#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৮
কাঁটাবন থেকে একটা ময়না পাখি কিনে বাড়ি ফিরলো রৌদ্রূপ। ছোট্ট একটা ময়না। একটা পেলেপুষে বড় করতে হবে। বড় ময়নাও কেনা যেতো। তবে, বড় ময়না পাখি কথা বলে না সহজে। ছোট ময়না বড় হতে হতেই কথা শিখে যায়।
তারা দরজা খুলতেই দেখলো রৌদ্রূপ ছোট্ট পাখির খাঁচা হাতে দাঁড়িয়ে। খাঁচার ভেতরে একটা ছোট্ট পাখি বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তারা উৎফুল্লে রৌদ্রূপের হাত থেকে পাখির খাঁচাটা নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। খাঁচাটার সামনে গিয়ে বললো,
— বলো তো পাখি তারা!”
রৌদ্রূপ পাশ থেকে উত্তর দিলো,
— না পাখি বলো চাঁদ। ”
তারা পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। আবার খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে বললো,
— না পাখি, বলো তারা!”
রৌদ্রূপ আবার ঠোঁট টিপে হেসে বললো,
— চাঁদ! ”
তারা বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ মুচকি মুচকি হেসে তারার দিকে তাকাচ্ছে। তারা আবার চোখ ফেরালো। দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে লোকটা! তাঁর কোনো কথাই শোনে না!
তারা অনেকটা সময় ধরে পাখিটাকে কথা বলা শেখানোর প্রচেষ্টা চালালো। কিন্তু ফলাফল শুন্য! পাখিটা হাবলার মতো তারার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর কিচিরমিচির শব্দ করে। কিন্তু, কোনো কথা বলে না!
তারা এবার অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ জামাকাপড় ছেড়ে সবেমাত্র বিছানায় বসেছে। তারা রৌদ্রূপের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
— দোকানদার যা দিয়েছে তাই নিয়ে বাড়ি চলে এলেন? একটাবার একটু দেখে আনলে কী হতো?”
রৌদ্রূপ উৎকন্ঠামাখা গলায় বললো,
— কেন কী হয়েছে? ”
তারা অতি উত্তেজিত হয়ে বললো,
— আপনাকে বোবা ময়না পাখি দিয়েছে! টিভিতে কখনো ময়না পাখি দেখেছেন? কত সুন্দর করে কথা বলে সেই ময়নাগুলো! আপনি কীসের কী ময়নাপাখি এনেছেন। এই ময়নাপাখি কোনো কথা বলতে পারে না। শুধু কিচকিচ শব্দ করে! আপনাকে ঠকিয়ে দিয়েছে রৌদ্রূপ!”
রৌদ্রূপ পেটে হাত দিয়ে দম ফাটিয়ে হাসতে লাগলো। তারা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। হয়েছে কী! এমন পাগলের মতোন হাসছেন কেন রৌদ্রূপ?
রৌদ্রূপ হাসতে হাসতে বললো,
— ময়নাপাখি প্রথমবারেই কথা বলে এসব কে বলেছে তোমাকে? টিভিতে তো কত কিছুই দেখানো হয়। সব কী সত্যি হয় না কি? ময়না পাখিকে কথা বলা শেখাতে হয়। তারপর ময়না কথা বলে। যেমন তোমাকে তোমার মা কথা বলা শিখিয়েছে। তুমি কী জন্মের সাথে সাথেই কথা বলতে পারতে না কি?”
তারার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। মাথা নিচু করে বললো,
— কিন্তু, আমাকে তো আমার মা কথা বলা শেখায়নি রৌদ্রূপ।”
রৌদ্রূপের ঠোঁট যুগল থেকে হাসির রেখা মুছে গেল মুহূর্তেই। কথায় কথায় সে কতবড় একটা দুঃখ দিয়ে ফেলেছে মেয়েটাকে! রৌদ্রূপের হৃদয় খানি এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেল। রৌদ্রূপ আবারও কিছু বলার পূর্বেই তারা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। রৌদ্রূপ একবার চাইলো তারার হাতটা ধরে তাঁকে থামাতে। তবে,সেই মুহূর্তে সেরূপ সৎ সাহস উদয় হলো না তাঁর।
বারান্দায় জানালার নিকটে পাখির খাঁচাটাকে বাঁধলো তারা। গোলাটে ডিম্বাকৃতির খাঁচা। বাতাসে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। ভেতরের ছোট্ট পাখিটা বারবার কিচিরমিচির করে ডাকছে।
রৌদ্রূপ তীব্র অনুতাপ বোধ নিয়ে তারার সামনে দাঁড়ালো। তারা আনমনে পাখির খাঁচার দিকে তাকিয়ে ছিল। রৌদ্রূপ তারার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করলো। তারা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। অক্লান্ত দরদ মাখা কন্ঠে রৌদ্রূপ বললো,
— ক্ষমা করো আমাকে। আমার বেখেয়ালি ভাবে বলা কথায়ও যে তোমার বিক্ষিপ্ত হৃদয় এভাবে ভাঙ্গন ধরবে। সেটা বুঝলে কখনো এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতাম না। তুমি তো জানো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের তালিকায় আমি তোমাকে দেখতে চাই। ”
তারা নির্নিমেষ দৃষ্টি রৌদ্রূপকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিলো সেই মূহুর্তেই। তারা উন্মাদের ন্যায় রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে রইলো। শান্ত গলায় বললো,
— আমি আপনার ওপরে রেগে নেই রৌদ্রূপ। সত্যি বলতে আমার সেই সাধ্য নেই। আমি শুধু আমার অতীতের কথা ভেবে একটু হতাশ। তবে, আমি এখন আশাবাদী। আমার অতীত যতটা তিক্ত। আমার ভবিষ্যত ততটাই মিষ্ট। আমি জানও রৌদ্রূপ, আমি আমাকে কখনোই ইচ্ছেকৃতভাবে কষ্ট দেবেন না। এতটুকু ভরসা আপনার ওপরে আমার আছে।”
রৌদ্রূপের মন খারাপের আবহাওয়া যেন নিখোঁজ হয়ে গেল মূহুর্তেই! বহু খোঁজাখুঁজি করেও সেই মন খারাপের ঝড়কে আর পাওয়া গেল না। তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। হেসে বললো,
— আপনি কেন এই চাকরি বাকরির পেশা বেছে নিলেন রৌদ্রূপ? আমার পছন্দ একদমই যায় না আপনার সঙ্গে। আপনার মনরোগ্য বিশেষজ্ঞ হওয়া উচিত ছিল। আপনার চেম্বারে কোনো রোগী আসলেই সে যে দু’মিনিটের ভেতরেই সুস্থ হয়ে যাবে। এটা কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম!”
রৌদ্রূপ তারার হেয়ালি পনা দেখে মুচকি হাসলো।
এই কিছুদিনে তারা বহু জায়গায় এডমিশন টেষ্ট দিয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই ছিল সরকারি নামীদামী ভার্সিটি। প্রথম দিন এডমিশন টেষ্ট দিতে গিয়ে খুব হাত পা কাঁপছিল তাঁর। কাঁপা হাতেই প্রশ্নের উত্তর দাগিয়ে বের হয়েছে সে। প্রথম পরীক্ষাটা অতিরিক্ত ভয়ের কারণেই খারাপ হয়েছিল। এরপর পরেরগুলো তেমন একটা খারাপ হয়নি। সত্যি বলতে রৌদ্রূপ তাঁকে সেই মুহূর্তগুলোতে এত বেশি মানসিক ভাবে সার্পোট করেছিল যে ভয়কে আর ভয় মনে হয়নি। যুদ্ধে বিজয়ী যেমন ঘোড়া নিয়ে বিজয়ীর বেশে পদার্পণ করে। ঠিক তেমন ভাবেই নিজেকে দেখেছিল সে। রৌদ্রূপ ঠিকই বলে! সে আসলেই একটা ব্রেভ গার্ল! এখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে আগের মতো দুঃখে কষ্টে পতিত হওয়া তারাকে দেখে না সে। শুধু দেখে শক্তিশালী মন-মানসিকতার অধিকারী একটা নারীকে। রৌদ্রূপের বলা সব-কয়টা কথা ঠিক ছিল! নারীরা আসলেই সব পারে! সব! নারী মানেই অনন্যা! নারী মানেই সেরার সেরা!
— এই পাখিটা এখনও আমার নাম ধরে ডাকলো না কেন রৌদ্রূপ? ” তারা এটুকু বলেই অভিযোগের দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো।
রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে হেসে বললো,
— ওর বোধ হয় তোমার নামটা পছন্দ হয়নি। তাই ডাকছে না হয়তো!”
তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে ভ্রু সংকুচিত করলো। অশান্ত চাহনিতে বললো,
— এই পাখির পছন্দ খারাপ! নাহলে আমার এত সুন্দর নামটা পছন্দ হলো না? সে যাইহোক না কেন। আমার কিন্তু আমার নামটা খুব পছন্দ। তারা! কত সুন্দর না নামটা?”
রৌদ্রূপ মনে মনে খানিকটা হাসলো। হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো।
একটা সময় ছিল তখন কেউ খুব করে বলেছিল, ” আমার নামটা আমার একটুও ভালো লাগে না রৌদ্রূপ! কেমন বেক্ষাপ্পা মনে হয়!”
আজ নিজেকে কেউ এতটাই ভালোবেসে ফেলেছে যে নিজের নামটাও খুব মধুর লাগে। সত্যি! নিজেকে একবার ভালোবেসে ফেলতে পারলে। নিজের সবকিছুই অদ্ভুত ভাবে ভালো লেগে যায়। তারার ক্ষেত্রেও এই নীতির কোনো পরিবর্তন যে হয়নি। তা সাফ সাফ বোঝা যাচ্ছে।
রৌদ্রূপ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তারা বারবার ময়না পাখিকে নিজের নাম ডাকা শেখাচ্ছে। কিন্তু, পাখিটাকে দেখে মনে হচ্ছে;সে হয়তো দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ হয়ে তারার নাম উচ্চারণ না করার প্রতিজ্ঞা করেছে।
তারা একসময় বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। রাগে বিরবির করে বললো,
— শুধু শুধু খাওয়াচ্ছি এই পাখিটাকে! আজ অবধি মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হলো না। কিচকিচ করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।”
রৌদ্রূপ মুচকি হেসে তারার কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললো,
— আসলেই! পাখিটা কোনো কাজই জানে না! পাখিটাকে বিয়ে দিয়ে দেবো। সব কাজ শিখে যাবে!”
তারা অগ্নি দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। কড়া গলা বললো,
— আপনিও দেখি আমার সঙ্গে মজা করছেন রৌদ্রূপ! এই পাখি আসলেই অকর্মন্য! কত সহজ একটা নাম আমার। তা-রা! এত দিন ধরে শেখালাম। তবুও, কিচমিচ করা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। বোবা পাখি!”
রৌদ্রূপ ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে তারার দিকে তাকালো। মনে মনে একগাল বকা দিলো পাখিটাকে। আসলেই পাখিটা কোনো কাজ জানে না। রৌদ্রূপ আহসানের স্ত্রীর নামটা অবধি বলতে পারে না। পাখিটা একটুও ভালো না। দুষ্টু পাখি!
চলবে…
(সমাপ্তির খুব সন্নিকটে অবস্থান করছি আমরা।হয়তোবা খুব শীঘ্রই গল্পটির সমাপ্তি হবে।)