচেতন মন বারবার ছুটে যায় কার কাছে, পৃথা তীর খুঁজে পায় না।
১১
দিনগুলো যাচ্ছে কেটে। পড়াশোনা করতে ভীষণ ভালো লাগে পৃথার। সবকিছুতেই যেন আনন্দ। আকাশে বাতাসে আনন্দের ঝর্ণা ধারা বইছে। পৃথার এখন একদমই সায়ানকে ভেবে কষ্ট হয় না। দিনরাত এক করে পড়াশোনা করে ও, জিমে যায়, বাসায় ওয়ার্ক আউট করে। সময়গুলো কিভাবে পেরিয়ে যাচ্ছে টেরই পায় না। একটু গল্পের বই খুলে বসলেই আর সময় খুঁজে পায় না। নতুন বন্ধু হয়েছে ক্লাসে। তাদের সাথে আড্ডা, গল্প, কখনো ফুচকা খেতে যাওয়া। সবমিলিয়ে সময় বেশ কেটে যাচ্ছে।
এমন এক দিনে হঠাৎ মা ফোন করে জিজ্ঞেস করে, তুই কি এখন বিয়ে করতে চাস?
পৃথা খানিকটা অবাক হয়, কি বললে আম্মু?
– তুই কি এখন বিয়ে করতে চাস?
– দুঃস্বপ্নেও না, স্বপ্নেও না।
– তাহলে বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিস কেন?
– মানে কি? আমি পাঠিয়েছি? হাসালে আম্মু।
– হেসেছি তো আমিও। আমাকে তো কিচ্ছু জানাস নি। তোর খালাকেও না।
– আম্মু, লুকোচুরি না করে বলবে কে বিয়ের প্রস্তাব দিলো?
– তুই কি আসলেই জানিস না?
– একদমই না। সিরিয়াসলি বলছি আম্মু।
পৃথা হাসতে হাসতে বলে, উফফ মা তুমি কি বলছো এসব?
– হ্যাঁ। আমি বলছি৷ ঘটক তোর খালাকে ধরেছে, খালুকে ধরেছে। একেবারে জাইত্তা ধরেছে। তোর খালু তো তোর বাবার কাছে বিয়ের জন্য একেবারে উঠেপড়ে লাগছে।
– আম্মু, আমি এ সবের কিছুই জানিনা।
– তোর খালার কাছে বিস্তারিত জিজ্ঞেস কর। আমাকে তোর আব্বু বললো মেয়ে তো বিয়ে দিতে হবে। পাত্র সম্বন্ধ এসেছে।
– ভালো সম্বন্ধ আসলেই কি বিয়ে দিতে হবে নাকি? আব্বু না আমাকে মানুষ হওয়ার জন্য শহরে পাঠিয়েছে?
– বিয়ের পর কি মানুষ হওয়া যায় না নাকি? হা হা হা।
– তুমি বলছো এসব কথা? আম্মু? লাইক সিরিয়াসলি!
– মেয়ে যদি নিজেই বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলে তখন বাবা মা এসব বলবেই তো।
– ধেৎ, বারবার বলছি আমি কাউকে এমন কথা বলিনি।
– ছেলের বাবা তো তোর খালুকে বলেছে তুই নাকি বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে বলেছিস?
– আম্মু, আমি এরকম কাউকে বলিনি।
– ছেলের নাম সায়ান।
– কিহ!
– এবার বল তুই বলিস নি?
– আম্মু, এক মাসের বেশি হলো সায়ানের সাথে আমার যোগাযোগ নেই৷ ও কি করে এসব করলো আমি জানিনা। কিচ্ছু জানিনা।
– তোর আব্বু তো ওর সাথেই বিয়ে দিবে বলছে।
– কেন?
– তুই চেয়েছিস তাই।
– তুমি কিছু বললে না?
– আমি বাঁধা দিতে চেয়েছিলাম। পরে ভাবলাম তোদের ঝামেলা হয়তো মিটে গেছে। হয়তো আবার এক হয়ে গেছিস।
– আম্মু, মজা নিচ্ছো?
– মজা তুই নিচ্ছিস। বিয়ে করতে চেয়ে এখন আবার পবিত্র সাজছিস।
– আমি পবিত্র আম্মু। সায়ানের ব্যাপারটা আমি দেখছি। আর আব্বুকে বলো এ বিয়েতে আমার মত নেই। সায়ানকে আমি পাঠাই নি।
মায়ের কল কেটে দিলো পৃথা। বিছানার উপর টুপ করে বসে পড়লো। একটা ছেলে কতটা পাগলামো করতে পারে সায়ানকে না দেখলে বুঝতে পারতো না ও। ছেলেটা লেগে আছে তো আছেই৷ তার কোথাও ক্লান্তি নেই। দিনের পর দিন বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, রোদে পুড়ে কত ঘন্টা সময় ব্যয় করেছে। এতদিন ধরে ফেসবুকে ব্লক করে রেখেছে পৃথা, ফোন নাম্বার বন্ধ রেখেছে। যোগাযোগের কোনো পথ খোলা রাখে নি। সে এখন বাসায় প্রস্তাব নিয়ে গেছে। মানে পৃথাকে তার চাই- ই। এখন মেজাজ গরম হওয়ার কথা থাকলেও হচ্ছে না। আপন মনে হেসে উঠলো পৃথা। সায়ানটা এমন কেন! পাগল একটা।
চলবে..
#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ১৪
#নীলাভ্র_নেহাল
.
বিয়ের ব্যাপারে বাবা মা দুজনেই ভীষণ সিরিয়াস সেটা বোঝা গেলো যখন পরদিন বিকেলেই তারা খালার বাসায় এসে হাজির হলেন। মা পৃথাকে দেখে রীতিমতো অবাক। মেয়ের এ কি পরিবর্তন হয়েছে এই দেড় মাসে। ও এমনিতেই স্লিম, এখন আরো বেশি স্লিম হয়ে গেছে। চুলগুলো সিল্কি, ভারি সুন্দর হয়েছে মেয়েটা। পৃথার ভেতরে দারুণ জেদ কাজ করে সেটা মা ভালো করেই জানেন।
পৃথা বিয়ের ব্যাপারে উদাসীন। বিয়ে কিছুতেই এখন করবে না ও। আর বাবা মাকে বিয়ে নিয়ে উদ্বেগও দেখাচ্ছে না। ও দেখতে চায় তারা এখন কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে।
মা পৃথাকে ডেকে নিয়ে বসলেন। বললেন, তোদের ব্যাপারটা কি হলো বলতো?
– মা আসলে সায়ানই সঠিক ছিল। আমার ই ভুল হয়ে গিয়েছিলো।
– কিরকম?
পৃথা পুরো ব্যাপারটা খুলে বললো মাকে। যদিও সায়ানের সম্পর্কে মায়ের কিছুটা খারাপ ধারণা জন্মেছিল, তবুও তিনি ছেলেকে অপছন্দ করতে পারেননি। কিন্তু এখন সবকিছু শুনে ছেলেটার প্রতি ভালোবাসা আরো বেড়ে গেলো। বাস্তবে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন তিনি। পৃথা জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কি এ কারণে এসেছো? ছেলে দেখতে? আমাকে তো আসার আগে একবারও জানাও নি।
– তোর বাবা কিচ্ছু জানায় নি। আমি ফোন দিয়েছিলাম, ধরিস নি।
– এসেছো, ভালো করেছো। দুটো দিন তোমার সাথে ঘুমাতে পারবো।
– দ্যাখ তোর আব্বু কিন্তু ওই ছেলের সাথেই বিয়ে দিবে। তার মন একেবারে গলিয়ে ফেলেছে।
– কাহিনি কি আম্মু?
– কাহিনি হচ্ছে ছেলেটা প্রতিদিন কল দিয়ে তোর আব্বুর সাথে কথা বলে। খোঁজ খবর নেয়। আরো কিসব আলাপ হয় ওরাই জানে।
পৃথা বাটিতে করে তেল নিয়ে এসে বসলো। মাকে বলল চুলে দিয়ে দিতে। মা পৃথার চুলে তেল লাগিয়ে দিতে দিতে দুজনাতে কথা হতে লাগলো। পৃথা মাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলো ও এখন কোনোভাবেই বিয়ে করবে না। তারপর উঠে বই নিয়ে বসলো।
পরেরদিন সকালে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য পৃথা তৈরি হচ্ছিল। মা এসে জানালেন আজকে সায়ানের বাবা মা আসবেন। ভার্সিটি তে যাওয়ার দরকার নেই।
পৃথা চিন্তিত মুখে বললো, তোমরা আমার কথা কেন বুঝতে পারছো না আম্মু? আমার এখন বিয়ে করার একদমই ইচ্ছে নেই। তাছাড়া ওই ছেলেটাকে তো নয়ই।
– কেন? সায়ানকে তোর পছন্দ নয়? ওর সাথে তুই সম্পর্কে জড়াচ্ছিলি।
– কিন্তু মা আমি ওকে অনেক কষ্টে আমার মন থেকে সরিয়ে দিয়েছি। এখন আর ওকে নতুন করে জায়গা দিতে পারবো না। আমি আমার লাইফটাকে এনজয় করতে চাই।
– বেশ। আমি তোর আব্বুকে বলছি। তবে সায়ানের বাবা মায়ের সাথে দেখা কর, তারপর সিদ্ধান্ত নিস।
মায়ের কথামত সায়ানের বাবা মায়ের সামনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল পৃথা। শাড়ি পড়ে, চুল আঁচড়ে ,হালকা সাজুগুজু করে নিলো। পৃথা জানেনা সায়ান আসবে কিনা। মাকেও জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হয় নি। তৈরি হয়ে বাইরে আসার পর দেখলো সায়ানও আছে। দীর্ঘদিন পর সায়ানের সাথে দেখা। প্রথম চোখাচোখি হতেই সায়ান মুচকি হাসলো। সেই হাসি প্রশান্তির অর্থ বহন করে। অর্থাৎ সায়ান নিশ্চিত হয়েই আছে সে পৃথাকে পেয়ে গেছে। পৃথাও হাসলো, কিন্তু বিভ্রান্তিকর হাসি।
সায়ানের বাবা মা পৃথাকে দু একটা প্রশ্ন করার পর জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে বিয়ের দিন ক্ষণ নিয়ে কথা বলা যাক। পৃথা বলল, না। আমি আগে সায়ানের সাথে কিছু কথা বলতে চাই।
পৃথার রুমে এসে বসল সায়ান। পৃথা আগে কথা বলল, কেমন ছিলেন এতদিন?
– তুমি যেমন রেখেছিলে।
– হা হা, নিজের ভালো থাকা খারাপ থাকা বলে কিছু নেই?
– ইয়ে মানে তোমার চিন্তায় চিন্তায় আমাকেই ভুলতে বসেছি।
– এটা ভুল। আপনি আবেগে গা ভাসাচ্ছেন। আমিও সেই ভুল করতে বসেছিলাম। এখন নিজেকে শুধরে নিয়েছি।
– তুমি আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে গেছো পৃথা।
– আর চালাকও।
সায়ান হাসলো। পৃথা বলল, আমাকে না জানিয়ে আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে আপনি ঠিক করেন নি।
– কেন? তুমি কি এটাই চাও নি? প্রেম করতে না হয় ভয় ছিল, বিয়েতেও?
– আমি এখন বিয়ের জন্য প্রস্তত নই।
– আমিও নই। আমরা প্রস্তুত হয়ে যাবো।
– আমি এখন প্রস্তুত হতেও চাই না।
– মানে কি?
পৃথা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, আমি আমাকে আরো অনেক সময় দিতে চাই। আমরা অনেক ইমম্যাচিউর। যেকোনো সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নিতে পারি না। আমরা বিয়ে করে ভালো থাকবো কিভাবে?
সায়ান উঠে দাঁড়াল, কি বলতে চাইছো তুমি?
– আমার আরো বড় হওয়া দরকার। আপনারও।
– আমরা যথেষ্ট বড় হয়েছি।
– বাবা মাকে না জানিয়ে এক বন্ধুর বাসায় থেকে যাওয়া, আর বাড়িতে জানানো আমি কিডন্যাপড হয়েছি। এই বুদ্ধি যার মাথায় আসতে পারে সে ম্যাচিউর? যথেষ্ট ম্যাচিউর?
সায়ান উত্তরে কিছুই বলতে পারলো না। পৃথা তুচ্ছার্থক হাসি হেসে বললো, আপনি বাবার টাকাওয়ালা ছেলে। কিছু করলে বা না করলেও আপনার কিছু যাবে আসবে না। বাপের টাকায় সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবেন। কিন্তু আমার বড় হওয়ার স্বপ্ন আছে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তীব্র ইচ্ছা আছে।
– আমি তোমাকে বড় হতে সাহায্য করবো।
– কারো সাহায্য নিয়ে নয়, আমি নিজের যোগ্যতায় বড় হতে চাই।
– তুমি যা চাইবে তাই হবে। তবে আমার স্ত্রী হলে তোমাকে কিছুই করার প্রয়োজন হবে না।
– ঠিক সে কারণেই আমি এখন আপনার স্ত্রী হতে চাই না। আমি কারো ক্রেডিট চাই না সায়ান।
– আমি এসব বুঝতে চাইনা। আমি শুধু তোমাকে চাই।
– আমি এখন কারো হতে পারবো না। আমার মনটাও আপনাকে চাইত। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছি। আমি আমার যোগ্যতায় বড় হতে চাই। তার আগে বিয়ে করতে চাই না।
– বিয়ে হলে তোমার বড় হওয়ার পথে কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না পৃথা।
পৃথা বললো, বিয়েটাই একটা বাঁধা। সংসার একটা বন্ধন। এখানে চাইলেই নিজের মত চলা যায় না। দু বছরের মাথায় একটা বাচ্চা নিয়ে বাচ্চা পালতে হবে, সংসার সামলাতে হবে, এক গাদা দায়িত্ব নিয়ে চলতে হবে। আমি অবশ্যই বিয়ে করতে চাই কিন্তু এখন নয়। আমি এখন দায়িত্ব নিতে চাই না, আমি পারবো না। আমার গ্রাজুয়েশন করতে আরো কয়েক বছর বাকি। এই কয়েক বছরে আমার নিজেকে উপভোগ করতে চাই, পৃথিবীটাকে উপভোগ করতে চাই। তারপর বিয়ে।
– তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো?
– আপনার সামনে ফাইনাল এক্সাম পরে রয়েছে। আপনার একটা উজ্জ্বল ক্যারিয়ার পরে রয়েছে। তারপরও? এখন এ কোন নেশায় মেতেছেন আপনি?
সায়ান পৃথার বাহু চেপে ধরে বলল, নেশায় তো তুমি মাতিয়ে রেখেছো আমাকে। তুমিই বিভোর করে রেখেছো। কেন এভোয়েড করো আমাকে? কেন?
– কারণ আমি আপনাকে চাই না। এখন এসবে ব্যয় করার মত সময় হাতে নেই। প্লিজ আমাকে জোর করবেন না।
– জোর করবো না?
– না।
– ওকে, চলে যাচ্ছি। আর কোনোদিনো জোর করবো না।
– এটা আগেও বলেছেন। তারপরও কেন এসেছেন? কেন?
পৃথা চেঁচিয়ে উঠলো। সায়ান মুহুর্তেই এগিয়ে এসে পৃথাকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ধরে পৃথার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। সায়ানের নরম ঠোঁটের গভীরে হারিয়ে গেলো পৃথার ঠোঁট। সায়ান এক হাত দিয়ে পৃথার চিবুক ধরে অন্য হাতে কোমরে ও পেটে জোরে চাপ দিতে লাগল। পৃথা অনেক চেষ্টা করেও সরাতে পারলো না। শেষে বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে ঠোঁট দুটোকে সমর্পণ করলো সায়ানের কাছে। সায়ান ইচ্ছেমত চুষতে লাগল। পাগলের মত কামড়াতে লাগল। পৃথা খামচি দিয়ে ধরল সায়ানকে। দীর্ঘ এক লম্বা চুম্বন শেষ করে সায়ান পৃথাকে ছেড়ে দিলো। তারপর হাত দিয়ে মুখ মুছে বলল, ছেড়ে দিলাম তোমায়। যে যন্ত্রণায় আমি পুড়ছি, তুমিও এখন যে দহনে দগ্ধ হবে। জানি পারবে না, তবুও বলি ভালো থেকো।
সায়ান দ্রুত পদে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। পৃথা আচমকা চুম্বনে স্থবির হয়ে গেছে। শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে ওর। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল ও। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
বাইরে সবাই আড্ডা দিচ্ছেন। সায়ান এসে সোফার উপর বসে পড়ে। মা সায়ানের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন ছেলের মাথা গরম আছে। কেউ সায়ানকে রাগিয়ে দিলে ওকে এমন ভয়ংকর দেখায়। চোখ দুটো পুরো লাল হয়ে যায়। মা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে বাবা আমরা কবে বিয়ের দিন ঠিক করছি?
সায়ান কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল, মা। পৃথা এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। আমার মনেহয় ওকে সময় দেয়া দরকার। ভালো হয় বিয়ের আলাপটা বন্ধ করে অন্য কিছু নিয়ে তোমরা আলাপ করো। কেমন?
সায়ান উঠে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। ওর দেহে, মনে সবখানে আগুন জ্বলছে। ভালোবাসার জ্বালা, ভালোবাসা পেয়েও হারাবার জ্বালা, কাছে পেয়েও দূরে সরে যাবার জ্বালা। এতদিন অনেক প্রচেষ্টা করে বাবা মাকে রাজি করিয়ে পৃথার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। মামা, ঘটক সবার পিছনে টাকা ঢেলে বিষয়টাকে সিরিয়াস করে তোলা হয়েছে। কত দুশ্চিন্তায় রাত কেটেছে, মুহুর্তের জন্য টেনশন দূর হয়নি। বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার অপেক্ষায় ছিল সায়ান। অথচ আজকে সবকিছু এক কথাতেই শেষ হয়ে গেল। যে পৃথা সায়ানের হাত ধরে দূরে হারিয়ে যেতে রাজি ছিল, সে পৃথা কতটা বদলে গেছে। মানুষ পারে দ্রুত বদলাতে। সায়ানও বদলেছে। কিভাবে একটা মেয়েকে পাওয়ার জন্য বারবার বাবা মাকে বলতে হয়, কিভাবে সবকিছু ঠিক করে ফেলতে হয়, সবকিছু পেরেছিল সে। কিন্তু আজকে বাবা মা অপমানিত হলো। বড় মুখ করে তারা এসেছিলেন বিয়ের তারিখ ঠিক করতে। তাদের মুখটা কোথায় ঢেকে গেলো! বড্ড খারাপ লাগছে সায়ানের। বুকটা ফেটে যেতে চাইছে হাহাকারে।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পৃথা এভাবে দূরে ঠেলে দিলো। এটা হবে ভাবতেও পারেনি সায়ান। বাইরে গিয়ে দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে ফুকতে লাগল। সিগারেটের মাথায় আগুন দেখে মনটা কিছুটা শান্ত হলো।
বাবা মায়ের সামনে কিভাবে যাবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে উঠলো ও। যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে সেখানে আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কোন মুখেই বা যাবে। সায়ান সিগারেট শেষ করে সোজা বাড়িতে চলে গেলো। টানা এক ঘন্টা শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে বসে রইলো। মনেমনে ভীষণ ক্ষোভ জন্মাচ্ছে।
কতগুলো দিন ধরে সায়ান স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে পৃথাকে নিয়ে। দুজনের একটা সুখী সংসার হবে, বাইরে থেকে এসেই পৃথাকে জড়িয়ে ধরবে, বাইরে যাওয়ার আগে কপালে একটা ছোট্ট চুমু দেবে, বাইরে থেকে রোজ কিছু না কিছু নিয়ে আসবে ওর জন্য। বাচ্চাদের মত আদর করবে ওকে। সবসময় ওর সব আবদার পূরণ করবে। বিয়ের পরে দেশের বাইরে হানিমুন ট্রিপ তো থাকছেই। কত শত পরিকল্পনা, সবকিছু শেষ হয়ে গেলো! যেন হঠাৎ আসা ঝড় এলোমেলো করে দিলো সব।
চলবে..