#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ১৯
লেখিকাঃমাহযাবীন
ডাক্তারের বলা টেস্টগুলো করিয়ে হাসপাতাল হতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে আফিম ও নাফিয়া।নাফিয়ার মন ভালো রবে না এটিই স্বাভাবিক।গাড়ি চালানোর মাঝেই নাফিয়াকে আড়চোখে দেখে নিচ্ছে আফিম।মেয়েটি অন্য মনস্ক হয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।বিষয়টি ভালো লাগছে না আফিমের।
প্রকৃতি প্রেমি মানুষদের মন খারাপ, বিষন্নতা, কষ্টগুলো প্রকৃতির স্পর্শে এলে নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়।এরা প্রকৃতির মাঝে প্রশান্তি খুঁজে পায়।প্রকৃতি যেনো এদের কষ্টগুলো শুষে নিজের মাঝে নিয়ে নেয় এবং তাদের অস্থির হৃদয়কে প্রশান্ত করে দেয়।
নাফিয়া প্রকৃতি প্রেমিদের মাঝে একজন।আফিম বিষয়টি জানে।তাই এই মুহূর্তে নাফিয়াকে প্রকৃতির সংস্পর্শে আনাটি সঠিক বলে মনে করছে সে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি এলাকা হাতিরঝিল।যা জনসাধারণের চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে।এখানে একটি ঝিল রয়েছে এবং ঝিলের চারপাশ ঘিরে গাছপালাসহ রয়েছে বসার ব্যবস্থা।জায়গাটি ভীষণ রকমের সুন্দর।
নাফিয়া নিজের ধ্যানে এতোটাই মগ্ন ছিলো যে সে খেয়ালই করেনি আফিম বাড়ির পথে না গিয়ে হাতিরঝিলে এসে পৌঁছেছে।গাড়ির ব্রেক কষতেই ধ্যান ভাঙে তার।জায়গাটি অপরিচিত লাগায় ব্রু জোড়া কুঁচকে আফিমকে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-কোথায় এসেছি?
উত্তরে কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে পরে আফিম।আফিমকে নামতে দেখে নাফিয়াও গাড়ি হতে নেমে পরে।চারপাশটায় চোখ বুলোতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে নাফিয়ার।সে আফিমের কাছে এসে বলে ওঠে,
-এটা হাতিরঝিল?
-হু।
-আমার ভীষণ পছন্দের জায়গা।কিন্তু কখনো সেভাবে আসা হয়নি।শুধু এক বারই এসেছিলাম।তাও অনেক আগে।
উত্তরে ঠোঁটে একটু হাসি টেনে নেয় আফিম।নাফিয়াও নিজের ঠোঁটে হাসি টেনে নিয়ে বলে ওঠে,
-ধন্যবাদ এত্তগুলা!
ঠোঁট হাসি বজায়ে রেখে আফিম বলে ওঠে,
-চলো ঝিলের কাছে যাওয়া যাক।
!!
দু’জনে হাতে হাত গুঁজে পাশাপাশি হাঁটছে।মৃদু বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে উভয়কে।নাফিয়া ঝিলের দিকে তাকিয়েই হেঁটে চলছে।ঝিলের বহমান পানি, কোলাহলমুক্ত পরিবেশ,মৃদু বাতাসে গাছের পাতাগুলো নড়ার শব্দ সেই সাথে প্রিয় মানুষটির সঙ্গ।সবটাই খুব উপভোগ করছে সে।আফিমও এসব উপভোগ করছে।নাফিয়ার মুখ নেকাবে ঢাকা থাকলেও আফিম বেশ বুঝতে পারছে,নাফিয়ার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে আছে।এই হাসিটির জন্যেই তো সে অসাধ্যকেও সাধন করবার সর্বোচ্চ চেষ্টাটি করতে প্রস্তুত।
হাঁটার মাঝেই আফিমের চোখ পরে একটি আইসক্রিমের ভ্যান গাড়ির দিকে।একটি লোক ভ্যানটি নিয়ে পথ চলছে।নাফিয়াকে দাঁড় করিয়ে সে ভ্যানটির দিকে এগিয়ে যায় আফিম।একটি কোণ আইসক্রিম হাতে নিয়ে ফিরে আসে সে।আইসক্রিম দেখে নাফিয়ার ঠোঁটের হাসিটি প্রশস্ত হয়ে ওঠে।
আফিম নাফিয়ার হাতে আইসক্রিম টি দিয়ে বলে ওঠে,
-ঐ দিকটি গিয়ে বসি!ওখানে কোনো লোকজনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
-জ্বি।
অতঃপর দুজনে গিয়ে বসে পরে।সামনেই ঝিলের পানি দেখা যাচ্ছে।পেছনে এবং আশপাশে গাছগাছালি।নাফিয়া নেকাব খুলে খাওয়া আরম্ভ করে।আর আফিম নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তাকে।মেয়েটি বাচ্চাদের মতো খাচ্ছে।মুখে তো আইসক্রিম লেগেছেই।সেই সাথে নাকেও লাগিয়ে বসে আছে সে।এটি দেখে মৃদু হাসে আফিম।আফিমের ঠোঁটে হাসি দেখে নাফিয়া জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-হাসছেন কেনো?
-দেখবা?
-হু।
নিজের পকেট হতে ফোন বের করে নাফিয়ার চেহারার অবস্থাটি ক্যামেরা বন্দী করে নেয় সে।ছবিটি নাফিয়াকে দেখাতেই সে নিজের মুখটি মুছে নেওয়ার উদ্দেশ্য হাত উঠায় কিন্তু আফিম তার হাতটি ধরে থামিয়ে দেয়।
-তুমি তো মজা করে আইসক্রিম খেলে।আমি খাবো না?
-আইসক্রিম তো একটিই কিনেছিলেন।
-তো?
-কিভাবে খাবেন?আমার টা তো আমি খেয়ে নিয়েছি।দুঃখিত।(মন খারাপ করে বলে নাফিয়া)
ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আফিম বলে ওঠে,
-No problem.[সমস্যা নেই]
আফিমের চাহনি সুবিধের ঠেকছে না নাফিয়ার।আফিমের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আশপাশ টায় চোখ বুলিয়ে নেয় সে।এই জায়গার ধারে কাছে মানুষ নেই বললেই চলে।যারা আছে তারা দূরেই তাও বেশি মানুষ না।ঢোক গিয়ে আফিমের দিকে তাকিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-কি চাইছেন?
কথায় সময় অপচয় না করে নাফিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে আফিম।একদম কাছে যেতেই চোখ জোড়া বুজে নেয় নাফিয়া।আফিম আলতো করে নাফিয়ার নাকে লাগানো আইসক্রিম খেয়ে নেয়।সেই সাথে থুঁতনি ও ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা আইসক্রিম গুলোও বাদ দেয় না সে।
!!
সূর্য ডুবে যাচ্ছে।আকাশ হলদে বর্ণ ধারণ করেছে।কিছুক্ষণের মাঝেই সূর্য মামা পুরোপুরি বিদায় জানাবে এবং আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পরবে।
আফিমের কাঁধে মাথা রেখে সূর্যের ডুবে যাওয়ার সময়টা উপভোগ করছে নাফিয়া।আফিম একহাতে নাফিয়াকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।উভয়ই অনেকটা সময় নিরাবতা পালন করছে।অবশেষে নিরাবতা কাটিয়ে আফিম বলে ওঠে,
-I want to prepare you for one thing.[আমি তোমাকে একটি বিষয়ের জন্যে প্রস্তুত করতে চাইছি।]
-কোন বিষয়?
ঠোঁট আলতো হাসি ফুটিয়ে আফিম বলে ওঠে,
-তুমি শিক্ষকতা করেছো।তাই নৈতিক জ্ঞান তোমার আছে।বলো তো,মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে কেউকে বিচার করা বা তা নিয়ে মন্তব্য করা টা কতোটুকু সঠিক?
-বিন্দু পরিমাণ সঠিক নয়।
-Correct. যদি কেউ কারো বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে বাজে মন্তব্য করে তখন কি করা উচিৎ?
-সাধ্যে থাকলে উচিৎ জবাব দেওয়া উচিৎ।আর তা সম্ভব না হলে উপেক্ষা করা উচিৎ।
-Again correct.[আবারও সঠিক] আজ টেস্ট করিয়েছি,কাল বা পরশু ডাক্তার চিকিৎসা জানাবে।সার্জারি হলে প্রতিবেশীদের কানে যাবে।সেই সাথে তারা তাদের নোংরা মানসিকতার পরিচয়ও দিতেই পারে।কিন্তু এসব কিছুর কোনো প্রভাব তোমার উপর পরতে দিবা না।
এতো টুকু বলে নাফিয়ার মাথা তার কাঁধ হতে উঠিয়ে দু’হাতে নাফিয়ার গাল স্পর্শ করে আফিম বলে ওঠে,
-চিকিৎসা যাই হোক,তুমি এখন যেমন সুন্দর,পরেও ঠিক এমনই সুন্দর থাকবে।এ রোগ কোনো ত্রুটি নয়।আর রোগ তোমায় বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন করতে পারবে না।আমি চাই,তুমি নিজেকে ভালোবাসো।ঠিক যেমন তুমি আমাকে ভালোবাসো।আমার এক হাত বা পা যদি কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তবে কি তুমি আমাকে অযোগ্য ভাববে?
-কখনোই না।(জ্বলজ্বল করা চোখে আফিমের দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে নাফিয়া)
-ঠিক তেমনই নিজেকে মূল্য দিতে শেখো।সাহসিকতার সাথে এই রোগ মোকাবেলা করো এবং সমাজের কিছু মানুষের নোংরা মানসিকতার বিপক্ষে দাঁড়াও।আমি সবসময় তোমার সাথে তোমার ঢাল হয়ে থাকবো ইন শাহ আল্লাহ।
চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরতেই আফিমের বুকে মুখ গুঁজে নেয় নাফিয়া।এই স্থানটি তার জন্যে সব থেকে নিরাপদ ও পরম শান্তির।
চলবে