“সতীন” নতুন নাম
“কাঠগোলাপের সুবাস”
৫.
দেড় মাস পেরিয়েছি সাদ এবং খাদিজার বিয়ের। এই দেড় মাসে অনেক কিছুই বদলে গেছে। বদলে গেছে হুমায়রার জীবন। তবে হুমায়রা মনে করে এতেও কোনো না কোনো কল্যাণ রেখেছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা। কারণ আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।
.
পানে জর্দা ঢেলে সুন্দর করে ভাজ করে মুখে পুরলো লিমা। তার মায়ের এই বিষয়টা বেশ বিরক্ত লাগে খাদিজার। জর্দার গন্ধে নাকে কাপড় চেপে ধরতে হয়। লিমা পান চিবুতে চিবুতে বললো,
— “ওই ছেমরির কি খবর বল? ওর মতিগতি কি বুঝলি?”
— “কিছুই না।” অলস ভঙিতে জবাব দিলো খাদিজা।
— “আরো চাপ দে দেখবি সব ছেড়েছুড়ে পালাবে।”
— “আর কিভাবে চাপ দিবো আমি?”
— “সাদকে তোর পক্ষে নিয়ে এলেই ওই মেয়ের খেল খতম হয়ে যাবে।”
— “সাদ খুবই দায়িত্বশীল পুরুষ। সে এতো সহজে তার দায়িত্ব ছাড়বে না।”
— “ধুর রাখ তোর দায়িত্ব। মেয়েরা চাইলেই সব করতে পারে। আর তুই একটা পুরুষকে বাগে আনতে পারছিস না।”
— “বললাম তো সাদ বাগে আনার মতো পুরুষ নয়। সে একজন সৎ, দায়িত্বশীল পুরুষ। যে তার বিবিদের দায়িত্ব, কর্তব্য, টেক কেয়ারের প্রতি খুবই কঠোর।”
লিমা মুখ কুচকালো। তার বড় মেয়ের প্রতি খুব বিরক্ত হলেন তিনি। সামান্য একটা পুরুষকে নিজের আঁচলের সাথে বাধতে পারছে না তার মেয়ে। রাগে গাঁ রিঁ রিঁ করছে লিমার। খাদিজা কোনোদিকে তোয়াক্কা না করে রেডি হয়ে নিলো। কালো-খয়েরী রঙের আবায়াটা চড়ালো গায়ে। আগে কখনো বোরকা পরেনি সে। এবং সাদও কিছু বলেনি। কিন্তু বিয়ের পর সাদের কঠোর আদেশ যেখানেই যাবে পর্দার সাথে যেতে হবে। পর্দা বিহীন এক পা ঘরের বাহিরে বেরোনো নিষেধ। সাদের এই মেনলি রুপটা খাদিজাকে বেশ আকৃষ্ট করে। একটা আলাদা নেশা কাজ করে।
আজ একটু মার্কেটে যাবে খাদিজা তাই রেডি হয়েছে। একাই যেতে চেয়েছে কিন্তু সাদ একা ছাড়বে না। নিজেই নিয়ে যাবে বলেছে। সাদ যখন কড়া স্বরে বললো,
— “একদম একা বেরোনোর দুঃসাহস করবে না। একেবারে ঠ্যাং ভেঙে দিবো। আমার সাথেই যাবে। যা দরকার আমি থাকা অবস্থায় কিনবে এবং আমার সাথেই ফিরবে।”
খাদিজা শুধু মাথা নাড়লো। সাদের উপর কথা বলার আর সাহস পেলো না। আসলে খাদিজা ইচ্ছে করেই আর কিছু বলেনি। সাদের এই অধিকার খাটানো খুব ভালো লাগছিলো তার। খাদিজা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিকাব বেঁধে নিলো। ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখছে। বয়স বাড়ার কারণে চেহারায় একটু বয়সের ছাপ পরে গেছে। গায়ের চামড়া হালকা কুচকেছে। অথচ সাদের চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, সে এখনো ষোলো বছরের কোনো যুবতী। যার রঙ-রুপে সাদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। খাদিজার ভাবনার মাঝে লিমা বিরক্তে কণ্ঠে বলে উঠলো,
— “আয়নার সামনে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে কি করছিস?”
— “এমনি। কিছু না।”
— “সাদ ওই মেয়ের সাথে কেমন আচরণ করে?”
— “আমার সাথে যেমন আচরণ করে তেমন আচরণই করে।”
— “প্রতি রাতেই যায় ওই মেয়ের কাছে?”
— “মা!!!!!!” কিছুটা চেঁচিয়ে উঠলো খাদিজা।
— “এমন চেঁচাস কে? তোর ভালোর জন্যই তো এতোকিছু করতেছি।”
— “মানছি আমার ভালোর জন্যেই করছো। তারমানে এই নয় যে, আমাদের স্বামী স্ত্রীদের পারসোনাল আলাপও আমি বলে বলে বেড়াবো।”
— “তুই দেখি ওই মেয়ের সাইড নিচ্ছিস।”
— “আমি ওর সাইড নিচ্ছি না। এটা আমাদের পারসোনালিটি। আর সাদ খুব কঠোর পারসোনালিটির একজন পুরুষ। সে তার বিবিদের সাথে কেমন এটা বলে বেড়ানো তার পারসোনালিটির সাথে যায়না। তাই আমি বলতে পারবো না।”
— “হুম। এমনই থাক। আর তলে তলে ওই মেয়ে তোর জামাইরে হাত কইরা লইয়া যাক। তখন চাইয়া চাইয়া খালি দেখিস।”
লিমা হিজাব মাথায় চড়িয়ে বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। রাগ লাগছে খুব। মেয়েটার সংসারটা একমাত্র নিজের করে দিতে চাচ্ছেন তিনি। আর তার মেয়ে অন্য সুর ধরেছে। যত্তসব।
লিমা যেতেই খাদিজা তার মায়ের শেষের কথা ভাবলো। আচ্ছা এমন যদি হয়, হুমায়রা সাদকে একেবারে নিজের করেই নিয়ে গেলো তখন সে কিভাবে থাকবে? না না, মেয়েটা এমন করবে না। সে নিজেই তো সাদকে পাঠিয়েছে মাসনার জন্য। কিন্তু..? যদি আমি ওকে সরিয়ে দেই তাহলে তো সাদের পুরোটাই আমি পাবো তাইনা? পুরোটা মানে পুরোটা। তখন আর ভেতরে ভেতরে এতো জ্বলতে হবে না আমার। হুম..! কালই এই নিয়ে মায়ের সাথে পরামর্শ করবো। এই মেয়েকে যেভাবেই হোক এখান থেকে সরাতে হবে।
সাড়ে এগারোটা বাজে। সাদ ঘড়ি দেখে অজু করে নিলো। তারপর দুই রাকাত সালাতুল দোহা পড়া শেষে জায়নামাজ রেখে রেডি হয়ে নিলো। গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে খাদিজাকে ডাকলো। সাদের ডাকে খাদিজা নিচে নেমে এলো। খাদিজার দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
— “এই আবায়াতে তোমায় দারুণ লাগছে।” খাদিজা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। সাদ বললো,
— “চলো তাহলে। যহোরের আগেই কিন্তু ফিরতে হবে বলে দিলাম।”
— “জ্বী ঠিকাছে।” নিচু আওয়াজে জবাব দিলো খাদিজা।
সাদ মুচকি হাসে। খাদিজাকে নিয়ে মেইন ডোরের সামনে এসে একবার রান্নাঘরের দিকে তাকায়। খাদিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি আসছি।”
— “দেরি হয়ে যাবে তো।”
— “হোক দেরি। কিন্তু এই দেরির কারণে আমি আমার দায়িত্ব থেকে পিছপা হতে পারিনা।”
— “হুম..!”
খাদিজা বিরক্ত হয়ে গিয়ে গাড়িতে বসলো। সে জানে সাদ এখন হুমায়রার কাছে যাবে। একটু আগে খুব ভালো লাগছিলো সাদের প্রসংসা শুনে। কিন্তু এখন মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে তার মা ঠিকই বলেছিলো। এই মেয়ে ধীরে ধীরে সাদকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে নিবে।
____________
ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে হুমায়রা। ওড়নার কোণ দিয়ে কপাল মুছে তরকারির লবণ চেক করলো। লবণ কম হলে আবার তার বোনটা রাগ করবে। একটু বকাও দিবে।
হুমায়রার সাথে খাদিজার ব্যবহার এমন হয়েছে, যেনো সে এই ঘরের মালকিন আর হুমায়রা আশ্রিতা। খুব রুড বিহেভ করে হুমায়রার সাথে। খাবারে একটু লবণ কম হলেই চিল্লাচিল্লি শুরু করে। খাদিজার কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ হুমায়রাকেই করতে হয়। সাদ অবশ্য এসব জানে না। হুমায়রাই জানতে দেয়না।
এখন এমন অবস্থা, হুমায়রা যেনো খাল কেটে নিজেই স্বেচ্ছায় কুমির এনেছে ঘরে। যদিও হুমায়রা এটা ভাবে না। সে তার রবের প্রতি খুবই নির্ভরশীল। রব তাকে নিশ্চয়ই ঠকাবেন না। আর তাছাড়া দিনশেষে সাদের একটু ভালোবাসায় সারাদিনের সব ক্লান্তি, অবসাদ কোথায় যেনো হারিয়ে যায়।
এসব ভেবে মুচকি হেসেই প্লেট, বাটি ধুয়ে রাখছিলো হুমায়রা। কোমড়ে শক্ত হাতের স্পর্শ পেলো। আর কাধে গরম নিঃশ্বাসের আভাস। হুমায়রা একটু কেঁপে উঠে। চোখ বুজে নেয় আবেশে। সে জানে এটা কে। তার সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটা। যার সান্নিধ্যে গেলে সব অবসাদ, খারাপ লাগা সব দূর হয়ে যায়।
— “আমার কথাই ভাবছিলে বুঝি এতোক্ষণ?”
— “আপনি নির্দিষ্ট একজন ছাড়া আমার আর কেউ নেই যাকে নিয়ে কল্পনায় বিভোর থাকবো।”
সাদ হাসলো। হুমায়রাকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে নিয়ে বললো,
— “এখানে এসি লাগিয়ে দিলে ভালো হতো তাই না?”
— “ঢং ছাড়ুন। যেই কাজে যাচ্ছিলেন সেখানে যান।”
— “আমি বুঝি ঢং করি?” গাল ফুলিয়ে বললো সাদ।
— “না আমি করি। হয়েছে? এবার যান।”
— “আমার পাওনা?”
হুমায়রা কিছুটা কেঁপে উঠে। লজ্জাও পেলো। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— “দেখুন আমি কাজ করছি এখন। বিরক্ত করবেন না।”
— “কালকে তুমি প্রমিজ করেছিলে তুমি আমার পাওনা মিটিয়ে দিবে। তাহলে এখন কথা ঘুরাচ্ছো কেনো?”
— “আ..আম..আমি ক.কখন ক.কি বলেছি। হেহে।”
সাদ ভ্রু কুচকে তাকালো। হুমায়রা একটা ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। সাদ এগিয়ে এলো হুমায়রার দিকে। নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে। ফিসফিস করে বললো,
— “খুব কষ্ট হয় না তোমার এইভাবে ? আমি খুব খারাপ স্বামী তাইনা? তোমার যত্ন নিতে পারছি না। ক্ষমা করো আমায়।”
— “যত্ন তো নিচ্ছেনই। আর কিরকম করে যত্ন নেয়? আর এই কাজ করতে গেলে একটু পরিশ্রম হবেই।”
— “আমি জানি ঘরে কি কি হয়। তাই আমাকে সাত পাঁচ বুঝিয়ে লাভ নেই।”
হুমায়রা চুপ হয়ে গেলো। সাদ গভীরভাবে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো হুমায়রার কপালে। কিছুটা সময় ওভাবে জড়িয়ে ধরেই দুজন দাঁড়িয়ে ছিলো। হুমায়রা মুখ তুলে বললো,
— “একজনকে ভালোবাসতে গিয়ে আরেকজনকে অপেক্ষায় মারছেন। যান তো।”
— “খাদিজার ভাবনাগুলো যদি তোমার মতো হতো। তাহলে এই বাড়ির ভেতরটা জান্নাতের মতো হতো।”
— “দোয়া ব্যাতীত কোনো কিছুই পরিবর্তন করা যায়না। আমার বিশ্বাস, এই ঘরটা একদিন জান্নাতের মতো হয়ে উঠবে।”
— “আমাদের দুজনের দোয়া কি আরশের মালিক কবুল করবেন না?”
— “জ্বী ইনশাআল্লাহ করবেন। সেই বিশ্বাস নিয়েই দোয়া করতে থাকুন।”
— “যাচ্ছি। তোমার কিছু লাগবে?”
— “না।”
— “আচ্ছা আমি নিজেই নিয়ে আসবো তোমার জন্য। আমার দেয়া গিফট কিন্তু গ্রহণ করতেই হবে ম্যাডাম।”
হুমায়রা ঢোক গিলে একবার সাদের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। সাদ ভ্রু নাচিয়ে হেসে আরো একবার কপালে একটুখানি উষ্ণ পরশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
সাদ হুমায়রা দুজনেই দোয়া করে খাদিজার হেদায়েতের জন্য। সাদ ভাবে, যদি খাদিজা একবার সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতো যেমনটা হুমায়রা মেনে নিয়েছে তাহলে এই ঘরটা জান্নাতের মতো হতো। সুখের ছড়াছড়ি হতো। কিন্তু…! তাও দুজনে আশা হারায়না। তাদের বিশ্বাস আল্লাহ তাদের ফিরিয়ে দিবেন না। যেহেতু তিনিই তিনজনের তাকদীর একসাথ করেছেন। সুতরাং তিনিই ভালো কিছু অবশ্যই দিবেন।
.
সম্পূর্ণভাবে নতুন একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে সাদ। আজ ব্যবসার কাজে একটু বাহিরে যেতে হবে। অনেক টাকারও প্রয়োজন। সাদ এসব নিয়ে একটু চিন্তিত। খাদিজা সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “কি নিয়ে ভাবছো?”
— “ওই ব্যবসায়ী বিষয়। আর কিছু না।”
খাদিজা সাদের পাশে বসে বললো,
— “কি হয়েছে আমাকে একটু খুলে বলো।”
— “তুমি তো জানোই নতুন করে ব্যবসাটা দাড় করিয়েছে। এখন টাকার প্রয়োজন। এদিকে আগের জবটা ছেড়ে দেয়ায় একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন ভরসার মতো কাউকে পাচ্ছিও না যার কাছ থেকে টাকা ধার নিবো।”
— “কত টাকা লাগবে?”
— “বাদ দাও। কোনো একভাবে ম্যানেজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”
— “আরে বলো না।”
— “এই লাখের মতো কিছু।”
— “আমি দিলে তুমি নিবে?”
— “আরে কি যে বলো না। এসবের একদম দরকার নেই। অযথা তোমার মায়ের হয়রানি হবে।”
— “মায়ের কাছ থেকে চাইবো না। ওগুলো আমার টাকা। সেখান থেকেই তোমাকে দিবো।”
— “না না। এটা তোমার। তুমিই রাখো।”
— “বেশি কথা না বলে যেটা বলছি সেটাই করো। এতো বছর জব করেছি সব তো আর খরচ করিনি। দরকারও পরেনি। তাই সব জমেছে। তুমি সেখান থেকে খরচ করো।”
— “এগুলো তোমার কষ্টের উপার্জিত টাকা। আমি কিভাবে..?”
— “আমার সব কষ্ট তোমাতে এসেই শেষ। এখন তুমি কষ্টে আছো সেটা আমার ভালো লাগছে না একদম। আর তোমাকে যদি এই একটু সাহায্য করতে না পারি তাহলে কেমন বিবি হলাম আমি?”
সাদ মুচকি হাসলো। একটু ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দিলো খাদিজার কপালে। খাদিজা আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে। দুজনে কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর খাদিজা বললো,
— “কখন বের হবে তুমি?”
— “এইতো একটু পরেই।”
— “আমি সব গুছিয়ে দিচ্ছি।”
— “হ্যাঁ দাও। আমি আসছি।”
সাদ রুম থেকে বেরিয়ে হুমায়রার কাছে গেলো। খাদিজার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। সাদ যখনই হুমায়রার কাছে যায় খাদিজা সহ্য করতে পারেনা। খাদিজা মনে মনে ঠিক করে নিলো কি কি করবে সে। তাই এখন চুপ করে আছে। চুপচাপ সাদের ব্যাগ গুছিয়ে দিলো।
.
জানালার পাশে বসে বই পড়ছে হুমায়রা। বই থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আজকে রোদের তেজ তেমন একটা নেই। বেলকনিতে তাকিয়ে দেখলো টবে গোলাপ ফুল ফুটেছে। হুমায়রা বইটা রেখে উঠে বেলকনিতে গেলো।
একটু ঝুকে গোলাপের সুবাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায় হুমায়রা। বাগানের দিকে চোখ গেলো। সেদিক থেকে কাঠগোলাপের সুবাস আসছে। একটা আলাদা ভালো লাগা কাজ করলো হুমায়রার মনে। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে পেছন ফিরতেই আবদ্ধ হলো বাহুবন্ধনে।
হুমায়রা নড়চড় না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে তাকালো। সাদের স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় চোখ বুজে নিলো। বেশ খানিকটা সময় পর সাদ মুখ সরিয়ে নিলো। হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “কিভাবে বুঝে যাও আমিই আসি তোমার কাছে?”
— “আপনি ছাড়া আর কেই বা এতো কাছাকাছি আসবে আমার? আর তাছাড়া আপনার গায়ের ঘ্রাণে বুঝে যাই।”
— “তাই?”
— “হুম..!”
— “আমার গায়ের ঘ্রাণ আপনার এতো ভালোলাগে?”
হুমায়রা সাদের বুকে নাক ঘষে বললো,
— “উম..! নেশা নেশা লাগে।”
সাদ হাসলো। একটু শব্দ করেই হাসে। হুমায়রার থুতনি ধরে বললো,
— “তোমার এই বাচ্চা বাচ্চা টাইপের কথাগুলো ভিষণ ভালো লাগে আমার। আমার বাচ্চাবউ।”
— “হিহি…!”
— “তোমার এই বাবুসুলভ আচরণের প্রেমে পরেছি।”
— “কয়বার?”
— “অনেকবার।”
দুইজনেই আবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। হুমায়রা সাদের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললো,
— “আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?”
— “হ্যাঁ। ব্যবসার কাজে একটু শহরের বাহিরে যাচ্ছি।”
— “কয়দিনের জন্য?”
— “সিউর বলতে পারছি না। তবে আনুমানিক তিনদিন থাকা লাগবে।”
— “ওহ..!”
— “মন খারাপ করো না। আমি খুব জলদিই ফিরার চেষ্টা করবো।”
— “হুম।”
আবার দুজনেই নিরব। তবে এখনো সাদের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পায়নি হুমায়রা। সাদ বললো,
— “নতুন কোনো বইয়ের লিস্ট করেছো কি?”
— “হ্যাঁ।”
— “লিস্ট দাও। আমি আসার সময় নিয়ে আসবো।”
— “আচ্ছা।”
— “তোমার আর কি চাই বলো।”
— “আপনি সুস্থভাবে ফিরে আসুন এটাই চাই।”
— “আর..?”
— “এসেই আমাকে অনেক ভালোবাসবেন।”
— “এভাবে বললে? এখন তো আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।”
— “আচ্ছা ছাড়ুন। আপনার দেরি হচ্ছে।”
— “নিচে আসো। দুজনের সাথেই আজ নাস্তা করবো।”
— “ঠিকাছে।”
টেবিলের মাঝ বরাবর সাদ বসেছে। তার দুইপাশে দুই বিবি। সাদ প্রথমে খাবার হুমায়রার মুখে দিলো। তারপর খাদিজার। এরপর নিজে খেলো। হুমায়রা রুটিতে গোস্ত নিয়ে প্রথমে খাদিজার মুখের সামনে ধরলো। সাদ তা দেখে বললো,
— “বাহ বাহ সতীনের জন্য এতো টান? আমি কই গেলাম?”
— “আপনাকেও দিচ্ছি।”
খাদিজা না চাইতেও মুখে নিলো খাবার। এরপর হুমায়রা সাদের মুখে দিলো খাবার। সাদ মুচকি হাসে। এভাবে দুষ্টামি করে তিনজন খাবার শেষ করলো। হুমায়রা রান্নাঘরে চলে গেলো। খাদিজা সাদের ব্যাগ আনতে উপরে গেছে। সাদ রান্নাঘরে এসে হুমায়রাকে জড়িয়ে ধরে কপালে গভীর এক উষ্ণ পরশ দিয়ে বললো,
— “সাবধানে থেকো। পর্দা ছাড়া ঘরের চৌকাঠে পা রাখবে না। উল্টাপাল্টা কোনোকিছু আমার কানে এলে খবর আছে কিন্তু। দারোয়ান চাচাকে রেখে যাচ্ছি তোমাদের পাহারাদার হিসেবে।”
— “জ্বী ঠিকাছে। আপনিও সাবধানে যাবেন।”
দরজার সামনে আসতেই খাদিজা ব্যাগ এগিয়ে দিলো। সাদ ব্যাগ নিয়ে কাছে টেনে নিলো খাদিজাকে। কানের পেছনে চুল গুজে দিয়ে বললো,
— “খুব জলদিই ফিরবো আমি।”
— “সাবধানে যেও। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করো।”
— “কিছু লাগবে তোমার?”
— “উহু..! তুমি সুস্থভাবে ফিরে এসো এটাই চাই।”
— “আমি না আসা পর্যন্ত বাহিরে বের হবে না একদম। ঠিকাছে?”
— “হু..!”
খাদিজার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো সাদ। খাদিজা ততক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো যতক্ষণ সাদকে দেখা গেছে। তারপর ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো।
___________________
এক বালতি কাপড় ধুয়ে উঠে দাঁড়ায় হুমায়রা। কোমড়ের ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। পেছনে ফিরতেই দেখলো খাদিজা দাঁড়িয়ে আছে। হুমায়রা কিছু বলার আগেই খাদিজা কাপড়গুলো ছুড়ে দিয়ে বললো,
— “এগুলো এখনোই ধুয়ে দিবি।”
— “এখন..? কাল ধুয়ে দিলে হবে না আপু?”
— “না। এখন বলেছি মানে এখনই দিতে হবে।”
— “আচ্ছা।”
হুমায়রার চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসে। সাদ গেছে আজ চারদিন হলো। এই চারদিকে খাদিজার অন্যরুপ দেখেছে সে। তবুও কিছু বলেনি। চুপ করেই ছিলো। হুমায়রা চোখ মুছে খাদিজাকে ডাকলো।
— “আপু।”
খাদিজা ফিরে তাকালো হুমায়রার দিকে। একটু গভীরভাবেই তাকিয়েছে। মুখটা এতটুকুন হয়ে গেছে হুমায়রার। খুব করুন কণ্ঠেই ডাকলো আপু বলে। খাদিজাকে ফিরতে দেখে হুমায়রা বললো,
— “আমাকে অল্প করে ভাত দিবে এখন? আসলে খুব ক্ষিদে পেয়েছে তো তাই। খেয়েই সব কাপড় ধুয়ে দিবো।”
খাদিজা কঠিন হতে গিয়েও পারলো না। মাথা নাড়িয়ে বুঝালো টেবিলে আসতে। হুমায়রা হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে এলো। ভাতের প্লেটে ভাত একটু বেশি এবং মুরগির মাংস দেখে হুমায়রা ভিষণ খুশি হলো। খাদিজা উপর থেকেই দেখছিলো হুমায়রাকে। এই চারদিনে তার মায়ের কথায় খাবার -দাবার খুব কম দিয়েছে হুমায়রাকে। এখনও তাই করতো। কিন্তু কেনো যেনো পারলো না। হুমায়রার হাসি হাসি মুখটা দেখে খুব খারাপ লাগলো। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো, ‘এমন বিহেভ করে আমি কি ঠিক করছি মেয়েটার সাথে? এসব করলে সত্যিই কি সাদ আমার হবে? নাকি আরো দূরে সরে যাবে?”
খাদিজা আনমনেই হুমায়রার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের মধ্যে শত কল্পনা-জল্পনা চলতে থাকে।
চলবে,,,
® “নাহার”