ভালোবাসার সংসার পর্ব ১

0
1765

বিয়ের দশ বছর পরে নিজের স্বামীর মুখে তা’লা’কে’র কথা শুনে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে সায়রা।দম দেওয়া পুতুলে’র মতো আলভির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এক ফোঁটা পানিও পড়ছেনা চোখ থেকে।কথায় বলে না”অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথ’র”।সেরকমটাই হচ্ছে সায়রার সাথে।উপর থেকে তাকে দেখতে যতোটা শান্ত লাগছে ভিতরে ভিতরে ঠিক ততটাই যন্ত্রণা’র কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণের নিরবতার পালা শেষ করে কাঁপা কাঁপা স্বরে সায়রা আলভিকে জিজ্ঞেস করলো,,,

–“আ..আমার অ’প’রা’ধ?”

সায়রার প্রশ্নের জবাবে কিছুই বললোনা আলভি।পুরোপুরি নিশ্চুপ রয়ে গেলো।তা দেখেই সায়রা কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে আলভির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,,,

–“কি হলো বললেনা তো আমার অপরাধটা কি?”

আলভির নিরবতা সহ্য করতে না পেরে অধৈর্য্য হয়ে ওর শার্টের কলার খাঁম’চে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো সায়রা,,,

–“বলো..বলছো না কেনো?তা’লা’কে’র কথা বললে কেনো তুমি?আমার অ’প’রা’ধ কি বলো?”

জোর করে নিজের কলার থেকে সায়রার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো আলভি।সায়রার মতোই চিৎকার করে বলে উঠলো,,,

–“তোমাকে আমার বিরক্ত লাগছে।বিরক্তি ধরে গেছে আমার এই সংসার সংসার খেলায়।আর শোনো তোমাকে আমি কোনো কৈফিয়ত দেবোনা।তুমি আমাকে আর আমার সন্তানদেরকে মুক্তি দিয়ে একটু শান্তি’তে থাকতে দাও প্লিজ।তুমি না থাকলেই আমরা শা’ন্তি পাবো।”

কথাগুলো বলেই আর একমূহুর্তও দাঁড়ালোনা আলভি।রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।আলভি রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো সায়রা।এ..এটা কি শুনলো সে?কি বলে গেলো এসব আলভি?সামান্য একটু কথা কাটাকাটি থেকে কি হয়ে গেলো এগুলো?

সায়রা যেনো এই আলভিকে চিন্তেই পারছেনা।এই কি সেই আলভি যে তাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতো একটা সময়।পাগল ছিলো তার জন্য।সেই সময় যেনো সায়রাকে ছাড়া সবকিছুই অচল ছিলো আলভির।এই কি সেই আলভি সায়রাকে যে চোখে হারাতো সবসময়?তবে আজ কেনো এতোটা দূরত্ব?কবে তৈরি হলো এই দূরত্ব?কবে রোপণ হলো বি’ষা’ক্ত বিরক্তির বীজ?..কই সায়রার মনে তো এসব কিছুই আসেনি কোনোদিন।সে তো ভেবেছিলো দায়িত্ব আর মাতৃত্ব-পিতৃত্বের চাপে পড়ে হয়তো আগের মতো সহজ-সরল নেই সবটা।বাহ্যিকভাবে সামান্য কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে যার প্রভাব পড়েছে আলভির মনে।তবে দূরত্ব আর বিরক্তির পরিমাণ এতোটাই বেশি কখন হয়ে গেলো যে এতো প্রিয় মানুষটিকে দূরে যেতে বলার সময়’ও বিন্দুমাত্র আটকালোনা আলভির?

রুমের মেঝেতে বসেই অঝোরে কেঁদে চলেছে সায়রা।আজ যেনো তার চোখের পানি কোনো বাঁধই মানছেনা।খুব ক’ষ্ট হচ্ছে তার।বুকটা যেনো ফেঁটে যাচ্ছে য’ন্ত্র’ণা’য়।আর কেউ জানুক বা না জানুক সে নিজে তো জানে আলভিকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে।মুখে প্রকাশ করতে না পারলেও সেই ভালোবাসাটুকুতে কোনোদিন কোনো আস্তরণ পড়েনি।একদম খাঁদহীন খাঁটিই রয়ে গেছে।তাই বুঝি আজ বিচ্ছেদের এই বি’ষা’ক্ত য’ন্ত্র’ণা তার প্রাপ্তি’
তে যোগ হয়েছে।

কতক্ষণ ওভাবে মেঝেতে বসে নিজের ভাবনাতে ডুবে ছিলো তা জানা নেই সায়রার।দুটি মিষ্টি কন্ঠের ডাকে তার ঘোর ভাঙে।বিষণ্ন চোখদুটো তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো নিজের আদরের মানিকদের।তার আর আলভির ভালোবাসার প্রতীক তাদের পাঁচ বছরের যময দুই ছেলে।ছেলেদের দেখতেই মনে কিছুটা জোর পেলো সায়রা।নিজের সন্তানদের জন্যই আলভিকে ছেড়ে যেতে পারবেনা সে।আলভির বিরক্তি চিরদিনের মতো ঘুচিয়ে দিতে পারবেনা।

মাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে আবারও তাদের মিষ্টি কন্ঠ দিয়ে ডাকলো সাইরিফ ও আদনান।চমকে উঠে তাদের নিজের কাছে টেনে নিলো সায়রা।কোলে বসিয়ে বেশ খানিকটা আদর দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,,,

–“কি হয়েছে আমার সোনা’মানিকদের।কিছু খাবে তোমরা?খবদে পেয়েছে?”

মায়ের প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে হ্যাঁবোধক উত্তর দিয়ে জানিয়ে দিলো দুইভাই যে তাদের খিদে পেয়েছে তারা খাবে।সায়রাও আর সময় নষ্ট না করে তৎক্ষনাৎ চলে গেলো রান্নাঘরে।রান্না করার মতো মন-মানসিকতা না থাকলেও কিছুতো একটা করতেই হবে।ছেলেদের তো আর না খাইয়ে রাখা যাবেনা।তাই ইনসটেন্ট নুডুলস বানিয়ে নিলো ছেলেদের জন্য।ইনসটেন্ট নুডুলস দেখতেই যেনো জ্বলে উঠলো দুইভাই।কিছুতেই এই খাবার তারা এখন খাবেনা।তাদের জন্য অন্য কিছু করে আনতেই হবে।নতুন করে আর কিছু রান্না করার জন্য শরীরটা আর সায় দিচ্ছেনা সায়রার।নিজের পায়ে যেনো দাঁড়িয়ে থাকতেও ভীষণই কষ্ট হচ্ছে তার।বেশ কিছুক্ষণ জোরাজোরি করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেও যখন কোনো লাভ হলোনা তখন বিরক্ত হয়ে খানিকটা জোরেই দুজনকে দুটো চ’ড় লাগালো সায়রা।ধমক দিয়ে উত্তেজিতভাবে বললো,,,

–“খেতে হলে এটাই খাবি আর নাহলে যা এখান থেকে।”

সায়রার কথা শুনেই সাইরিফ চিৎকার করে বলে উঠলো,,,

–“লাগবেনা তোমার খাবার আমাদের।তুমি আমাদের শুধুই ব’কা দাও।তুমি চলে গেলেই আমরা নিজেদের মতো থাকতে পারবোনা।কেউ বকবেনা আমাদের।”

সাইরিফ ও আদনান চলে যেতেই পাশে থাকা সোফাটা কোনোমতে আঁকড়ে ধরে সেখানে বসে পড়লো সায়রা।তার ছেলেরাও কিনা শেষমেশ তাকে চলে যেতে বললো?নাহ্ এটা তেমন একটা নতুন কিছু নয়।আজকালকার ছেলেমেয়েরাই এমন নিজেদের পছন্দসই কিছু একটা না হলেই বাবা-মাকে কথা শোনাতে ছাড়েনা।এই ঘটনা প্রতিটা ঘরে ঘরের নিত্যদিনের কাহিনী।ছোটো-ছোটো জেদি ছেলেমেয়েরা নিজেদের জেদ পূরণ করতে না পেরে এসব কথা হরহামেশাই বলে যাচ্ছে।তাদের ছোটো অপরিণত মস্তিষ্ক এটা কখনো ভাবে না যে তারা তো আমাদের বাবা-মা।আমাদের মুখ থেকে এমন কথা শুনতে তাদের খারাপ লাগে।সাইরিফ,আদনানও ব্যতিক্রম নয়।এর আগেও দুজনের মুখে এধরনের কথা শুনেছে সায়রা।তখন এতোটা গায়ে না লাগলেও আজ যেনো এই কথাগুলোই বি’ষা’ক্ত তী’রে’র মতো তার বুকটাকে ফালা ফালা করে দিচ্ছে।সে চলে গেলে তারাও শা’ন্তিতে থাকতে পারবে।কাদের জন্য তবে এতোদিন এতোসব করলো সায়রা?কাদেরকে নিজের ভালোবাসায়,মমতায় ভরিয়ে রেখেছিলো সে?তাকে আর কারোই কোনো প্রয়োজন নেই।তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে সকলের কাছে।

অনেকক্ষণ ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিলো সায়রা। মু’ক্তি দেবে সে।সকলকেই সে মু’ক্তি দিয়ে সে চলে যাবে।সকলের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে সে।যেখানে তার কোনো মূল্যই নেই সেখানে তার থাকা না থাকা সমান ব্যাপার।মূল্যহীন জড়বস্তুর মতো পড়ে থাকতে রাজি নয় সে।

___________________________________________________________________

রাত আড়াইটা বাজে।চারিদিক অত্যন্ত সুনশান-নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন।সায়রা দাঁড়িয়ে আছে তাদের ছোট্ট তিন তলা বাড়িটার মেইন গেটের বাইরে।মন-প্রাণ, দুচোখ ভরে দেখে নিচ্ছে তার সাজানো বাড়িটাকে।তার ভালোবাসার সংসারকে।আর কোনোদিন এই ভালোবাসা,আবেগ জড়ানো সংসারে ফিরতে পারবে কিনা তা জানা নেই সায়রার।কিন্তু দূর থেকেই সে ভালোবেসে যাবে এই বাড়িকে,এই সংসারকে আর…আর এই বাড়িতেই বসবাসরত নিজের প্রাণের থেকেও প্রিয় তিনটি মানুষকে।

চলবে…

#ভালোবাসার_সংসার
#পর্বঃ০১
#ফারজানা

_____________________________________________________________________
ভুল-ত্রুটি ক্ষ’মা’সু’ন্দ’র দৃষ্টিতে দেখবেন এবং গল্পটি সম্পর্কে মতামত জানাবেন।
হেপি রিডিং!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here