#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১১
তারা মুখ গোমড়া করে বাড়ি থেকে বের হয়েছে রৌদ্রূপের সঙ্গে। সকালেই কেন কোচিংয়ের ক্লাসটা হতে হলো? বিকেলে হতো!
রৌদ্রূপ তারার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলো। তারা ভয়ে ভয়ে রৌদ্রূপের সঙ্গে ওপরে উঠে এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করলো।কোচিংয়ে নিশ্চয়ই সে একা নয়। আরো অনেকেই তো আছে। কিন্তু…অজানা আশংকায় তারা বারবার শিউরে উঠলো।
রৌদ্রূপ ভেতরে ঢুকে একজন ভদ্রলোককে সালাম দিলো। তারাও রৌদ্রূপের দেখাদেখি সালাম দিলো। রৌদ্রূপ তারাকে ইশারা করে ভদ্রলোকটিকে বললো,
— এই যে স্যার আপনার ছাত্রী। আপনার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম। খেয়াল রাখবেন একটু। পড়াশোনা না করলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানাবেন। পড়াশোনার ব্যাপারে আমি সবসময়ই সিরিয়াস। এসব ব্যাপারে অবহেলা আমি মেনে নিতে পারি না।”
উক্ত ভদ্রলোকটিও রৌদ্রূপের সঙ্গে একমত হলো।
তারার হৃদয়ঙ্গম হলো যে এটাই কোচিংয়ের মেইন টিচার। তারা ফ্যালফ্যাল করে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ক্লাস ঢুকতেই তারা দেখলো বেশ বড়সড় একটা ক্লাস। সে শুধু একা নয় এখানে। আরো অনেকে আছে তাঁর মতো। তারা কিছুটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারপাশে একবার তাকালো। সামনের বেঞ্চগুলো সব দখল হয়ে গেছে। তারা তাই একটু পেছনে গিয়েই বসলো। তারা সেখানে বসা মাত্রই এক এক করে সবাই তারার দিকে তাকাতে শুরু করলো। তারা সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে স্যারের লেকচারের দিকে ধ্যান দিলো। এটা আর নতুন কিছু নয়। স্কুল জীবনেও ক্লাসে নতুন কেউ আসলে সবার কেন্দ্রবিন্দু থাকতো সে ব্যাক্তি। তারা এসবের সাথে পরিচিত। তাই খুব একটা অস্বস্তি অনুভব হয়নি তাঁর।
ক্লাসে বেশ ভালোই লেগেছে তারার। যদিও কোনো সঙ্গী সাথী না থাকায় একটু বিরক্তি বোধ হয়েছে। তবুও খুব যে খারাপ লেগেছে তেমনও না।
ক্লাস থেকে বের হয়েই তারা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এপাশ ওপাশ ফিরে তাকালো। কী ব্যাপার? রৌদ্রূপ কোথায়? তারা ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। ক্লাসে আজকে স্যার বলেছিল ফোন ক্লাসে আনা যাবে। তবে, সাইলেন্ট মুডে রাখতে হবে।
ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করেই তারা রৌদ্রূপের নাম্বারে কল করলো। রৌদ্রূপ কলটা ধরেই বললো,
— হ্যাঁ, বলো তারা।”
তারা ফোনটা শ্রবন ইন্দ্রিয়ের খানিকটা সামনে ধরে বললো,
— রৌদ্রূপ আপনি কোথায়? আমি দেখতে পাচ্ছি না আপনাকে। জলদি আসুন, ক্লাস শেষ হয়ে গেছে তো আমার।”
রৌদ্রূপ তারার কথার জবাবে বললো,
— এখন! এখন আমি অফিস থেকে বের হবো কী করে?তুমি একা বাড়ি ফিরতে পারবে না?”
তারা বিস্ফোরিত কন্ঠে বললো,
— আমি! আমি একা একা বাড়ি ফিরবো কী করে? আমি তো কিছুই চিনি না। আপনি একটু কষ্ট করে আসুন না রৌদ্রূপ।”
রৌদ্রূপ শান্তনার ভঙ্গিতে বললো,
— আজকে একটু কষ্ট করে একাই বাড়ি চলে যাও। কালকে থেকে আমি নিতে আসবো।”
তারা আর কিছু বলার আগেই রৌদ্রূপ ফোনটা কেটে দিলো। তারা ফোন হাতে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকালো। কিছুই তো চেনে না সে! বাড়ি যাবে কী করে? তারার ফোনটা আবার বেজে উঠলো। তারা কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা ধরে বললো,
— হ্যালো!”
পাশ থেকে রৌদ্রূপ বলে উঠলো,
— কী হলো? এত চমকে উঠলে কেন?
তারা বিক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠলো,
— এমনিতে এত বড় বড় কথা শোনান আমাকে। জ্ঞানের ভান্ডার! এখন সামান্য কাজের জন্য আমাকে নিয়ে যেতে পারছেন না? আপনার কাজই আগে। আমি কেউ না। কিছুই না! একটাবার আমার কথা চিন্তা করা উচিত ছিল রৌদ্রূপ। আমি কিছু চিনি না। জানি না! বাড়ি ফিরবো কী করে? আমি আজ কোথাও যাবো না। দাঁড়িয়ে থাকবো এখানেই। যত রাত হবো হোক! আমি কোথাও যাবো না। যতক্ষন অবধি আপনি আমাকো নিতে না আসবেন। আমি একচুল পরিমানও নড়বো না।”
তারা এটুকু বলেই অগ্নিশিখার ন্যায় রেগেমেগে ফোনটা কেটে দিলো। ফোন হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়েই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো তারা। হঠাৎ কে যেন তারার মাথায় কিছু দিয়ে টোকা দিলো। তারা মাথায় হাত দিয়ে দেখলো একটা ছোট্ট শুকনো বরইয়ের আঁটি। তারা কিছুটা বিব্রত হলো। বড়ইয়ের আঁটিটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আবার সামনের দিকে তাকালো। আবারও অপ্রত্যাশিত ভাবে তারার মাথায় বরইয়ের আঁটি নিক্ষেপ করা হলো। তারা বিরক্ত হয়ে মাথায় হাত দিয়ে পেছনে তাকালো। ওমা একি! রৌদ্রূপ অবস্থান করছে সেখানে। হাতে শুকনো বরই আর বাদামের ঠোঙা! তারা হতবিহ্বলের ন্যায় রৌদ্রূপের দিকে তাকালো।
নিজের দিকে এভাবে তারাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রৌদ্রূপ আবারও বরইয়ের আঁটি মুখ থেকে বের করে তারার মাথায় ঢিল মারলো।
মাথায় আবারও ঢিলের আঘাত পরাতে তারার হুঁশ ফিরে এলো। রৌদ্রূপের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
— আপনি না কি অফিসে? আসতে পারবেন না? এখন এলেন কীভাবে? ”
রৌদ্রূপ নির্দ্বিধায় তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
— এখন আসিনি। তোমার ছুটি হওয়ার আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছি।”
তারা বিস্মিত হয়ে বললো,
— এত আগে এসেছেন? কই আমি তো দেখিনি। আর আপনি তো আমায় বললেন আপনি আসতে পারবেন না। তাহলে?”
রৌদ্রূপ নিস্তব্ধ ভঙ্গিতে বললো,
— এত কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি আমাকে না দেখে তবে আর কী করার বলো? আমি থাকা যা না থাকাও তো তা।”
তারা রৌদ্রূপের এত গাম্ভীর্য্যপূর্ন জবাব মেনে নিতে পারলো না। মৌনতা এড়িয়ে নিজেই বললো,
— আজকাল প্রায়ই দেখছি অফিস কামাই দিচ্ছেন। বস কিছু বলে না না কি? একটু তো কড়া হওয়া দরকার বসের।”
রৌদ্রূপ তারা পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। রৌদ্রূপ নিজের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বললো,
— বলেনি আবার! বলতে কিছু বাকি রেখেছে কিনা সেটা বলো। আজ সকালে অফিসে ম্যানেজারের কাছে ছুটি চাইলাম। সে ছুটি দিতে নারাজ। তাই বলেছি বড় ভাই খুব অসুস্থ। আমি তাঁর সঙ্গে হসপিটালে আছি!”
তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে পেটে হাত দিয়ে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বললো,
— ওমা! আপনার ভাইও আছে! জানতাম না তো! কোন হসপিটালে ভর্তি হয়েছেন?”
রৌদ্রূপ ভ্রু কুচঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— মজা করছো আমাকে নিয়ে? ছুটিটা কিন্তু তোমার জন্যই নিয়ে ছিলাম আমি”
তারা রৌদ্রূপের যুক্তির সঙ্গে আবার হেরে গেল। এবার চুপচাপ হাঁটতে শুরু করলো। এই রৌদ্রূপের সঙ্গে কথা বলেও কোনো লাভ নেই। সব কথায় যুক্তি আর যুক্তি! এত যুক্তি পায় কোথায় কে জানে!
রৌদ্রূপ নিরবতার সমাপ্তি কাটিয়ে বললো,
— আজ কেমন লাগলো কোচিংয়ে? পড়াশোনার মান কেমন? ভালো লেগেছে তোমার? ”
তারা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বললো,
— হুম, ভালো লেগেছে।পড়াশোনার মানও খুব ভালো। তবে, আমি যখন ক্লাসে ঢুকলাম সবাই এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল।যেন আমি মানুষ না। আমি বাঘ কিংবা ভাল্লুক। আমার ওটাতে বেশ বিরক্ত লেগেছে। ”
রৌদ্রূপ তারার কথায় মুচকি হাসলো।এই কিছুদিন আগেও তারা রৌদ্রূপের সঙ্গে ঠিকঠাক কথাও বলতো না। কিন্তু, এখন? মুখ দিয়ে কথার বন্যা বহে। মানব জাতি বড্ড আদূরে জাতি। যাঁর কাছে আদর ভালোবাসা পায়। তাঁর সঙ্গেই সর্বক্ষন রয়।
আনুমানিক রাত তখন এগারোটা। রৌদ্রূপ তখন ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় একটা টোকা দিলো। তারা উচ্চস্বরে বললো,
— জি আসুন।
তারার মুখে সম্মতিসূচক শব্দ শুনে রৌদ্রূপ ভেতরে প্রবেশ করলো। টেবিলে সব নতুন নতুন বই। এগুলো আজ বিকেলেই কেনা। স্যার তারাকে বইয়ের একটা লিস্ট দিয়ে বলেছিল বইগুলো কিনে নিতে। রৌদ্রূপ পরে বিকেলে বাইরে গিয়ে বইগুলো এনে দিয়েছে তারাকে।
তারা আয়নার সামনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখছে। আকস্মিক রৌদ্রূপের সামনে গিয়ে দু’ঠোঁট নাড়িয়ে তারা বললো,
— আচ্ছা রৌদ্রূপ আমি কী সুন্দর? ”
রৌদ্রূপ হেসে বললো,
— কেন?”
তারা ভদ্রতার খাতিরে হেসে বললো,
— না এমনি। বলুন না আমি কী সুন্দর? ”
রৌদ্রূপ মৃদু হেসে বললো,
— হুম খুব সুন্দর। শুধু তুমি না;পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষই সুন্দর।”
তারা নিজের দুই গালে হাত বুলিয়ে বললো,
— তাই? আমি তো ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি আমি সুন্দর না। আমি মোটেও আমার চাচা ফুপিদের মতো অতোটা সুন্দরী না। আমাকে দেখে না কি মনেই হয় না আমি ওই বংশের মেয়ে।”
রৌদ্রূপ ক্ষীন হেসে বললো,
— তুমি একটা প্রবাদ শুনেছো তারা?
তারা চমকিত হয়ে বললো,
— কী প্রবাদ?
রৌদ্রূপ জোড়ালো নিশ্বাস ফেলে বললো,
— যাঁর চোখে-তে যাঁরে লাগেরে ভালো। আমার চোখে তোমাকে ভালো লাগে বলে যে সবার লাগবে এমন কোনো কথা নেই। প্রত্যেকটা মানুষের পছন্দ আলাদা আলাদা। তাই, একেকজন মানুষের কাছে তোমার ব্যাক্তিত্ব তোমার সৌন্দর্যও আলাদা। আর সবার তোমাকে ভালো লাগবে এমনও কোনো কথা নেই। তুমি মানুষ তারা। তুমি তো আর বিরিয়ানি নও;যে সবার তোমাকেই ভালো লাগবে। তুমি যেমন তুমি তেমনই। আর,কারো জন্য নিজেকে পরিবর্তন করো না তারা। সবার পছন্দের চেয়ে তোমার তুমিটাই সবচেয়ে সুন্দর!”
তারা এক ঝাঁক বিষ্ময় নিয়ে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। কী সুন্দর বাচনভঙ্গি! কী সুন্দর কথার ধরন!
চলবে…