চন্দ্রবিলাসীনি পর্ব ১৯

0
360

#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৯

এডমিশন টেষ্টের রেজাল্ট দিয়েছে। রৌদ্রূপ বাড়ি ফিরলেই জানা যাবে। তারা মনে মনে বেশ কয়েকবার প্রার্থনা করলো। কষ্টেসৃষ্টে একটাতে টিকে যেতে পারলেই কেল্লাফতে!

রৌদ্রূপ বাড়ি ফিরেই উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো,
— তুমি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছো তারা!”

তারা খানিকটা বিস্মিত হলো। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার ইচ্ছে তাঁর মোটেও ছিল না। নেহাতই রৌদ্রূপের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়েছে সে। নাহলে হয়তো কখনোই সেখানে আবেদন করা হতো না।

তারা কিছুটা মন খারাপ করলো। এখান থেকে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ দূরে। যাতায়াত করতে গেলে দুই তিন ঘন্টার মতো লেগে যাবে। আর নাহলে হোস্টেলে গিয়ে থাকতে হবে। বিবাহিত হয়ে হোস্টেলে! নাহ! রৌদ্রূপ কখনোই মানবে না। তাই, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা বাদ। ভালো কোনো প্রাইভেট ভার্সিটিতেই ভর্তি হতে হবে।

রৌদ্রূপ হঠাৎ তারার সামনে এসে বললো,
— কী হয়েছে? মন খারাপ কেন? তোমার তো খুশি হওয়ার কথা। এত গম্ভীর হয়ে বসে আছো কেন?”

তারা আমতাআমতা করে বললো,
— বাসা থেকে কত দূরে আপনি তো জানেনই! যাতায়াতেই তো দিনের অর্ধেকটা কেটে যাবে।”

রৌদ্রূপ তারার কথায় হেসে বললো,
— পাগল না কি? তুমি হোস্টেলে গিয়ে থাকবে। নাহলে, আলাদা মেয়েদের মেস ভাড়া নিয়ে দেবো। সেখানেই থাকবে! এখান থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করতে কে বলেছে তোমাকে?

তারা উদাস দৃষ্টিতে বললো,
— রৌদ্রূপ, আমি এখন বিবাহিত। আর মানুষই বা কী বলবে? আমার সংসার আছে। এখন কী হোস্টেলে গিয়ে পড়াশোনা করার মতোন বয়স আমার?”

রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
— তুমি একজন শিক্ষিত মেয়ে তারা। তোমার কাছে আমি এসব ধরনের মন্তব্য আশা করি না। পড়াশোনার ব্যাপারে আমি সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে রাজি। আর শোনো, সবসময় নিজের মনের কথা শুনবে।যেহেতু মানুষটা তুমি সেহেতু তোমার শুধু নিজের মনের কথাই শোনা উচিত। কে কী বললো। কে কী ভাবলো? এসবে কান দেবে না। এসবে কান দেওয়া মানে নিজেই নিজের ক্ষতি করা।”

তারা নির্নিমেষ ভাবে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। কোন ধাতুতে গড়া এই মানুষটা? সবটা উজাড় করে দিয়েছে তাঁকে। কখনো কোনো কিছুতে মানা করেনি। এতটা সুন্দর মনের মানুষ কী এখনও পৃথিবীতে আছে? তারা রৌদ্রূপের দিকে উন্মাদের দৃষ্টিতে তাকালো। তৃপ্ত কন্ঠে বললো,
–আমি আপনার কাছে ঋনী হয়ে রইলাম রৌদ্রূপ! আপনি আমার জন্য কত কিছু করেছেন! বিনিময়ে কী আপনার বিন্দুমাত্রও চাহিদা নেই?”

রৌদ্রূপ তারার দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে একবার তাকালো। শান্ত গলায় বললো,
— আমার একটাই চাওয়া আছে তোমার কাছে। আমি চাই তোমাকে কেউ রৌদ্রূপ আহসানের স্ত্রী নয়। বরং, তারা ইমতিয়াজা নামে চিনুক। তুমি আমার পরিচয়ে বড় হবে সেটা আমি চাই না। তুমি বড় হবে তোমার নিজের পরিচয়ে। আর এটাই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।”

তারা দৃষ্টিতে তখন ছলছল! ফুলে ফেপে উঠেছে পানিরকণাতে। খানিক থেমে রৌদ্রূপ আবার বললো,
— তুমি একটা পাখি! খাঁচায় বন্ধ করে রেখে;আমি তোমার সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাইনি। সেজন্যই মুক্তি দিয়েছি তোমাকে। তুমি আজ থেকে মুক্ত! পাখি তুমি উড়ে যাও! ভেসে বেড়াও মুক্ত নীল আকাশে! পৃথিবীর বুকে মুক্ত তুমি! মুক্ত তোমার স্বাধীনতা!”

তারা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রৌদ্রূপকে। রৌদ্রূপ বাঁধন হালকা করে দিলো। ধীর বেগে বয়ে চলা নিঃশ্বাস গুলো ঘন হলো। চারিপাশে ছড়িয়ে পরলো কয়েক বিন্দু মুগ্ধতা! মুগ্ধতার সুঘ্রানে চোখ বন্ধ করলো দুটি মানুষ।হৃদয়ে জমে থাকা অনুভূতি গুলোও আজ মুক্ত। পৃথিবী সত্যিই আজ মুক্ত!

দীর্ঘ বিরতির শেষে সময় শেষ হলো। যাওয়ার সময় হলো কারো। কেউ আবার আসলো।
রৌদ্রূপ বড় বড় ধাপ ফেলে ছাঁদের দিকে এগোলো। তাঁর সামনে একটি মেয়ে ওপাশ ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে উজ্জ্বল রঙের পোশাক। গায়ের ওরনাটা বারবার বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। এলোমেলো হয়ে চুলগুলো বারি খাচ্ছে। রৌদ্রূপ সহসাই বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো। এতদিনের অভ্যাস কী আদৌও পরিবর্তন যোগ্য? তারার বলা একটা কথা আজ খুব মনে পরছে। “শুন্যতা আমায় এভাবে ঘ্রাস করলো রৌদ্রূপ? ” অদ্ভুত ভাবে আজ নিজেকেও শুন্য লাগছে রৌদ্রূপের। অতি প্রিয় মানুষটা কাল চলে যাবে। বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে। বারান্দার ময়নার খাঁচা দুলিয়ে দুলিয়ে কে কথা বলবে? কে প্রশ্ন করে রৌদ্রূপকে বিরক্ত করবে? কে ছবি আঁকার সময় রঙ লেপ্টে দেবে? নাহ! রৌদ্রূপ আর ভাবতে পারছে না। বুকের মাঝখানটায় চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। রৌদ্রূপ ভাবনার প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো। এক পা এক পা করে সামনের দিকে এগোলো।সামনের নারীটির দৃষ্টি গিয়ে ঢেকেছে চন্দ্রের দিকে। রৌদ্রূপ মনে মনে দু’লাইন ভাবনাকে বাক্যে রূপ দিলো। বিরবির করে বললো,
— সে তো চন্দ্রের পানে অবাক দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকে।কিন্তু, চন্দ্র তো তাহারে চোখে দেখে না।”

রৌদ্রূপের আর টক মূহুর্তও সেখানে অবস্থান করার ইচ্ছে রইলো না। দ্রুত গতিতে প্রস্থান করলো, সেই স্থান হতে। সেই নারী মূর্তির অবয়বটিকে দেখলে রৌদ্রূপ আর ঠিক থাকতে পারে না। ভেতরটা ছাড়খার হয়ে যায় রৌদ্রূপের।

সকাল বেলা রৌদ্রূপ একবার বাড়ির পরিবেশটার দিকে তাকালো। কেমন যেন নির্জীব! হয়তো আরো নির্জীব হয়ে যাবে একটু পরে। তারা চলে যাবে আজ। হোস্টেলে বিবাহিত মেয়েদের থাকা নিয়ে কিছুদিন আগে বেশ ঝামেলা হয়েছে। তাই, রৌদ্রূপ কাছেপিঠের মধ্যেই একটা মহিলা মেসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তারা আজ সেখানে গিয়ে উঠবে।

তারার দিকে তাকাতেই রৌদ্রূপের বুকটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। সৌজন্যতার খাতিরে একবার তাকিয়ে হাসলো। যাওয়ার পথে একটা কথাও বলেনি আজ রৌদ্রূপ। তারা গাড়ির জানালা দিয়ে বারবার বাইরের দিকে দেখছিল। আর রৌদ্রূপ দেখছিল তারাকে।

গাড়ি নির্দিষ্ট অবস্থানে পৌঁছাতেই রৌদ্রূপের বুকের ধুকপুকানি আরো কয়েক ধাপ বেড়ে গেল। এখনই হয়তো হারিয়ে যাবে পাশের অনন্যা নারীটি। মিলিয়ে যাবে ব্যস্ততার ভিঁড়ে। রৌদ্রূপ তারার হাত ধরে নিচে নামলো। আজ এই হাত দুটি ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। রেখে দিতে ইচ্ছে করছে বুকের মধ্যিখানে। কিন্তু, এমনটা কেন হচ্ছে? সে তো চেয়েছিল এটাই। তারা নিজের মতো থাকবে। সুখী থাকবে, এটুকুই তো চাওয়া ছিল। তবুও, আজ কেমন যেন নিজেকে বিরহে জর্জরিত প্রেমিকের চেয়ে রিক্ত লাগছে।

— এই যে এটা,এবার যাও তুমি। দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার।”

রৌদ্রূপ এটুকু বলেই তারার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারা নেত্র কোনে কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল। কেমন একটা অশান্ত গলায় তারা বললো,
— আপনি আসবেন না?”

রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
— এটা মহিলা মেস। পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ”

তারা এটুকু শুনে ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে এগিয়ে চললো। রৌদ্রূপের দৃষ্টি তারার দিক থেকে খানিকের জন্যও সরলো না। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তারার দিকে। তারা বেশ কয়েকবার পেছন ফিরে ফিরে তাকালো। রৌদ্রূপ তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে। দুরত্বের পরিমান এত বেশি হলো যে কেউ আর কাউকে দেখতে পেল না।

রৌদ্রূপ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাড়ি ফিরলো। বাড়িতে সবই আছে। ওই চেনা মুখটাই নেই। কেন সেই মানুষটার অনুপস্থিতি এত কষ্ট দিচ্ছে তাঁকে? কেন?

রৌদ্রূপ বসার ঘরের টি টেবিলটার দিকে একবার তাকালো। কয়েকটা পৃষ্ঠা জুড়ে একটা বড় কাগজের মতো। জরুরি কাগজ ভেবে রৌদ্রূপ সেটি তুলে নিলো। অদ্ভুত ভাবে সেখানে শুরুতেই লিখা প্রান প্রিয় রৌদ্রূপ! রৌদ্রূপের হৃদয় এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেল। লেখাটা বড্ড চেনা চেনা!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here